Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রাজনীতি ও অর্থনীতিতে লাভ-লোকসানের জিরো সাম গেম

ধরুন, আপনার সামনে টেবিলের ওপর একটা মজাদার কেক দেখতে পেলেন। কেক একটা হলেও মানুষ আপনি একা নন। আপনার সাথে আপনার বন্ধুও আছে। আপনারা দুজনই কেকটা খেতে চান। এ অবস্থায় সাধারণভাবে বিবেচনা করলে মনে হবে আপনারা কেকটা দুই ভাগ করে খাবেন। কিন্তু আপনারা ভাগ করতে চান না। দুজনই পুরো কেকটা নিজে খেতে চান। এ পরিস্থিতিতে আপনারা দুজনই পড়ে গিয়েছেন জিরো সাম গেমে। যদিও বাস্তব জীবনে জিরো সাম গেম এত সরলভাবে কাজ করে না। এখানে থাকে রাজনীতি ও অর্থনীতির অনেক জটিল হিসাব।

জিরো সাম গেম কী?

জিরো সাম গেম (Zero Sum Game) হচ্ছে বিখ্যাত ‘গেম থিওরি’র একটা অংশ। এটা দিয়ে বোঝায় যেকোনো ক্ষেত্রে দুই বা ততোধিক পক্ষ কোনো নির্দিষ্ট জিনিস পেতে চাইলে, এক পক্ষ যে পরিমাণ সম্পদ অর্জন করবে, অন্য পক্ষ ঠিক সে পরিমাণ সম্পদ হারাবে। এতে নিট ফলাফল শূন্য হবে।

জিরো সাম গেমে এক পক্ষের জয় হলে অন্য পক্ষের পরাজয় হতে হবে; Image Source: amyjokim.com

কেকের উদাহরণে আবার ফেরা যাক। যদি কেকটি আপনি নিতে পারেন তাহলে আপনার অর্জন হবে +১ আর আপনার বন্ধুর অর্জন হবে -১। এতে দুজনের নেট পরিবর্তন হবে +১-১ = ০। এখানে নতুন কোনো কেক তৈরি হয়নি, কিংবা বিদ্যমান থাকা কেকের পরিমাণও কমে যায়নি। দাবা, টেনিস কিংবা জুয়া খেলাকে জিরো সাম গেম বলা যায়। কারণ এসব খেলায় এক পক্ষে জেতে, অন্য পক্ষ হারে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও জিরো সাম গেমের কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়। যেমন, যে সময়টা আপনি ফেসবুকে কাটাচ্ছেন, সেটার কারণে হয়তো আপনার পড়াশোনার সময়টা হারিয়ে যাচ্ছে।

জিরো সাম গেমের বৈশিষ্ট্য

  • এ ক্ষেত্রে চাহিদার তুলনায় যোগান সব সময়ই কম থাকবে।
  • সম্পদের পরিমাণ একই থাকবে। কোনো কিছুর সংযোজন বা বিয়োজন ঘটবে না।
  • সব পক্ষের জন্যই সম্পদের নেট পরিবর্তন হবে শূন্য।

চাহিদার তুলনায় সম্পদের পরিমাণ কম হলে এক পক্ষ যে পরিমাণ সম্পদ পেয়ে থাকে, অন্য পক্ষকে সে পরিমাণ ত্যাগ করতে হয়। এক্ষেত্রে আমাদের করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিকের সময়ের কথা বলা যায়। তখন ভাইরাস শণাক্ত করার কিটের স্বল্পতা ছিল। তাই কিছু সংখ্যক মানুষ তখন করোনা শনাক্তের পরীক্ষা করাতে পেরেছে, কিছু সংখ্যক পারেনি। এটাও ছিল জিরো সাম গেম। কিন্তু যদি শুধু এক পক্ষই থাকে সেটা জিরো সাম গেম হবে না। ধরুন টেবিলের ওপরের কেকটা আপনি খেতে চান, কিন্তু আপনার বন্ধু খেতে চায় না। সেক্ষেত্রে এটা জিরো সাম গেম হবে না। এটাকে বলা হয় নিট অর্জন বা লাভ। এখানে আপনার নেট লাভ হবে +১। কিন্তু আপনার বন্ধুর নেট লাভ বা ক্ষতি কিছুই হবে না। 

