Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

চীনা ক্রিকেটের জনক আমিনুল ইসলাম বুলবুল

হুট করে দেখলে চমকে যেতে হয়। মনে হবে ফেরিওয়ালা। পায়ে কেডস, পরনে হাতাকাটা সোয়েটার, পিঠে একটা ব্যাটের ব্যাগ আর হাতে ব্যাট নিয়ে রাজপথের এক পাশ ঘেঁষে হেঁটে চলেছেন একজন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, ব্যাপারটা খুবই পরিচিত। কিন্তু চীনের মতন দেশে এমন দৃশ্য যেন ‘এলিয়েন’ দেখার মতন। আর সেই লোকটা যদি হন আমিনুল ইসলাম বুলবুল তাহলে ক্রিকেট বিশ্বের যে কেউ এই দৃশ্য দেখলে সত্যিই চমকে উঠবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চমকটা দিতে পেরেছিলেন বুলবুল। সফলও হয়েছিলেন। চীন এখন ক্রিকেটকে চেনে। আর চেনে তাদের দেশের ক্রিকেটের জনক বুলবুলকে

চৈনিক মুল্লুকে বুলবুলের ক্রিকেট দীক্ষাদান; Source: Aminul Islam

চাঁদে মানুষ হিসেবে প্রথম পা ফেলেছিলেন নীল আর্মস্ট্রং। আর চীনে ক্রিকেট ব্যাট হাতে প্রথম পা ফেলেছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ অধিনায়ক, দেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরিয়ান, সাবেক অধিনায়ক, কোচ, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) গেম ডেভেলপমেন্ট অফিসার; একজন মানুষের কতগুলোই না পরিচয়। কিন্তু দিন শেষে তিনি একজন পর্যটক। ক্রিকেটের ইবনে বতুতা বললেও ভুল হবে না। চীনের মতন ক্রিকেটের ‘অজো পাড়াগাঁয়ে’ যাওয়ার ঝুঁকি কজন নামকরা ক্রিকেটারই বা নিতে চাইত তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু তাতে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন আমিনুল ইসলাম। বাঁধা ছিল ভাষা। দেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটাও শিখে নিলেন। সঙ্গে লেভেল-২ পর্যন্ত কোচিং ডিগ্রী নেওয়ায় ছিল। ফলাফল, ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মতো করে চীনাদের ক্রিকেট শেখাতে প্লেনে চেপে বসলেন। তারপর আর কী! এই রাজ্য থেকে সেই রাজ্য। কত সংগ্রাম, পরিশ্রম! বল-ব্যাট না চেনা একটি জাতিকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ক্রিকেট সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া, আগ্রহী করে তোলা; সবকিছুই করেছেন এই বাংলাদেশি মানুষটি। শুধু ক্রিকেট নয়, বাংলাদেশেরও গর্ব তিনি।

চীনে ক্রিকেট শুরু করার পিছনে যে পরিকল্পনা করেছিল এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এসিসি), সেটার বাস্তব রুপ দিয়েছেন বুলবুল। ব্যাডমিন্টন, রাগবী, ফুটবলের দেশে ক্রিকেট যেন বড্ড বেনানান। তার মধ্যেও পরিশ্রম করেছেন। এর পিছনে ক্রিকেটের স্বার্থ সামনে রেখেছেন বাংলাদেশের সাবেক এই অধিনায়ক, বুড়ো চার্লস ব্যানারম্যানের সঙ্গী। ক্রিকইনফোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি যদি ক্রিকেটকে চায়নাতে নিতে পারি, তাহলে ক্রিকেটের জন্যই ভালো হবে। এই ভাবনাটা শুরু থেকেই ছিল। কারণ, চায়না অনেক বড় দেশ, বিশ্বব্যাপী তাদের প্রভাবও অনেক। সেক্ষেত্রে চায়নাতে ক্রিকেট নিতে পারলেই সত্যিকার অর্থে ক্রিকেটের বিশ্বায়ন সম্ভব হবে।’

