Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আঙুল ফোটানোর মাধ্যমে যেভাবে শব্দ তৈরি হয় অস্থিসন্ধিতে

২০০৯ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইগনোবেল পুরষ্কার পান ডোনাল্ড আঙ্গার নামে একজন চিকিৎসক। ইগনোবেল হলো নোবেল পুরষ্কারের একটি প্যারোডি সংস্করণ। ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে প্রতি বছরই দশটি ভিন্ন ক্যাটাগরিতে পুরষ্কার প্রদান করা হয়ে থাকে। ইগনোবেল পুরষ্কারের জন্য যোগ্য হতে গেলে গবেষক কিংবা উচ্চশিক্ষিত হওয়া জরুরী নয়। প্রয়োজন হলো আপনাকে এমন কিছু আবিষ্কার করে দেখাতে হবে যার কথা শুনে শ্রোতাদের প্রথমে হাসি পাবে, তারপর সেই আবিষ্কারে তারা যুক্তি খুঁজতে যাবে। এই পুরষ্কারের পুরোটা জুড়েই রয়েছে হাস্যরসাত্মক সব ব্যাপার। পুরষ্কার হিসেবে যে অর্থ প্রদান করা হয় সেখানেও রয়েছে বিরাট রসিকতা।

পুরষ্কারটি হাঁসির উপযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম, কিন্তু ফেলনা কিছু নয়। অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্ব এ পুরষ্কার পেয়েছেন। এর অনেক আবিষ্কারকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করে পরবর্তীতে বহু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়েছে।

ডাক্তার ডোনাল্ড আঙ্গার; Source: huffingtonpost.com

ইগ নোবেল পুরষ্কার অনুষ্ঠানে ডাক্তার ডোনাল্ড আঙ্গার; Source: science20.com

ডাক্তার ডোনাল্ড আঙ্গার এ পুরষ্কারটি পেয়েছিলেন ৬০ বছর যাবৎ প্রতিদিন নিয়ম করে বাম হাতের আঙুলগুলো ফোটানোর জন্য এবং ডান হাতের আঙুলগুলো না ফোটানোর জন্য। মনে হতে পারে এ আর এমন কঠিন কাজ কী! প্রশ্ন তো এখানেই, এক হাতের আঙুল ফুটিয়ে আর অপর হাতের আঙুল না ফুটিয়ে কোন বিষয়টি প্রমাণ করা সম্ভব এই বিষয়টিই আমাদের কারো মস্তিষ্কে আসবে না, যার জন্য বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয় ডাক্তার ডোনাল্ড আঙ্গারকে।

ছোটবেলা থেকেই আমাদেরকে আঙুল ফুটানোর হরেক রকমের অপকারিতা শোনানো হয়েছে, অত বেশি আঙুল ফুটানো যাবে না, এখন ফুটানো যাবে না, তখন ফুটানো যাবে না ইত্যাদি। সাধারণ একটি শারীরিক কার্যক্রমকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ভয়াবহ সব কুসংস্কার।

শিক্ষিত সমাজে যে ধারণাটি প্রচলিত রয়েছে সেটি হলো, আঙুল ফুটালে আর্থ্রারাইটিস হবে। এই বিভ্রান্তিকর তথ্যটিকে চিরতরে শূন্যে পাঠিয়ে দিতেই ডোনাল্ড আঙ্গারের এই অভিনব পন্থা, তিনি ব্যয় করেছেন তার জীবনের ষাটটি বছর। ষাট বছর পর দেখা যায় যে, তার দুই হাতের মাঝে আসলে কোনো পার্থক্য তৈরি হয়নি, সম্পূর্ণ সুস্থ-স্বাভাবিক আছে তার দুটি হাতই। এই আবিষ্কারের জন্যই তাকে মনোনীত করা হয় ইগনোবেল পুরষ্কারের জন্য।

অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্রে নায়ক কিংবা ভিলেনদের জন্য আঙুল ফুটানো অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি দৃশ্য, দর্শকেরা পছন্দ করে বেশ। কিন্তু এই শব্দ কি শুধুমাত্র আঙুলেই হয়ে থাকে? হাতের কনুইকে বেশ কিছু সময় ধরে একই অবস্থায় রেখে সংকুচিত করে আনুন, কিংবা বেশ কিছু সময় বসে থেকে উঠে দাঁড়ান অথবা দাঁড়ানো অবস্থা থেকে বসে পড়ুন। আপনি শব্দ শুনবেন, এই শব্দটি কোথা থেকে এলো? স্বাভাবিকভাবে আপনার কী মনে হয়? দুটি হাড়ের ঘর্ষণ থেকে কি এমনটি হতে পারে? ঘর্ষণ কার্যক্রমের সাথে যেহেতু আপনি পরিচিত, আপনি নিশ্চয় জানবেন যে, ঘর্ষণের ফলে দুটি হাড়ের ক্ষয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। হাড় যদি ক্ষয়ে যেতে শুরু করে, তবে এ তো রীতিমতো চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।

