উত্তর-পূর্ব ইংল্যান্ডের একটি শহর নিউক্যাসল। সেই নিউক্যাসলের গসফোর্থে অ্যানি ও অ্যালান পেতেছেন লাল-নীল ভালোবাসার সংসার। একঘেঁয়ে ও কঠিন জীবন। শ্রমজীবী মানুষের সংসার যেমন হয়, স্বচ্ছলতা নেই পুরোপুরি, আবারও অভাবও গেঁড়ে বসেনি সেভাবে। ভালোবাসা আছে, আছে নিজেদের মতো আনন্দ খুঁজে নেয়ার উপকরণ। অ্যালানের সবচেয়ে আনন্দমুখর সময় কাটে ফুটবলের সঙ্গে। তিনি মনে করেন, ফুটবল খেলাটির মতো সুখের ব্যাপার পৃথিবীতে আর নেই। জীবনের সব লেনাদেনা চুকিয়ে যদি গোল বলটার সঙ্গে সময় কাটানো যেত, তাহলেই সবচেয়ে ভালো হতো।
অ্যানি সন্তানসম্ভবা। অ্যালান উদ্বিগ্ন হন স্ত্রীর জন্য, অনাগত সন্তানের জন্য। সকল জল্পনার অবসান ঘটিয়ে টানাপোড়েনের সংসারে নতুন অতিথির আগমন ঘটে; পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান, নাম রাখা হয় অ্যালান শিয়ারার। সময়কাল তখন ১৩ই আগস্ট, ১৯৭০।
ছোট্ট অ্যালান দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠে। হাঁটতে শেখে, কথা বলতে জানে, বাবা ডাকতে পারে। একসময় গিয়ে সে বোঝে, সারাদিন মস্ত খাটেন বাবা। ঘরে ফিরে ছেলেকে সময় দেয়ার ফুরসত মেলে না; তবে যেটুকু সময় বাবার সঙ্গে কাটে, বাবা ফুটবলের গল্প করেন। বাবার ফুটবলপ্রেম সঞ্চারিত হয় ছেলের মধ্যে। গোল বলটায় লাথি মারতে শেখে সে। ফুটবলের সঙ্গে ভাব জমে, দোস্তি হয়। বাবা সপ্তাহান্তে ফুটবল ম্যাচ দেখেন, ছেলেকে ফুটবলের পথে চলতে শেখান, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ছক কষেন — ছেলেকে তিনি বড় ফুটবলার বানাবেন। বাবার স্বপ্নের চারাগাছ ছেলের বুকে অঙ্কুরিত হয়। বয়সের সঙ্গে ধীরে ধীরে বাড়ে তা, দক্ষ মালীর মতো পরিচর্যা করেন বাবা, আর ছেলে পুষ্পপল্লবে সুগন্ধি-সৌরভে তা প্রস্ফুটিত করতে সামর্থ্যের সবটা ঢেলে দেন। মা তাকে আগলে রাখেন পরম মমতা ও ভালোবাসায়। নিম্নবিত্ত পরিবারে ছোট্ট গোল ফুটবলটি হয়ে উঠে স্বপ্নের সুবিশাল আকাশ, আর সে আকাশজুড়ে মহা-আনন্দে ফুটবল খেলতে খেলতে বড় হয় ছোট্ট অ্যালান শিয়ারার।
ছেলেবেলা থেকেই দারুণ ফুটবল খেলে সে; স্কুলে, পাড়ায় বা গলিতে। স্কাউটদের নজরে পড়ে যায় দ্রুত। নিউক্যাসলের হয়ে খেলার আজন্ম লালিত স্বপ্ন। ট্রায়াল দিতে যায় ক্লাবের জুনিয়র টিমে। কিন্ত কপাল মন্দ হলে যা হয়, টিকল না সে। ম্যানচেস্টার সিটি, ওয়েস্ট ব্রমউইচও কোথাও মিস করে গেল তার দক্ষতা। কিন্তু ভুল করল না সাউদাম্পটন ফুটবল ক্লাব। জ্যাক হিক্সন সাউদাম্পটন ক্লাবের স্কাউট, জহর চিনতে দেরি হয় না তার। হিক্সনের জোরাজুরিতে ‘কিশোর’ অ্যালান শিয়ারার সেই ক্লাবের সঙ্গে যোগ দেয়, ইয়ুথ টিমের হয়ে ট্রেনিংয়ে অংশ নেয়। আস্তে আস্তে ক্লাবের মূল দলে প্রবেশের পথ সুগম হয় তার। শৈশবের স্বপ্নটা পেখম মেলে ওড়ার অপেক্ষায়; একদিকে বাবার আনন্দ, আর অন্যদিকে ছেলের উত্তেজনা — ফুটবলের সবুজ নন্দনে পিতা-পুত্রের এক রোমাঞ্চকর অধ্যায়ের অভিযাত্রা!
