কী ঘটবে যদি পৃথিবী থেকে হঠাৎ সব মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়?

কোথাও কেউ নেই। পরিত্যক্ত শহরে বাতাসে উড়ে বেড়ানো কিছু কাগজপত্র আর পলিথিনের ব্যাগের শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দও নেই। একটু পরপর ভূতুড়ে কঙ্কালের মতো যেন দাঁড়িয়ে আছে ভগ্নদশার পরিত্যক্ত বহুতল ভবনগুলো। মাঝে মাঝে এ গলি থেকে ও’ গলিতে দ্রুতগতিতে ছুটে যাচ্ছে হ্যামেলিনের গল্পের মতো বিশালাকৃতির ইঁদুর অথবা অন্য কোনো নাম না জানা বিদঘুটে প্রাণী। আর এই পরিত্যক্ত শহরেই হয়তো বাঁচার চেষ্টা করছে বিচ্ছিন্ন একটি-দুটি পরিবার।

শিল্পীর দৃষ্টিতে পরিত্যক্ত বিশ্ব যেরকম হবে; Image Source: Entertainment One

এই দৃশ্য আমাদের অত্যন্ত পরিচিত। শত শত পোস্ট অ্যাপোক্যালিপ্টিক চলচ্চিত্র আছে, যেখানে এ ধরনের দৃশ্য দেখানো হয়। কোনো ভাইরাসের আক্রমণে, রহস্যময় কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে, কিংবা বিষাক্ত কোনো রাসায়নিক দুর্ঘটনায় বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের মৃত্যুর পর অল্প কিছু বেঁচে থাকা মানুষের ভাগ্যে কী ঘটতে পারে, সেটাই এ ধরনের চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সত্যিই যদি কখনো হঠাৎ করে বিশ্বের সব মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবীতে কী কী ঘটতে পারে? মানব সভ্যতা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হতে কীরকম সময় লাগতে পারে?

উৎসাহী বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময় এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং ইউটিউব চ্যানেল বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গবেষকের সাহায্যে মনুষ্য পরবর্তী যুগের পৃথিবীর চিত্র আঁকার চেষ্টা করেছেন। সামান্য কিছু পার্থক্য থাকলেও তারা অধিকাংশই মোটামুটি একই ধরনের সম্ভাবনা এবং আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছেন। চলুন জেনে নিই কী ঘটতে পারে পৃথিবীর ভাগ্যে, যদি আমরা হঠাৎ করেই গায়েব হয়ে যাই।

শিল্পীর দৃষ্টিতে পরিত্যক্ত বিশ্ব যেরকম হবে; Image Source: tokyogenso

মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পৃথিবীর অধিকাংশ এলাকা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যাবে। বিশ্বের অধিকাংশ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় জ্বালানি তেলের মাধ্যমে। মানুষ না থাকলে সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করার মতো কেউ না থাকায় কয়েক ঘন্টার ব্যবধানেই বিশ্বের অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। কেবলমাত্র উইন্ডমিল, সোলার প্যানেল এবং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরবরাহকৃত এলাকাতেই বিদ্যুৎ প্রবাহ অবিচ্ছিন্ন থাকবে।

উইন্ডমিলের লুব্রিক্যান্ট শেষ হয়ে গেলে এবং সোলার প্যানেলের উপর ধুলোবালি পড়ে তা আচ্ছাদিত হয়ে গেলে কয়েক মাসের মধ্যে সেগুলোও অকার্যকর হয়ে যাবে। শেষপর্যন্ত শুধুমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত থাকতে পারে। এগুলো কয়েক মাস, এমনকি কয়েক বছর পর্যন্তও কার্যকর থাকতে পারে। অব্যবস্থাপনায় সেগুলোও নষ্ট হয়ে গেলে কয়েক শত বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো পৃথিবী সম্পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে।

শিল্পীর দৃষ্টিতে পরিত্যক্ত বিশ্ব যেরকম হবে; Image Source: tokyogenso

প্রথম কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আরেকটি বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে। বিশ্বের তেল এবং গ্যাস শোধনাগারগুলোতে বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকান্ডের সৃষ্টি হবে। নিয়ন্ত্রণ করার কেউ না থাকায় সেগুলো মাসের পর মাস ধরে জ্বলতে পারে। লোকালয় কিংবা বনাঞ্চল থেকে বেশি দূরে অবস্থিত না হলে অগ্নিকান্ড ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে। এছাড়াও প্রথম ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই শক্তি গ্রহণের মাত্রায় ব্যাপক হ্রাস হওয়ায় বিশ্বের নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেফ মোডে চলে যাবে।

