Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

এক বিশ্বকাপে ফন্টেইনের ১৩ গোলের রেকর্ডের ইতিহাস

ব্রাজিল বিশ্বকাপে কিংবদন্তি স্ট্রাইকার রোনালদোর ১৫ গোলের রেকর্ড ভেঙ্গে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোলদাতার খেতাব অর্জন করেন জার্মান স্ট্রাইকার মিরোস্লাভ ক্লোজা। রেকর্ড ১৬ করতে ক্লোজাকে খেলতে হয়েছিলো ৪টি বিশ্বকাপে মোট ২৪টি ম্যাচ। রোনালদো ৩টি বিশ্বকাপে ১৬টি ম্যাচ খেলে করেছিলেন ১৫ গোল। রোনালদো ও ক্লোজার পরেই রেকর্ড গোলদাতা হলেন জার্ড ম্যুলার এবং জাস্ট ফন্টেইন, যাদের গোলসংখ্যা যথাক্রমে ১৪ ও ১৩।

সবাই তাদের গোলগুলি করেছিলেন দুই বা ততোধিক বিশ্বকাপ খেলে, কিন্তু এখানে সবার থেকে ভিন্ন এবং অনন্য ফরাসি কিংবদন্তি ফন্টেইন। মাত্র একটি বিশ্বকাপ খেলেই ফন্টেইন গোল করেছিলেন ১৩টি, যেখানে তিনি ম্যাচ খেলেছিলেন মাত্র ৬টি! ম্যাচ প্রতি গোল গড় ২টিরও বেশি। ১৯৫৮ সালের সুইডেন বিশ্বকাপে ফন্টেইনের এক বিশ্বকাপে ১৩ গোল করার রেকর্ড এত বছর পর আজও বিদ্যমান এবং এই রেকর্ড ভাঙ্গা বর্তমানে একরকম অসম্ভব।

দ্য ব্লু’দের জার্সি গায়ে জাস্ট ফন্টেইন; Source: fifa.com

রেকর্ডের সৃষ্টিই হয় ভাঙ্গার জন্য, কিন্তু কিছু রেকর্ডের ক্ষেত্রে হয়তো চেষ্টা করা অনেকটা অনর্থক। ফন্টেইনের এক বিশ্বকাপে ১৩ গোলের রেকর্ডও তেমনই। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো সুইডেন বিশ্বকাপ ফন্টেইনের একমাত্র ও প্রথম বিশ্বকাপ এবং টুর্নামেন্টে তিনি যে বুট জোড়া পরে গোলের ঝড় তুলেছিলেন সেগুলো তার ছিল না। ফন্টেইনের পর এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোল করে তার কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন মাত্র একজন, তিনি হলেন গার্ড ম্যুলার। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপে ম্যুলার এক ম্যাচে করেছিলেন ১০ গোল। ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জেতানোর ২০০২ আসরে সর্বোচ্চ ৮ গোল করেছিলেন রোনালদো, কিন্তু ফন্টেইনের রেকর্ড ভাঙ্গা তো দূরের কথা, তা স্পর্শও করতে পারেননি কেউই।

জাস্ট ফন্টেইন মরক্কোর মাহাকেসে ১৯৩৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন, তার মা ছিলেন একজন স্প্যানিশ। ফন্টেইনের জন্মের সময় মাহাকেস ফ্রেঞ্চ মরক্কোর অংশ ছিল। ফন্টেইন ছিলেন জাত স্ট্রাইকার, নিখুঁত ফিনিশিং। তার ছিলো স্বচ্ছন্দ গতি, বল ও সহযোগী খেলোয়াড়দের বোঝার অসাধারণ দক্ষতা এবং দুই পায়েই শক্তিশালী শট নিতে পারতেন এই কিংবদন্তি। মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কার হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন তিনি, ১৯৫০ সাল থেকে খেলেছেন ১৯৫৩ পর্যন্ত। এরপর নিস ফুটবল ক্লাবের হয়ে খেলেন তিনি। ১০ নম্বর জার্সিধারী কিংবদন্তিদের মধ্যে অন্যতম রেমন্ড কোপার শূন্যস্থান পূরণের জন্য ১৯৫৬ তাকে দলে নিয়ে আসে ফুটবল ক্লাব গা’স। ক্যারিয়ারের শেষ পর্যন্ত এই ক্লাবেই খেলেন ফন্টেইন।

