Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

এই সহস্রাব্দের তরুণরা কীভাবে স্টার্টআপেই তৈরি করছে কোটি কর্মসংস্থান?

ব্যবসায়ী শুনলেই একটা সময় চোখে ভেসে উঠতো মধ্যবয়স পেরুনো প্রৌড়তার দিকে এগুনো কোনো লোকের কথা; বয়সের বিচার তো বাদই, এমনকি লিঙ্গের বিচারেও যেন পুরুষেরাই ব্যবসায়ীর দৌড়ে থাকতেন এগিয়ে, হোক বাস্তবে, হোক কল্পনার মানসপটে। কিন্তু এই একবিংশ শতকে এসে টেবিল যেন একদম উল্টে গিয়েছে, বিলিয়নিয়ার হবার দৌড়ে এগিয়ে এখন তরুণ উদ্যোক্তারাই! তারুণ্য আর প্রযুক্তির মিশেলে বদলে যাওয়া একবিংশ শতাব্দীর আধুনিকতম ব্যবসা পদ্ধতি ‘স্টার্টআপ’ আর সহস্রাব্দের তরুণতম প্রজন্ম ‘মিলেনিয়াল’ তরুণদের চিন্তাভাবনা নিয়েই নিয়েই আলাপ থাকছে এবারের মে দিবসে।

‘মিলেনিয়াল’ বলে ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে, বাংলায় একে বলা চলে ‘সহস্রাব্দ’। গত শতাব্দী শেষ হয়ে একুশ শতক শুরু হবার সাথে সাথে গণনা হচ্ছে একটি নতুন সহস্রাব্দ। তাহলে ‘মিলেনিয়াল তরুণ’ কারা? আভিধানিকভাবে বললে, আশি আর নব্বই এর দশকের মাঝে, বিশেষ করে ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে যাদের জন্ম, তারাই মিলেনিয়াল তরুণ, যারা নিজেদের প্রাপ্তবয়স্ক হবার দৌড়ে দেখেছে এক মিলেনিয়াম থেকে আরেক মিলেনিয়ামে প্রবেশের মুহূর্তটি। কেউ কেউ অবশ্য ২০০০ এর প্রথম দশকের গোড়ার দিকে জন্ম নেয়াদেরকেও মিলেনিয়াল তরুণ বলে থাকেন। এই মিলেনিয়াল তরুণদের একটি বিশেষ ঝোঁক নিয়েই আমাদের আলোচনা, সেটি হলো ‘উদ্যোক্তা’ হবার ঝোঁক। এই তরুণদের অনেকেই আজকের সময়ে প্রথাগত চাকরির বাইরে এসে করছেন দুর্দান্ত সব কাজ, যা বদলে দিচ্ছে পৃথিবীকে, সহজ ভাষায় যেগুলো পরিচিত হয়ে উঠেছে ‘স্টার্টআপ’ নামে।

এই তরুণদের অনেকেই আজকের সময়ে প্রথাগত চাকরির বাইরে এসে করছেন দুর্দান্ত সব কাজ; Image Source: thepitcher.org

স্টার্টআপ কোম্পানি আসলে কী? ফোর্বস এর মতে, একটি স্টার্টআপ কোম্পানি একজন প্রতিষ্ঠাতা বা উদ্যোক্তার হাত ধরে গড়ে ওঠে, আর ব্যবসাটি হতে হবে ‘স্কেলেবল’ (scalable) অর্থাৎ সময় ও প্রয়োজনমাফিক আরও বড় করে তোলার যোগ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ৯০ শতাংশ স্টার্টআপই সাফল্যের মুখ দেখে না, দেখে বাকি ১০ শতাংশ, আর এগুলোর নামই জানতে পারি আমরা।

আপনি কি অনুমান করতে পারেন, পৃথিবীতে এ মুহূর্তে কতগুলো স্টার্টআপ আছে? অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, সংখ্যাটা প্রতি বছরে প্রায় ৩০৫ মিলিয়ন! এ মুহূর্তে কয়টি আছে সেটা বলতে পারা সম্ভব নয়, কারণ স্টার্টআপ যেমন খুব নিয়মিতই খোলা হয়, তেমন অনেক স্টার্টআপই বন্ধ হয়ে যায়। চলতি শতাব্দীর এই সময়টাতে এসে গড়ে প্রায় ৪৭২ মিলিয়ন উদ্যোক্তা প্রতি বছর স্টার্টআপগুলোর সাথে জড়িত থাকেন। আর এতগুলো স্টার্টআপের মাঝে প্রযুক্তিগত স্টার্টআপের পরিমণা হলো মাত্র ১.৩৫ মিলিয়ন।

