Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কল্কি সুব্রমানিয়াম: এক সফল রূপান্তরকামী মানুষের কাহিনী

আমাদের দেশে ইদানিংকালে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুদের নিয়ে প্রায়ই নানা তর্ক-বিতর্ক শোনা যায়। সংবাদমাধ্যমে, জনপরিসরে হিন্দু-মুসলমান বা উচ্চবর্ণ দলিত ইত্যাদির সংঘাত নিয়ে কচকচানি চলছে নিরন্তর। কিন্তু ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘু ছাড়াও এদেশে আরও এক শ্রেণীর সংখ্যালঘু রয়েছে, যাদের নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা বিশেষ শোনা যায় না। অথচ এই সংখ্যালঘুদের গুরুত্ব আমাদের সমাজে আর পাঁচজন মানুষের মতোই। কিন্তু তাদের নিয়ে আমরা- রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক- কেউই বেশি মাথা ঘামাতে রাজি নই, দুর্ভাগ্যজনকভাবে।

এই সংখ্যালঘুরা হচ্ছেন লিঙ্গবিশেষে এবং আমরা তাদের অমার্জিত ভাষায় ‘হিজড়ে’ বা পরিমার্জিত ভাষায় ‘রূপান্তরকামী’ বলে বর্ণিত করি।

বছর খানেক আগে এই রূপান্তরকামী মানুষ বা তৃতীয় লিঙ্গের গণনা (স্বাধীনতার পরে এই প্রথম) হলে বলা হয়, সারা দেশে তাদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লক্ষ। যদিও এই শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে কাজ করা কর্মীদের মতে সংখ্যাটি অন্তত আরও কয়েকগুণ বেশি। তবে তারা খুব অখুশি হননি এই ভেবে যে, অন্তত পাঁচ লক্ষ মানুষ নিজেদের এই তৃতীয় লিঙ্গের বলে চিহ্নিত করতে সাহস দেখিয়েছেন।

অবস্থা তাহলে কি কিছুটা হলেও বদলাচ্ছে?

হয়তো বদলাচ্ছে। কিন্তু সেই বদলের গতি ধীর। আজকে, এই একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক শেষ হওয়ার মুখেও এদেশে রূপান্তরকামী মানুষের জীবনে সুখের থেকে অসুখের কারণই বেশি। সামাজিক, অর্থনৈতিক, শারীরিক কিংবা অর্থনৈতিকভাবে এই মানুষগুলির দৈন্য আজও প্রকট। রূপান্তরকামী মানুষদের আজও আমরা ‘হিজড়ে’ বলে তাচ্ছিল্য করি; জনসমক্ষে তাদের নিয়ে মস্করা করি; আজকের দিনে লিঙ্গের সময় নিয়ে যখন দুনিয়া উত্তাল, এই মানুষগুলি রয়ে যায় উপেক্ষার অন্ধকারেই। ট্র্যাফিক সিগন্যালে ভিক্ষা করা আজও রূপান্তরকামীদের এক অন্যতম বড় রুজি-রোজগারের উপায়। আইনের ঘরেও তারা ব্রাত্য। তাদের সঙ্গে অন্যায় ঘটলে আইনরক্ষকরা প্রথমে তাদের চরিত্র নিয়েই প্রশ্ন তোলে। ঘরে পরিবারের কাছে পরিত্যক্ত; বাইরে সমাজের কাছে অবহেলিত এই শ্রেণীর মানুষদের কাছে তাহলে বেঁচে থাকার পাথেয় কী? লিঙ্গ পরিবর্তন করে সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর চিন্তা করাও সবার পক্ষে সম্ভব নয়; কারণ, ব্যয়বহুল অস্ত্রোপচার।

রূপান্তরকামী মানুষের কাছে তাই ভরসা সামাজিক আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ পথিকৃৎ তারাই যারা তাদের মতো যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে। অর্থাৎ, সেই রূপান্তরকামীরাই।