দুই-তিন দিনের মধ্যেই বিশ্বের অধিকাংশ ভূগর্ভস্থ রেললাইন এবং টানেল পানিতে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়ে যাবে। নিয়মিত পানি নিষ্কাশনের জন্য অধিকাংশ ভূগর্ভস্থ রেললাইন এবং টানেলেই পাম্প ব্যবহার করা হয়। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় এবং জেনারেটরের জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ায় সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে এবং পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব না হওয়ায় ধীরে ধীরে ভূগর্ভস্থ পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়ে পড়বে।

শিল্পীর দৃষ্টিতে পরিত্যক্ত বিশ্ব যেরকম হবে; Image Source: wallpapercave.com

১০ দিনের মধ্যেই অধিকাংশ পোষা প্রাণী অনাহারে মৃত্যুবরণ করবে। ইলেক্ট্রিক গেটগুলো অকেজো হয়ে পড়ায় প্রথম কয়েক দিনের মধ্যেই বিশ্বের শত কোটি গরু, ছাগল, শূকর, মুরগিসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাণী তাদের খামার থেকে বেরিয়ে পড়বে। যারা বের হতে পারবে না, তারা খামারের ভেতরেই মারা যাবে। আর যারা বের হতে পারবে, তারাও বাইরের পরিবেশের সাথে অভ্যস্ত না হওয়ায় এবং খাবারের সংকট থাকায় ধীরে ধীরে মারা পড়বে। বেঁচে থাকবে কেবল আগে থেকেই বাইরে থাকা হিংস্র বন্য পশুরা। বিভিন্ন জাতের ইঁদুর এবং তেলাপোকা বেঁচে থাকলেও যেগুলো মানুষের ফেলে দেওয়া ময়লার উপর নির্ভরশীল ছিল, খাদ্যের অভাবে তাদের সংখ্যাও বিপুলভাবে হ্রাস পাবে।

এক মাসের মধ্যেই নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরগুলোকে ঠান্ডা করার জন্য ব্যবহৃত পানি বাষ্পীভূত হয়ে যাওয়ার ফলে রিঅ্যাক্টরগুলোতে বিস্ফোরণ শুরু হবে। নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এর প্রতিক্রিয়া হবে চেরনোবিল এবং ফুকুশিমার সম্মিলিত বিপর্যয়ের চেয়েও মারাত্মক। বিশাল এলাকা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে এবং পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে যাবে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত পৃথিবীর বড় একটি অংশ জুড়ে এর প্রভাব বজায় থাকবে। আশেপাশের এলাকার প্রচুর প্রাণী দীর্ঘকাল পর্যন্ত ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করবে।

শিল্পীর দৃষ্টিতে পরিত্যক্ত বিশ্ব যেরকম হবে; Image Source: wallpapercave.com

নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর ছাড়াও প্রাকৃতিক কারণেও নিয়মিত অগ্নিকান্ড ঘটবে। সামান্য বজ্রপাতের কারণে কোনো এলাকায় অগ্নিকান্ডের সূচনা হলে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকায় গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। অগ্নিকান্ডের কারণে বিশ্বের প্রচুর গ্রামের কাঠের নির্মিত ঘরবাড়ি পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আগুনের হাত থেকে বেঁচে গেলেও কাঠের অধিকাংশ ঘরবাড়ি ধীরে ধীরে ঘুণপোকা এবং ছারপোকার আক্রমণে ধ্বসে পড়তে থাকবে। মোটামুটি ৭৫ বছরের মধ্যে কাঠের বিম এবং কলামগুলো ভেঙে পড়তে শুরু করবে এবং ১০০ বছরের মধ্যে বিশ্বের অধিকাংশ কাঠের স্থাপনা ধ্বসে পড়বে।

