আমেরিকার পেনসিলভানিয়ার এক পত্রিকা ‘হ্যারিসবার্গ টেলিগ্রাফ’। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৯ তারিখে সেই পত্রিকায় অদ্ভুত একটা খবর ছাপা হলো। খবরের বিষয়বস্তু হচ্ছে: মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত শেফিল্ড শিল্ডের এক ম্যাচে এক রেকর্ড গড়ে ফেলেছেন অ্যালান কিপ্যাক্স আর হ্যাল হুকার নামের দুই ভদ্রলোক।
অবাক হবেন না যেন! যা পড়েছেন, ঠিকই পড়েছেন। জায়গাটা আমেরিকাই। সেই আমেরিকা, যেখানে ফুটবলকে আজকের দিনেও বলা হয় সকার, যেখানে ক্রিকেট আর বেসবলের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পায় না সে দেশের মানুষ। সেই দেশের এক পত্রিকায় যখন ক্রিকেটের খবর ছাপা হয়, তখন রেকর্ডটা যে আসলেই খুব দুর্লভ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এর ছয় দিন আগের কথা। ২২ ডিসেম্বর, ১৯২৮।
শেফিল্ড শিল্ডের ম্যাচ শুরু হলো মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। এমসিজি ভিক্টোরিয়ার হোম গ্রাউন্ড, তাদের সাথে অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে এসেছে নিউ সাউথ ওয়েলস। ২২ ডিসেম্বর ছিল শনিবার। তখন খেলার ফাঁকে একদিন বিশ্রাম নেয়ার প্রচলন ছিল, সাধারণত সেই দিনটি হতো রবিবার। এবারেও তার ব্যতিক্রম হলো না। ২৩ ডিসেম্বর বিশ্রাম দিবস হিসেবে কাটিয়ে ক্রিসমাসের দিনে খেলার সিদ্ধান্ত হলো।
ভিক্টোরিয়ার ক্যাপ্টেন ছিলেন জ্যাক রাইডার, টসে জিতে ব্যাটিং নিলেন তিনি। শুরুটা খুব ভালো হলো না অবশ্য, ২৯ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ফেললো ভিক্টোরিয়া। সেখান থেকে জ্যাক রাইডারের ১৭৫ আর টেড এ’বেকেটের ১১৩ রানে ভিক্টোরিয়া অলআউট হলো ৩৭৬ রানে।
ব্যাটিংয়ে নেমে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়লো নিউ সাউথ ওয়েলস, স্কোর এক পর্যায়ে দাঁড়ালো ৫৮ রানে ৭ উইকেট। এই অবস্থায় দ্বিতীয় দিনের খেলার সমাপ্তি ঘোষণা হলো, পরদিন খেলা শুরু হবে আবার।
পরদিন ছিল ক্রিসমাস। সে সময় ক্রিসমাসের দিনেও কখনো কখনো খেলা হতো। রাত পোহালেই উৎসব, তারপরও নিউ সাউথ ওয়েলসের কোনো খেলোয়াড়ের মুখে হাসি দেখা গেল না। অবশ্য দলের এই অবস্থায় হাসি আসবেই বা কীভাবে?
পরদিন সকালে আবার খেলা শুরু হলো। মাঠে তখন দর্শকের সংখ্যা প্রায় হাজার পাঁচেক। কীসের আশায় যে এরা ক্রিসমাসের সকালে মাঠে এসেছিলো, তা কেবল তারাই জানে। একে তো একটা উৎসবের দিন, তারপরে পুরোপুরি একতরফা ম্যাচে দেখার আছেই বা কী! যাই হোক, খেলা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই অষ্টম উইকেট হিসেবে ড্রেসিংরুমের পথ ধরলেন চার্লস নিকোলস, স্কোর তখন ৭৪/৮। নবম উইকেট হিসেবে স্যাম এভারেটও ফিরে গেলেন দলীয় ১১৩ রানে। ফলোঅন তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে মাঠে আসলেন হ্যাল হুকার। অপর প্রান্তের ব্যাটসম্যানের নাম অ্যালান কিপ্যাক্স।
আগের রাতে হুকারের কাছে সান্তা এসেছিলেন কিনা তা জানা যায়নি। কোনো উপহার জুটেছিলো কিনা, জানা যায়নি তা-ও। তবে হুকারের জন্য সেই সান্তা হয়ে এলেন ভিক্টোরিয়ার উইকেটকিপার জ্যাক এলিস। হুকারকে তিনি বললেন,
‘হ্যাভ এ গো, হুকার। দ্য বোলিং ইজ ইজি। (চালিয়ে খেলো, হুকার। বোলিং কিন্তু সহজ হচ্ছে অনেক)।’
মানুষ মাঝে মাঝে নির্দোষ কোনো কৌতুক করে ফেঁসে যায়। জ্যাক এলিসের হলো সেই অবস্থা। তার কথা যে হুকার সিরিয়াসলিই নিয়ে নেবেন, তা তিনি হয়তো কল্পনাতেও ভাবতে পারেননি। নিউ সাউথ ওয়েলস যখন লাঞ্চে যাচ্ছে, তখন স্কোর ১৭০/৯। ৫৭ রানের পার্টনারশিপ হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই, হুকারের সংগ্রহ ১৮।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে লাগলো দর্শকের সংখ্যাও। এক পর্যায়ে দর্শকসংখ্যা দাঁড়াল ১৫ হাজারে। আর এদিকে মনের আনন্দে খেলে যেতে লাগলেন হুকার আর কিপ্যাক্স। ক্রিসমাসের দিনে যখন স্ট্যাম্পস ঘোষণা করা হলো, তখন নিউ সাউথ ওয়েলসের সংগ্রহ ৩৬৭/৯। দশম উইকেট জুটিতে কিপ্যাক্স আর হুকার জড়ো করে ফেলেছেন ২৫৪ রান! কিপ্যাক্সের ব্যক্তিগত রান ২২১, হুকারের ৫২।
ম্যাচের পরিণতি কী হবে, তা তখনও জানেন না নিউ সাউথ ওয়েলসের কোনো খেলোয়াড়। তবে সে রাতে ক্রিসমাসের ডিনারটা যে বেশ তৃপ্তি সহকারেই সম্পন্ন করেছিলেন, সেটা আর না বললেও চলছে।
পরের দিন ছিল বক্সিং ডে। নৈতিক বিজয় নামে যে জিনিসটা আছে, সেটা ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছিল কিপ্যাক্স বাহিনীর। তবুও দর্শকদের অনেকেই অপেক্ষা করে ছিল নিউ সাউথ ওয়েলস লিড নিতে পারে কিনা, তার জন্য। বক্সিং ডে’র চতুর্থ ওভারেই সেটা হয়ে গেল। বার্ট আয়রনমঙ্গারের বলে এক রান নিয়ে ভিক্টোরিয়ার ৩৭৬ রানকে পিছনে ফেলে দিলেন ক্যাপ্টেন কিপ্যাক্স!
