মস্কো থেকে হাজারখানেক মাইল পূর্বে, উত্তরে আর্কটিক সাগর থেকে শুরু করে দক্ষিণে মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত, উরাল থেকে মাঞ্চুরিয়ার মাঝে এক জনবিরল জায়গা আছে। এই অঞ্চলটি আসলে আয়তনে পুরো পশ্চিম ইউরোপ থেকেও বড়। এই একাকী প্রান্তরের কেন্দ্রে আছে টাংগুসকা নদের গুপ্ত উপত্যকা। এই নদীর নামকরণ করা হয়েছে টাংগাস জনগোষ্ঠীর নামে। প্রায় পঞ্চাশ হাজার একরের একটি বন আছে ওখানে, যে বনে গ্রীষ্মের দিনগুলোতে অগণিত পাইনের মাঝে চরে বেড়ায় বল্গা হরিণের দল। ছোট্ট এই জনগোষ্ঠী মূলত ঐ বনে হরিণ এবং ভালুক শিকার করে জীবনধারণ করে।
৩০ জুন, ১৯০৮ সাল। ভোর হয়েছে, আরেকটি নতুন দিনের শুরু। নীল আকাশের মাঝে রোদ খেলা করছে। কোথাও মেঘের ছিঁটেফোটাও নেই। নাস্তা করে সকাল সোয়া সাতটার দিকে সার্গেই সেমেনভ, পেশায় যিনি একজন কৃষক, বাড়ির সামনের সিঁড়ির ধাপে এসে বসেছিলেন জিরিয়ে নেবার আশায়। অমন সময় আকাশের বুকে ভয়াবহ বিস্ফোরণটা হলো।
পরবর্তীতে তিনি বিজ্ঞানীদের বলেছিলেন, ঐ বিস্ফোরণের ফলে উৎপন্ন আগুণের গোলা এত ভয়াবহ রকমের উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল যে, সূর্যকে মনে হচ্ছিল অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেছে। আর ঐ বিস্ফোরণের সময় উৎপন্ন উত্তাপের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, "মনে হচ্ছিলো যেন, আমার শার্ট শরীরের উপরেই একেবারে ঝলসে যাচ্ছিল।" এমনকি ঐ উত্তাপে তার এক প্রতিবেশীর রুপোর প্লেট, কাঁটা চামচ ইত্যাদি গলেই গিয়েছিল। অনুসন্ধান করতে গিয়ে আরো চমকে দেয়া তথ্য বেরিয়ে এলো। জানা গেল, ঐ বিস্ফোরণ মূলত সেমেনভ থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটারের মতো দূরের এক জায়গায় হয়েছিল।
আরেকজন কৃষক, ভাসিলি ইলিচের ভাষ্যমতে, এত বিশালাকারের আগুন সবকিছুকে ঘিরে ফেলেছিল যে, এই আগুন পুরো বন, বনের সব বল্গা হরিণ, এমনকি অন্যান্য সব প্রাণীকেও ধ্বংস করে ফেলে। তিনি এর সাথে বেশ কিছু প্রতিবেশীকে নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখেন, কিছু পুড়ে যাওয়া হরিণের লাশের অবশিষ্টাংশ ছাড়া আর সবকিছু রাতারাতি ‘নেই’ হয়ে গিয়েছে।
অসম্ভব উজ্জ্বল ঐ আগুনের গোলা মুহূর্তের মাঝে দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে ছুটে এসেছে উত্তর-পশ্চিমে। পৃথিবী জুড়ে পাওয়া গেছে ভূমিকম্পের তরঙ্গ, আর বায়ুমণ্ডলের মাঝে চাপ-তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছে, ছাড়িয়ে গেছে রাশিয়া এবং ইউরোপকেও। ৮০০ কিলোমিটার দূরেও এই বিস্ফোরণ দৃশ্যমান ছিল।