প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের তুলনায় যে স্টার্টআপ দেওয়ার হার প্রতি বছর বেড়েই চলেছে সেটা বলাই বাহুল্য! আন্তর্জাতিক কনসালটেন্সি নেটওয়ার্ক ইউএইচআই (UHI) এর মতে, ব্রিক (BRIC) দেশগুলোতে (অর্থাৎ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন) স্টার্টআপ বৃদ্ধির হার অন্যান্য স্থানের তুলনায় প্রায় ৪০ গুণ বেশি! বাংলাদেশেও এ সংখ্যাটা কাছাকাছিই হবে ধারণা করা যায়, যেহেতু ভারত প্রতিবেশী দেশ এবং প্রায় একই সংস্কৃতির অধিকারী। ব্যাপারটা খুলে বললে দাঁড়ায়, ব্রিক দেশগুলোতে ইতোমধ্যে যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, বছরে তার তুলনায় প্রায় ১৮% বেশি স্টার্টআপ বা ব্যবসা খোলা হয়, কিন্তু ব্রিক এর বাইরের দেশে এই বৃদ্ধির হার মাত্র ০.৪%। সবচেয়ে বেশি দ্রুত স্টার্টআপ বাড়ছে রাশিয়াতে, প্রায় ২৫.৬% হারে!

চলতি শতাব্দীর এই সময়টাতে এসে গড়ে প্রায় ৪৭২ মিলিয়ন উদ্যোক্তা প্রতি বছর স্টার্টআপগুলোর সাথে জড়িত থাকেন; Image Source: Pinterest

এ মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে দামি স্টার্টআপ কোনটি? রাইডশেয়ারিং অ্যাপ উবার! সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী, আইপিও চালুর পর উবারের বাজারমূল্য হতে যাচ্ছে ৮,৪০০ কোটি মার্কিন ডলার!

এ তো গেল পরিসংখ্যানের ব্যাপার। প্রশ্ন হলো, মিলেনিয়াল তরুণদের কাছে স্টার্টআপ কেন এত জনপ্রিয়? কেন এত আকর্ষণীয়? সব স্টার্টআপগুলোই কিন্তু প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলোর মতো এত বেতন বা সুযোগ সুবিধা দিতে পারে না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, তারপরও কেন তরুণেরা ছুটে যাচ্ছেন উদ্যোক্তা হবার পথেই? এর প্রধানতম কারণ হলো, স্টার্টআপগুলোতে আছে শেখার সুযোগ, আছে তাড়াতাড়ি গড়ে ওঠার সুযোগ। বয়স ৩২ বছরের হতে হতেই দেখা যায়, গ্রাজুয়েটরা গড়ে চারটি চাকরি করে ফেলেছেন, এভাবে দ্রুত চাকরি বদলের কারণ আসলে পদোন্নতির আশা। যেকোনো চাকরিতে দু’বছর ধরে থাকা কেউ চাকরি বদলকারীর চেয়েও কম বেতনই পেয়ে থাকেন বলে দেখা যায় জরিপে। কিন্তু এ ঝামেলা পোহাতে হয় না স্টার্টআপে, কারণ এখানে পদোন্নতি আর ‘গ্রোথ’ বা ‘বিস্তৃতি’ বেশ দ্রুতই হয়।

