Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

একজন মাশরাফি, কিছু অনুপ্রেরণা ও একটি জয়

তামিম ইকবাল খুব কম সময়ের ব্যবধানে কয়েকটি বাউন্ডারি মারলেন। একটি ছক্কার মার গিয়ে পড়লো গ্যালারিতে থাকা এক দর্শকের পাশে। লোকটি এমনিতেই বিরক্ত উইন্ডিজ বোলারদের আত্মাহুতি দেখে। তার উপর কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার মতো করে তামিমের হাঁকানো বলের তোপ। মেজাজ হারালো সে। রাগ করে খেলাই দেখা বাদ দিয়ে দিল! গজরাতে গজরাতে উঠে গেল নিজের আসন থেকে। মাঠের দিকে তাকিয়ে মাতৃভাষায় কী সব বলতে বলতে বের হয়ে গেল।

রবিবার গায়ানার প্রভিডেন্স মাঠে বাংলাদেশ-উইন্ডিজের ম্যাচে প্রায় ২০ মিনিট বৃষ্টি হয়েছিল। খেলা বন্ধ ছিল সেসময়। কিন্তু পুরো ম্যাচে স্নিগ্ধ বৃষ্টি ঝরিয়ে গেলেন তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান। তাদের ব্যাটে রানের বন্যা বইলো পুরো গায়ানায়। এসব দেখে কে বলবে, পরপর দুই টেস্টে ক’দিন আগে এই দলটির বিপক্ষেই সটান মুখ থুবড়ে পড়েছিল ঠিক এই দলটিই?

কে বলবে, বাংলাদেশ গড়েছিল লজ্জার রেকর্ড? খোলা চোখে আসলেও বিশ্বাস করা ভার। কি এক অজানা মন্ত্র যেন সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছিল! হার, সমালোচনা, বিতর্কের সব কালো পর্দা সরিয়ে কেবলই আলোর দেখা। ব্যাটিং কিংবা বোলিং; সবখানেই যেন বদলে যাওয়া শরীরী ভাষা। ফলাফল, ৪৮ রানের জয়।

সাকিবের চোখ ধাঁধানো ইনিংসের একটি শট; Image Source: AFP

ওয়ানডে আসতেই গায়ানায় বদলে গিয়েছিল বাংলাদেশ। আর সেই বদলে যাওয়ার কান্ডারি অধিনায়ক। মাশরাফি বিন মুর্তজা। তার অধীনে, তার মন্ত্রণায় ঘুরে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ। চোখে চোখ রেখে লড়াই করেছিলেন তামিম ইকবাল-সাকিব আল হাসান, মেহেদী হাসান মিরাজ, মাশরাফি বিন মুর্তজা ও দলের বাকি সদস্যরা।

ফলাফল, মাশরাফির মন্ত্রণায় একটি জয়।

মাশরাফি ওয়ানডে সিরিজ খেলবেন কিনা, সেটা নিয়েই সংশয় ছিল। তার স্ত্রী অসুস্থ। পারিবারিকভাবে বেশ চাপে ছিলেন। মিরপুরের ক্রিকেট পাড়ায় গুঞ্জন ছিল, এবারের ওয়ানডে সিরিজটা খেলবেন না মাশরাফি। যেহেতু টেস্ট খেলা হয় না, টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়েছেন; ওয়ানডে না খেলা মানে মূলত উইন্ডিজ সিরিজ থেকেই নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। সেভাবে নাকি ভেবেও রেখেছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় এই খেলোয়াড়। ভাগ্যের মোড়, যে স্ত্রীর কারণে যেতে চাইছিলেন না; তিনিই জোর করে পাঠালেন মাশরাফিকে। দল চলে যাওয়ার কয়েকদিন পর ক্যারিবিয়ান সফর শুরু হলো তার। দীর্ঘ যাত্রার পর সেখানে পৌঁছলেন। মাত্র দুয়েকদিনের অনুশীলনে বুঝে গেলেন সবকিছু। সফলও হলেন।

যদিও পরিসংখ্যান বলে, গায়ানা বরাবরই বাংলাদেশের জন্য ‘লাকি ভেন্যু’। সেখানে ২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিশ্বকাপের সুপার এইটের ম্যাচে হারিয়ে দিয়েছিল। দীর্ঘ সেই সময়ের পর আবারও এই মাঠে নামলো লাল-সবুজ জার্সিধারীরা, এবারও এলো জয়।

উইকেট নেওয়ার পর মাশরাফির উদযাপন; Image Source: CWI

কিন্তু ড্রেসিংরুমে মাশরাফি দলের সদস্যদের যা বলেছিলেন, সেটাই আসলে অনেকখানি মানসিকভাবে জয়ের পথে এগিয়ে নিয়েছিল বাংলাদেশকে। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ধারাভাষ্যকার ড্যানি মরিসন মাশরাফিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এমন বদলে যাওয়ার পিছনে কী ছিল; কী বলেছিলেন তিনি। উত্তরে মাশরাফি বলেছেন,