দুরু দুরু বুকে চেলসির বিপক্ষে বদলি হিসেবে নেমে শুরু হলো মূল দলের হয়ে প্রথম দৌঁড়। সাউদাম্পটন এফসির হয়ে তারপর সে দৌঁড় চললো পরের আরো চারটি বছর। অভিষেকের মাসখানেকের মধ্যে হ্যাটট্রিক, প্রতিপক্ষ আর্সেনাল। বয়স মাত্র ১৭ তখন, শরীরজুড়ে কৈশোরের গন্ধ। তবে অমন দুর্দান্ত সূচনার ধারাবাহিকতা না থাকলেও, খুব একটা মন্দ নয় তার মাঠের পারফরম্যান্স। জীবনের মঞ্চেও ড্রিবলিং, নান্দনিকতার প্রয়োজন দেখা দিল; রঙিন বাঁকের সন্ধান পেল সে। উত্তরের ছেলে দক্ষিণে গিয়ে প্রেমে পড়ল। মনপ্রাণ উজার করে দিল ‘লাইনিয়া’ নামের তরুণীর জন্য। বছরখানেকের মধ্যেই প্রেম পেরিয়ে সম্পর্কের পরিণতি রূপ নিল বিয়েতে। ১৯৯১ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসলো সে। খুব শীঘ্রই আরো নতুন রোমাঞ্চকর ও চ্যালেঞ্জের সামনে পড়বে সে, খুব করে দরকার হবে বৌ-ভাগ্যেরও। পাবে তো?
ইংল্যান্ডের দক্ষিণের ক্লাবটায় সময় একরকম চলেই যাচ্ছিল অ্যালানের। নতুন সংসার, স্ত্রী, পরিবার নিয়ে উপভোগ্য সময় যাচ্ছে তার জন্য। কিন্তু ক্লাব কর্তৃপক্ষ জানেন, তার প্রস্থান অনিবার্য। এই মানের ফুটবলার ধরে রাখতে পারবে না তারা। স্ট্রাইকার হলেও অনেক সময় মিডফিল্ডার বনে যায় সে, গোল তৈরি করে সতীর্থের জন্য বাড়িয়ে দেয়। প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডার থেকেও বল কেড়ে নিতে ওস্তাদ। উল্টোপাল্টা ট্যাকল করে কার্ডও দেখতে হয় বটে; তবে আপাদমস্তক টিমম্যান সে, গা করে না ওসব।
শিয়ারারের শরীরে পরিপূর্ণ তারুণ্যের ছাপ স্পষ্ট; ‘সে’ থেকে ‘তিনি’তে রূপান্তর করতেই হয় এবার। ১৯৯২-এর গ্রীষ্মে সাউদাম্পটন ছাড়লেন অ্যালান শিয়ারার। নতুন গন্তব্য ব্ল্যাকবান রোভার্স। সেখানেও শুরুটা দুর্দান্ত করলেন। ২১ ম্যাচে করলেন ১৬ গোল। কিন্তু ইনজুরি কেড়ে নিল সিজনের বাকি সময়।
কিংবদন্তি গ্যারি লিনেকার অবসরে গেছেন। শিয়ারারকে ইংল্যান্ড জাতীয় দলে বড্ড প্রয়োজন। অথচ এই হতভাগা ইনজুরি কি না তাকে স্বদেশের প্রতিনিধিত্বের সময়ে বাদ সাধল! অনূর্ধ্ব-২১, ইংল্যান্ড-বি দল হয়ে জাতীয় দলের জন্য প্রস্তুতি সেরে নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৪ বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব পেরোতে ইংল্যান্ডের ব্যর্থতার উল্টো পিঠে শিয়ারারের অভাবই যেন আরো প্রকট হয়ে ধরা দিল।