তিনি বলেছিলেন, ‘চায়নাতে কেউ কখনও ক্রিকেট খেলেনি। সেক্ষেত্রে আমি সেখানে নীল আর্মস্ট্রংয়ের মতো। আরেকটা ব্যাপার হল, চায়না যদি ক্রিকেটকে গুরুত্বের সাথে নিতে পারে তাহলে বিশ্ব বুঝবে, নতুন একটা জাতি ক্রিকেট খেলতে আসছে।’

ব্যাটটা কিভাবে ধরতে হবে, সেটা পর্যন্ত শিখিয়েছেন চীনে। Source: Aminul Islam

চীনে বুলবুলের ক্রিকেট শেখানোর প্রক্রিয়া নিয়ে একটা প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছিল এসিসি। সেখানে দেখা যায়, ছোট ছোট বাচ্চাদের ব্যাট কিভাবে ধরতে হয়, কিভাবে বল হাতে নিতে হয়, বল করতে হয়, ক্যাচ কিভাবে ধরতে হয়; ক্রিকেটের এসব সাধারণ ব্যাপার শেখাচ্ছেন। অথচ লেভেল-২ পাশ করা কোচ তিনি। বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা তারকা ক্রিকেটার। কোচ হিসেবে কাজ করেছেন আবাহনী লিমিটেডের মতো দলের সঙ্গে। বাংলাদেশ জাতীয় দল তো বটেই, যেকোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশের কোচ হওয়ার যোগ্যতাও রয়েছে তার। সেই তিনিই কিনা শিখিয়ে বেড়াচ্ছেন কিভাবে ব্যাট ধরতে হয়! খোলা চোখে ব্যাপারটি কৌতুক ও অপমানজনক মনে হতে পারে। কিন্তু বুলবুলের কাছে তা ‘ক্রিকেটকে এগিয়ে নেওয়া’। কোচ হিসেবে সবকিছুই করা লাগে। সেটা প্রাইমারি হোক কিংবা এলিট পর্যায়েরই হোক। চীনে সেটাই করতে চেয়েছেন আমিনুল ইসলাম।

চীন এখন ক্রিকেট চেনে, ক্রিকেট খেলে। ক্রিকেটের সাথে তাদের সখ্যতাও অনেক। এ দেশের কিছু ক্রিকেটার ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটেও অংশ নিচ্ছে। যে শুরুটা করেছিলেন আমিনুল ইসলাম, সেই সংগ্রামে যোগ দিয়েছেন আরও কিছু কোচ। যারা বিভিন্ন দেশের জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন, কোচিংয়ের ডিগ্রী নিয়েছেন। কিন্তু দিনশেষে চীনের ক্রিকেটে আমিনুল ইসলামই শেষ কথা।

শুধু চীন নয়, বুলবুল হলেন ক্রিকেটের পর্যটক। এসিসি থেকে এখন তিনি আইসিসির কর্মকর্তা। এশিয়া থেকে কাজের পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে সুদূর অস্ট্রেলিয়া মুল্লুক পর্যন্ত। ক্রিকেটের বিশ্বায়ন কিভাবে সম্ভব, সেটা নিয়েই তার কাজ। বাংলাদেশের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে আদর করে ডাকা হয় ক্রিকেটের ফেরিওয়ালা। উইন্ডিজ টি-টোয়েন্টি কিংবদন্তি ক্রিস গেইলও একই নামে পরিচিত। বুলবুলকেও ক্রিকেট ফেরিওয়ালা বলা হয়। কিন্তু সাকিব-গেইলরা বিশ্বজুড়ে ক্রিকেট খেলেন, আমিনুল ইসলাম ক্রিকেটের স্বার্থে বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়ান। পার্থক্যটা এখানেই।

এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (এসিসি) গেম ডেভেলপমেন্ট অফিসার বুলবুল কোচিং শেখাচ্ছেন; Source: Aminul Islam

আজ চীন তো কাল কুয়েতে ক্রিকেট নিয়ে সেমিনার করছেন, তো পরশু আবার মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর। ক্রিকেটই যেন জীবন, ক্রিকেটই পাথেয়। বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার মাইল ঘুরছেন শুধু ক্রিকেটের জন্য। মজার ব্যাপার হল, টানা কাজ করে যাওয়ার পিছনে তার যুক্তি কিন্তু বাংলাদেশকে ঘিরে! চাপ নিয়ে কাজ করা, ছুটি না নেওয়া; সবকিছুই বাংলাদেশে ফেরার জন্য।

