Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আমিনুল ইসলাম বুলবুল: স্বপ্ন দেখানো একটি নাম

দশম টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে টেস্টের কুলীন জগতে পর্দাপণ করছে বাংলাদেশ – দিনটা ১০ নভেম্বর, ২০০০ সাল। প্রতিপক্ষ টেন্ডুলকার-গাঙ্গুলি-দ্রাবিড়-জহির খান সমৃদ্ধ শক্তিশালী ভারত। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটের যাত্রায় নাঈমুর রহমান দুর্জয় প্রথম দফায় জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

স্কোরবোর্ডে ১০ রান তুলতে প্যাভিলিয়নে ফিরেছেন মেহরাব হোসেন। দ্বিতীয় উইকেটের পতন ঘটে দলীয় ৪৪ রানে, আউট হন শাহরিয়ার হোসেন। উইকেটে আসলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল, টেস্ট ক্রিকেট পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেটার। প্রথম অর্ধশতক করতে সময় নিলেন ২৫৬ মিনিট – ততক্ষণে খেলে ফেলেছেন ১৭৯ বল। 

স্বপ্নের সীমানা ছাড়িয়ে যায় আরও বহুদূর। ৩৮৯ মিনিট ক্রিজে কাটিয়ে দিয়ে ২৮২ বলে যখন সেঞ্চুরিতে পৌঁছালেন, আমিনুল ইসলাম বুলবুল তখন নিজের এবং দেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করা মাত্রই তৃতীয় ক্রিকেটার। প্রথম দু’জন হলেন চার্লস ব্যানারম্যান এবং ডেভ হটন। ক্রিকেটের অভিজাত ফরম্যাটে একেবারে নবীন এক দলের এক ব্যাটসম্যান বুক চিতিয়ে খেলছেন শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে, সেটা সহজে নিতে পারার কথা নয় ভারতীয় বোলারদের। তাই শিকার হয়েছিলেন স্লেজিংয়ের। পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে সে বিষয়ে বুলবুল বলেন,

“তারা প্রচুর স্লেজিং করছিল, বিশেষ করে জাভাগাল শ্রীনাথ। সে আমাকে বলেছিল, কীভাবে ব্যাটিং করতে হয় তা আমরা জানি না, এবং যেকোনো সময় আউট হয়ে যাব।”

স্লেজিংয়ের শিকার হয়েছিলেন ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি’র কাছ থেকেও,

“যখন আমি ৭০ রানে প্রথম দিন শেষ করলাম, সৌরভ গাঙ্গুলি আমার কাছে এগিয়ে এসে বলে, আমরা অতি শীঘ্রই নতুন বল নিবো, তাই ভালো হয় এর আগে তুমি তোমার রান করে নাও।”

Image Credit: Reuters

ইনিংসের ১৪৭তম ওভারে ১৪৫ রান করে নয় নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন অজিত আগারকারের বলে সেই জাভাগাল শ্রীনাথকে ক্যাচ দিয়ে আউট হলেন, ততক্ষণে একে একে খেলে ফেলেছেন ৩৮০ বল। ঘড়ির কাঁটায় ক্রিজে কাটিয়ে দিয়েছেন ৫৩৫ মিনিট। ঘন্টার হিসেবে গেলে সেটি হয়ে যায় আট ঘন্টা পঞ্চান্ন মিনিট।

সতের চারের সাহায্য ১৪৫ রানে যখন আউট হয়েছেন, ততক্ষণে আরেকটি রেকর্ডে নিজের নামটি খোদাই করে যান বুলবুল। দেশের অভিষেক টেস্টে চার্লস ব্যানারম্যনের ১৬৫ রানের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইনিংসটি আমিনুল ইসলাম বুলবুলের – ১৪৫ রান এই ইনিংসের স্মরণ করতে গিয়ে পরবর্তীতে হিন্দুস্তান টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বুলবুল বলেন,

“I had tears in my eyes after the century. I had never thought I would score a century. For it to be against India and in our first Test was phenomenal.”

