Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্রিকেটে রঙ লেগেছিল যে বিশ্বকাপের মাধ্যমে

১৯৭৫ সালের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিকেট বিশ্বকাপের যাত্রা শুরু হলেও জনপ্রিয়তার দিক থেকে প্রত্যাশামূলক সাফল্য সেভাবে পাওয়া যাচ্ছিল না। এভাবে কেটে যায় বেশ ক’টি বছর, একে এক চারটি বিশ্বকাপ মাঠে গড়ায়। এদিকে সময়ের সাথে সাথে টেলিভিশন কোম্পানিগুলোর প্রসারও দিন দিন বাড়তে লাগল। যদি ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হয়, তবে এই টেলিভিশন মাধ্যমই হতে পারে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার, সেটা আইসিসি বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছিল।

কিন্তু সাদা জার্সি আর লাল বল কি দর্শককে ওই বোকাবাক্সের সামনে টানা ৭-৮ ঘণ্টা আটকে রাখার জন্য যথেষ্ট? তাছাড়া ব্যাট হাতে প্রতিটা দল খেলার প্রথম ১০-১৫ ওভার এতটা সাবধানে ব্যয় করে যে খেলার শুরুতে এসব ঠুকঠুক দেখতে গিয়ে আমজনতার হয়তো অনেকে ঘুমিয়েই পড়ে। এভাবে চললে কি আর জনপ্রিয়তা বাড়বে?

আর ঠিক সেই কারণেই প্রথমবারের মতো দক্ষিণ গোলার্ধ, অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় ১৯৯২ বিশ্বকাপে কিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয় আইসিসি। টেস্টের সেই সাদা জার্সি নয়, বিশ্বকাপ খেলা হবে রঙিন জার্সিতে, এবং প্রতিটি দল তাদের নিজ নিজ পছন্দের রঙের জার্সি পরে খেলবে। তবে একটা নির্দিষ্ট নকশা ঠিক করে দেয় আইসিসি, যেটা অনুসরণ করে প্রত্যেক দলকে তাদের জার্সি বানাতে হয়। রঙিন পোষাকের সাথে লালের বদলে সাদা বলকেও আমন্ত্রণ জানানো হয় ওয়ানডে ক্রিকেটে। 

আর মাঠে যাতে চার-ছক্কার ফুলঝুরি ছোটানো যায়, সেজন্য নিয়ে আসা হয় ফিল্ডিং সীমাবদ্ধতার নিয়ম, যা বর্তমানে ‘পাওয়ারপ্লে’ হিসেবেই সমধিক পরিচিত। এই নিয়ম অনুসারে প্রথম দশ ওভার ২ জনের বেশি খেলোয়াড় ৩০ গজের বৃত্তের বাইরে দাঁড়াতে পারবে না, এরপর বাকিটা সময়ে ফিল্ডিং দল সর্বোচ্চ পাঁচজন খেলোয়াড় ৩০ গজ বৃত্তের বাইরে রাখতে পারবে। এই নিয়মের ফলে ওয়ানডে ক্রিকেট যেন নতুন প্রাণ ফিরে পায়।

আগের সব আসরে প্রতি দলকে দুই গ্রুপে ভাগ করে টুর্নামেন্ট সাজানো হতো। তবে এই আসরের প্রথম পর্ব রাউন্ড রবিন লিগে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অর্থাৎ, অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশ একে অন্যের মুখোমুখি হবে এবং এরপর পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষ চার দলকে নিয়ে হবে সেমিফাইনাল। শুরুতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, টেস্ট খেলুড়ে সাত সদস্য ও সহযোগী সদস্য জিম্বাবুয়ে – এই আটটি দেশকে নিয়েই অনুষ্ঠিত হবে এই বিশ্বকাপ। কিন্তু বর্ণবাদের কারণে দীর্ঘ ২২ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিষিদ্ধ থাকা দক্ষিণ আফ্রিকার অবস্থা নেলসন ম্যান্ডেলার হাত ধরে পরিবর্তিত হওয়ায় তাদেরকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফলে দলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় নয়টি। রাউন্ড রবিন লিগের গ্রুপপর্ব ছিল নানা নাটকীয় ঘটনায় ভরপুর।