ভয় পাবেন না, আঙুল ফুটালে কিংবা হাতে-পায়ে যে শব্দ হয়ে থাকে উঠতে-বসতে সেটির কারণে হাড় ক্ষয়ে যাবার সম্ভাবনা নেই। কেন অস্থিসন্ধিতে এমন শব্দ হয়ে থাকে সেটিই ব্যাখ্যা করা হবে এই লেখায়।

মাথার খুলিতে থাকা বিভিন্ন সুচার; Source: commons.wikimedia.org

আমাদের শরীরে ভিন্ন ভিন্ন হাড়ের মাঝে রয়েছে অস্থিসন্ধি, এই অস্থিসন্ধিগুলোর মাঝেও রয়েছে ভিন্নতা। যেমন মাথায় থাকা অস্থিগুলো কখনো নড়াচড়া করাতে পারবেন না আপনি, এই হাড়গুলোর সন্ধিকে বলা হয় ‘সুচার’। যদি হাতে-পায়ে এই সুচার থাকতো তাহলে আমাদের আর কখনো হাঁটা-চলা করা সম্ভব হতো না। হাতে-পায়ে যে সন্ধি রয়েছে তাকে বলা হয় ‘সাইনোভিয়াল সন্ধি’; সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এক অস্থিসন্ধি। আঙুল ফুটালে কিংবা হাত-পা সংকুচিত-প্রসারিত করতে গিয়ে যেসব শব্দের সৃষ্টি হয় সেগুলোর জন্য দায়ী এই সাইনোভিয়াল সন্ধি। একটি সাইনোভিয়াল সন্ধিক্ষেত্রকে আবদ্ধ করে রাখে সাইনোভিয়াল পর্দা, পর্দার দুই মাথা যুক্ত থাকে যে দুটি হাড়ের মাঝে এই সন্ধি তাদের সাথে। পর্দা দ্বারা আবৃত ভেতরের ফাঁকা স্থানগুলোতে থাকে সাইনোভিয়াল ফ্লুইড। এই ফ্লুইডকে আপনি যানবাহনের মোবিলের সাথে তুলনা করতে পারেন, মোবিলের মতো যন্ত্রের ঘর্ষণ রোধই হলো এর কাজ। এখান থেকে এটি প্রমাণিত যে, অস্থিসন্ধিতে সাইনোভিয়াল ফ্লুইড উপস্থিতির দরুণ কোনো ঘর্ষণ হবে না, অতএব এখানে কোনো হাড়ক্ষয়েরও যৌক্তিক কারণ নেই।

একটি সাইনোভিয়াল সন্ধি; Source: noborukataoka.com

সাইনোভিয়াল ফ্লুইডটিই শব্দের সৃষ্টি করে থাকে। সাইনোভিয়াল অস্থিসন্ধি শরীরের প্রায় অধিকাংশ স্থানেই রয়েছে। হাতের মাঝে শব্দ সৃষ্টি করাটাই আপেক্ষিকভাবে সোজা, অনেককেই দেখা যায় ঘাড় কিংবা কাঁধেও নড়াচড়ার মাধ্যমে শব্দ সৃষ্টি করছে। যে যে স্থানে আমরা সাইনোভিয়াল সন্ধি পাবো, সেখানেই শব্দ তৈরি করি সম্ভব। এর মূলমন্ত্র হলো সন্ধিস্থলের অস্থিদ্বয়কে এমনভাবে নাড়াতে হবে যাতে সন্ধিতে অবস্থিত প্রান্তদ্বয় পরস্পরের থেকে সামান্য দূরে চলে যায়।

Source: home.bt.com

Source: mensfitness.com

Source: journosdiary.com

হাতের আঙুল ফুটিয়ে দেখুন, দুইভাবে করা যাবে এটা। হাতে আঙুল সবগুলো সংকুচিত করে একটু বেশি চাপ প্রয়োগে আরো সংকুচিত করা হলে শব্দ শুনবেন আপনি। আরেকভাবে করতে পারেন, এক হাত দিয়ে আরেক হাতের আঙুল স্বাভাবিকের চেয়ে প্রসারিত করুন, তাহলেও শব্দ শুনবেন। দুই ক্ষেত্রেই অস্থিসন্ধিতে অস্থিদ্বয়ের মাঝে দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পূর্বেই বলা হয়েছে যে, একটি বদ্ধ সাইনোভিয়াল সন্ধিতে পিচ্ছিলকারক পদার্থ হিসেবে থাকে সাইনোভিয়াল ফ্লুইড, এতে উপস্থিত হায়াল্যুরনিক এসিড ও লুব্রিসিন। এর প্রধান কাজই হলো একটি অস্থিকে আরেকটি অস্থির সংস্পর্শে পিছলিয়ে যেতে সাহায্য করা।