২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে ফুটপাথ এবং রাস্তাঘাটগুলোতে ফাটল ধরে সেখানে আগাছা এবং গাছপালা জন্মাতে থাকবে। এ সময়ের মধ্যে ফুটপাত এবং খোলা চত্বরগুলোর তিন-চতুর্থাংশই ঘাস এবং আগাছায় আবৃত হয়ে যাবে। বিশ্বের অনেক রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাবে। শীত প্রধান দেশে শীতকালে পানি জমে বরফ হয়ে যাবে এবং গরমকালে আবার বরফ গলে পানিতে রূপান্তরিত হবে। এই তারতম্যের কারণে রাস্তাঘাটের ভাঙণ ত্বরান্বিত হবে। বৃষ্টির পানি ছাদের উপর জমে কনক্রিটের ভবনগুলোরও একই দশা সৃষ্টি করবে। মোটামুটি ২০০ বছরের মধ্যে বিশ্বের অধিকাংশ কনক্রিটের বিল্ডিং ভেঙে পড়তে শুরু করবে।

শিল্পীর দৃষ্টিতে পরিত্যক্ত বিশ্ব যেরকম হবে; Image Source: wallpapercave.com

ব্যবস্থাপনার অভাবে স্টিলের তৈরি ভবন এবং ব্রিজগুলোতে বৃষ্টির পানি এবং বাতাসের অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় মরচে ধরতে শুরু করবে। মোটামুটি ৩০০ বছরের মধ্যে আইফেল টাওয়ার, গোল্ডেন গেট ব্রিজসহ বিশ্বের অধিকাংশ স্টিলের স্থাপনা ভেঙে পড়তে শুরু করবে। মরুভূমিতে এই প্রক্রিয়া একটু মন্থর হবে, কিন্তু তার আগেই আরব আমিরাত, কাতারসহ বিশ্বের অধিকাংশ মরুময় এলাকা পুনরায় বালিতে ডুবে যাবে। যত মজবুতই হোক, ব্যবস্থাপনা না থাকায় কয়েকশো বছরের মধ্যে বাঁধগুলোও ভেঙে পড়বে এবং প্রচুর এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে। প্রকৃতি ধীরে ধীরে মানব সভ্যতাকে গ্রাস করে নিতে থাকবে।

মানুষের কারণে যেসব বন্যপ্রাণী, পাখি এবং সামুদ্রিক মাছের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছিল, তাদের সংখ্যা পুনরায় বৃদ্ধি পেতে শুরু করবে। চিড়িয়াখানা থেকে বের হয়ে যাওয়া বন্য এবং বিরল প্রজাতির প্রাণীরাও নতুন করে বংশবৃদ্ধি করতে শুরু করবে। মানুষের অনুপস্থিতিতে দূষণ হ্রাস পাবে, বায়ুমন্ডল পরিষ্কার হয়ে উঠতে থাকবে। কয়েক হাজার বছর পরে মানুষের নির্মিত শহরগুলোর খুব কম চিহ্নই অবশিষ্ট থাকবে। শহরের রাস্তাগুলো নদীতে এবং শহরগুলো বনাঞ্চলে পরিণত হয়ে যাবে। প্রকৃতি ধ্বংস করে মানুষ যে কৃত্রিম আবাসস্থল তৈরি করেছিল, প্রকৃতি সেগুলো আবার অধিগ্রহণ করে নিবে।

শিল্পীর দৃষ্টিতে পরিত্যক্ত বিশ্ব যেরকম হবে; Image Source: wallpapercave.com

মানুষের নির্মিত স্থাপনাগুলোর মধ্যে শেষপর্যন্ত টিকে থাকবে প্রাচীনকালে পাথর কেটে তৈরি করা বিশালাকৃতির স্থাপনাগুলোই। ১০ হাজার বছর পর কেবলমাত্র চীনের মহাপ্রাচীর, মিসরের পিরামিড এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাউন্ট রাশমোর ন্যাশনাল মেমোরিয়াল ছাড়া বলতে গেলে মানুষের নির্মিত আর কোনো স্থাপনাই টিকে থাকবে না। মাউন্ট রাশমোরে পাহাড় কেটে প্রেসিডেন্টদের তৈরি মূর্তিগুলোই হয়তো সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হবে। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত না হলে সেগুলো সাত মিলিয়ন বছর পর্যন্ত অক্ষত থাকতে পারবে। দশ থেকে পনেরো মিলিয়ন বছর পর যদি কোনো এলিয়েন পৃথিবীতে ভ্রমণ করে, তবে কেবলমাত্র কিছু প্লাস্টিকের অবশেষ ছাড়া মানুষের তৈরি কোনো কিছুই তারা খুঁজে পাবে না।

ফিচার ইমেজ- tokyogenso

Related Articles