সুকুমার রায়ের “খিচুড়ি” কবিতার মতো হাঁসজাড়ু কিংবা বকচ্ছপ বানাতে না পারলেও যুক্তরাষ্ট্রের স্যাম ভেন অ্যাকেন একটি গাছে চল্লিশ ধরনের ফল ধরিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। ল্যাবরেটরিতে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বানানো কোনো পাগল বিজ্ঞানীর অলীক ফ্যান্টাসি গল্প না, প্রাকৃতিক কোনো কিছুতে বিকৃতি আনাও তার উদ্দেশ্য নেই। বরং বিরল প্রজাতির কিছু ফলকে সংরক্ষণের উপায় হিসেবেই এই বিষয়টি তার মাথায় আসে।
পেন্সিলভানিয়া ডাচের একটি কৃষক পরিবারে জন্ম স্যাম ভেন অ্যাকেনের। বড় হয়ে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন চিত্রশিল্পকে। বর্তমানে সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্যবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। তবে তার জীবনের সেরা কীর্তিটির পেছনে কৃষিবিদ্যা এবং চিত্রশিল্প দুটোরই অবদান আছে।
২০০৮ সালে ভ্যান অ্যাকেন জানতে পারেন, ফান্ডিংয়ের অভাবে নিউ ইয়র্কের জেনেভার একটি কৃষি গবেষণা স্টেশনের একটি ফলের বাগান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সেখানে আদি, মিশ্র এবং দেশজ প্রজাতির বিভিন্ন স্টোনফ্রুটের গাছ ছিল, যেগুলোর কোনো কোনোটা ১৫০-২০০ বছর বয়সী। স্টোনফ্রুট বলতে মূলত তাল, পিচফল, চেরি এ ধরনের ফলগুলোকে বোঝায়, যেগুলোর শক্ত খোলস আছে। ফান্ডিংয়ের অভাবে এ ধরনের অনেক দুর্লভ প্রজাতির ফলগাছ বিলুপ্ত হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। সেগুলোকে সংরক্ষণ করার জন্য ভ্যান অ্যাকেন নতুন বুদ্ধি বের করলেন। ফল বাগানটি কিনে পরের কয়েক বছর ধরে তিনি সেগুলো থেকে কলম নিয়ে একটি গাছে রূপান্তরের চেষ্টা করতে লাগলেন।
ভিন্ন ভিন্ন ফলগাছগুলোর ওপর কাজ করার সময় ভন অ্যাকেন তাদের মধ্যেকার সৃষ্ট সম্পর্কগুলোর একটি টাইমলাইন বানালেন। যে গাছগুলোর মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করা যাচ্ছে, তাদের গোড়ায় কলম দিয়ে আরো কয়েকটি গাছের মূলের সংযোজনের চেষ্টা করতে থাকেন। এভাবে গাছটির বয়স দু'বছর হলে তিনি চিফ গ্রাফটিং নামের একটি নতুন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা শুরু করেন। ফলের কলিসহ অন্য একটি গাছের ফালি পরীক্ষা করা গাছটির মধ্যে কেটে সেখানে স্থাপন করেন। তারপর সেটা সেভাবেই কয়েক মাস রেখে শীতকাল পার করা হয়। যদি সব ঠিকঠাক থাকে, তাহলে পরীক্ষা করা গাছটির শাখা-প্রশাখা অন্য আর দশটি গাছের মতোই বেড়ে উঠবে। প্রায় পাঁচ বছর ধরে এই এক্সপেরিমেন্ট চালানোর পর ভ্যান অ্যাকেনের প্রথম চল্লিশটি ফলওয়ালা গাছ সুস্থভাবে বেড়ে ওঠে।
বছরের বেশিরভাগ সময়েই একে দেখতে আর দশটা স্বাভাবিক গাছের মতোই লাগে। তবে বসন্তকালে গাছটি গোলাপ, সাদা, লাল, বেগুনির মিশেলে এক অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক শোভায় পরিণত হয়। মাস দুয়েক পরে গ্রীষ্মকালে গাছটিতে ধরে অ্যালমন্ড, চেরি, পিচফল, বরই, নেক্টারিন, অ্যাপ্রিকট থেকে শুরু করে চল্লিশ রকমের ফল।
নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপহার দেবার পাশাপাশি এটি বিশ্বের নানা প্রজাতির বৈচিত্র্যময় স্টোনফ্রুটগুলোকে সংরক্ষণ করারও একটি দারুণ উপায়। শিল্প আর বিজ্ঞানকে একসূত্রে গাঁথার জন্য পুরস্কারজয়ী চিত্রশিল্পী ভ্যান অ্যাকেনের তাকে বেশ ভালোই জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। টেড টক থেকে শুরু করে অনেক সাক্ষাৎকারের জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছেন। সাম্প্রতিককালে কালিফোর্নিয়া অঞ্চলের ব্যাপক খরা সেখানকার ফলের উৎপাদনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তেমনিভাবে শীতে তাড়াতাড়ি বরফ পড়া শুরু হলেও অনেক ফলের কুঁড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যেহেতু স্টোনফ্রুট গাছের তেমন পানি লাগে না, এই বিশাল আকারের মনো-কালচার দিয়ে স্বল্প এলাকাজুড়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ ফলের চাষ করে চাহিদা মেটানো সম্ভব।
ভ্যান অ্যাকেনের নিজস্ব ওয়েবসাইট অনুযায়ী এ ধরনের পঁচিশটার বেশি গাছ সফলভাবে বেড়ে উঠছে এখন। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস, সান্তা ফে, নিউ মেক্সিকো, নিউইওয়র্ক, কেন্টাকি, শর্টহিলস, নিউজার্সি, লুইভিল, পাউন্ডরিজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে আছে এই চল্লিশ ফলওয়ালা গাছগুলো। বিভিন্ন যাদুঘর, কমিউনিটি সেন্টার আর কয়েকজন ব্যক্তিগত সংগ্রাহকের কাছে গেলে সেগুলো মিলবে। ভ্যান অ্যাকেনের নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও আছে ট্রি সেভেন্টি ফাইভ। এমনকি চীন এবং সুইডেনেও পৌঁছে গেছে এই প্রকল্পের কিছু গাছ। আমেরিকান হিস্ট্রি’স এর অ্যাক্সেলারেট ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড ইনোভেশন ফেস্টিভ্যালের অংশ হিসেবে স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল মিউজিয়ামেও এরকম একটি গাছ প্রদর্শন করা হয়।
ভ্যান অ্যাকেনের পরিকল্পনা আছে নিজস্ব একটি ফলবাগান করার। এই প্রকল্পের পিছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে তার দাদার কথা উল্লেখ করে ভ্যান অ্যাকেন বলেন, এটা আমার ছোটবেলায় দেখা একটি জাদুকরি বিষয়। আমার দাদা একটি পিচফল গাছের কলম নিয়ে আরেকটি পিচফলের গাছে বসিয়ে দিয়ে বলতেন, এখন কেবল অপেক্ষার পালা। আর তারপরের বসন্তেই সেই গাছটি ভিন্ন একটি শাখা নিয়েও স্বাভাবিকভাবেই ফল দিত।
কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে কৃষির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ভালোই ধারণা ছিল ভ্যান অ্যাকেনের। তবে কলম করার মাধ্যমে শংকর করার এই পদ্ধতি তার কাছে সবসময়ই রহস্যময় লাগতো। এ ব্যাপারে আরো জানতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন, সাহিত্যে কলম করা বা ড্রাফটিংকে সেক্সুয়ালিটির রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ওভিডের মেটামরফসিস কিংবা মেরি শেলির মডার্ন ম্যান ফ্রাঙ্কেনস্টেইন ইত্যাদির মতো গাছকে নিয়েও ফ্যান্টাসি সায়েন্স ফিকশন কিংবা ফ্যান্টাসিমূলক সাহিত্যের জন্ম দিতে চেয়েছেন তিনি।