ইনজুরি থেকে সেরে উঠে ব্ল্যাকবান রোভার্সে নিজেকে পূর্ণরূপে মেলে ধরলেন শিয়ারার। নিয়মিত গোল পেতে থাকেন, শারীরিক উচ্চতা কাজে লাগিয়ে হেড থেকে গোল করা হয়ে যায় সাধারণ চিত্র। ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের রানার্সআপ হয় তার দল। গড়ে প্রায় ম্যাচপ্রতি গোল করেন তিনি। ভয়ঙ্কর জুটি গড়ে তোলেন ক্রিস শাটনের সঙ্গে। এই দু’জনের উড়ন্ত ফর্মে ভর দিয়ে ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে প্রায় আশি বছর পর প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা ঘরে তোলে ব্ল্যাকবান রোভার্স। টানা দু’বার সর্বোচ্চ গোলদাতা হন শিয়েরার। নাম, যশ, খ্যাতি, অর্থ-সম্পদ সমস্ত লুটায় তার পায়ে। ইউরোপের বড় বড় বহু দল তাকে চায়। এমন একজন ‘গোলমেশিন’ দলে কে না ভেড়াতে চাইবে?
কিন্তু অ্যালান শিয়ারার ভাবলেন ভিন্ন। পরিবার অন্তঃপ্রাণ তিনি; বাচ্চা, বৌ, পিতামাতা, বন্ধু-আত্মীয় সেসবের টান বড্ড বেশি অনুভব করেন। ইংল্যান্ডের বাইরের শত প্রলোভনের প্রস্তাব তাই ‘নাকচ’ করে দেন অনায়াসে। বরং নিউক্যাসল যখন তার জন্য দুয়ার খুলে দেয়, সেই ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা তার থাকে না। সেই সময়ের রেকর্ড ট্রান্সফার ফি-তে যোগ দেন আশৈশব লালিত স্বপ্নের ক্লাব নিউক্যাসল ইউনাইটেডে। ঘরের ছেলে আর এদিক-সেদিক না ঘুরে ফিরে আসেন নীড়ে।
তারপরের গল্পটা যে ফেভিকলের মজবুত জোড়ের চমৎকার বিজ্ঞাপন হতে যাচ্ছে তা নিশ্চয় জানার কথা নয় তার! নিউক্যাসলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলের মালিক হবেন, পরের এক দশক নড়বেন না আর কোথাও, বিদায় নেবেন এখান থেকেই… ক্লাবের মাঠের বাইরেই দাঁড়িয়ে যাবে তার সুদৃশ্য স্ট্যাচু; এত কিছু যিনি গল্পটা লিখেছেন, তিনি জানলে জানবেন। কিন্তু গল্পের চরিত্র জানবেন কীভাবে?
