Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অরবিন্দ ডি সিলভা: আন্ডারডগ শ্রীলঙ্কা পরাশক্তি হয়েছিলো যার হাত ধরে

ইডেন গার্ডেনে ১৯৯৬ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে মুখোমুখি ভারত ও শ্রীলঙ্কা। সেসময়ে শক্তির বিচারে ভারতের আশেপাশেও শ্রীলঙ্কার থাকার কথা না, ভারত যেখানে একবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন সেখানে ওই বিশ্বকাপের আগে শ্রীলঙ্কা কখনো গ্রুপ পর্বই পার হতে পারেনি! কিন্তু ওই বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা যেন এক ভিন্ন এক অবতারে হাজির হয়েছিলো, গ্রুপ পর্বে এই ভারতকে একপ্রকার উড়িয়েই দিয়েছিলো শ্রীলঙ্কা। তাই এই সেমিফাইনালটা ভারতের জন্য ছিল প্রতিশোধের ম্যাচ।

সেবার শ্রীলঙ্কাকে যত বড় টার্গেটই দেওয়া হচ্ছিলো তার কোনোটাই লংকার ডায়নামিক ব্যাটিং লাইনআপের কাছে ধোপে টিকতে পারছিলো না একারণে ভারতের অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন টসে জিতে নিলেন ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত। তার সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণের জন্য খুব বেশি সময় ভারতীয় বোলাররা নিলো না, প্রথম ওভারে মাত্র ১ রানের মধ্যেই শ্রীলঙ্কার দুই পিঞ্চ হিটার ওপেনার কালুভিতারানা ও জয়াসুরিয়াকে ফিরিয়ে দেন পেসার জাভাগাল শ্রীনাথ। রেগুলার ব্যাটিং অর্ডার অনুযায়ী তখন অরবিন্দ ডি সিলভার নামার কথা, কিন্তু তখন ডি সিলভার গায়ে বেশ জ্বর।

ড্রেসিংরুমের অনেকেই ডি সিলভাকে আরেক উইকেট পরে নামতে বলেছিলো কারণ জ্বর গায়ে ডি সিলভা খুব বেশিক্ষণ উইকেটে থাকতে পারবেন না। ডি সিলভা তখন বলেছিলেন, “৪৫ মিনিট খেলতে পারলেই যথেষ্ট হবে।” ডি সিলভা তার কথা রেখেছিলেন, ১ রানে দুই উইকেট হারিয়ে যেখানে শ্রীলঙ্কার রানের চাকা একদম শ্লথ হয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে ডি সিলভা ব্যাটিংয়ে নেমেই শুরু করেন কাউন্টার অ্যাটাক। একঘণ্টা পর ডি সিলভা যখন আউট হন, তখন শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ ১৪.২ ওভারে ৮৫/৪। আর সেই ৮৫ রানের মধ্যে ডি সিলভার ব্যাট থেকেই এসেছিলো ৬৬ রান! রানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল ডি সিলভা এই রান করতে খরচ করেছিলেন মাত্র ৪৭ বল! ১ রানে দুই ওপেনারের উইকেট পেয়ে যাওয়ার পর ভারত যখন লংকান ব্যাটিং ইউনিটকে পুরোপুরি চেপে ধরার প্ল্যানে ছিল, খেলার এমন পর্যায়ে ডি সিলভার এমন কাউন্টার অ্যাটাকে উল্টো ভারতের বোলাররাই চাপে পড়ে যায়। ডি সিলভার ইনিংসটার জন্যই পরের ব্যাটসম্যানদের রানরেট নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হয়নি, ধীরেসুস্থে খেলে বাকি ব্যাটসম্যানরা মিলে শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ ২৫১ রানে নিয়ে যায়

ইডেনের সেই তপ্ত দুপুরে অসাধারণ কাউন্টার অ্যাটাকিং ফিফটির পর ডি সিলভা; Source: espncricinfo.com