গাছের ফলগুলোর গুণগত মানও অন্য স্বাভাবিক গাছের ফলের মতোই। ভ্যান অ্যাকেন মজা করে বলেন, এলাকার স্থানীয় হরিণদের কাছে ফলগুলো খুবই জনপ্রিয় ছিল, কিন্তু আপাতত পেপারমিন্ট আর রসুন দিয়ে তাদেরকে তাড়ানো হয়েছে। তার কাছে মনে হয়, একধরনের ফল বিশাল পরিমাণে জন্মানোর চেয়ে পরিমিত পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের ফল জন্মানো লাভজনক। এই ফলগুলো জুলাই থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যবর্তী সময়ে পেকে খাবার উপযোগী হয়।
তিনি আরো বলেন, আমি এসব ফলের বেশিরভাগই বিলিয়ে দেই। অনেকে আমার কাছে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের তাল, পিচফল কিংবা চেরি খেয়ে বলে, সেগুলো কেন বাজারে পাওয়া যায় না। পৃথিবীতে হাজারো প্রজাতির স্টোনফ্রুট আছে। তবে এর মধ্যে মাত্র অল্প কয়েকটিই বাণিজ্যিকভাবে জনপ্রিয়। দুর্ভাগ্য যে, ব্যবসায়ীরা এসকল ফলের গৎবাঁধা কয়েকটি প্রজাতিই বিক্রি করতে আগ্রহী। ত্রিশ কিংবা পঞ্চাশটি নয়, ঠিক চল্লিশটি প্রজাতিকেই কেন বেছে নিলেন, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পশ্চিমা ধর্মবিশ্বাসে “চল্লিশ” একটি বিশেষ সংখ্যা। নূহ নবীর আমলে চল্লিশ দিন ধরে দুর্যোগ হয়েছিল। আবার যিশুখ্রিস্ট তার টেম্পটেশনের আগে চল্লিশ দিন চল্লিশ রাত ধরে মরুভূমিতে ছিলেন। চল্লিশ এমন একটি সংখ্যা যাকে গণনার বাইরে বলে ধরা হয়।
নিজের ওয়েবসাইটের পাশাপাশি ট্রিঅফফরটিফ্রুট নামে ভ্যান অ্যাকেনের আরেকটি ওয়েবসাইট আছে। সেখানে এই গাছগুলো বেচা-কেনার ব্যবস্থাও আছে। তবে বোঝাই যাচ্ছে, গাছগুলোকে এরকম অবস্থায় আনতে ধৈর্যের চরম পরীক্ষা দিতে হয়। এজন্য ছয়-আট বছর অপেক্ষা করা লাগে। বিশটি প্রজাতির কলমের সাথে গাছটিকে মানিয়ে নিতেই প্রায় ছয় বছরের কাছকাছি লাগে। এরপরে সেগুলোকে কাটছাট করে স্বাভাবিক আকারে আনা হয়। একটি গাছে কমপক্ষে বিশটা ফল ধরলে ভ্যান অ্যাকেন সেটাকে বেচার উপযোগী বলে মনে করেন। একেকটি গাছের দাম পড়বে প্রায় আটাশ হাজার ডলার। অংকটা বেশি মনে হলেও এই গাছের ভিন্নধর্মী ফল বেচে এর কয়েকগুণ বেশি আয় করা সম্ভব।
এ পর্যন্ত ভ্যান অ্যাকেন আড়াইশো প্রজাতির ওপরে কাজ করেছেন। ভবিষ্যতে তার ইচ্ছা গ্রামাঞ্চলে নয়, বরং শহরের বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের গাছ লাগানো। পোর্টল্যান্ডের কাছে দক্ষিণ মেইনে তার নিজস্ব ফল বাগান করার পরিকল্পনা আছে। কেবলমাত্র বৈপ্লবিক শিল্পকর্ম হিসেবেই নয়, ফল উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত দেখিয়ে দিয়েছে এই চল্লিশ ফলের গাছ। আর সেই সাথে আমেরিকার ঐতিহ্যবাহী কিছু ফলের প্রজাতিও বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে।
This article is in Bengali Language. It is about Tree of 40 Fruit, which is one of a series of fruit trees created by the New York-based artist Sam Van Aken using the technique of grafting. For references please check the hyperlinked texts in the article.
Feature Image: Sam Van Aken