মার্টিন ক্রোর অদম্য নিউ জিল্যান্ড

অধিনায়ক মার্টিন ক্রোর অসাধারণ রণকৌশলে বিশ্বকাপের সহ-আয়োজক নিউ জিল্যান্ড এই বিশ্বকাপে যেনো এক ভিন্ন অবতারে হাজির হয়। ক্রো এমন সব কৌশল কাজে লাগান, যা পরবর্তীতে ওয়ানডে ক্রিকেটের বাঁকবদলে বড় ভূমিকা রেখেছিল। যে ‘পিঞ্চ হিটিং তত্ত্ব’ কাজে লাগিয়ে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে রীতিমতো তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিল শ্রীলঙ্কা, সেই পিঞ্চ হিটিংয়ের ধারণা সর্বপ্রথম ক্রো’র নিউজিল্যান্ডই কাজে লাগিয়েছে। ১৯৯২ বিশ্বকাপে মার্ক গ্রেটব্যাচকে ওপেনার হিসেবে পাঠিয়ে ফিল্ডিং সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে ইনিংসের শুরুতেই ঝড় তোলার রীতিটা চালু করে তারা। 

ক্রোর অনবদ্য নেতৃত্বে আসরজুড়ে দাপুটে পারফরম্যান্স উপহার দেয় নিউ জিল্যান্ড; Image Source: Pocket

এছাড়া ক্রিকেটের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে নতুন বলে সবসময় পেসাররা বল করবে, এমনটাই সবাই ভেবে আসছিল। কিন্তু ক্রো সবাইকে অবাক করে দীপক প্যাটেলের মতো একজন স্পিনারকে দিয়ে অধিকাংশ ম্যাচে বোলিং শুরু করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। শুধু পুরাতন বল নয়, নতুন বলেও যে স্পিনাররা কার্যকরী হতে পারে, সেটা দীপক প্যাটেলের নতুন বল হাতে সফলতা দেখেই সবার কাছে পরিষ্কার হয়। এমন সব দারুণ কৌশল, সাথে অধিনায়ক মার্টিন ক্রো’র দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে গ্রুপপর্বের আট ম্যাচের মধ্যে টানা সাতটি ম্যাচে জিতে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থেকে পরের রাউন্ড নিশ্চিত করে ব্ল্যাক ক্যাপসরা।

দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন

দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নির্বাসনে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকা কেপলার ওয়েসেলসের নেতৃত্বে এই আসরের মাধ্যমে বিশ্বআসরে অভিষেক ঘটায়। তবে শুরুটা খুব একটা ভালো হয়নি তাদের, প্রথম ম্যাচেই নিউ জিল্যান্ডের কাছে হেরে যায় তারা। পরের ম্যাচের ফলাফল তো আরো খারাপ, সেই সময়ের আন্ডারডগ শ্রীলঙ্কার কাছে অপ্রত্যাশিত হারে বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়ে তারা। তবে সেখান থেকে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ায় প্রোটিয়ারা, বাকি ছয় ম্যাচের পাঁচটিতে জিতে পয়েন্ট টেবিলের তৃতীয় স্থানে থেকে নিশ্চিত করে পরের রাউন্ড। 

উড়ন্ত জন্টি রোডস; Image Source: livemint.com

তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রুপপর্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা হয়ে থাকে একটা বিচিত্র রানআউট। পাকিস্তানের মুশতাক আহমেদ পয়েন্ট অঞ্চলে বলটা ঠেলে সিঙ্গেল নেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু জন্টি রোডসের হাতে বল চলে গেছে দেখে মঈন খান তাকে ফিরিয়ে দেন। বল যখন রোডস হাতে নিলেন, তখন তিনি দেখলেন মুশতাক আহমেদ যেখানে আছেন, সেখান থেকে দৌঁড়ে আসতে যতটুকু সময় লাগবে, তার মধ্যে তিনি নিজেই দৌঁড়ে গিয়ে তাকে রানআউট করতে পারবেন। দৌঁড়ে গিয়ে উড়ন্ত মানবের মতো স্ট্যাম্পটা ভেঙে দিলেন জন্টি রোডস। এই ‘অদ্ভুতুড়ে’ রানআউট বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত।