১৯৫৮ বিশ্বকাপের ফ্রান্স দল; Source: ahalftimereport.com

সুইডেন বিশ্বকাপে ফ্রান্স দলে জায়গা পাওয়া নিশ্চিত ছিল না ২৪ বছর বয়সী ফন্টেইনের। ১৯৫৩ সালে প্রথম জাতীয় দলে সুযোগ পেলেও এই কয়েক বছরে মাত্র ৫টি ম্যাচ খেলতে পেরেছিলেন তিনি। ১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপ বাছাইতে লুক্সেমবার্গের সাথে হ্যাটট্রিক করার পরও টানা তিন বছর দলে ডাক পাননি তিনি। যদিও দল হিসেবে লুক্সেমবার্গ আহামরি কিছু ছিল না, তাই তেমন একটা চোখে পড়েননি হয়তো। বিশ্বকাপের পূর্বে গা’সের হয়ে দুর্দান্ত খেলে যাচ্ছিলেন ফন্টেইন, লিগে ২৬ ম্যাচে ৩৪ গোল করেছিলেন তিনি এবং ক্লাবের এক মৌসুমে দুটি শিরোপা জয়ে অসাধারণ ভূমিকা রাখেন। ফ্রান্স দলের নির্বাচক পল নিকোলাস ফন্টেইন ও ব্লিয়ার্ডকে একান্তে ডেকে বলেছিলেন তাদের একজন কোপা ও পিয়ান্তোনির সামনে খেলবে। বিশ্বকাপের মাত্র কিছুকাল পূর্বে হাঁটুর ইনজুরির কারণে বিশ্রামে ছিলেন ফন্টেইন, ফন্টেইনের মতে যা তাকে আলাদা সুবিধা দিয়েছিল।

ডিসেম্বরে হাঁটুর অপারেশনের জন্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একটি দারুণ শীতকালীন বিরতি পেয়েছিলেন তিনি। ফলে জুনে আয়োজিত বিশ্বকাপে পাওয়া যায় সতেজ ও প্রাণবন্ত ফন্টেইনকে। প্রস্তুতি ম্যাচে ব্লিয়ার্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে দেশে ফিরে আসলে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়ে দেখা দেয় ফন্টেইনের জন্য। ফ্রান্স দল যখন সুইডেনে পা রাখে, তখন তাদের সাথে থাকা স্ট্রাইকার ফন্টেইনের বিগত ৫৩ মাসে আন্তর্জাতিক গোল ছিলো মাত্র ১টি!

কিংবদন্তি কোপা, সুইডেন বিশ্বকাপে ফন্টেইনের সাথে অসাধারণ জুটি গড়ে তুলেছিলেন; Source: thetimes.co.uk

রেমন্ড কোপার সাথে ফন্টেইনের দারুণ একটা জুটি গড়ে উঠেছিল বিশ্বকাপে, যদিও এই জুটি একসাথে বেশিদিন খেলতে পারেনি। নিজের বিশ্বকাপের শুরুটা ফন্টেইন স্মরণীয় করে রেখেছিলেন দুর্দান্ত এক হ্যাটট্রিকের মাধ্যমে। তার হ্যাটট্রিকেই বেশ শক্তিশালী প্যারাগুয়েকে গ্রুপ পর্বে ৭ – ৩ গোলে উড়িয়ে দেয় ফ্রান্স, যেখানে ম্যাচের একটা সময়ে ২ – ৩ গোলে এগিয়ে ছিল প্যারাগুয়ে।