আমি তাদেরকে বিশেষ কিছুই বলিনি। শুধু বলেছিলাম মন উজাড় করে দেশের জন্য খেলতে। টেস্ট সিরিজে যা হয়ে গেছে, তা গেছেই। এটি নতুন একটি সিরিজ। আমরা যদি এখানে শুরুটা ভালো করতে পারি, তাহলেই সব আমাদের পক্ষে চলে আসবে। আমরা আজ (রবিবার) সেটাই সঠিকভাবে করেছি। পরের ম্যাচগুলোতেও আশা করছি এই পারফরম্যান্স আমরা ধরে রাখতে পারবো।

তবে ২০০৭ সালের সেই সুখস্মৃতি শুরু থেকেই দলের প্রতি বাড়তি প্রত্যাশার চাপ আরোপ করেছিলেন মাশরাফি। টেস্টে যা-ই হোক, ওয়ানডেতে ভালো কিছু হবে সেই শক্তি নিচ্ছিলেন পুরনো দিনের সফলতা থেকে।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, 

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২০০৭ সালের সেই জয় এখনও আমাদের মনে আছে। আমরা এবার খেলছি উইন্ডিজের বিপক্ষে। আমাদের উইকেট আর এখানকার উইকেট আমাদের সঙ্গে বেশ মানিয়ে যায়। এখানকার উইকেট মনে হয় আমাদের হয়ে কথা বলে। আমাদের ব্যাটিংয়ের শুরুটা বেশ চ্যালেঞ্জিং মনে হলেও তামিম-সাকিবের ব্যাটে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দল।

টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন মাশরাফি। ব্যাটে নামলেন দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ও এনামুল হক বিজয়। সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স খুব একটা উল্লেখ করার মতো নয় বলে, সৌম্য জাতীয় দলের বাইরে। সেখানে সুযোগ পেয়েছেন এনামুল হক বিজয়। টিম ম্যানেজমেন্টের হাতে ওপেনিংয়ের জন্য আরও দুটি অপশন ছিল। লিটন কুমার দাস এবং ইমরুল কায়েস। কিন্তু প্রতিপক্ষ উইন্ডিজ বলেই কিনা একাদশের দৌড়ে উতরে গেলেন এনামুল হক বিজয়। কারণ এই দলের বিপক্ষে তার দুটি সেঞ্চুরি রয়েছে যা কিনা যেকোনো বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেবে একমাত্র। আর কারো কোনো সেঞ্চুরিও ছিল না রবিবারের ম্যাচের আগে।

কিন্তু বিজয় পারলেন না। দলের যখন ১ রান, তখনই আউট হয়ে গেলেন। মাত্র ১ রানে ১ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ দল তখন বিপাকে। যেন টেস্টের ভূত আবারও ফিরে আসছে। উইকেটে নিজের পছন্দের জায়গা ২ নম্বরে নামলেন সাকিব আল হাসান। শুরু হলো লড়াই। সেই লড়াইয়ের শুরুটা থমকে গিয়েছিলো বৃষ্টিতে। খেলা যখন শুরু হলো, তখন চরম সতর্ক দুই ব্যাটসম্যান।

দুর্ভাগ্য, তাদের সতর্কতা চোখে পড়েনি সমর্থকদের। উল্টো সমালোচিত হতে হয়েছে। ধীরগতির ব্যাটিংয়ে নবম ওভারে প্রথম বাউন্ডারি পেল বাংলাদেশ দল। সেখান থেকে ২০৭ রানের রেকর্ড জুটি। দ্বিতীয় উইকেটে সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ড। পাশাপাশি বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসের যেকোনো উইকেটেও এটা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ড।

ম্যাচের দুই ভিত তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসান; Image Source: CWI

সাকিব ও তামিম; দু’জনেরই সেঞ্চুরি হতে পারতো। কিন্তু ৯৭ রানের মাথায় ব্যর্থ হলেন সাকিব। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো নার্ভাস নাইন্টিনের কাছে মাথা নত করলেন। কিন্তু দলের হয়ে যা করে দিয়ে গেছেন, তার জন্য নিজের নত শীরকে উদ্ধত রাখতেই পারেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই বিজ্ঞাপন। সাকিব যাওয়ার ঠিক ৯ বলের মাথায় সেঞ্চুরি পেলেন তামিম ইকবাল। শেষ পর্যন্ত ১৩০ রানে অপরাজিত থেকে মাঠ ছেড়েছিলেন তিনি।

