৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯। সকাল গড়িয়ে দুপুর হচ্ছে। বিসিবি একাডেমি মাঠে ক্রিকেটারদের মেলা। মাঠের চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জাতীয় ক্রিকেট লিগের (এনসিএল) অনুশীলনে ব্যস্ত অন্তত জনা-পঞ্চাশেক ক্রিকেটার। এর মাঝেই নীরবে একাডেমি মাঠে ঢুকলেন আলিস আল ইসলাম, যা খুব বেশি নজর কাড়েনি অন্য ক্রিকেটারদের, এমনকি মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাংবাদিকদেরও। টিভি চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান কিংবা আলোকচিত্রীদের মাঝেও আগ্রহের রেশ দেখা যায়নি তাকে ঘিরে।
আলিসকে দেখে অবশ্য ক্রিকেটার শাহবাজ খান (সাবেক ক্রিকেটার জাভেদ ওমর বেলিমের ভাগ্নে, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলেন) ডাক দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন,
‘আরে আলিস, কী খবর ভাই, তুমি তো বড় ক্রিকেটার, দেখা যায় না আজকাল, বড় স্পিনার।’
শাহবাজ খানের কথা শুনে যেন কিছুটা লজ্জাই পেলেন আলিস। দ্রুতই ‘না ভাই, না ভাই’ করতে করতে শাহবাজকে টেনে নিয়ে গেলেন একাডেমি মাঠের আরেক প্রান্তে।
অথচ বছরের শুরুতে (১১ জানুয়ারি, ২০১৯) এই আলিসই নাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অলিগলির খবর রাখা দুঁদে সাংবাদিকও সেদিন ঘোল খেয়েছিলেন। আলিস, আলিস, আলিস… কে এই আলিস? মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সজুড়ে ছিল একটাই কথা। মাথা চুলকে, স্মৃতির পাতা হাতড়েও এই নামের সঙ্গে পরিচয়ের কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাননি জ্যেষ্ঠ্ সাংবাদিকরা। অনেকে আবার এই আলিস বাংলাদেশী কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছিলেন।
প্রেসবক্সের এই আলোচনার রেশ যেন গোটা বাংলাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছিল। আলিসের বৃত্তান্ত খুঁজতে উঠেপড়ে লেগেছিল সাংবাদিকসহ ক্রিকেট অনুরাগীরা। অবশ্য রাত পোহাবার আগেই তার সম্পর্কে জেনে গিয়েছিল বাংলাদেশ।
অখ্যাত আলিসকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণও ছিল। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অভিষেকেই হ্যাটট্রিক ছিল না কোনো বোলারের। সে হোক ঘরোয়া, কি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে। সেদিন কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) রংপুর রাইডার্সের বিরুদ্ধে অভিষেকেই হ্যাটট্রিক করে ফেলেছিলেন ঢাকা ডায়নামাইটসের হয়ে খেলতে নামা আলিস। তার অফস্পিনের ঘূর্ণিতে দিক হারায় রংপুর। মোহাম্মদ মিঠুন, মাশরাফি বিন মুর্তজা, ফরহাদ রেজাকে সাজঘরে পাঠিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েন এই তরুণ। ২৬ রানে চার উইকেট নিয়ে অভিষেকটা স্মরণীয় করেছেন ম্যাচসেরা হয়ে। যদিও ওই ম্যাচেই তার বোলিং অ্যাকশন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন আম্পায়াররা। ত্রুটিপূর্ণ বোলিং অ্যাকশনের জন্য রিপোর্টেড হয়েছিলেন এই তরুণ। তারপর আরও তিনটি ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি।