ফন্টেইনের যাত্রা অব্যাহত ছিল পুরো আসর জুড়েই, সেখানে তিনি করে গেছেন গোলের পর গোল। তার দুর্দান্ত ও নিখুঁত পার্ফরম্যান্সের উপর ভর করে ফ্রান্স পৌঁছে গিয়েছিল সেমিফাইনালে, যেখানে তারা মুখোমুখি হয়েছিল শক্তিশালী ব্রাজিলের। যা-ই হোক, যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে ৩ – ২ গোলে জয়ের দুটি গোল আসে ফন্টেইনের পা থেকে। পরবর্তী ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে একটি গোল ও অ্যাসিস্ট করেন ফন্টেইন। তার অ্যাসিস্ট থেকে কোপা গোল করেন এবং ২ – ১ গোলের জয় নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পা রাখে ফ্রান্স। কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তর আয়ারল্যান্ডকে ৪ – ০ গোলে গুড়িয়ে দিয়ে সেমিফাইনালে পা রাখে ফন্টেইনের দল এবং এই ম্যাচে ফন্টেইন দুই গোল করে দলের বিশাল জয়ে বড় ভূমিকা রাখেন।

নিজের প্রথম বিশ্বকাপে দুর্দমনীয় ফন্টেইন; Source: frenchfootballweekly.com

টুর্নামেন্ট জুড়ে ফ্রান্সের পার্ফরম্যান্স ছিল মনোমুগ্ধকর ও রাজকীয়। আত্মবিশ্বাসী ও দুর্দমনীয় ফ্রান্স সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয় তারকাসমৃদ্ধ ব্রাজিলের, যারা শিরোপার অন্যতম দাবিদার। ব্রাজিল দলে তখন খেলছেন ভাভা, পেলে, গাহিন্সা, নিলতন, সান্তোস, দিদি, মারিও জাগালোদের মতো কিংবদন্তিরা। ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিটেই ভাভার গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। কিন্তু এই গোলের ৭ মিনিটের মধ্যেই দলকে সমতায় ফিরিয়ে আনে ফন্টেইনের গোল।

তবে ফ্রান্স দলে বিপর্যয় নেমে আসে ম্যাচের ৩৬ মিনিটে, ভাভার ট্যাকেলে  ফ্রান্স অধিনায়ক রবার্ট জঙ্কের পা ভেঙ্গে যায়। তৎকালীন সময়ে বদলি খেলোয়াড় নামানোর সুযোগ না থাকায় দশজনের দলে পরিণত হয় ফ্রান্স। শেষ পর্যন্ত ৫ – ২ গোলে পরাজিত হয়ে মাঠ ছাড়তে হয় ফ্রান্সকে। সেমিফাইনাল পর্যন্ত ফন্টেইনের গোল সংখ্যা ছিল ৫ ম্যাচে ৯টি। হাঙ্গেরিয়ান কিংবদন্তি সান্দোর কচিসের ‘৫৪ বিশ্বকাপে করা ১১ গোলের রেকর্ড ভাঙ্গতে তার দরকার মাত্র ৩টি গোল। কিন্তু হাতে রয়েছে মাত্র একটি ম্যাচ। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ফ্রান্সের প্রতিপক্ষ বিগত আসরের চ্যাম্পিয়ন পশ্চিম জার্মানি।

সেমিফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে ফন্টেইন; Source: sportskeeda.com