সেঞ্চুরির পর ম্যাচ শেষে শুভেচ্ছা পেয়েছিলেন শচীন টেন্ডুলকারের কাছ থেকে এবং ম্যাচের বিরতিতে শুভেচ্ছা পেয়েছিলেন কিংবদন্তি সুনীল গাভাস্কারের কাছ থেকে। সে বিষয়ে একই সাক্ষাৎকারে হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেন,

Sunny Gavaskar met me downstairs. He just looked at me and shouted, ‘First century, what a knock!’

ক্যারিয়ার সায়াহ্নে খেলা এই ইনিংসটি বুলবুলের ক্যারিয়ারের উজ্জ্বলতম অংশ হয়ে আছে। দুর্দান্ত শুরুটা অবশ্য কাজে লাগাতে পারেননি ক্যারিয়ারের বাকি সময়টায়। পরের ১২ টেস্টে যোগ করতে পারেন আর মাত্র দু’টি ফিফটি। তাই তো খেলতে পারেন সাকুল্যে ১৩ টেস্ট। প্রায় ১৩ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের খেলেছেন ১৩টি টেস্ট এবং ৩৯টি ওয়ানডে। 

Image Credit: Getty Images

আমিনুল ইসলাম বুলবুলের শুরু অবশ্য ভিন্ন ধারায়। খেলাধুলার জগৎ, তবে ক্রিকেট নয়। শুরুটা হয়েছিল পেশাদার ফুটবলার হিসেবে। বাংলাদেশের ফুটবলের সোনালী সময়ে প্রিমিয়ার লিগে খেলেছেন ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। বাংলাদেশে ক্রিকেট তখনও ফুটবলের তুলনায় ‘অবহেলিত’। এখনকার সময়ে যেমন সবাই ক্রিকেটে বুঁদ, তখনকার সময়ে ফুটবলের চিত্র ছিল ঠিক এমনই। 

বুলবুল অবশ্য পারদর্শী ছিলেন ক্রিকেটেও। সে সময় তিনি আজাদ বয়েজের হয়ে প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে খেলতেন। ক্রিকেটটা তখনো পেশাদারিত্বের খাতায় তোলেননি। সেই সময় ডাক পান আইসিসি সহযোগী দেশের সেরা একাদশের জন্য। সালটা ১৯৮৮। উপলক্ষ, সেবার অস্ট্রেলিয়ায় আয়োজিত প্রথম এবং একমাত্র ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ কাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট।

এরপর ক্যারিয়ার হিসেবে ক্রিকেটকে বেছে নিতে পিছুপা হননি। এর মধ্যে একটি পেশাদার ফুটবল ম্যাচ চলাকালীন এক হাঁটুর লিগামেন্টে ইনজুরি ক্যারিয়ার হিসেবে ক্রিকেট বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্তকে আরো ত্বরান্বিত করে।

টুর্নামেন্টে বুলবুল কেমন ছিলেন, সেদিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। টুর্নামেন্টে ব্যাট হাতে ছিলেন একেবারে নিষ্প্রভ। আমিনুলের মতো তার দলও ছিল ছন্নছাড়া। আট দলের টুর্নামেন্টে সাত ম্যাচের সবক’টা হেরে অষ্টম হয় তার দল। তবে অফস্পিনে হাত ঘুরিয়ে আমিনুল ইসলাম বুলবুল নিয়েছিলেন ছয় উইকেট। যেখানে দু’টি উইকেটের নাম শুনলে সবার ভ্রু কুঁচকে ওঠার কথা, ব্রায়ান চার্লস লারা এবং সনাৎ জয়াসুরিয়া! 