সে বছরই — যে বছর নিউক্যাসলে যোগ দিলেন, ইংল্যান্ডের হয়ে ইউরোতে গোল্ডেন বুট জিতলেন শিয়ারার। গ্রুপপর্বের প্রত্যেকটি ম্যাচেই গোল করেছেন, কোয়ার্টার ফাইনালে গোল করতে পারেননি, দলও গোল পায়নি। গোলশূন্য ম্যাচে টাইব্রেকারে জিতে ইংল্যান্ড সেমিফাইনালে। সেখানে তিন মিনিটেই গোল করে জার্মানির বিপক্ষে দলকে এগিয়ে দিলেন অ্যালান, কিন্তু অদম্য জার্মানরা ‘হার না মানা’ লড়াই উপহার দিয়ে ঠিক ম্যাচে ফেরে। পরে টাইব্রেকারে যায় ম্যাচ। পেনাল্টি শ্যুটআউটের প্রথমটিই গোল করে সেখানেও দলকে লিড এনে দেন তিনি। ৫-৫ হওয়ার পর ছয় নম্বরটি মিস করে বসে ইংল্যান্ড, জার্মানি সেই ভুল করে না। সেই আসরে অ্যালান শিয়ারের দল ‘তৃতীয়’ হয়েই শেষ করে ঘরের মাঠের ইউরো মিশন।
নিউক্যাসল যেমন তাকে চেয়েছে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডও তেমনি চেয়েছে তাকে। আর সব দলগুলোও যে চায়নি, তেমন নয়; কিন্তু তার নিজের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল এই দু'টি ক্লাব। ম্যানইউতে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের কোচিংয়ে খেলতে পারবেন, তিনি তার অসম্ভব গুণমুগ্ধ একজন; কীভাবে সুযোগটা হেলায় হারাবেন? মনের দোদুল্যমানতায় যখন সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন, তখন নিউক্যাসল ম্যানেজারের টোপ — গসফোর্থে জন্মেছো তুমি। বেড়ে ওঠা এখানে। এখানেই তোমার নাঁড়িপোতা। বন্ধু, স্বজন সবাই এখানকার। এই অঞ্চলের মানুষদের প্রতি একটা দায়িত্ববোধ আছে তোমার…
মন বদলে যায় অ্যালানের। প্রাণের ক্লাব, শৈশবের ক্লাব, বাবার পছন্দের ক্লাবের হয়ে খেলবেন তিনি। একসময় এই ক্লাবে গোলকিপার হিসেবে ট্রায়াল দিয়েছিলেন, ‘কিশোর’ শিয়ারার ব্যর্থ মনোরথে ফিরে গিয়েছিল, আর আজ সেই ক্লাব তাকে বরণ করে নিয়েছে সবচেয়ে দামী ফুটবলারের স্বীকৃতি দিয়ে। ছেলেবেলায় বুকে ফুটবল নিয়ে ঘুমুতে যাওয়ার সময় বরাবর যে স্বপ্ন দেখেছেন, তা-ই বাস্তবে রূপ নিয়েছে। কে বলে, স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থাকে?
ব্ল্যাকবান রোভার্সের দুর্দান্ত ফর্ম নিউক্যাসলের হয়েও অনূদিত করেন তিনি। মাঠে নামা এবং গোল করা প্রায় সমর্থক হয়ে উঠে তার ক্ষেত্রে। টানা চারবারের মতো সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় ওঠে নাম। ১৯৯৭ সালেও পিএফএ প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার ওঠে তার হাতে, প্রথম ফুটবলার যিনি ভিন্ন দুটি ক্লাবের হয়ে এই পুরষ্কার পেয়েছেন। এই সময় ইনজুরি হানা দিয়ে ছন্দপতন ঘটাল ক্যারিয়ারে। পরের মৌসুমে সেভাবে মেলে ধরতে পারলেন না। কোচের সঙ্গে বনিবনা না হওয়া, কোচ বদল, নতুন কোচ, শৃঙ্খলাজনিত বিতর্ক… নানানভাবে সময়টা ভালো যায়নি তার। তবে মাঠের ফুটবলে ধীরে ধীরে ফিরে পেতে শুরু করেন।