ঠিক ঘটনার সময়, ঘটনাস্থল থেকে হিসেব করলে পৃথিবীর ব্যাসের মোটামুটি এক-চতুর্থাংশ দূরে অবস্থিত লন্ডনে সেদিন এত আগে দিনের শুরু হয়ে গিয়েছিল যে, মধ্যরাতের আকাশ দেখে মনে হচ্ছিলো আসন্ন বিকেল। তুলনা করতে গেলে বলতে হবে, ঘটনাটা যদি আমেরিকার শিকাগোতে ঘটতো, এর আলো পেনসিলভানিয়া, টেনেসি এবং টরোন্টো থেকেও দেখা যেতো। ইস্ট কোস্টে দাঁড়ালে, কিংবা আটলান্টা যতটুকু দক্ষিণে, সেখানে কিংবা পশ্চিমে রকি পর্বত পর্যন্তও এর গর্জন শোনা যেত। এবং সবকিছু স্বাভাবিক হতে হতে লেগে যেত দু'মাস। আর, এই বিস্ফোরণ সেদিন বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে এত বেশি ধোঁয়া আর ধুলো ছুঁড়ে দিয়েছে যে, বিশ্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশেও পৃথিবীর ছায়ায় সূর্যের আলো ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।
বহির্বিশ্ব থেকে মহাজাগতিক কিছু এসে আমাদের বায়ুমন্ডলে আঘাত করেছে, এটুকু তো নিশ্চিত। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। অ্যারিজোনায় এরকম একটি বিশাল গর্ত আছে, যা মূলত একটি ধুমকেতুর আঘাতের ফলে তৈরি হয়েছে। আসলে ওটা ছিল একটি ছোট পাথরখন্ড, এদেরকে বলা হয় গ্রহাণু। কিন্ত ‘টাংগুসকা ইভেন্ট’ নামে পরিচিত এই ঘটনা ছিল পুরোপুরি অন্যরকম।
বিজ্ঞানীরা সেসময় ধারণা করে নিয়েছিলেন, বিশালাকারের কোনো উল্কাপিন্ড হয়তো পৃথিবীকে সরাসরি আঘাত করার আগে বাতাসে থাকতেই বিস্ফোরিত হয়েছে এবং ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে চারপাশে। এবং এর ফলেই অমন ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে।
কয়েক বছর পরে, ১৯২৭ সালে চেকোস্লোভাকিয়ান বিজ্ঞানী লিওনিদ কুলিকের নেতৃত্বে বিজ্ঞানীদের একটি দল ঘটনাস্থলে গেল অনুসন্ধান চালাতে। যদি বিস্ফোরণের জন্য দায়ী জিনিসটি সৌরজগতের কোনো জায়গা থেকে ছুটে আসা টুকরো কোনো গ্রহাণু বা উল্কাপিন্ড হয়ে থাকে, তাহলে এর চিহ্ন হিসেবে ঘটনাস্থলে তো একটি গর্ত অন্তত থাকবে। তারা ওখানে গিয়ে অমন কিছুর চিহ্নও খুঁজে পেলেন না। তারা আবিষ্কার করলেন, আকাশের যে জায়গায় বিস্ফোরণটা হয়েছিল, ঠিক ঐ বরাবর নিচে মাটিতে বিশাল অংশ জুড়ে কাদা কাদা সবকিছু যেন একেবারে জমে সমান হয়ে গেছে। যেন হাজারখানেক বুলডোজার দিয়ে পুরো বনটাকে একেবারে সমান করে ফেলা হয়েছে লন্ডনের মতো আকারের কোনো শহরের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপনের জন্য।
এই সমান জায়গাকে ঘিরে আছে পুড়ে যাওয়া ভাঙাচোরা গাছের ধ্বংসাবশেষ। এর আশেপাশের অনেকটা জায়গাজুড়ে ভাঙাচোরা ম্যাচের কাঠির মতো গাছের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে। বোঝা যায়, ভয়াবহ কোনো হারিকেন এখানে এসে আছড়ে পড়েছিল, নিজের ভেতরে জমে থাকা সবটুকু উন্মাদনা পুরোপুরি উসুল করে নিয়েছিল ঠিক এখানে এসেই। এটা আসলে ছিল ঐ বিস্ফোরণের ধাক্কা। এর ফলে এই অঞ্চলের সব ধরনের জীবন একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এবং পরবর্তী মোটামুটি পঁচিশ বছরের মতো সময় এই জায়গা ওভাবেই পড়েছিল, বিধ্বস্ত অবস্থায়। পরবর্তীতে ৩০ মিটার গভীর করে মাটি খুঁড়েও দেখা হয়েছে, কিন্তু কোনো ধরনের মহাজাগতিক কোনো পদার্থ, ধুমকেতু, উল্কাপিন্ড বা গ্রহাণুর সামান্য চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সরল কথায়, সেদিন পৃথিবীকে যা-ই আঘাত করে থাকুক, ওটা রাতারাতি বাতাসে মিলিয়ে গেছে!