কোণঠাসা পাকিস্তানের নাটকীয় গল্প

দল হিসেবে সেই সময়ের পাকিস্তান অবশ্য বেশ শক্তিশালী ছিল। শেষ পাঁচ বছরে তাদের পারফরম্যান্সও দারুণ ছিল। কিন্তু বিশ্বকাপ শুরুর আগেই সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। চোটের কারণে বিশ্বকাপ শুরুর আগেই দলের বাইরে চলে যান ওয়াকার ইউনিস। উইন্ডিজের কাছে ১০ উইকেটে হেরে বিশ্বকাপের শুরুটাও হলো জঘন্যভাবে। এরপর জিম্বাবুয়ের সাথে জিতলেও ইংলিশদের সাথে আবারো হতশ্রী রূপে পাকিস্তান, মাত্র ৭৪ রানে গুটিয়ে যায় তারা। তবে বৃষ্টির আগমন পাকিস্তানের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে, নিশ্চিত হারা ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়ায় এখান থেকে এক পয়েন্ট পেয়ে যায় তারা।

ভাগ্যের জোরে প্রাপ্ত এই এক পয়েন্টই পাকিস্তানের জন্য টার্নিং পয়েন্ট হয়ে আসে। টুর্নামেন্টের এক পর্যায়ে পাকিস্তানের সেমিফাইনালে ওঠার জন্য বাকি তিন ম্যাচের সবগুলোতেই জয় ভিন্ন অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না। সেই তিনটি ম্যাচের দু’টিতে প্রতিপক্ষ ছিল দুই স্বাগতিক দেশ অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ড। অধিনায়ক ইমরান খান তার বিদায়ী আসরকে স্মরণীয় করতে সবাইকে উজ্জ্বীবিত করে এক করলেন। শেষ পর্যন্ত শেষ তিনটি ম্যাচেই জয় পায় পাকিস্তান, আর সাথে বৃষ্টিতে প্রাপ্ত ওই এক পয়েন্ট উইন্ডিজ ও অস্ট্রেলিয়াকে টপকে তাদের সেমিফাইনালের টিকিটটাও এনে দেয়।

বয়কটের অবজ্ঞার দাঁতভাঙা জবাব

গ্রুপপর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে আসরের সবচেয়ে খর্বশক্তির দল জিম্বাবুয়ের মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড। ইতঃমধ্যে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলা ইংলিশরা ছিল ফুরফুরে মেজাজে, অন্যদিকে আগের সাতটি ম্যাচেই হারা জিম্বাবুয়ে চাচ্ছিল ভালো কিছু করে সম্মানজনক একটা বিদায় নিতে। টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক ডেভ হটন। কিন্তু ইনিংসের শুরু থেকেই নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকায় মাত্র ১৩৪ রানেই গুটিয়ে যায় তারা।

এমন সংগ্রহ দাঁড় করানোর পর জিম্বাবুয়ের বড় হার অনুমান করাটাই স্বাভাবিক ছিল, ডেভ হটনরাও নিজেরাও হয়তো তেমনটাই ভেবেছিলেন। কিন্তু গোল বাঁধালেন সাবেক ইংলিশ ওপেনার জিওফ্রে বয়কট, ইনিংস বিরতিতে তিনি হটনকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

‘তোমাদের মতো ছোট দলগুলোকে নিয়ে এই এক সমস্যা। কীভাবে স্ট্রাইক রোটেট করে সিঙ্গেল বের করতে হয়, তার কিছুই তোমরা জানো না। মধ্যাহ্নবিরতি শেষ করে মাঠে এসে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং দেখো, তাহলে বুঝতে পারবে, পেশাদার ক্রিকেটাররা কীভাবে সিঙ্গেল বের করে খেলে।’ 

ঐতিহাসিক সেই জয়ের পর জিম্বাবুয়ের খেলোয়াড়েরা; Image Source: Getty Images/ Adrian Murell

এই এক কথাতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন হটন, নিজেদের সেরাটা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য সতীর্থদের অনুরোধ করলেন তিনি। এডো ব্রান্ডেজের ১০ ওভারে ২১ রানে ৪ উইকেটের অনবদ্য এক স্পেল ও বাকিদের মিতব্যয়ী বোলিংয়ে মাত্র ১২৫ রানে ইংলিশদের গুটিয়ে দিয়ে ৯ রানের জয় তুলে নেয় জিম্বাবুয়ে। বয়কটের সেই অবজ্ঞার জবাব এর চেয়ে ভালো আর কী-ই বা হতে পারতো?