১৯৯৮ সালে ফ্রান্সে যান বিশ্বকাপ খেলতে — প্রথম ও একমাত্র। প্রতিটি ফুটবলারের আজন্ম লালিত স্বপ্ন — স্বদেশের জার্সি গায়ে বিশ্বমঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করা। দ্বিতীয় রাউন্ডে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে সমতাসূচক গোলটির আগে গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচে তিউনিশিয়ার বিপক্ষে পেয়ে গেছেন তার প্রথম বিশ্বকাপ গোল। পেনাল্টি শ্যুটআউটে বিদায় হয় সেবারও, ঠিক '৯৬ ইউরোর মতো। শিয়ারার যে বড় মাপের খেলোয়াড়, তা প্রতিটি বড় মঞ্চে প্রমাণ করেন। গোল করা তার কাছে যেন নেশার মতো।
বয়স ত্রিশের কোঠা ছুঁয়েছে, তবে মাঠের পারফরম্যান্সে খুব একটা পরিবর্তন নেই। শিয়ারার তেমনি ক্ষুধার্ত, গোলের জন্য সেই কুড়ি বছরের ছোকরার মতো মরিয়া। নিউক্যাসলের হয়ে পরপর দুই মৌসুম — ১৯৯৭-৯৮ ও ১৯৯৮-৯৯ এফএ কাপের ফাইনালে উঠেও হেরে গেছেন। তবে দু’বারই সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় প্রথম নামটি তার।
আন্তর্জাতিক ফুটবলের প্রথম হ্যাটট্রিক পেয়েছেন লুক্সেমবার্গের বিপক্ষে, ২০০০ সালের ইউরোর বাছাইপর্বে। ওয়েম্বলি বহু ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী। ইংলিশ ফুটবলের বহু দাপট ও অপমানের উপাখ্যান হয়ে আছে এই স্টেডিয়াম। আগের ইউরোতে এই ঘরের মঞ্চে, এই ওয়েম্বলিতে জার্মানির বিপক্ষে টাইব্রেকারে সেমিফাইনাল হেরেছিলেন। আর সেই ওয়েম্বলিতে পূর্ণ হলো তার হ্যাটট্রিক — যা তার ক্যারিয়ারে একমাত্র।
ইউরো ২০০০ আসরের যৌথ আয়োজনের দায়িত্বে বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ড। প্রথম ম্যাচেই পর্তুগালের বিপক্ষে পরাজয় দিয়ে শুরু, দ্বিতীয় ম্যাচে জার্মানির বিপক্ষে ১-০ গোলের জয়ে একমাত্র গোলটির মালিক অ্যালান শিয়ারার। ১৯৬৬ বিশ্বকাপের পর কোনো বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় জার্মানিকে হারালো ইংল্যান্ড। রোমানিয়ার বিপক্ষে ৩-২ গোলে হেরে ইউরোযাত্রা শেষ হয়ে যায় ইংল্যান্ডের, সেখানেও একটি গোল শিয়ারারের। তবে সেটিই শেষ গোল, এবং আন্তর্জাতিক ফুটবলেরও শেষ ম্যাচ। ৬৩ ম্যাচে ইংলিশ ফুটবলের পঞ্চম সর্বোচ্চ ৩০ গোল নিয়ে অ্যালান শিয়ারার টেনে দেন দাড়ি। ৩৪ ম্যাচে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন। তারপর বিশ্বকাপ ২০০২ বা ইউরো ২০০৪ আসরের জন্য অবসর ভেঙে ফেরার গুঞ্জন উঠলেও সত্যি হয়নি। অ্যালান শিয়ারারের ইংল্যান্ড-অধ্যায় শেষ এখানেই।