ইডেনের স্লো টার্নিং উইকেটে ২৫০ পার করা এই স্কোরটাই হয়ে যায় উইনিং স্কোর আর ডি সিলভার ৬৪ রানের মিডিয়াম সাইজের ঝড়ো ইনিংসটা গুরুত্বের দিক থেকে ছাড়িয়ে যায় অনেক শতাধিক রানের ইনিংসকেও। সব ইমপ্যাক্ট বিবেচনা করে অনেক ক্রিকেট অ্যানালিস্টই বিশ্বকাপে তাদের প্রিয় ইনিংসের তালিকায় এই ক্যামিওটাকে রাখেন।

ইডেনে জ্বর গায়ে ওই পাগলাটে ইনিংসের মতো ডি সিলভার ক্যারিয়ারের শুরুটাও ছিল পাগলাটে। তবে পার্থক্য হলো সেদিন ইডেনে ডি সিলভা সাফল্য পেলেও ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তা পাননি। স্টাইলিশ ব্যাটিংয়ের জন্য স্কুল ক্রিকেটে থাকাকালীনই সবার নজরে চলে আসেন ডি সিলভা, উচ্চতায় মাত্র ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি হলেও স্কয়ার অফ দ্য উইকেটে বেশ ভালো খেলতেন ডি সিলভা। বিশেষ করে পুল আর হুক শটে তিনি তো সর্বকালেরই অন্যতম সেরা। তার এমন অমিয় প্রতিভা দেখে নির্বাচকরা ১৯৮৪ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই তাকে ওয়ানডে একাদশে সুযোগ দেন।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নিজের অভিষেক ম্যাচে অবশ্য তেমন সুবিধা করতে পারেননি। রিচার্ড হ্যাডলির বলে বোল্ড হয়ে মাত্র ৮ রানেই প্যাভিলিয়নে ফিরে যান ডি সিলভা। একই বছরের আগস্টে ঐতিহাসিক লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয় তার। তবে ওয়ানডে অভিষেকের মতো টেস্ট অভিষেকেও সুবিধা করতে পারেননি। ক্যারিয়ারের প্রথমদিকে বেশ কিছুদিন অতি বেশি আক্রমণাত্মক হতে গিয়ে ক্রিজে থিতু হওয়ার আগেই উইকেট বিলিয়ে দিতেন ডি সিলভা। আর এ কারণেই সবাই তাকে “ম্যাড ম্যাক্স” বলে ডাকা শুরু করে।

তবে এই ম্যাড ম্যাক্স নিজের জাত চেনান ১৯৮৫ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের বিপক্ষে ফয়সালাবাদ টেস্টে, সেই টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১২২ রানের ইনিংস খেলেন ডি সিলভা। ওই সিরিজেই পাকিস্তানের সাথে আবারো সেঞ্চুরি করেন আর জিতে নেন ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতন সিরিজসেরার পুরষ্কার। কিন্তু এরপর আবারো আগের মতো অতি বেশি শট খেলতে গিয়ে উইকেট বিলিয়ে আসা শুরু করেন।

১৯৮৬-৮৮ এই তিন বছরে সেঞ্চুরি তো দূরের কথা, টেস্টে কোনো ফিফটিও ডি সিলভার ছিল না! এদিকে ওয়ানডে অভিষেকের পাঁচ বছর হয়ে গেলেও তখনও তিনি ওয়ানডে সেঞ্চুরির দেখা পান নি। পারফর্মেন্সের কারণে দল থেকে কয়েকবার বাদ পড়লেও কিছুদিন পরেই নির্বাচকরা ডি সিলভাকে আবারো দলে ফিরিয়ে আনতেন, কারণ সেসময়ে তার মতো স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান শ্রীলঙ্কা দলে আর কেউই ছিল না। কিন্তু অতি বেশি শট খেলতে গিয়ে প্রতিবারই ইনিংস বড় করতে ব্যর্থ হওয়ায় বারবার নির্বাচকদের হতাশই হতে হচ্ছিলো।