এই ম্যাচের ফলাফল বিশ্বকাপের পয়েন্ট টেবিলে তেমন কোনো প্রভাব না রাখলেও জিম্বাবুয়ের টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তিতে রেখেছিল বড় এক ভূমিকা। এছাড়া বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ভারত-পাকিস্তানের মুখোমুখি হওয়াটাও এই আসরকেও স্মরণীয় করেছে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে ৪৩ রানে হারিয়ে মর্যাদার লড়াইটা জিতলেও সেই আসরে ভারতের পারফরম্যান্স ছিল হতাশাজনক, মাত্র ৫ পয়েন্ট নিয়ে সপ্তম স্থানে থেকে টুর্নামেন্ট শেষ করেছিল তারা।

ইনজুরি ও ইনজামামের কাছে থামলো নিউ জিল্যান্ড

যদিও গ্রুপপর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে এই নিউ জিল্যান্ডকে হারিয়েই সেমিফাইনালের টিকিট পেয়েছিল পাকিস্তান, তবুও প্রথম সেমিফাইনালে সব দিক বিবেচনাতেই ফেভারিট ছিল নিউ জিল্যান্ড। অকল্যান্ডে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন অধিনায়ক মার্টিন ক্রো, আর সেই সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করতে নিজেই ব্যাট হাতে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। সবকিছু বেশ ভালোভাবেই চলছিল, কিন্তু হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে পড়ে কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলেন ক্রো। শেষ পর্যন্ত রানারের সাহায্য নিয়েও লাভ হয়নি, রান আউটই হতে হয়েছে তাকে। তবে ৮৩ বলে ৯১ রানের দারুণ এক ইনিংস দিয়ে দলকে শক্ত একটা ভিত গড়ে দিয়েছিলেন। সাথে রাদারফোর্ডের ফিফটি ও লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের ছোট ছোট কিছু ঝড়ো ক্যামিওতে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে ৭ উইকেটে ২৬৭ রান দাঁড় করায় ব্ল্যাক ক্যাপসরা। 

রানের ধারা সেমিফাইনালেও বজায় রাখেন মার্টিন ক্রো; Image Source: espncricinfo.com

সেই সময়ে এই লক্ষ্যমাত্রাকে বিশাল বলা ছাড়া উপায় ছিল না। তার উপর ছিল সেমিফাইনালের চাপ। তাই সবদিক থেকে পাকিস্তানের জয়ের আশা বেশ ফিকেই হয়ে গিয়েছিল। তবে নিউ জিল্যান্ডের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে আসে অধিনায়ক ক্রো’র ওই ইনজুরি, যার দরুণ তিনি মাঠে নেমে দলকে নেতৃত্ব দিতে পারেননি। আগেই বলা হয়েছে, ওই আসরে নিউ জিল্যান্ডের সাফল্যের বড় কারণ ছিল ক্রো’র অসাধারণ নেতৃত্ব, তিনি মাঠে না থাকায় দল কিছুটা ছন্নছাড়া হয়ে যায়। তার বদলে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করা জন রাইট খুব একটা পারদর্শিতার প্রমাণ দিতে পারেননি। আর এই সুযোগটা দারুণভাবে কাজে লাগায় পাকিস্তান, রমিজ রাজা ও অধিনায়ক ইমরান খান উভয়ে ৪৪ রান করলে এই রান তাড়া করার জন্য একটা ভিত তারা পেয়ে যায়।

কিন্তু সেই ভিত দাঁড় করাতে গিয়ে ওভারপ্রতি প্রয়োজনীয় রানরেট বেশ উপরের দিকে তুলে ফেলেছিলেন তারা। শেষ ১৫ ওভারে পাকিস্তানের দরকার ছিল ১২৩ রান,যা সেই যুগ তো বটেই, এই যুগেও সহজ কোনো কাজ নয়। ক্রিজে অভিজ্ঞ জাভেদ মিঁয়াদাদের সাথে তখন আছেন ২২ বছর বয়সী ইনজামাম-উল হক। সেই আসরে ইনজির ফর্ম ছিল রীতিমতো ভয়াবহ, আট ইনিংসে ১৫.৩৭ গড়ে করেছিলেন মাত্র ১২৩ রান। এই ম্যাচটাও জ্বরের কারণে খেলার কথা ছিল না তার, কিন্তু অধিনায়ক ইমরান খানের অনুপ্রেরণায় শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা খেলতে নামেন তিনি। 