জিরো সাম গেম বনাম গেম থিওরি

গেম থিওরির মৌলিক ধারণা পাওয়া যায় হাঙ্গেরিয় বংশদ্ভূত আমেরিকান গণিতবিদ জন ফন নিউম্যান এবং তার সহযোগী জার্মান বংশদ্ভূত আমেরিকান অর্থনীতিবিদ অস্কার মরগেনস্টার্নের লেখা ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত ‘থিওরি অব গেমস অ্যান্ড ইকোনমিক বিহেভিয়ার’ বই থেকে। গেম থিওরি অর্থনীতি ও রাজনীতির বিস্তৃত ক্ষেত্রে তাত্ত্বিকভাবে ব্যবহার করা হয়। এর অন্যতম অংশ হচ্ছে জিরো সাম গেম এবং নন-জিরো সাম গেম।

সাধারণত আন্তর্জাতিক যে দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক চুক্তিগুলো করা হয়, এতে সব পক্ষেরই লাভজনক অবস্থা বা ‘উইন-উইন সিচুয়েশন’ থাকে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সব পক্ষই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যেমন, যুদ্ধের ক্ষেত্রে সব পক্ষেরই কম বেশি ক্ষতি হয়। এগুলো হচ্ছে ‘নন জিরো সাম গেম’। জিরো সাম গেমের ক্ষেত্রে এক পক্ষের লাভ হলে অন্য পক্ষের ঠিক একই পরিমাণ ক্ষতি হতে হবে।

ন্যাশ সাম্যাবস্থার জনক জন ফোর্বস ন্যাশ; Image Source: SOUTH CHINA MORNING POST VIA GETTY IMAGES

তাত্ত্বিকভাবে জিরো সাম গেম সমস্যার সমাধান করা যায় তিনটি উপায়ে। এদের মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে ‘ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়াম’ বা ন্যাশ সাম্যাবস্থা। এ সাম্যাবস্থার ধারণা দেন ১৯৫১ সালে জন ফোর্বস ন্যাশ তার ‘নন-কোঅপারেটিভ গেমস’ গবেষণাপত্রের মাধ্যমে। এ সাম্যাবস্থায় দুই বা ততোধিক পক্ষকে তাদের পছন্দনীয় বিষয় সম্পর্কে জানানো হয় এবং একইসাথে দেখানো হয় এর ব্যতিক্রম হলে কারোরই কোনো লাভ হবে না। এতে কেউই আর বিকল্প কিছু বাছাই করতে যায় না। এটা শুধুই তাত্ত্বিক ধারণা।

বহুপাক্ষিক জিরো সাম গেম

জিরো সাম গেমের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ উদাহরণই দেখা যায় দ্বিপাক্ষিক। বহুপাক্ষিক খুব বেশি দেখা যায় না। কারণ যত পক্ষ যোগ হতে থাকে গাণিতিকভাবে জিরো সাম গেমের সমাধান বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রায় ক্ষেত্রে গাণিতিকভাবে এটা দেখানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।

জিরো সাম গেমের ক্ষেত্রে যেকোনো সংখ্যক পক্ষ থাকতে পারে, যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের নিট লাভ ও ক্ষতির পরিমাণ শূন্য হবে। ধরা যাক, কোনো কোম্পানির ম্যানেজার ঠিক করলেন তার পাঁচ কর্মীকে পাঁচ হাজার টাকা বোনাস দেবেন। এক্ষেত্রে তিনি পাঁচ কর্মীর প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করে দিতে পারেন। কিন্তু সব কর্মী তো আর একরকম পারফরম্যান্স দেখাতে পারে না। তাই যে ভালো পারফর্ম করেছে, সে বেশি বোনাস পাবে এবং যার পারফরম্যান্স খারাপ, সে কম বোনাস পাবে বা পাবে না।