১৯৬৫ সালে আবারো একজন পদার্থবিদ, একজন রসায়নবিদ এবং একজন ভূতত্ত্ববিদের সমন্বয়ে গঠিত তিনজনের একটি দল সব ধরনের প্রমাণ, মানে ঐ ঘটনা সংশ্লিষ্ট যত কিছু আছে, সব কিছু খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন। তাদের আশা ছিল, হয়তো তারা এই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। যে এক-দুটো গাছ তখনও এত কিছুর মধ্যেও টিকে গেছে, ওগুলোকে পরীক্ষা করে ঐ বিস্ফোরণের ধাক্কার (এখানে ধাক্কা মানে বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট যে ‘ব্লাস্ট ওয়েভ’ সবকিছুর উপর আছড়ে পড়েছিল) ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছিলো। এটা থেকে সে সময়ের বাতাসের শক্তির ব্যাপারে একটি ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল, আর এ থেকে এত গাছকে পুড়িয়ে ফেলার জন্য মোট কী পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন, সেটা হিসেব করে বের করা গিয়েছিল। রেকর্ড থেকে দেখা গেল, সে সময় পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র কোনো কারণে খুব বিশৃংখল হয়ে গিয়েছিল, এবং সিসমোমিটার থেকে দেখা গেল সেটা ভূমিকম্পের সমান শক্তির কম্পনের রেকর্ড দেখাচ্ছে।
এরপরে বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট আলোর উজ্জ্বলতা এবং সেটার স্থায়ীত্ব হিসেব করে দেখা হলো। পরীক্ষা থেকে তারা সিদ্ধান্তে আসলেন, ঐ বিস্ফোরণের ফলে কয়েক সেকেন্ডের মাঝে এক মিলিয়ন বিলিয়ন জুল শক্তি উৎপন্ন হয়েছে এবং চারপাশের উপরে আছড়ে পড়েছে। এই পরিমাণ শক্তি দিয়ে পুরো যুক্তরাজ্য ১ ঘন্টা চলতে পারতো! এটাকে মোটামুটি সরলীকরণ করে নিউক্লিয়ার বিষ্ফোরণের সাথে তুলনা করা যেতে পারে, তাহলে হয়তো কিছুটা বোঝা যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিরোশিমায় যে পারমাণবিক বোমাটি ফেলা হয়েছে, সে তুলনায় এই বিস্ফোরণ ছিল প্রায় ১,০০০ গুণ বেশি শক্তিশালী!
আচ্ছা, হ্যাঁ, আজকের দিনে ঐ বিস্ফোরণ ঘটলে একে হয়তো মানুষের তৈরি কৃত্রিম নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ বলে সন্দেহ করা হতো। কিন্তু ১৯০৮ সালে, আজকে আমরা যেটাকে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স জানি, ঐ জিনিস তখনো দূর ভবিষ্যত! হ্যাঁ, এরপরেও এটা কোনো ধরনের নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ হতে পারে, কিন্তু সেটা অবশ্যই প্রাকৃতিকভাবে হতে হবে।
অর্থাৎ, সেদিন পৃথিবীকে আসলে কী আঘাত করেছিল, এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের এখন পর্যন্ত স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। হতে পারে বিশাল কোনো ধূমকেতু, উল্কাপিন্ড কিংবা গ্রহাণু আঘাত করেছিল পৃথিবীকে। তবে, বর্তমান সময়ের প্রতিপদার্থবিজ্ঞানীদের ধারণা, বিস্ফোরণের যেসব প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং এজন্য দায়ী একটি সামান্য কিছুকেও যে ঘটনাস্থলে একদমই খুঁজে পাওয়া যায়নি- এসব কিছুই প্রতিপদার্থের দিকে ইঙ্গিত করে।
সামান্য একটুখানি প্রতিপদার্থ পদার্থের সংস্পর্শে এসে পড়লেও এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এর বিশেষত্ব হচ্ছে, বিস্ফোরণের ফলে প্রতিপদার্থের পুরোটাই ধ্বংস হয়ে যায়, কোনো ধ্বংসাবশেষ থাকে না। তবে, প্রতিপদার্থের এ ধরনের আর কোনো ঘটনার কথা আমাদের জানা নেই। যেহেতু প্রতিপদার্থ আর পদার্থের সংস্পর্শের ফলে বিস্ফোরণ হলে তা প্রতিপদার্থের কোনোরকম ধ্বংসাবশেষ রেখে যায় না, কাজেই পৃথিবীর একেবারে শুরুর দিকে, মানুষ আসার আগে কিংবা মানুষ জ্ঞানে-বিজ্ঞানে এমন উন্নত হয়ে ওঠার আগে যদি এমন কোনো বিস্ফোরণ হয়েও থাকে, তাহলে এর কথা আমাদের জানার কোনো উপায়ও তো নেই। হয়তো সেদিন প্রতিপদার্থ দিয়ে তৈরি এক মিটারের মতো একটুকরো পাথর ছুটে এসে আঘাত করেছিল পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে।
এ সবই অনুমান। সেদিন আসলে কী হয়েছিল, সেই রহস্যের সমাধান আজও হয়নি। কোনোদিন আদৌ হবে কি না, কেউ জানে না।
This article is in Bangla language. It is about the unsolved mystery of Tunguska Event. Necessary references have been mentioned below.
Reference:
[1] Antimatter by Frank Close was
Featured Image: newsbeezer.com