শ্রীলঙ্কার হয়ে টেস্ট জার্সিতে ডি সিলভা; Source : Pinterest

বয়সে কিছুটা পরিণত হওয়ার পর ডি সিলভা বুঝতে পারলেন যে সবসময় আক্রমণাত্মক ভঙ্গি নিয়ে খেললে ক্যারিয়ার খুব একটা বড় করা যাবে না। তাই ১৯৮৯ এ এসে ব্যাটিং এপ্রোচে কিছুটা পরিবর্তন আনলেন। বোলারদের ডোমিনেট করে খেলার অভ্যাস অবশ্য ছাড়েননি, তবে সেই ডোমিনেশনের আগে পরিস্থিতি আর পিচের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াটাও তিনি আস্তে আস্তে রপ্ত করলেন। এর সুফলও পেতে লাগলেন।

১৯৮৯ সালে এসে ডি সিলভা চার বছর পর টেস্ট সেঞ্চুরির দেখা পান। ওদিকে ওয়ানডেতে সেঞ্চুরির দেখা না পেলেও বছরটা ভালোই যায়, চার ফিফটিসহ সেবছর ওয়ানডেতে তার গড় ছিল ৪৪.১০। এরপর ডি সিলভাকে আর দলে নিজের জায়গা নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি।

১৯৯০ সালে নাগপুরে ভারতের বিপক্ষে ডি সিলভা পেয়ে যান তার প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি, যদিও ম্যাচটা ১৯ রানে হেরে যায় শ্রীলঙ্কা। ১৯৯১ সালে ওয়েলিংটন টেস্টে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি খেলেন ২৬৭ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলার পুরষ্কার হিসেবে দলের অধিনায়ক হিসেবে মনোনীত হন ডি সিলভা। কিন্তু তার অধিনায়কত্বে দল খুব একটা ভালো খেলতে পারেনি। ১৯৯২ বিশ্বকাপে তার নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কা ৮ ম্যাচের মধ্যে মাত্র ২ ম্যাচে জিতে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। ৬ টেস্টে নেতৃত্ব দিলেও একম্যাচেও জয়ের দেখা পায়নি শ্রীলঙ্কা। ফলে সেবছরই অধিনায়কত্ব হারান তিনি। এরপর আর কখনোই নিয়মিত অধিনায়ক হওয়ার সুযোগ পাননি তিনি।

বিশ্বকাপ শুরুর আগে অধিনায়কদের অফিসিয়াল ফটোশ্যুটে ডি সিলভা; Source : thedailystar

অধিনায়কত্ব হারালেও ক্যারিয়ারে সেটার প্রভাব পড়তে দেননি ডি সিলভা। সেবছরই কলম্বোয় অজিদের দেওয়া ২৪৭ রানের টার্গেট তাড়া করে তিনি খেলেন ১০৫ বলে ১০৫ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। ম্যাচটা শ্রীলঙ্কা জিতে নেয় চার উইকেটে। ওই সিরিজের পরের ম্যাচে তিনি খেলেন ৬১ বলে ৬৩ রানের অসাধারণ এক ইনিংস আর এক ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার জন্য সেসময়ে এটা ছিল ঐতিহাসিক এক সিরিজ জয়।

১৯৯৫ সালে ফয়সালাবাদ টেস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে শ্রীলঙ্কা যখন নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংস খেলতে নামে, তখন শ্রীলঙ্কা ১১০ রানে পিছিয়ে। ওই টেস্টের প্রথম ইনিংসে ডি সিলভা শূন্য রানে সাজঘরে ফিরে গেলেও দ্বিতীয় ইনিংসে খেলেন ১০৫ রানের চমৎকার এক ইনিংস। তার ইনিংসে ভর দিয়েই পাকিস্তানকে ২৫২ রানের টার্গেট ছুঁড়ে দেয় শ্রীলঙ্কা। শেষপর্যন্ত ওই টেস্ট ৪২ রানে জিতে সিরিজে ১-১ এ সমতা ফেরায় শ্রীলঙ্কা। পরের ম্যাচে ডি সিলভা ব্যর্থ হলেও শ্রীলংকা ঠিকই ওই টেস্ট জিতে পাকিস্তানের মাঠে ঐতিহাসিক এক সিরিজ জয়ের দেখা পায়। তবে ডি সিলভা মহানায়ক হয়ে ওঠেন ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ দিয়েই।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অরবিন্দ ডি সিলভা; Source: espncricinfo.com