নেট থেকে তুলে এনে ‘অচেনা’ আলিসকে ক্রিকেটে পরিচিতি দেয়া এবং গোটা বাংলাদেশকে চমকে দেয়ার মূল কৃতিত্বটা ছিল ঢাকা ডায়নামাইটসের কোচ, বিসিবি পরিচালক ও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজনের। নেটে দলের অনুশীলনে আলিসের বোলিং দেখে মুগ্ধ হন সুজন। দ্রুতই এই অফস্পিনারকে দেশীয় কোটায় দলভুক্ত করেন তিনি।
ওই সন্ধ্যার আগে ক্রিকেটে আলিসের দৌড় ছিল ঢাকার প্রথম বিভাগ ক্রিকেট পর্যন্ত। ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগেও কখনো খেলা হয়নি সাভারের বলিয়ারপুরে বেড়ে উঠা এই তরুণের। কাঠালবাগান গ্রিন ক্রিসেন্ট ক্লাব দিয়ে ঢাকার ক্রিকেটে তার যাত্রা শুরু। পরে দ্বিতীয় বিভাগ ও প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগে খেলেছেন তিনি। সঙ্গত কারণেই দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে তার পরিচিতি তেমন একটা ছিল না।
হঠাৎ করেই পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসা আলিস বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেননি বিপিএলে। আলোর মঞ্চে তিনি স্থায়ী হয়েছিলেন মাত্র আটদিন, ম্যাচ খেলেছিলেন চারটি। সিলেটে বিপিএলে নিজের চতুর্থ ম্যাচেই ইনজুরিতে পড়েন এই অফ স্পিনার। সিলেট সিক্সার্সের বিরুদ্ধে ম্যাচে হাঁটুর ইনজুরিতে পড়ে বিপিএল থেকেই ছিটকে পড়েছিলেন তিনি।
সেই ইনজুরির ধাক্কায় ক্রিকেট থেকে লম্বা সময় বিরতি নিতে হয়েছে তাকে। প্রায় আট মাস পেরিয়ে গেছে। এখনও ২২ গজের রঙ্গমঞ্চে ফেরার লড়াইয়ে আছেন আলিস। তার মতে, এখন প্রায় ৮০-৮৫ ভাগ ফিট তিনি। ২২ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার অনুশীলন শুরু করেছেন, বোলিং করছেন, ফিটনেস নিয়েও কাজ করছেন। অমন শুরুর পরও ইনজুরির দুর্ভাগ্যে আড়ালে চলে গিয়েছিলেন। প্রতিশ্রুতিশীল এই বোলার অনায়াসেই হয়তো বিসিবির কাঠামোতে চলে আসতে পারতেন, নির্বাচকদের নজরে থাকতেন। কিন্তু ইনজুরির কারণে উল্টো মঞ্চ থেকে ছিটকে পড়েন।
বিসিবি একাডেমির জিমে নিজের সার্বিক অবস্থান নিয়ে কথা বলেছেন বিপিএলে অভিষেকেই বল হাতে বিস্ময় ছড়ানো আলিস।
আলিস কেমন আছেন এখন?
এই তো, আছি আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।
বিপিএলে ইনজুরিতে পড়েছিলেন। তারপর কীভাবে সময় কাটল? কোথায় সার্জারি করেছেন?
ভারতে সার্জারিটা হয়েছে, মার্চ মাসের ২৭ তারিখে। তারপর রিহ্যাবে ছিলাম। সব মিলিয়ে ২ মাস আগে রানিং, বোলিং শুরু করেছি। এখন ইনশাল্লাহ ভালো আছি। রিহ্যাবে কাজ করেছি, ফিল্ডিং-ফিটনেস নিয়েও কাজ করেছি।
জাতীয় লিগ খেলবেন?
না, জাতীয় লিগ খেলব না।
অনুশীলন কোথায় করছেন?
আমি অনুশীলন করছি রাজশাহীতে বাংলা ট্র্যাক ক্রিকেট একাডেমিতে (যার হেড কোচ খালেদ মাহমুদ সুজন)। মাঝে মাঝে ঢাকায় যখন আসি বাসায়, তখন মিরপুর আসি।
বোলিং শুরু করেছেন ঠিক কতদিন আগে?
রিহ্যাবের পর বোলিং শুরু করেছি দেড় মাস হবে।
আগের ছন্দ কি ফিরে পাচ্ছেন?
এখনও পুরোপুরি না। পুরো শতভাগ ফিট হইনি, ৮০ ভাগ বলতে পারেন। আমাদের যে ফিজিও মোহন ভাই বলেছে, আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে আমি পুরো ফিট হতে পারব।
বিপিএল দিয়ে আপনাকে চিনেছে পুরো বাংলাদেশ। সামনে আরেকটা বিপিএল আসছে। বিপিএল দিয়েই কি ফেরার চিন্তা করছেন?