Image Credit: Getty Images

একই বছরের ২৭ অক্টোবর চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপে আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ওয়ানডে অভিষেক হয়, প্রতিপক্ষ ছিল ভারত। সে ম্যাচে বল করার সুযোগ পাননি, ব্যাট হাতে করেছিলেন ১০ রান। টুর্নামেন্টে নিজের সর্বোচ্চ রানের স্কোরটি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে, সে ম্যাচে ২৭ রান করেন।

আইসিসির পূর্ণ সদস্য দেশ ছিল না বলে কদাচিৎ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পেত বাংলাদেশ। তাই দেশের জার্সি গায়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচের জন্য অপেক্ষা করতে হতো দিনের পর দিন। শারজায় অস্ট্রেলেশিয়া কাপে দুই বছর পর অবশেষে আবার সুযোগ আসে খেলার, সালটা ১৯৯০। ব্যাট হাতে বুলবুল উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছেন, কিন্তু বাংলাদেশ হারে নিজেদের দুটো ম্যাচই।

প্রথম ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে দলকে অলআউট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে খেলেন ৫৬ বলে অপরাজিত ৩০ রানের একটি ইনিংস। তখন বুলবুল খেলতেন লোয়ার মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে। যদিও বাংলাদেশ ম্যাচটা হারে ১৬০ রানের বিশাল ব্যবধানে। পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলেন ৭৬ বলে অপরাজিত ৪১ রানের আরেকটি দুর্দান্ত ইনিংস। সে ম্যাচও বাংলাদেশ হারে সাত উইকেটের বড় ব্যবধানে। একই বছর ভারতে বসে এশিয়া কাপের আসর, সেখানে বুলবুল খেলেন দু’টি ম্যাচ।

এরপরের আন্তর্জাতিক ম্যাচের অপেক্ষার পালা আরো দীর্ঘ। ১৯৯৫ এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে পাঁচ বছরের বেশি সময়ের প্রতীক্ষার প্রহর গোনা শেষ হয়। ভারতের বিপক্ষে বুলবুল করেন ৩০ রান। টুর্নামেন্টের শেষ দিকে পাকিস্তানের বিপক্ষে করেন ৪২ রান। স্পিনে সিদ্ধহস্ত বুলবুল অবশ্য পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে ছিলেন নড়বড়ে। এর মাঝে একই বছর ঢাকায় ইংল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে তিনদিনের একটি ম্যাচে সেঞ্চুরি করেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। 

Image Credit: Getty Images

যেহেতু বাংলাদেশ আইসিসির পূর্ণ সদস্য না, এশিয়া কাপ ছাড়া আন্তর্জাতিক ম্যাচের সুযোগ আসতো না খুব একটা। পরবর্তী এশিয়া কাপের আসর বসে শ্রীলঙ্কায়, সালটা ১৯৯৭। সেবার নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি বুলবুল। এক বছর পর কেনিয়ার নাইরোবিতে বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়া মিলে একটি ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টের আয়োজন হয়। বাংলাদেশ চার ম্যাচের সবক’টা হেরে ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করে আসে। 

তবে সে টুর্নামেন্টে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বুলবুল দেখা পান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের প্রথম উইকেটের – ফ্লাওয়ার ভাইদের ‘গ্রান্ট’ ছিলেন সেই প্রথম উইকেট। সেটি ছিল টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ম্যাচ, ৫৭ রান খরচে বুলবুল নেন তিন উইকেট। বাকি দুই উইকেট ছিলেন ক্রেইগ ইভান্স এবং ফ্লাওয়ার ভাইদের আরেকজন ‘অ্যান্ডি’। সেটিই ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং ফিগার ছিল আমিনুল ইসলাম বুলবুলের।