এম জি মোটর ইন্ডিয়া এবং দ্য বেটার ইন্ডিয়া-র যৌথ প্রয়াস চেঞ্জমেকার্স আপনাদের সামনে তুলে ধরেছে সেই সমস্ত কৃতী নারীদের কাহিনী, যারা তাদের অদম্য মনের জোরে ও ইচ্ছায় নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজেদের তো বটেই, পাশাপাশি আরও অসংখ্য মানুষের জীবনেও এনেছেন এক ইতিবাচক পরিবর্তন। আজ আমরা বলব এমন একজনের কথা যিনি নিজে একজন সফল রূপান্তরিত নারী হয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তার মতো অসংখ্য মানুষের দিকে, যাদের প্রতিনিয়ত নানা অবমাননার শিকার হতে হচ্ছে। 

অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েও তিনি হাল ছাড়েননি একটি দিনের জন্যও

আজ আমরা এই সংখ্যালঘু রূপান্তরকামী মানুষদের একজন প্রতিনিধির কথাই বলব। তিনি তার চারপাশে তার মতো মানুষদের সঙ্গে অন্তহীন অন্যায়-অবিচার হতে দেখেছেন অজস্রবার; নিজের সঙ্গেও হতে দেখেছেন সামাজিক ব্যাভিচার।

কল্কি সুব্রমানিয়াম। রূপান্তরকামী মানুষদের একজন সফল প্রতিনিধি হিসেবে আজ যার নাম দেশ, বিদেশে সমানভাবে আদৃত। শিল্পী, লেখক, রূপান্তরকামী মানবাধিকার কর্মী, অভিনেত্রী, অন্ত্রেপ্রেনর- কল্কির বহুমুখী প্রতিভা আজ চর্চিত সমাজের নানা মহলে। কিন্তু আজকের নামযশ পেতে তাকে কম লড়াই করতে হয়নি। বা বলা চলে, আজকে তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, সেখানে পৌঁছতে তাকে যে সিংহহৃদয়ের পরিচয় দিতে হয়েছে, তা সমাজের তথাকথিত ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ মানুষের মধ্যেও ক’জনের আছে তা বলা মুশকিল। কিন্তু শত সামাজিক ব্যাভিচারের শিকার হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে কোনওদিন লুকিয়ে রাখেননি; নিজের মধ্যে অন্তর্নিহিত প্রতিভাকে বিফলে যেতে দেননি। মনুষ্য আরোপিত অন্যায় সংখ্যালঘু তকমা ঝেড়ে ফেলতে নিজেই উদ্যোগ নিয়েছেন; নিজের পাশাপাশি লড়েছেন নিজের মতো মানুষদের জন্যেও।

সামাজিক, অর্থনৈতিক, শারীরিক কিংবা অর্থনৈতিকভাবে এই মানুষগুলির দৈন্য আজও প্রকট (প্রতীকী ছবি); Image Source: Pinterest

কল্কি যখন জন্মান, পরিবারে খুশির ঢেউ ওঠে দুই মেয়ের পর ‘ছেলে’ এসেছে বলে

কল্কির জন্ম দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। এবং জন্মের পর তার প্রাথমিক পরিচয় ছিল একজন পুরুষ হিসেবে, নারী হিসেবে নয়।

তার জন্মের পর তার পরিবারে বিরাট উৎসব যাপন করা হয়, কারণ দু’টি মেয়ের পর প্রথম একজন ‘ছেলে’ আসে। তার উপরে আরোপিত ছেলেত্ব নিয়ে পরিবার-পরিজনের মধ্যে সীমাহীন আনন্দের রেশ চলতেই থাকে, কিন্তু কল্কির জীবন হয়ে ওঠে যন্ত্রনাময়। আধুনিক দিনের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘জেন্ডার ডিসফোরিয়া’ (নিজের প্রকৃত লিঙ্গের সঙ্গে নিজের মানসিক এবং আবেগজনিত যে সংঘাত), তাতে কল্কিকে ভুগে হয় দীর্ঘ ১৩ বছর। সে শারীরিকভাবে পুরুষ হলেও তার মনটা যে একজন মেয়ের, তা বোঝেনি বা বুঝতে চায়নি কল্কির নিজের পরিবার-স্বজনেরা। দীর্ঘায়িত হয়েছে তার অন্তরের রক্তক্ষরণ।