পশ্চিম জার্মানিকে ৬ – ৩ গোলের বড় ব্যবধানে পরাজিত করে ফ্রান্স। এই ম্যাচ ফন্টেইর রেকর্ড চলে যায় অস্বাভাবিক উচ্চতায়, যা স্পর্শ করা প্রায় অসম্ভব। ফ্রান্সের ৬ গোলের মধ্যে ৪টি গোলই করেছেন ফন্টেইন এবং এক বিশ্বকাপে তখন মাত্র ৬ ম্যাচ খেলে তার গোলসংখ্যা ১৩টি। ফন্টেইনের গোল ১৩টির বেশি হতে পারতো, জার্মানির বিপক্ষে একটি পেনাল্টি নিয়েছিল কোপা এবং ম্যাচের ঐ সময়ে ফন্টেইনের গোল সংখ্যা ছিলো ১০টি। কচিসের রেকর্ড থেকে সামান্য দূরে দাঁড়িয়েও ফন্টেইন পেনাল্টি নেননি। পরবর্তী বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ হয়নি ফন্টেইনের, অন্যদের মতো আরো বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেলে হয়তো রূপকথার গল্পের মতো কোনো অর্জন উপহার দিতেন ফুটবল বিশ্বকে।

বারবার ইনজুরিতে আক্রান্ত হওয়ায় শেষ পর্যন্ত খেলা চালিয়ে যেতে পারছিলেন না তিনি। ১৯৬০ সালেই দুইবার পা ভেঙ্গে যায় তার। ১৯৬২ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে ইনজুরির কাছে পরাজিত হয়ে ফুটবল থেকে অবসর নেন ফুটবলের অন্যতম সেরা এক স্ট্রাইকার, ফুটবলকে যার দেওয়ার ছিলো আরো অনেক কিছু। জাতীয় দলের হয়ে মাত্র ২১টি ম্যাচ খেলে গোল করেছেন ৩০টি, ৩০ গোল করা খেলোয়াড়দের মধ্যে ম্যাচ প্রতি ১.৪৩ গোল গড় নিয়ে তিনিই সেরা। ক্লাব ক্যারিয়ারে ২৩৫টি ম্যাচ খেলে মোট গোল করেছেন ১৯৭টি

পুরো আসরে এমনই অপ্রতিরোধ্য ছিলেন ফন্টেইন; Source: futboldesdefrancia.com

যারা মনে করে, বর্তমানের তুলনায় আগের দিনে ফুটবলে গোল দেওয়া অনেক সহজ ছিল, তাদের জন্য উত্তরটা দিয়েছেন ফন্টেইন নিজেই। তিনি বলেন, “না, ১৯৫৮ সালে গোল করা সহজতর ছিলো না।” তিনি আরো বলেন, “সবচেয়ে বড় কথা, রেফারি আমার সময়ের চেয়ে স্ট্রাইকারদের বেশি সুরক্ষা দিয়ে থাকে।” তার রেকর্ড ভাঙ্গা সম্ভব নয় বলে বিশ্বাস করেন ফন্টেইন। তার মতে, “১৩ গোল একটি বিশাল সংখ্যা। আমার রেকর্ড ভাঙ্গা? আমার মনে হয় না এটা কোনোদিন সম্ভব।”

নিজের অনন্য অর্জনের আইকনিক জার্সি হাতে ফন্টেইন; Source: cdusport.com

ব্রাজিলের সাও পাওলোতে ২০১৪ সালে অ্যাডিডাসের প্লাটিনাম বুট দিয়ে অসামান্য অর্জন ও দীর্ঘ সময়ের রেকর্ডের জন্য এই কিংবদন্তিকে সম্মাননা জানানো হয়। তাছাড়া ফ্রান্স ফুটবল ফেডারেশন কর্তৃক ফ্রান্সের বিগত ৫০ বছরের সেরা ফ্রেঞ্চ ফুটবলার খেতাবও পান তিনি ২০০৩ সালে। ৮৪ বছর বয়সী কিংবদন্তি বর্তমানে সময় কাটান আফ্রিকান নেশনস কাপ, প্রিমিয়ার লিগ, বুন্দেসলিগা, সেরি আ এবং লা লিগা দেখে। ফন্টেইনের রেকর্ড ভাঙ্গা সম্ভব হোক কিংবা না হোক; মাত্র একটি বিশ্বকাপ খেলে যে অনন্য কৃত্তির মানদণ্ড তৈরি করেছেন তিনি, তা তাকে ফুটবল ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।

ফিচার ইমেজ- ahalftimereport.com

Related Articles