২২ বছরের তরুণ ইনজির ইনিংসটা খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেয়; Image Source: ICC

আর খেলতে নেমেই বাজিমাত। সব চাপ উপেক্ষা করে খেলেন ৩৭ বলে ৬০ রানের অনবদ্য এক ইনিংস, যা সমগ্র বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ম্যাচজয়ী ইনিংস। দলীয় ২২৭ রানে তিনি আউট হয়ে গেলেও জয়ের রাস্তাটা তখন পুরোপুরি পেয়ে গেছে পাকিস্তান। জাভেদ মিঁয়াদাদের ৬৯ বলে ৫৭ রানের ঠাণ্ডা মাথার ইনিংস, আর মঈন খানের ১১ বলে ২০ রানের ক্যামিওতে এক ওভার হাতে রেখেই চার উইকেটের অবিশ্বাস্য এক জয় তুলে প্রথমবারের মতো ফাইনালের টিকিট পেয়ে যায় পাকিস্তান। পুরো টুর্নামেন্টে সবার চেয়ে সেরা ক্রিকেট উপহার দিয়েও ইনজির ব্যক্তিগত নৈপুণ্য আর ক্রো’র দুর্ভাগ্যজনক ইনজুরির কাছে হার মানতে হয় স্বাগতিক নিউ জিল্যান্ডকে।    

বৃষ্টি নামক তামাশায় কলঙ্কজনক এক অধ্যায়

সিডনিতে দ্বিতীয় সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের প্রতিপক্ষ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করে গ্রায়েম হিকের ৯০ বলে ৮৩ রানের দারুণ এক ইনিংসে নির্ধারিত ৪৫ ওভারে ৬ উইকেটে ২৫২ রান সংগ্রহ করে ইংলিশরা। জবাব দিতে নেমে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকলেও সবার অল্প অল্প অবদানে বেশ ভালোই জবাব দিচ্ছিল প্রোটিয়ারা।

শেষ ১৩ বলে ৪ উইকেট হাতে রেখে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ছিল ২২ রান, উইকেটে ছিলেন ব্রায়ান ম্যাকমিলান ও ডেভিড রিচার্ডসন।  সম্ভাবনার বিচারে দুই দলেরই তখন সমান সম্ভাবনা ছিল। ঠিক তখনই বারো মিনিটের এক বৃষ্টি এমন জমজমাট ম্যাচে পুরো জল ঢেলে দেয়। সে সময়ের বৃষ্টিসংক্রান্ত আইন অনুযায়ী খেলার দ্বিতীয় ভাগে বৃষ্টি এলে প্রথমে বোলিং করা দলের সবচেয়ে কম রান দেওয়া ওভারগুলোর রানসংখ্যা কমানো হবে। 

এই স্কোরকার্ডই যেন বিশাল এক তামাশার প্রতিচ্ছবি; Image Source: espncricinfo.com

এই নিয়ম অনুযায়ী দক্ষিণ আফ্রিকার ২ ওভার যখন কমানো হলো, তখন দেখা গেলো তাদের টার্গেট থেকে এক রানও কমানো হয়নি! কারণ, নিজেদের ইনিংসে দু’টি ওভারে একটি রানও করতে পারেনি ইংলিশরা, তাই নিয়ম অনুযায়ী সবচেয়ে কম রান দেওয়া ওভার হিসেবে ওই দুই ওভারের হিসাব ধরায় প্রোটিয়াদের টার্গেট থেকে যায় অপরিবর্তিত! ১৩ বলে ২২ রান থেকে প্রথমে ৭ বলে ২২ রান, পরে স্কোরবোর্ডে উঠলো ১ বলে ২২ রান। পুরো ক্রিকেট ইতিহাসে এর চেয়ে বড় তামাশা আর কখনো ঘটেনি, ভবিষ্যতেও হয়তো ঘটবে না। ভাগ্যের কাছে হেরে সেই আসরের সেমিফাইনাল থেকেই বিদায় নিতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে। এদিকে জিতেও সেদিন সেভাবে কোনো উল্লাস করেনি ইংল্যান্ড। এমন বিতর্কিত জয় হয়তো তারা নিজেরাও চায়নি। স্মরণকালের সেরা এই বিশ্বকাপে এই একটি ঘটনাই কলঙ্কের দাগ এঁকে যায়।