একটি নতুন কোম্পানিতে শুরুর দিকে করে যাওয়া কাজগুলো অনেক প্রভাব ফেলে এর ভবিষ্যতের ওপর, আর সেই প্রভাব ফেলার অংশীদার হতে পারাটাও একটা মনঃতুষ্টির ব্যাপার, যেটা টানে তরুণদের। এখানে আছে, নতুন নতুন আইডিয়া দেবার সুযোগ, আছে ‘আউট অফ দ্য বক্স’ বা প্রথার বাইরে কিছু করার হাতছানি। অন্যান্য কর্পোরেট কালচারের তুলনায় স্টার্টআপের কালচার সাধারণত অনেক শিথিল আর বন্ধুত্বভাবাপন্ন হয়ে থাকে। জরিপে দেখা যায়, ৪৫% মিলেনিয়াল তরুণ কম বেতন হলেও শিথিল কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে আগ্রহী। আর নয়টা-পাঁচটা বা দশটা-ছয়টা অফিসের কাঠিন্য এখানে পোহাতে হয় কম। অফিসের কঠিন নিয়মকানুন বড্ড ক্লান্তিকর, কাজ আর কাজ ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে এসে সুন্দর একটি অফিস সংস্কৃতি উপহার দেয়াটা স্টার্টআপেই সম্ভব।

অন্যান্য কর্পোরেট কালচারের তুলনায় স্টার্টআপের কালচার সাধারণত অনেক শিথিল আর বন্ধুত্বভাবাপন্ন হয়ে থাকে; Image Source: mandegar.info

এই সহজে কাজ করার সুযোগটাই বেশি হাতছানি দেয় মিলেনিয়ালদের। আর ওয়ার্ক/লাইফ ব্যালেন্স বলে যে কথাটা আছে, অর্থাৎ অফিসের কাজ শেষে নিজের ব্যক্তিগত জীবনে যে সময়টা দিতে পারা- সেটাও তুলনামূলক সহজেই পাওয়া যায় স্টার্টআপে! কর্পোরেট অফিসগুলোতে যেখানে ঢুকলেই কিছু কিউবিকল বা খুপড়িতে কাজ করতে দেখা যায় সবাইকে, তেমনটি খুঁজে পাওয়া যায় না স্টার্টআপগুলোতে। এখানে যে যার মতো কাজ করতে থাকেন ওপেন ফ্লোর নীতি মেনে চলে।

মিলেনিয়াল তরুণদের স্টার্টআপের কথা আসলে মার্ক জাকারবার্গের কথা আসবেই। যে বয়সে আর দশটা ছেলে কম্পিউটারে গেম খেলত সে বয়সে গেম খেলার থেকে গেম বানানোতেই যেন বেশি আগ্রহ ছিল মার্কের। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কের তৈরি নতুন সামাজিক যোগাযোগের সাইট ‘দ্য ফেসবুক’ ব্যবহারের সুযোগ ছিল কেবলই হার্ভার্ডের ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যাত্রা শুরুর এক মাসের মধ্যেই ফেসবুকে হার্ভার্ডের অর্ধেকে বেশী শিক্ষার্থী যোগ দেয়। মার্চের মধ্যেই দ্যা ফেসবুক হার্ভার্ডের গন্ডি পেরিয়ে যাত্রা করে স্ট্যানফোর্ড, কলাম্বিয়া এবং ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে। আস্তে আস্তে আমেরিকা ও কানাডার সব বিশ্ববিদ্যালয়েই ছড়িয়ে যায় সেটি। সেবছরের জুন মাসে ব্যবসায় মনোযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে হার্ভার্ড থেকে ড্রপআউট করার পর থেকে এখন পর্যন্ত ফেসবুকের গ্রাহক সংখ্যা ২৩০ কোটিরও বেশি!

ওয়ার্ক/লাইফ ব্যালেন্স বলে যে কথাটা আছে, অর্থাৎ অফিসের কাজ শেষে নিজের ব্যক্তিগত জীবনে যে সময়টা দিতে পারা- সেটাও তুলনামূলক সহজেই পাওয়া যায় স্টার্টআপে; Image Source: topsimages.com

মাত্র ২০ বছর বয়সে নতুন এক কোম্পানি শুরুর মাধ্যমে পথচলা মার্ক জাকারবার্গের। ২৩ বছর বয়সে তিনি বিলিয়নিয়ার। পথিমধ্যে অনেক বাধা এসেছে, মুখোমুখি হতে হয়েছে এমন সব সমস্যার যা আগে চিন্তাও করেনি কেউ কোনোদিন। এত বাধার মুখেও মার্কের সাফল্য কেউ আটকে রাখতে পারেনি। পারেনি রুখতে তার প্রত্যয়। তারুণ্য তাকে এগিয়ে রেখেছে। মিলেনিয়াল তারুণ্য। ফেসবুক যেন মিলেনিয়াল তরুণদের স্টার্টআপদের সবচেয়ে বড় প্রতিচ্ছবি।