ধরা যাক, আরেক ম্যানেজার সাহেব তার তিন কর্মীর এক জনকে বোনাস দিলেন দুই হাজার টাকা এবং বাকি দুই কর্মীকে দিলেন ৫০০ টাকা করে। তাহলে এতে নিট পরিবর্তন হবে +১০০০, -৫০০, -৫০০; যা পরিণত হবে ০/০ তে। তিন জনের নিট লাভ এবং ক্ষতিও হবে শূন্য।

রাজনীতি ও অর্থনীতিতে জিরো সাম গেম

রাজনীতিবিদদের মধ্যে জিরো সাম চিন্তাধারা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এক্ষেত্রে নির্বাচন একটি জিরো সাম গেম। কারণ এক জন ভোটার এক দলকে ভোট দিলে অন্য দল সেই ভোটটি হারায়। এক দল নির্বাচনে জয়ী হলে অন্য দল পরাজিত হয়। ফলে নিট লাভ ও ক্ষতি হয় শূন্য।

অনেক সময় একইসাথে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে জিরো সাম গেম দেখা যায়। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করতেন চীনের সাথে বাণিজ্য চুক্তি আমেরিকার জন্য জিরো সাম গেম। কারণ এতে শুধু চীনেরই একতরফা উপকার হচ্ছে। ট্রাম্প কিংবা রক্ষণশীল রিপাবলিকানরা মনে করেন অভিবাসীদের আমেরিকায় আগমনও এক প্রকার জিরো সাম গেম। কারণ এতে আমেরিকানরা চাকরি হারাচ্ছে।

আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসন ব্যবস্থাকে জিরো সাম গেম মনে করতেন; Image Source: Alex Brandon / AP

বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এক পক্ষের কাছ থেকে কোনো পণ্য কিনলে তার অর্থ চলে যায় অন্য পক্ষের দেশে। এতে যারা পণ্য কেনে তাদের জন্য জিরো সাম গেম মনে হতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাণিজ্যগুলো জিরো সাম গেম নাও হতে পারে। ধরা যাক, কোনো দেশে প্রচুর কয়লা উৎপাদন হয়, তাই সে দেশে কয়লার দাম সস্তা। কিন্তু পাশের দেশে কয়লার খনি নেই। তাই কয়লার দামও বেশি। সেই দেশটি তখন পাশের দেশ থেকে সস্তায় কয়লা কিনে নিতে পারে। এতে এক পক্ষ কয়লা রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে, অন্য পক্ষ সস্তায় কয়লা পেতে পারে। এটা দুজনের জন্য উইন-উইন হয়ে ওঠে।

একইভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের কথা। এখানে শ্রমের বাজার সস্তা। কিন্তু আমেরিকায় শ্রমের বাজার ও উৎপাদন খরচ অনেক ব্যয়বহুল। তাই তারা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক কম দামে কিনে নিজেদের দেশে বেশি দামে বিক্রি করতে পারে। এখানে দুই পক্ষই উপকৃত হয়।

ডেমোক্রেটরা আমেরিকার বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ বৃদ্ধিকে জিরো সাম গেম মনে করেন; Image Source: financesonline.com

আবার আমেরিকায় উদারমনা ডেমোক্রেটরা বিলিয়নিয়ারদের লাগামহীন সম্পদ বৃদ্ধিকে জিরো সাম গেম মনে করেন। ধনীদের করের পরিমাণ বেশি না থাকায় আয়ের বৈষম্য বাড়ছে। এতে ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে, গরিবরা গরিব হচ্ছে। কিন্তু রিপাবলিকানরা মনে করেন, করের পরিমাণ কম থাকলে তাদের ব্যবসার আরো বিস্তৃতি ঘটবে, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। তাই এটা জিরো সাম গেম হিসাবে দেখেন না তারা।

শেয়ার বাজারকেও জিরো সাম গেমের উদাহরণ হিসেবে দেখেন কেউ কেউ। কারণ এখানে একজন বিনিয়োগকারী যে পরিমাণ লাভ করেন, অন্য আরেকজন বিনিয়োগকারীর একই পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে। যদিও এটা এত সরল নয়। বাস্তব জীবনে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাত্ত্বিকভাবে হুবুহু জিরো সাম গেমের উদাহরণ খুব কমই পাওয়া যায়।

Related Articles