এ প্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন, ‘আমি টানা কাজ করি এর পিছনে কারণ হল, আমি যেন লম্বা সময়ের জন্য ছুটি পাই এবং বাংলাদেশে আসতে পারি। একজন গেম ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, চায়না ও কুয়েতের মতো জায়গায় আমাকে কাজ করতে হয়।’

সাবেক কোচ গর্ডন গ্রিনিজের সঙ্গে; Source: Getty Image

দিন শেষে ফেরাটা বাংলাদেশে। সপরিবারে অনেক আগেই পাড়ি জমিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। এক ছেলে এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ায় বয়সভিত্তিক দলে খেলছেন। কিন্তু ক্রিকেটের সবটুকু আগ্রহ এই বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে। দেশের ক্রিকেটীয় সমস্যা, দুর্নীতি আর বিভিন্ন সময় বোর্ডের সাংঘর্ষিক  সিদ্ধান্তের বিপক্ষে মুখ খুলেছেন দৃঢ়চিত্তে। তাতে করে কর্তাব্যক্তিদের চোখের বালি হয়েছেন, অবহেলিত হয়েছেন। তারপরও থেমে থাকেননি। যেকোনো সময় বাংলাদেশের হয়ে কাজ করার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন। দীর্ঘদিন আগে থেকেই দেশের জাতীয় দলের কোচ হিসেবে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

সেই আগ্রহটা থাকতে পারত বিসিবির কর্মকর্তা হওয়ার। তার সমসাময়িক অনেকেই এখন বিসিবির গদি গরম করছেন কর্তাব্যক্তি হয়ে। সেখানে জাতীয় দলের কোচ হতে চাওয়ার আগ্রহ বুলবুলের। সেটার পিছনে দুটি কারণ দেখিয়েছেন এই ‘নান্দনিক’ ব্যাটসম্যান। তিনি বলেছেন, ‘আমার কোচিং ক্যারিয়ারে স্বপ্ন হল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে কোচিং করানো। আমি আমার কোচিং সামর্থ্য প্রমাণ করতে চাই। দ্বিতীয় ব্যাপার হল, আমি আমার দেশকে সাহায্য করতে চাই। দেশে তরুণ ক্রিকেটারদের নিয়ে একটি শক্তিশালী মিশেল গড়তে চাই।’

২০১৭ বিজয় দিবস ক্রিকেট ম্যাচে মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বুলবুল; Source: BCB

কিন্তু দুর্ভাগ্য, জাতীয় দল তো দুরের কথা, কোনো পর্যায়ের কোচ হতেই আমিনুলকে কখনও ডাকেনি বিসিবি। বাংলাদেশের ক্রিকেটে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের অবদান কখনই ভোলার নয়। জাতীয় দল থেকে নিভৃতে যে বিদায় নিয়েছিলেন ৩৪ বছর বয়সে, সেই আমিনুলে ভর করে এখন চীনারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বপ্ন দেখে, অনেক দেশের মরুভূমিতে উইকেটের জন্য ঘাস বানানো হয়।

যখন বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পেল, বিশ্ব ক্রিকেট নাকি বাংলাদেশকে নিয়ে মজা করেছিল। বলেছিল, বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছে কাগজে-কলমে। তাই ভারতের বিপক্ষে ২০০০ সালে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল নেমেছিল অস্তিত্ব ধরে রাখার লড়াইয়ে। আর সেই দায়িত্বটা নিয়েছিলেন বুলবুল। খেলেছিলেন ১৪৫ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। যদিও নয় উইকেটে সেই ম্যাচে জয় পেয়েছিল ভারত।

একটা কথা বলা হয়নি। বুলবুল কিন্তু ক্রিকেটের আগে ফুটবলার ছিলেন! সেটাও আবার পেশাদার ফুটবলার। পুরনোদের মুখে গল্প ফেরে, ক্রিকেটে না আসলে বুলবুলের কারণে নাকি বাংলাদেশ একজন জাত ফুটবল তারকা পেত। কেমন খেলতেন তিনি?

থাক, সে গল্প আরেকদিন হবে।

ফিচার ইমেজ- AFP

Related Articles