১৯৯৬ বিশ্বকাপ শুরুর আগে শ্রীলঙ্কা অস্ট্রেলিয়া সফরে যায়। সেখানে ট্রাই নেশন্স সিরিজে উইন্ডিজকে টপকে ফাইনালে খেললেও ডি সিলভা ছিলেন ব্যর্থ। তবে বিশ্বকাপ শুরুর সাথে সাথে পাশার দান পুরোপুরি উল্টে যায়। নিজেদের প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া ওয়াকওভার দিলে শ্রীলঙ্কা মাঠে নামার সুযোগ পায় মূলত জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই।

সিংহলিজ স্পোর্টস গ্রাউন্ডে জিম্বাবুয়ের দেওয়া ২২৯ রানের টার্গেট শ্রীলঙ্কা ১৩ ওভার হাতে রেখেই পৌঁছে যায় আর এই রান তাড়ায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন ডি সিলভা। ৮৬ বলে ৯১ রানের ইনিংস খেলে পান ম্যাচসেরার পুরষ্কার। তৃতীয় ম্যাচে আবার ওয়াকওভার পায় শ্রীলংকা, এবার ওয়াকওভার দেয় উইন্ডিজ। নিজেদের চতুর্থ ম্যাচে শক্ত বাঁধার সম্মুখীন হয় শ্রীলঙ্কা, দিল্লিতে ভারতের বিপক্ষে সেই ম্যাচে ডি সিলভা ব্যর্থ হলেও জয়াসুরিয়ার তাণ্ডবে সহজ জয় নিয়েই মাঠ ছাড়ে শ্রীলঙ্কা। গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে কেনিয়ার মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কা। এ ম্যাচে শ্রীলঙ্কা রানের ফোয়ারা ছোটায়, যার নেপথ্য কারিগর ছিলেন অরবিন্দ ডি সিলভা। মাত্র ১১৫ বলে তিনি করেন ১৪৫ রান আর শ্রীলঙ্কা দাঁড় করায় ৩৯৮ রানের পাহাড়সম সংগ্রহ।

সেসময়ে এই ৩৯৮ রান ছিল ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ, যে রেকর্ড দীর্ঘ ১২ বছর অক্ষুণ্ণ ছিল। পাঁচ ম্যাচের পাঁচটিতেই জিতে শ্রীলঙ্কা কোয়ার্টার ফাইনালে প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় ইংল্যান্ডকে। সেই ম্যাচে আবারো জয়াসুরিয়া তাণ্ডবে ম্যাচ জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা, ডি সিলভা করেন ৩০ বলে ৩১ রান। তবে সেমিফাইনাল আর ফাইনালে জয়াসুরিয়া নন, নায়ক ছিলেন একজনই, আর তিনি অরবিন্দ ডি সিলভা। ভারতের বিপক্ষে সেমিফাইনালে প্রথমেই বর্ণিত ৪৭ বলে ৬৬ রান ছাড়াও নয়ন মঙ্গিয়ার উইকেটটিও ডি সিলভা নেন আর জিতে নেন ওই ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার।

১৭ মার্চ, ১৯৯৬ ছিল শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ফাইনালে লংকানদের প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া, যারা কিনা নিরাপত্তার অজুহাত দিয়ে গ্রুপ পর্বে শ্রীলঙ্কাকে ওয়াকওভার দিয়েছিলো। টসে জিতে সবাইকে অবাক করে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেন লংকান অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা। কিন্তু ২৮ ওভার শেষে অজিদের রান যখন মাত্র এক উইকেট হারিয়ে ১৩৭, তখন মনে হচ্ছিলো টসে জিতে ফিল্ডিং নিয়ে ম্যাচটাই বুঝি হাত থেকে ফেলে দিয়েছেন রানাতুঙ্গা। তখনই বল হাতে দলের ত্রাণকর্তা হয়ে আবির্ভূত হন অরবিন্দ ডি সিলভা, অজি অধিনায়ক মার্ক টেইলরকে ফিরিয়ে দিয়ে ভাঙেন টেইলর-পন্টিং এর ১০১ রানের জুটি। এরপরের ওভারেই আরেক সেট ব্যাটসম্যান পন্টিংকে বোল্ড করে খেলার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি শ্রীলঙ্কার হাতে এনে দেন ডি সিলভা।