আমিনুল ইসলাম বুলবুল ক্যারিয়ারে মোট তিনটে আইসিসি ট্রফি খেলেন, যেগুলো বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ার রাউন্ড হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রথমটি ১৯৯০ সালে, সেখানে ৫ ম্যাচ খেলে ১৭.৬০ গড়ে করতে পারেন ৮৮ রান, উইকেট ছিল একটি। দ্বিতীয়টি ১৯৯৪ সালে; সেখানে ৭ ম্যাচে ২৩.৮৩ গড়ে করেন ১৪৩ রান, উইকেট পান একটি। 

Image Credit: Getty Images

বিশ্বকাপের দ্বার উন্মোচিত করার আনন্দ-উল্লাসে সারা দেশ কাঁপিয়ে দেওয়া ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জয়ে বুলবুলের ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যদিও টুর্নামেন্টের প্রথম দিকে সুবিধা করতে পারেননি তিনি। তখন তিনি লোয়ার-অর্ডার ছেড়ে মিডল-অর্ডারে উঠে এসেছেন।  প্রথম সত্যিকারের ঝলক দেখান সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে। গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তৃতীয় উইকেটে খালেদ মাসুদ পাইলটের সাথে ১১৫ রানের জুটি গড়ে তোলেন, আউট হন ৫৭ রান করে। সে ম্যাচটাই আসলে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলার দ্বার খুলে দিয়েছিল।

তারপর সেই ফাইনাল, যেটা বাংলাদেশ ক্রিকেটে একটা নতুন মাত্রা দিয়েছিল। দলের চরম মুহূর্তে এক চার আর এক ছক্কায় খেলেন ৩৭ বলে ৩৭ রানের দলের প্রয়োজন মিটানো ঝড়ো ইনিংস। অধিনায়ক আকরাম খানের সাথে চতুর্থ উইকেটে ৫৩ রান যোগ করেন। তারপরের ইতিহাস তো সবারই জানা।

হাঁটি হাঁটি পা পা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাটিয়ে দিয়েছেন প্রায় দশ বছর। তখনও একজন ব্যাটসম্যানের পরম মুহূর্ত, অর্থাৎ হাফসেঞ্চুরি বা সেঞ্চুরি করে ব্যাট উঁচিয়ে ধরা হয়নি বুলবুলের। অবশেষে ১৯৯৮ সালের ১০ জানুয়ারি আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, প্রতিপক্ষ ভারত। ঘরের মাঠ, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সে ম্যাচে বুলবুল খেলেন ৯৬ বলে ৬৯ রানের দুর্দান্ত একটি ইনিংস। ইনিংসের মাত্র দশ বল বাকি থাকতে চার উইকেটে ম্যাচ জিতে নেয় ভারত। দ্বিতীয়-বার ব্যাট উঁচিয়ে অভিবাদনের জবাব দেয়ার উপলক্ষ আনেন মাত্র দুই ম্যাচ পর – সময়ের হিসেবে এবার মাত্র ১২৪ দিন সময় নেন। 

সেবার বাংলাদেশ এবং কেনিয়াকে নিয়ে ভারত নিজেদের মাটিতে একটি ত্রিদেশীয় সিরিজের আয়োজন করে। সেখানেই ভারতের বিপক্ষে মোহালিতে বুলবুল করেন ১২৬ বলে ৭০ রান। সেটিই হয়ে থাকে বুলবুলের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। 

বুলবুলের প্রিয় প্রতিপক্ষ ভারত ছিল কি না, কে জানে! ৮ ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে করেন ২৭৭ রান, গড়টাও দুর্দান্ত – ৪৬.১৭। ওয়ানডেতে তিনটে হাফসেঞ্চুরির দুটোই তাদের বিপক্ষে। যদিও ম্যাচটা বাংলাদেশ হারে পাঁচ উইকেটের ব্যবধানে। সে টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্বে ছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড আকরাম খান থেকে হস্তান্তরিত হয় তার কাছে। ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জিতে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলার গৌরব অর্জন করা বাংলাদেশ নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে যায় তারই নেতৃত্বে। 