এখন বিপিএল নিয়েই চিন্তা-ভাবনা করছি। এজন্য প্রস্তুত হচ্ছি। ফিটনেস লেভেলটা সেভাবে তৈরি করার চেষ্টা করছি। স্ট্রেন্থ বাড়ানোর কাজ করছি। সব মিলিয়ে হার্ড ওয়ার্ক করছি।
বোলিং অ্যাকশনের পরীক্ষা কি দিয়েছেন?
বোলিং অ্যাকশনের পরীক্ষা দিতেই আসলে ঢাকায় আসা এখন রাজশাহী থেকে। নাসু স্যার (নাসির আহমেদ নাসু) যখন শ্রীলঙ্কা থেকে ঢাকা আসবেন, তখন পরীক্ষা দিব। পরীক্ষা ১৫-২০ তারিখের মধ্যে হতে পারে এই মাসে।
নেট বোলার থেকে বিপিএলে ঢাকা ডায়নামাইটসের জার্সিতে স্বপ্নের শুরু। ওই সময়ের কথা মনে পড়লে কেমন লাগে?
অবশ্যই ভালো লাগার মতোই ছিল। সব কিছু উপভোগ করার মতোই ছিল। যে সময়টুকু এখানে ছিলাম, খুবই উপভোগ করেছি।
এখন কি মনে হয়, ওই জায়গায় আবার যেতে পারবেন?
আসলে ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব, আগের মতো, আগের জায়গায় ফিরে আসার জন্য। আশা করি, হবে।
অফ স্পিনার হিসেবে আপনার শক্তির জায়গা কোনগুলো?
টি-টোয়েন্টি খেলাতে আপনারা জানেন ডট বল বেশি কার্যকর। আমি ডট বল করার চেষ্টা করি বেশি। ব্যাটসম্যান তো ব্যাটসম্যানের কাজ করবে। ব্যাটসম্যান মারবে, আমার কাজ ডট বল করে যাওয়া। ব্যাটসম্যান ছক্কা মারবে, মারুক।
আপনার বিশেষ ডেলিভারি তো ক্যারম বল। অনেকে বলে, আপনি দুসরা করেন...
আমি যে বলটা করি, সেটা দুসরা না। অনেকে মনে করে, দুসরা। আমারটা আসলে ক্যারম বল। আর ক্যারম বল এখন অনেকেই করে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের নারাইন করে, আফগানিস্তানের মুজিব-উর রহমান করে। আমিও করি। ক্যারম বলই আমার মূল শক্তি।
ইনজুরির পর আর কোথাও খেলেছেন?
ইনজুরি হওয়ার পর এখনও মাঠে নামিনি খেলার জন্য। যখন আবার বাংলা ট্র্যাক একাডেমিতে যাব, তখন ম্যাচ খেলব।
অফ স্পিনার হিসেবে কাকে আদর্শ মানেন?
আমার আদর্শ খেলোয়াড় হচ্ছে সুনীল নারাইন। তাকেই আমি অনুসরণ করি। বাংলাদেশের ভেতর বলতে গেলে আমি চাই যে, আমি সাকিব ভাইয়ের মতো একজন অলরাউন্ডার হবো। সাকিব ভাইয়ের মতো হতে চাই।
নারাইনের সঙ্গে তো ঢাকা ডায়নামাইটসে একই ড্রেসিংরুমে ছিলেন। বোলিং নিয়ে কথা হয়েছে কি ওর সাথে?
হ্যাঁ, বোলিং নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। অনেক টিপস দিত, কীভাবে বোলিং করতে হয়, কীভাবে উন্নতি করা যায়। আমাকে বেশ পছন্দও করতো।
রাজশাহীর বাংলা ট্র্যাক একাডেমিতেই চলছে আলিসের ফেরার লড়াই। নিকট ভবিষ্যতে বল হাতে আগের ছন্দ ফিরে পাবেন কি না, তা বলা কঠিন। তবে এটুকু সত্য, এক সন্ধ্যায় গোটা দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনি।
This article is in Bangla language. It is on Aliss Al Islam, the wonder kid of the last BPL. Now that the Bangabandhu BPL is near at hand, this young off-spinner, currently struggling to recover from an injury, is camping on a rehab to prepare himself for this year's BPL. This piece is an interview of Aliss, where he talked about his struggle, his sweet memories and his philosophy towards the game.
Featured Image: Firoz Ahmed