এত কম সময়ের ব্যবধানে দুজন সেট ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে ব্যাটিংয়ের খেই হারিয়ে ফেলে অস্ট্রেলিয়া। ফলে একপর্যায়ে ৩০০ রানের কাছাকাছি স্কোর গড়ার কথা ভাবলেও শেষপর্যন্ত অজিদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৭ উইকেটে ২৪১ রান। আর টেইলর, পন্টিং এর পর শেষে ইয়ান হিলির উইকেটটাও তুলে নিয়ে ফাইনালে শ্রীলঙ্কার সেরা বোলার ছিলেন অরবিন্দ ডি সিলভাই।

২৪২ রান সেসময়ের বিচারে খুব একটা সহজ টার্গেট ছিল না। কিন্তু সেই টুর্নামেন্টে শ্রীলঙ্কা দুই পিঞ্চ হিটার ওপেনারে ভর করে যেকোনো টার্গেট এত অবলীলায় তাড়া করছিলো যে ২৪২ রানকে খুব একটা বড় মনে হচ্ছিলো না। তবে সেমিফাইনালের মতো ফাইনালেও দুই পিঞ্চ হিটার কালুভিতারানা ও জয়াসুরিয়া ব্যর্থ, মাত্র ২৬ রানেই দুজন সাজঘরে ফিরে গেলে ২৪২ রানের টার্গেটকেই পাহাড়সম লাগছিলো। সেমিফাইনালের মতো ফাইনালে আবারো ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির অরবিন্দ ডি সিলভা।

এবার আর পাগলাটে কোনো ক্যামিও না, খেললেন ঠাণ্ডা মাথায় অমায়িক এক ইনিংস। প্রথমে গুরুসিনহার সাথে ১২৮ রানের জুটি গড়ে প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নেন। এরপর জুটি বাঁধেন অধিনায়ক রানাতুঙ্গার সাথে। অস্ট্রেলিয়াকে কোনো সুযোগ না দিয়ে খেলেন ১২৪ বলে ১০৭ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংস। ক্লাইভ লয়েড আর ভিভ রিচার্ডসের পর তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ফাইনালে সেঞ্চুরি করেন ডি সিলভা আর একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে সেঞ্চুরি ও তিন উইকেট নেওয়ার নজির গড়েন তিনি। তার এই অতিমানবীয় পারফর্মেন্সের উপর ভর করে ২০ বল হাতে রেখেই অজিদের বিপক্ষে ৭ উইকেটের জয় পেয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা। ফাইনালে অনবদ্য পারফর্মেন্সের জন্য ম্যান অব দ্য ফাইনাল হন অরবিন্দ ডি সিলভা।

ওই বিশ্বকাপে তিনি ছয় ম্যাচে ৮৯.৯০ গড়ে ৪৪৮ রান করেছিলেন, আর স্ট্রাইক রেট ছিল ১০৭.৬৯! আজ থেকে ২২ বছর আগে আশির উপরে স্ট্রাইক রেটই যেখানে যথেষ্ট হিসেবে বিবেচিত হতো, সেখানে ১০৭.৬৯ স্ট্রাইক রেট সত্যিই অবিশ্বাস্য ছিল। সাথে ২১.৭৫ গড়ে চার উইকেটও নিয়েছিলেন ডি সিলভা। তবে এমন পারফর্মেন্সের পরেও টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার যায় আরেক লংকান সনাথ জয়াসুরিয়ার দখলে! অথচ সেমিফাইনাল আর ফাইনালে ডি সিলভার দাপুটে পারফর্মেন্সের বিপরীতে জয়াসুরিয়া ব্যাট হাতে ছিলেন বেশ ম্লান। তাই শ্রীলঙ্কার ওই বিশ্বকাপ জয়ের মূল নায়ক হিসেবে কাউকে নির্বাচিত করা হলে সেটা জয়াসুরিয়া না, ডি সিলভাই হবেন।