জাতীয় দলের হয়ে সম্পর্ক চুকিয়ে দিলেও নিউক্যাসলের সঙ্গে সম্পর্কে যবনিকাপাত ঘটতে ঢের দেরি। উত্তর ইংল্যান্ডের দলটির হয়ে সর্বোচ্চ নিংড়ে দেন তিনি। গোল করেন, গোল করান। একটি ট্রফি জিততে চান, কিন্তু পারেন না। সেই কবে বহু বহু বছর আগে প্রিমিয়ার লিগ জিতেছে দলটি, বড় কোনো টুর্নামেন্ট জিতেছে বহুকাল হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত শো-কেস পরিপূর্ণ, দলের হয়ে জেতা বাকি। সমর্থকদের উপহার দিতে চান প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ স্মারক। প্রতিদান দিতে চান ভালোবাসার। কিন্তু পারেন না। ক্লাবের ইতিহাসে তিনবার বর্ষসেরা খেলোয়াড় হয়েছেন, সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরষ্কার জিতেছেন, যে ট্রফির জন্য ছিল আক্ষেপ ও আকুতি, তা-ই জেতা হয়নি। ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে খুব কাছে গিয়েও পারেননি, রানার্সআপ হওয়াটাই ছিল পরিণতি।
শরীরে কামড় বসিয়েছে বয়স। আগের মতো দাপিয়ে বেড়াতে পারেন না। চাইলেও তাই আর প্রাণপ্রিয় ক্লাবের সঙ্গে খেলোয়াড়ি সম্পর্ক রাখার জো নেই। এর মধ্যে আবার পড়েছেন ইনজুরিতে, সে সময়ই জানিয়ে দিলেন — বিদায়। পেশাদারি ফুটবলকেই ‘শেষ’ বলে দিয়েছেন। তবে তার আগে প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন ২৬০টি গোলের মালিকানা নিয়ে, যার মধ্যে ২০৬টি করেছেন নিউক্যাসলের হয়েই। বলাই বাহুল্য, ক্লাবের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তা। তার অর্জন ও নিবেদনের স্বীকৃতিস্বরূপ ক্লাবের সম্মুখে দাঁড়িয়ে গেছে সাড়ে ন’ফিট উচ্চতার ভাস্কর্য। গোলের পর সমর্থকদের দিকে ছুটে গিয়ে এক হাত তুলে আর অন্য হাত বুকে রেখে যে ট্রেডমার্ক সেলিব্রেশন ছিল, তা-ই শোভা পাচ্ছে ভাস্কর্যের ভঙ্গিমায়।
তার সম্মানে ফেয়ারওয়েল ম্যাচ আয়োজন করে ক্লাব কর্তৃপক্ষ, ইনজুরি-আক্রান্ত হওয়ায় সেই ম্যাচ খেলা হয় না তার। সেল্টিকের বিপক্ষে ‘ফেয়ারওয়েল’ ম্যাচের আগে ১৭ই এপ্রিল সান্ডারল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি খেলেছেন তার শেষ ম্যাচ। ক্যারিয়ারের শেষ গোলটিও করেছেন সেখানে। হাঁটুর ইনজুরিটা তাকে আর গোল বলটার পিছু চলার আনন্দ দৌড়ে অংশ নিতে দেয়নি। সময়কাল তখন ১১ই মে, ২০০৬; ঘটলো প্রায় দেড়যুগ আগে যে অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল তার ইতি। তবে গল্পের শেষ নেই, তা আরেকটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশের উপলক্ষ মাত্র।
খেলা ছাড়লেও ফুটবল ছাড়া হয়নি তার। কোচ, ম্যানেজার, ধারাভাষ্যকার… ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়ে বারবার ফিরে এসেছেন ফুটবলের মঞ্চে। বাবা তার হৃদয়ে ফুটবল খেলাটির প্রতি যে প্রেম ও ভালোবাসা প্রোথিত করে দিয়েছিলেন, তার বুঝি কোনো শেষ নেই। তার বাবার মতোই অ্যালান শিয়ারারের দৃঢ় বিশ্বাস — ফুটবল খেলাটির মতো সুখকর ব্যাপার দুনিয়ায় আর কিছু নেই।
This article is in the Bengali language, a short biography of Alan Shearer - The English Football Legend; This feature is a tribute to him.
Featured Image: Getty Images