এক ম্যাজিকাল স্পেলে পাকিস্তানের বিশ্বজয়

মেলবোর্নের ফাইনালে টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন পাকিস্তানের অধিনায়ক ইমরান খান। কিন্তু মাত্র ২৪ রানে দুই উইকেট খুঁইয়ে শুরুতেই বেশ চাপে পড়ে যায় তারা। সেখান থেকে জাভেদ মিয়াঁদাদের সাথে জুটি গড়ে দলকে টেনে তোলার দায়িত্ব নেন অধিনায়ক নিজে। মিয়াঁদাদের ৫৮ ও ইমরানের ৭২ রানে বেশ ভালো একটা ভিত পেয়ে যায় পাকিস্তান। এই দুইজন আউট হয়ে গেলে সেমিফাইনালের নায়ক ইনজামাম হাল ধরেন, তার ৩৫ বলে ৪২ ও শেষ দিকে ওয়াসিম আকরামের ১৮ বলে ৩৩ রানের ঝড়ো ইনিংসে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে ৬ উইকেটে ২৪৯ রানের লড়াকু সংগ্রহ দাঁড় করায় তারা। 

ওভারপ্রতি পাঁচ রান, সেই সময়ের ফাইনালের মঞ্চে কাজটি কিছুটা কঠিনই ছিল। মাত্র ৬৯ রানে ৪ উইকেট খুইয়ে ফেলায় ইংল্যান্ডের কাজটা আরো দুরূহ হয়ে যায়। তবে নিল ফেয়ারব্রাদার ও অ্যালান ল্যাম্বের দারুণ এক জুটিতে খেলায় ফিরে আসে ইংলিশরা। এই জুটি এতটাই সাবলীলভাবে ব্যাট চালাচ্ছিলেন যে, মনে হচ্ছিল খেলাটা বুঝি পাকিস্তানের হাতছাড়াই হয়ে যাবে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে নিজের তুরুপের তাস ওয়াসিম আকরামকে বোলিংয়ে নিয়ে আসেন ইমরান। 

সেই ঐতিহাসিক স্পেল; Image Source: Wisden

অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দিতে ভুল করেননি ওয়াসিম, তার করা অসাধারণ দুই রিভার্স সুইঙ্গারে টানা দুই বলে সাজঘরে ফিরে যান দুই ইংলিশ ব্যাটসম্যান অ্যালান ল্যাম্ব ও ক্রিস লুইস। ১৪১/৪ থেকে মাত্র দুই বলের মাঝে ইংল্যান্ডের সংগ্রহ হয়ে যায় ১৪১/৬। ম্যাচের মোড় মূলত সেখানেই ঘুরে যায়, বাকি ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা লড়াই করার চেষ্টা করলেও তাতে লাভ হয়নি। ২২ রানে ম্যাচটা জিতে নিয়ে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম বিশ্বকাপ জিতে নেয় পাকিস্তান। 

বিশ্বকাপের শিরোপা হাতে ইমরান খান; Image Source: Dawn

নিজের বিদায়ী ম্যাচে দলকে এত বড় উপহার দিয়ে বিদায়টা স্মরণীয় করে রাখেন সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক ইমরান খান। দুর্দান্ত ক্যামিও আর অসাধারণ ওই স্পেলের জন্য ফাইনালসেরা হন ওয়াসিম আকরাম, আর দল ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হলেও পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের মাধ্যমে ১১৪ গড়ে ৪৫৬ রান করার পুরস্কারস্বরূপ টুর্নামেন্টসেরা হন নিউ জিল্যান্ডের অধিনায়ক মার্টিন ক্রো। 

অনেক বিশ্লেষকের মতেই, এখন পর্যন্ত যতগুলো বিশ্বকাপ হয়েছে, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ আসর ১৯৯২ বিশ্বকাপ। এই একটি আসরই ওয়ানডে ক্রিকেটের চিন্তাধারাকে আমূল বদলে দিয়েছে। এই আসরের কারণে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তাও হু হু করে বেড়েছে। যদিও সেমিফাইনালে বৃষ্টি প্রহসনের কারণে কিছুটা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, তবুও ওয়ানডে ক্রিকেটে অভাবনীয় প্রভাবের কারণে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে এই বিশ্বকাপ।

This article is in Bangla language. It's about the historical 1992 world cup which brought a huge change in ODI cricket. For references please check the hyperlinks inside the article.

Featured Image: espncricinfo.com

Related Articles