Image Credit: Getty Images

১৯৯৯ বিশ্বকাপ বাংলাদেশ দলের জন্য অনেক কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দলের জন্য চমক জাগানিয়া বিশ্বকাপ হলেও বুলবুলের জন্য ছিল ভুলে যাওয়ার মতো পারফরম্যান্সের এক টুর্নামেন্ট। তবে তার নেতৃত্বেই প্রথম কোনো টেস্ট-খেলুড়ে দেশকে হারানোর কৃতিত্ব দেখায় বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ যে পাকিস্তান ছিল, সেটা বোধহয় আর না বললেও চলবে।

তবে সেটি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম জয় নয়। মে ২৪, এডিনবার্গ – সেদিন স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপে প্রথম জয় পায় বাংলাদেশ। নেতৃত্বে স্বাভাবিকভাবেই বুলবুল। তবে ম্যাচটা নিজের জন্য যত তাড়াতাড়ি ভুলে যেতে পারতেন, ততই মঙ্গল ছিল। সে ম্যাচে প্রথম বলেই যে আউট হয়ে গোল্ডেন ডাক নিয়ে ফেরেন বুলবুল! 

Image Credit: Getty Images

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে স্মরণীয় এবং বিখ্যাত জয়টি আসে নর্দাম্পটনে, ৩১ মে। সেদিন দলীয় ২২৩ রানে বুলবুলের অবদান ছিল মাত্র ১৫ রান। সেটিই হয়ে থাকে বিশ্বকাপে তার সর্বোচ্চ রানের স্কোর। পরম আস্বাদিত অমরত্ব পাওয়া বিশেষ জয়টা আসে ৬২ রানের ব্যবধানে। ম্যাচ পরবর্তী প্রেজেন্টেশনে বুলবুলের আবেগাপ্লুত হয়ে পড়াটা মাঠে থাকা হাজারো দর্শককে কাঁদিয়েছিল সেদিন।

বিশ্বকাপে বাংলাদেশ আরো ম্যাচ জিতেছে, যতদিন ক্রিকেট থাকবে আরো জিতবে। কিন্তু এ জয়টার মাহাত্ম্য একেবারে আলাদা হয়ে থাকবে। সব জয়ের স্মারক হয়ে থাকবে এ জয়টি। সে জয়ে দেশের নেতৃত্ব দিতে পারার সৌভাগ্য হয়েছিল আমিনুল ইসলাম বুলবুলের, যে সৌভাগ্য সচরাচর সবার হয় না! 

টেস্ট স্ট্যাটাস পেতে এ জয়টি টনিক হিসেবে কাজ করেছিল। তবে তার আগে আরো কিছু ম্যাচ খেলার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। বুলবুল ওয়ানডে ক্যারিয়ারের তিন নাম্বার এবং শেষ ফিফটি করেন এই সময়ে। ১৯৯৯ সালে ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৮৯ বলে ৬৬ রানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেন। সে ম্যাচে বুলবুল আউট হন লারার বলে। ঠিক এগারো বছর পূর্বে একটি টুর্নামেন্টে এই লারাকেই আউট করেছিলেন বুলবুল। কাকতাল, নাকি নিছকই ক্রিকেটীয় ব্যাপার? 

টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার বছর আরেকটি ওয়ানডে ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে করেন ৭২ বলে ৪৭ রান। সেটি ছিল এশিয়া কাপের একটি ম্যাচে। এশিয়া কাপের আসর বসেছিল বাংলাদেশে। সে ম্যাচে ছয় উইকেটে বাংলাদেশ ২৪৭ রানের লড়াই করার পুঁজি দাঁড় করায়। তবে সৌরভ গাঙ্গুলির ১৩৫ রানের অতিমানবীয় ইনিংসের কাছে হার মানে সে পুঁজি। আট উইকেটে ম্যাচ হারে বাংলাদেশ। 