সাকিবের বিদায়ের পর সাব্বির রহমান মাঠে  নেমেছিলেন। দাঁড়াতেই পারেননি। ৩ রান তুলতেই ভূতের দেখা, অতঃপর তার কাঁধে চড়ে সাজঘরে ফেরা। সাকিব-তামিমের সাফল্যের পরও মনে শেষ দিকে বাংলাদেশের রানের ঘোড়ার রাশ টেনে ধরেছিল উইন্ডিজের বোলাররা। তখন মনে হচ্ছিল, কাঙ্ক্ষিত রানের চেয়েও ২০-৩৫ রান কম হতে পারে। কিন্তু সেই আশঙ্কা সরিয়ে দিয়েছিলেন মুশফিকুর রহিম। কয়েক ওভার হাতে পেয়ে সমানে ঝড় তুলতে থাকলেন। ১১ বলে ৩০ রানের বিধ্বংসী ও একটা সেঞ্চুরির চেয়েও বলা যায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলে ফিরলেন। এরপর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এসে ৪ রানে অপরাজিত থেকে শেষ করলেন ইনিংস।

খোলা চোখে মনে হতে পারে, সাকিব-তামিম একেবারে নিখুঁত খেলেছেন। কিন্তু সত্যি বলতে সেখানেও ছিল দুর্গতি। তাদের সাফল্যের পিছনে উইন্ডিজও দায়ী। দু’জনের ইনিংসে পাঁচটি সুযোগ হাতছাড়া করেছে উইন্ডিজ দল। তামিম ইকবাল ৩ বার সুযোগ পেয়েছেন। সাকিব পেয়েছেন ২ বার। উইন্ডিজ ব্যাটসম্যান ক্রিস গেইল একাই ৩টি ক্যাচ হাতছাড়া করেছেন। সেগুলো না হলে হয়তো সম্পূর্ণ ম্যাচের চেহারাই বদলে যেতো।

২৮০ রানের লক্ষ্য দিয়েও বোলিংয়ে সতর্ক ছিল বাংলাদেশ। দলের অন্যতম সেরা দুই বোলার মুস্তাফিজুর রহমান ও সাকিব আল হাসানকে শুরুতেই কাজে লাগাননি অধিনায়ক মাশরাফি। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাদেরকে হাতে রেখে নিজে ও মেহেদী হাসান মিরাজকে দিয়ে শুরুর কাজ করেছেন। সঙ্গে ছিলেন রুবেল হোসেন। যতটা পেরেছেন প্রতিপক্ষের ব্যাটিং লাইনআপকে চেপে ধরেছিল বাংলাদেশের বোলাররা।

খুব দ্রুত কিংবা খুব দেরিতে নয়; নিয়মিত বিরতিতে উইকেট নিচ্ছিল বাংলাদেশ। তবে উইকেট শিকারের বড় কাজটা মাশরাফিই করেছিলেন। ১০ ওভার বল করে খরচ করেন ৩৭ রান, তুলে নেন ৪ উইকেট। সমান সংখ্যক রান দিয়ে ১ উইকেট নিয়েছেন ডানহাতি স্পিনার মিরাজ। বাঁহাতি পেসার মুস্তাফিজ নিয়েছেন ২ উইকেট। ৭ ওভার বল করেছেন সাকিব। ছিলেন উইকেট শূন্য। সঙ্গে অন্যদের চেয়ে কিছুটা খরুচেও বটে। ৪৩ রান খরচ করেন তিনি।

স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে মাশরাফি নিজের অনুশীলনটা ঠিকভাবে করতে পারেননি। তাই  নিজের সামর্থ্যটা জানতেন। শুরুতে তাই লম্বা রান আপে বোলিং করেও রান আপ ছোট করে ফেলেন তিনি। এ নিয়ে মাশরাফির ব্যাখ্যা হলো,

আমি গত দুই-তিন মাসে সেভাবে বোলিং করতে পারিনি। লম্বা রান আপে অনুশীলনও করতে পারিনি। তাই আমার জন্য কঠিন ছিলো পুরো ব্যাপারটা। এমন সময় আসতেই পারে। যদিও মাঠে উপভোগ করেছি আমি।

সেঞ্চুরির পর তামিম ইকবাল; Image Source: AFP

তামিমের ব্যাটে সেঞ্চুরি এলেও, তার ধীরগতির ব্যাটিং সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু নিন্দুকদের মুখে ছাই দিয়েছেন বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা এই ব্যাটসম্যান। উইকেটে রান তোলাটা কত কঠিন ছিল সেটা জানিয়ে দিয়েছেন সবাইকে। বলেছেন, 

যখন আমরা ব্যাটিংয়ে নামি, সময়টা খুব কঠিন ছিল। ভালো অবস্থানে যেতে আমাকে ও সাকিবকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। বিশেষ করে প্রথম ২৫ ওভারে বল ঘুরছিল, খেলাটা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যতক্ষণ পারা যায় খেলার চেষ্টা করছিলাম আমরা। সফলও হয়েছি। রান তোলা অনেক কঠিন ছিল সেই উইকেটে।

ম্যাচ নিয়ে ব্যবচ্ছেদ যতই হোক, সফল হয়েছে বাংলাদেশ। যে আগুন মাশরাফি সবার মধ্যে জ্বালিয়ে দিয়েছেন, সেটা পুরো সিরিজে জ্বলতেই থাক। বাংলাদেশ সফল হতেই থাকুক এই মন্ত্রণায়।

ফিচার ইমেজ- Getty Images

Related Articles