মা কষ্টের কথা শুনে বলেছিলেন: “ভুলে যাও”

সবচেয়ে দুঃখের কথা, কল্কির নিজের মাও বুঝতে চাননি তার এই যন্ত্রনা। কৈশোরে সে যতবার মাকে বোঝাতে চেয়েছে যে সে তার পৌরুষের সঙ্গে আপোস করতে অক্ষম; মনে প্রাণে সে একজন নারী, তার জননী তাকে বলেছেন “ভুলে যাও ওকথা”। কল্কি বুঝে পেত না একথার মর্ম; এ তো তার হাতে নয়, তবে সে কেন কষ্ট পাচ্ছে এমনভাবে? আর কেনই বা লোকে তার এই আকুতি বুঝতে চাইছে না? কী দোষ করেছে সে?

কল্কি বুঝে পেত না মায়ের কথার মর্ম; Image Source: galaxymag

পরিবারের বাইরেও জীবন ছিল দুঃসহ। না পুরুষ, না মহিলা- সমাজের এই দু’টি স্বীকৃত লিঙ্গের কোনওটিতেই সে নিজেকে মিশিয়ে ফেলত পারত না; বন্ধুমহলে সে ছিল একা; শুনতে হত কটূক্তি; সহ্য করতে হতো অসভ্য ব্যবহার।

কেন ভগবান তাকে এমন বানালেন?

কিন্তু কল্কি নিয়তির হাতে নিজেকে সপেঁ দেওয়ার মতো দুর্বল ব্যক্তিত্ব ছিল না কোনওকালেই। পরিবার-পরিজন-সমাজের কাছে নিজের প্রকৃত মানবসত্ত্বার গ্রহণযোগ্যতা নেই দেখেও কল্কি মানসিক পরাজয়স্বীকার করেনি কোনওদিন। বরং, যত অন্যায় সে প্রত্যক্ষ করেছে প্রতিনিয়ত, ততসে নিজেকে আরও মানসিকভাবে শক্ত করেছে, অঙ্গীকার করেছে চোয়াল চেপে লড়াই করার। উপেক্ষা আর অপমানের আগুনে পুড়ে সে হয়ে উঠেছে আরও কঠিন লোহা।

যত একা, তত জেদ

বড় হয়ে কল্কি পরে বলেছেন যে তার একাকীত্বই তাকে একপ্রকার সাহায্য করেছিল সফল হতে। যত তিনি একা হয়ে পড়তেন, তত মন বসাতেন নিজের পড়াশোনায় আর যেহেতু তার পরিবারেই পড়াশোনার ভালো ছিল ছিল, সুযোগ ছিল; মেধাবী ছাত্রী হিসেবে তার নামও ছিল, কল্কিসেসবের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন পরবর্তীকালে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্যে।

সাংবাদিকতা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কে স্নাতকোত্তর কল্কি পরবর্তীকালে একটি বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি নেন এবং অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করে সেক্স রে-এসাইনমেন্ট সার্জারি করান এবং নিজের আকাঙ্খিত লিঙ্গে রূপান্তরিত হন; পরিপূর্ণতা দেন নিজেকে।