এরপর ২০০০ সালে বাংলাদেশ দলের যখন টেস্ট অভিষেক হয়, ততদিনে মাঠে নিজের সেরা সময়টা কাটিয়ে ফেলেছেন বুলবুল। অধিনায়কত্ব হারিয়েছেন নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের কাছে। তবে দেশের এবং নিজের টেস্ট অভিষেকটা আপন আলোয় আলোকিত করেছেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। টেস্ট অভিষেকের পর আর মাত্র দু’টি ওয়ানডে খেলার সুযোগ পান বুলবুল। একটি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারেতে, ২০০১ সালে। সেই টেস্ট সিরিজে নিজের দ্বিতীয় ম্যাচের প্রথম ইনিংসে বুলাওয়েতে বুলবুল খেলেন ২০০ বলে ৮৪ রানের একটি ম্যারাথন ইনিংস।  অন্য ওয়ানডে’টি খেলেন পাকিস্তানের বিপক্ষে ঢাকায়, ২০০২ সালে।

টেস্ট ক্যারিয়ার এরপর আর মাত্র একটি ফিফটির দেখা পান বুলবুল, সেটি আসে ২০০১ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলম্বোতে। সেদিন ১৫২ বলে করেন ৫৬ রান। যদিও সে ম্যাচটি বাংলাদেশের কাছে অমর হয়ে আছে অভিষেকে সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান মোহাম্মদ আশরাফুলের জন্য।

এরপর ধীরে ধীরে পুরোপুরি ফর্ম হারাতে থাকেন বুলবুল। কার্যত নিজের শেষ টেস্টটি খেলেন ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে, ২০০২ সালের ডিসেম্বরে। সে ম্যাচের দুই ইনিংসে বুলবুল করেন যথাক্রমে ৫ এবং ১২ রান। বাংলাদেশ ম্যাচটা হারে ইনিংস এবং ৩১০ রানের বিশাল ব্যবধানে। মাঠ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় বলার সুযোগ হয়নি বলে সেটিই হয়ে যায় ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ।

Image Credit: MUNIR UZ ZAMAN/AFP via Getty Images

ক্যারিয়ার শেষে বুলবুল পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে জিওফ লসন এবং মাইকেল স্ল্যাটারের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটির কোচিং স্টাফের একজন হিসেবে কাজ করেন। কোচিংয়ের লেভেল-২ শেষ করেন সেখান থেকেই।

অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরে আসেন ২০০৬ সালে। আমিনুল ইসলাম বুলবুলের কোচিং ক্যারিয়ারের প্রথম সাফল্য আসে আবাহনীর হাত ধরে। সাত বছর পর আবাহনীকে জেতান প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা। এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এসিসি)-এর সাথে যুক্ত হয়ে চীন, মালয়েশিয়া, নেপাল, মালদ্বীপ এসব দেশের ক্রিকেট উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বুলবুল। আমিনুল ইসলাম বুলবুল বর্তমানে নিযুক্ত রয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) এশিয়ান অঞ্চলের গেম ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে। 

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ১৩ টেস্টে ২১.২০ গড় এবং ৩৯ ওয়ানডেতে ২৩.৩৫ গড় – এই সংখ্যাগুলোর বোঝানোর সাধ্য নেই, বাংলাদেশের ক্রিকেটে তখনকার সময়ে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। তার নেতৃত্বেই ‘৯৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেটে নতুন সূর্য উদিত হয়েছিল। তিনিও দেখিয়েছেন স্বপ্ন, সেই অভিষেক টেস্টেই। 

This article is in Bangla language. It is about Aminul Islam Bulbul, a former Bangladeshi cricket captain who scored the first hundred for the Bangladesh cricket team when Bangladesh played their first Test against India thus becoming only the third cricketer after Charles Bannerman and Dave Houghton to score centuries on their own and their country's Test debut. He was one of Bangladesh's most celebrated cricketers in the pre-Test-status era.

Featured Image: Allsport UK /Allsport

Related Articles