কোমল পানীয়ের উপরের পৃষ্ঠে দ্রবীভূত গ্যাসের বুদবুদ আকারে জমা হওয়া; Source: videoblocks.com

সাইনোভিয়াল ফ্লুইডে দ্রবীভূত অবস্থায় গ্যাসীয় কিছু পদার্থ থাকে। আপনি যদি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী না-ও হয়ে থাকেন, তবু এই কার্যক্রমটির সাথে আপনি বেশ পরিচিত। কোমল পানীয় পান গোটা বিশ্বে একটি দৈনন্দিন ব্যাপার। কতটুকু স্বাস্থ্যকর সেই তর্কে না যাই। তবে আমাদের দেশে একটি বাচ্চা বুঝতে শেখার সাথে সাথেই কোমল পানীয় চিনে ফেলে, পান করা শুরু করে দেয়, ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। মানুষের মুখে মুখে নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন কীভাবে এগুলো তৈরি করা হয়। যদি না-ও শুনে থাকেন কোনো সমস্যা নেই, বোতলের ক্যাপ খোলার সঙ্গে সঙ্গে তরলের উপরের পৃষ্ঠে অসংখ্য বুদবুদ গ্যাসের আনাগোনা নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন। গ্যাসীয় পদার্থকে উচ্চ চাপে তরলে দ্রবীভূত করে রাখা হয়েছে। ক্যাপ খোলার সঙ্গে সঙ্গে চাপ কমে পরিবেশের সাথে সমন্বয়ে চলে আসে, তখনই আপনি গ্যাসীয় পদার্থগুলোকে বুদবুদ হিসেবে পেয়ে যান।

সাইনোভিয়াল সন্ধিতে উপস্থিত তরল পদার্থে চাপ স্বাভাবিকই থাকে। কিন্তু যখন আমরা নির্দিষ্ট নড়াচড়ার বিনিময়ে অস্থির প্রান্তদ্বয়কে পরস্পর থেকে দূরে সরিয়ে আনি, তখন এই তরলের আয়তন বেড়ে যায়। তরলের পরিমাণ কিন্তু আগের মতোই থাকে, কেননা এই ফাঁকা স্থানটি একটি পর্দা দ্বারা আবৃত। আয়তন বেড়ে যাবার ফলে যে কাজটি ঘটবে সেটি বিজ্ঞানের অতি পরিচিত একটি কার্যক্রম, পরিমাণ একই রেখে যদি আয়তন বাড়ানো হয় তাহলে উক্ত স্থানের চাপ কমে যাবে। অর্থাৎ আয়তন ও চাপের সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক।

নিম্নচাপের দরুণ সাইনোভিয়াল ফ্লুইডে দৃশ্যমান হওয়া বুদবুদসমূহ; Source: spinalsymmetry.com

চাপ কমে যাওয়াতে এই নিম্নচাপ তখন তরলে উপস্থিত দ্রবীভূত গ্যাসের কণাকে বুদবুদ আকারে চাক্ষুষ করে তোলে। এই বুদবুদগুলো একত্রে মিলিত হয়ে বড় এক বুদবুদে পরিণত হয়, এটি তৈরি হতে গিয়েই মূলত শব্দটি হয়, যেটি আমরা শুনতে পাই আঙুল ফুটানোর সময়। এই শব্দটি শুনতে পেয়েই মানসিকভাবে তৃপ্ত হই আমরা তখন।

অস্থিসন্ধিতে নড়াচড়া শেষে অস্থিদ্বয় যখন পুনরায় পূর্বাবস্থানে চলে আসে, তখন সেখানকার চাপও আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠে। সাইনোভিয়াল ফ্লুইড তখন বড় হয়ে ওঠা বুদবুদটিকে খন্ড খন্ড করে ফেলে। নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে সবগুলো বুদবুদ আপনা থেকেই মিলিয়ে যায় ফ্লুইডে, গ্যাসীয় পদার্থও পুনরায় দ্রবীভূত হয়ে যায়।

বামপাশের হাতের এক্স-রেতে দেখা যাচ্ছে স্বাভাবিক অস্থিসন্ধি, ডানপাশের হাতে চিহ্নিত সন্ধিতে তৈরি হয়ে আছে বড়সড় এক বুদবুদ; Source: sciencenewsforstudents.org

এই কারণেই একবার আঙুল ফুটানোর সঙ্গে সঙ্গে আরো কয়েকবার আপনি ফুটাতে পারবেন না, বুদবুদগুলো মিলিয়ে যাবার পর আবার আপনি এই সুযোগ পাবেন। মোটামুটি বিশ মিনিটের মতো সময়ের প্রয়োজন হয়ে থাকে একটি সাইনোভিয়াল সন্ধিতে উপস্থিত গ্যাসীয় পদার্থটি পুরোপুরিভাবে দ্রবীভূত হতে।

ফিচার ইমেজ: sciencealert.com

Related Articles