নিজের জীবন পরিপূর্ণতা পেলেও কল্কি ভোলেননি অন্যদের কথা

কিন্তু নিজে পূর্ণতা পেলেও কল্কি ভোলেননি তার মতো অসংখ্য মানুষের কষ্টের, গ্লানিময় জীবনের কথা। আজকে দেশের অন্যতম বিখ্যাত রূপান্তরকামী মানবাধিকার কর্মী হয়ে কল্কি ব্রত নিয়েছেন সেই সমস্ত সংগ্রামী মানুষকে, যারা প্রতি মুহূর্তে পরিবার-সমাজের বিরুদ্ধে লড়ে চলেছেন একঅসম লড়াই, তাদেরকে সাহায্য করতে, তাদের মনোবল বাড়াতে তাদের পাশে দাঁড়াতে।

তৈরী করেন সহোদরী ফাউন্ডেশন

এই মহৎ লক্ষ্যে কল্কি প্রতিষ্ঠা করেন তার নিজের সংস্থা সহোদরী ফাউন্ডেশন। গত এক দশক ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের রূপান্তরকামী মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের উপরে নিরন্তর কাজ করে চলেছে কল্কির এই প্রতিষ্ঠান।

রূপান্তরকামী মানুষের জন্য কল্কি গড়ে তোলেন সহোদরী ফাউন্ডেশন; Image Source: sahodari

রূপান্তরকামী মানুষদের নানা কর্মে প্রশিক্ষিত করা, তাদের শিল্পকলার প্রতিভাকে প্রস্ফুটিত করতে সাহায্য করে তার মাধ্যমে তারা যাতে নিজেদের জীবনধারণ করতে পারে তা সুনিশ্চিত করা ছাড়াও কল্কির সহোদরী ফাউন্ডেশন শুধুমাত্র রূপান্তরকামী মানুষদের জন্যে একটি বৈবাহিকওয়েবসাইটও চালায়। লক্ষ্য, এই সমস্ত সামাজিক একাকীত্বে ভোগা মানুষগুলিকে তাদের মনের মতো সঙ্গী নির্বাচন করার ন্যূনতম স্বাধীনতাটুকু দেওয়া।

কল্কির নামযশ আজ বিদেশেও চর্চিত

কল্কির যশ আজকে দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি আজ নিমন্ত্রণ পান নিজের জীবনের অনুপ্রেরণামূলক প্রেক্ষাপট বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে। পাশাপাশি, তিনি সোশ্যাল মিডিয়ার মতো একটি শক্তিশালী মাধ্যমেরসাহায্যেও তার লক্ষ্যপূরণের কাজে ব্রতী রয়েছেন। ফেসবুকের বারোজন প্রেরণামূলক নারীদের মধ্যে কল্কিও একজন আজকে যিনি নিরলস প্রয়াস করে চলেছেন এদেশের অসংখ্য রূপান্তরকামী মানুষের জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে।

কল্কি তার কথাগুলো বলেন শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে; Image Source: thenewsminute

কাজটা সহজ নয়- অতীতেও ছিল না; আজকেও নেই। কিন্তু কঠিন কাজকে সহজ করে তোলাই তো কল্কির মতো লৌহমানবীদের জীবনের ব্রত আর সে কাজে তারা সফল হবেনই।

ইউএন উইমেন-এর পূর্ণ সহযোগিতায় এম জি মোটর ইন্ডিয়া এবং দ্য বেটার ইন্ডিয়া ভারতের সেই সমস্ত কৃতী নারীদের সম্মান জানাচ্ছে যারা প্রতিনিয়ত নিজেদেরকে বিশ্বের সামনে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে দেশকে এক সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে  এ-গিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

এম জি মোটর ইন্ডিয়া এবং দ্য বেটার ইন্ডিয়ার এই যৌথ প্রয়াসে আপনিও সামিল হতে আগ্রহী? পেটিএম বা ব্যাঙ্ক মারফত করতে চান আর্থিক অনুদান? বিশদে জানতে ক্লিক করুন এখানে

এম জি মোটর ইন্ডিয়া সম্পর্কে আরও জানতে তাদের ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম পেজগুলি দেখুন।

ফিচার ইমেজ: sahodarifoundation

Related Articles