নয়টা পাঁচটা কিংবা দশটা ছ’টার চাকুরি যে তরুণ সমাজ করে না, তা নয়। অনেকেই, বলতে গেলে বেশিরভাগই তা করে। কিন্তু নতুন সহস্রাব্দের গোড়াতে দেখা মেলে নতুন সব যুগান্তকারী কর্মচিন্তার। কে কল্পনা করতে পারত যে, কেবল অসাধারণ কোনো আইডিয়া দিয়েই ঘরে বসে কীবোর্ডের কয়েকটি বাটনের আলতো পরশেই টাকা উপার্জন করা সম্ভব হবে? ফেসবুক-গুগল-উবার কিংবা আমাদের পাঠাও-চালডাল-হ্যান্ডিমামা’র মতো স্টার্টআপ প্রতিদিন জন্মায় না, কিন্তু যখন জন্মায় তখন তারুণ্যের দারুণ আইডিয়ার ফসল হিসেবেই জন্মায়! এরকম একটি চিন্তা কি আদৌ একশ বছর আগে সম্ভব হতো? একদমই না, প্রযুক্তিই তো ছিল না! যত রকমের সফটওয়্যার কোম্পানি গড়ে উঠছে এখন স্টার্টআপ হিসেবে, সবই তো কোনও না কোনও তরুণেরই দাঁড়া করানো।

ফেসবুক-গুগল-উবার কিংবা আমাদের পাঠাও-চালডাল-হ্যান্ডিমামা’র মতো স্টার্টআপ প্রতিদিন জন্মায় না; Image Source: Medium

বর্তমানে দুনিয়াজুড়ে অগণিত মানুষ কাজ করছে স্টার্টআপগুলোতে। আনুমানিক ৩০০ মিলিয়ন স্টার্টআপের ৯০% যদি ঝরে যায়, তবুও রয়ে যায় ৩০ মিলিয়ন, আর প্রতিটিতে গড়ে অন্তত ১০০ জন করেও কাজ করলে এসবের কর্মী সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ বিলিয়নে। আনুমানিক হিসেবে ভুল থাকবে স্বাভাবিক, তবে এর অর্ধেকও যদি আসলেই স্টার্টআপে কাজ করে থাকেন, তাহলে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশের কাজ জুড়িয়ে চলেছে এ তরুণদের স্টার্টআপগুলোই! কর্মসংস্থান সৃষ্টির এক অনন্য নজিরই তো বলা চলে একে। একটা সময় ছিল যখন মানুষ সন্দেহের চোখে দেখত যেকোনো নতুন সৃষ্ট চাকরিকেই। এমনকি যখন নতুন করে কম্পিউটারের যুগ এলো, অনেকেই মেনে নিতে পারেননি, বিশ্বাসও করতে পারেননি যে একটা সময় আসবে যখন প্রতিটি চাকরিতেই অবিচ্ছেদ্য থাকবে কম্পিউটার। তেমনই, স্টার্টআপও যে একটা সময় বিলিয়নের বেশি চাকরি দিয়ে বেড়াবে, এটাও ভাবতে পারেনি অনেকেই। কিন্তু যে বিশাল মেধাশ্রমিকদের কাজ দিয়েছে, কোটি কোটি মিলেনিয়াল তরুণদের অনুকূল কাজের সন্ধান দিয়েছে- এর জন্য স্টার্টআপগুলো অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।

প্রতি বছর পহেলা মে-তে পালিত হয় মে দিবস, যা মূলত পালন করা শুরু হয়েছিল কায়িক শ্রম দিয়ে কাজ করা শ্রমিকদের কথা মাথায় রেখেই। সারা পৃথিবীর শ্রমিকদের অবদানের প্রতি সম্মান জানানোর পাশাপাশি আজ আমরা বলছি মিলিয়ন মিলিয়ন কর্মসংস্থান করা স্টার্টআপগুলোর কথাও, যেগুলোর মূল কারিগর হিসেবে কাজ করছেন অসাধারণ সব মিলেনিয়াল তরুণ!

Related Articles