ভিক্টোরিয়ার দুই সেঞ্চুরিয়ানের প্রচেষ্টায় শেষ হলো হুকার তথা নিউ সাউথ ওয়েলসের ইনিংস। টেড এ’বেকেটের বলে হুকারের ক্যাচ নিলেন জ্যাক রাইডার। নিউ সাউথ ওয়েলসের স্কোর তখন ৪২০/১০।
যে দলটির ফলোঅন করার কথা ছিল, সেই দলটিই নিলো ৪৪ রানের লিড। কিপ্যাক্স অপরাজিত থেকে গেলেন ২৬০ রানে, হুকারের সংগ্রহ ৬২। এর আগে তার ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ছিল ২৮ রান। দশম উইকেট জুটিতে তারা যে ৩০৭ রানের পার্টনারশিপ গড়লেন, ৯০ বছর কেটে গেলেও তা রয়ে গেছে একদম অটুট। সম্ভবত স্যার ডনের গড়ের মতো এই রেকর্ডও স্পর্শের বাইরেই রয়ে যাবে সারাজীবন।
এরপরে এই ম্যাচে আর তেমন কিছু ঘটেনি। ভিক্টোরিয়া আবার ব্যাটিংয়ে নামে, নেমে ২৫১ রান করে ডিক্লেয়ার করে ইনিংস। ৪৪ রানের লিডের কারণে নিউ সাউথ ওয়েলসের সামনে টার্গেট দাঁড়ায় ২০৮ রানের।
ভিক্টোরিয়া যখন ডিক্লেয়ার করে, তখন খেলার বাকি আর মাত্র আড়াই ঘণ্টার মতো। এই টোয়েন্টি টোয়েন্টি ক্রিকেটের যুগেও আড়াই ঘণ্টায় ২০৮ রান চেজ করা মোটামুটি উচ্চাভিলাষীই বলা যায়। ১৯২৮ সালে তো ছিল রীতিমতো কল্পনাতীত। তাই এই ম্যাচ ড্র হওয়াটাই ভবিতব্য ছিল বটে। তবে তার আগে একটা চেষ্টা করতে চাইলেন স্যার ডন। ভুলেই গেছেন বোধহয়, ঘরোয়া ক্রিকেটে স্যার ডন কিন্তু নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়েই খেলতেন।
খেলা যখন শেষ হলো তখন নিউ সাউথ ওয়েলসের স্কোর ১৫৬/২, স্যার ডন অপরাজিত আছেন ৭১ রানে। আর আধা ঘণ্টা পেলে তিনি যে কী করতেন সে আর না বললেও চলছে! একটুর জন্য জয় হাতছাড়া হওয়ায় আক্ষেপ হয়েছিল হয়তো, তবে সেই মৌসুমে ভিক্টোরিয়ার থেকে ১০ পয়েন্ট এগিয়ে থেকে শিল্ড জিতেছিল নিউ সাউথ ওয়েলসই।
একটা তথ্য যোগ না করলেই নয়। শিল্ডেরই আরেক ম্যাচে আবার মুখোমুখি হলো এই দুই দল। এবার খেলা হলো সিডনিতে, নিউ সাউথ ওয়েলসের মাঠে। সেই ম্যাচে টানা ৪ বলে ৪ উইকেট নিলেন সেই হ্যাল হুকার। শেফিল্ড শিল্ডের ইতিহাসের প্রথম এরকম কীর্তি ছিল তা।
আমেরিকা দিয়ে শুরু করেছিলাম। শেষের আগেও আমেরিকাতেই ফিরে যাই। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট কেলভিন কুলিজ একবার বলেছিলেন,
‘হিরোইজম ইজ নট অনলি ইন দ্য ম্যান, বাট ইন দ্য অকেশন।’
কথাটা হয়তো সবচেয়ে ভালোভাবে প্রমাণ করেছিলেন অ্যালান কিপ্যাক্স আর হ্যাল হুকারই!
Featured Image: espncricinfo.com
References: The sources are hyperlinked in the article
Description: This is a Bangla article about the memorable last wicket partnership in Sheffield Shield.