ফাইনালে অসাধারণ সেঞ্চুরির পর ডি সিলভা; Source : Dailymotion

এই এক বিশ্বকাপ জয় শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের মানসিকতাই ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন করে দেয়। আগে যাদের সবাই আন্ডারডগ হিসেবে মনে করতো, তারাই পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। সেবছরই ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জিম্বাবুয়েকে নিয়ে চার জাতির “সিঙ্গার ওয়ার্ল্ড সিরিজ” আয়োজন করে শ্রীলঙ্কা। সেই সিরিজের ফাইনালে অজিদের বিপক্ষে ৬৪ বলে ৭৫ করে দলকে জয় এনে দেওয়ার পাশাপাশি ম্যান অব দ্য ফাইনাল হন ডি সিলভা। শুধু তা-ই নয়, ওই সিরিজে ৪ ম্যাচে ৩৩৪ রান করে সিরিজসেরাও হন তিনি।

সনাৎ জয়াসুরিয়ার সাথে ডি সিলভা। এক আন্ডারডগ ক্রিকেট টিম ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছিলো এই দুজনের হাত ধরেই; Source : kookaburra

১৯৯৭ সালে শারজাহ কাপের ফাইনালে আবারো জ্বলে উঠেন ডি সিলভা, ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৮৭ রান করে দলের শিরোপা নিশ্চিত করার সাথে সাথে জিতে নেন ফাইনাল সেরার পুরস্কার। সাথে সিরিজে একশোর অধিক গড়ে ৪১০ রান করে সিরিজ সেরার পুরষ্কারটাও জিতে নেন তিনি।

১৯৯৭ সালে টেস্ট ও ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই অসাধারণ সময় পার করেন ডি সিলভা। ওয়ানডেতে সেই বছর তিন সেঞ্চুরিসহ ৫২.৭০ গড়ে ২৮ ম্যাচে করেন ১,২১২ রান। আর টেস্টে তো সেই বছর নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান তিনি। যে ডি সিলভা আগের ১৪ বছরে সর্বসাকুল্যে করেছিলেন ৮ সেঞ্চুরি, সেই তিনি এই এক বছরেই করেন ৭ সেঞ্চুরি! শুধু তা-ই না, ১৯৯৭ সালে দুই দুইবার একই টেস্টে দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি করেন ডি সিলভা। ঐ বছর টেস্টে ৭৬.২৫ গড়ে ১১ ম্যাচে ১,২২০ রান করেন তিনি।

এরপর বয়স বাড়ার প্রভাবে আস্তে আস্তে ফর্ম হারাতে শুরু করেন ডি সিলভা। পরের দুই বছর টেস্টে পঞ্চাশোর্ধ্ব গড়ে রান করলেও ওয়ানডেতে তেমন সুবিধাই করতে পারছিলেন না। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে একদম ফ্লপ ছিলেন তিনি। পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র একটি ফিফটি ছিল তার। আর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে খেলতে এসেও গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয় লংকানদের।

এরপর মূলত ডি সিলভার শেষের শুরু হয়ে যায়। ২০০২ সালে এসে তিনি বুঝতে পারেন একদিন যে রিক্ত বাগানে তিনি এসেছিলেন কুঁড়ি হয়ে সেই রিক্ত বাগান নতুন কুঁড়িদের আগমনে ভরে উঠেছে আর বহুদিন সুবাস ছড়ানোর পর তার ক্যারিয়ারের ফুল হয়ে গেছে মলিন। তাই ২০০২ সালের জুলাইয়ে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন তিনি। ক্যারিয়ারের শুরুটা সুখকর না হলেও শেষটা হয়েছিলো অসাধারণভাবেই। কলম্বোয় নিজের শেষ ইনিংসে বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলেছিলেন ২৩৪ বলে ২০৬ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস, আর টেস্ট ক্যারিয়ারে নিজের শেষ বলেও পেয়েছিলেন উইকেট। এর সাথে সাথেই অবসান ঘটে ডি সিলভার ১৮ বছরের বর্ণিল টেস্ট ক্যারিয়ারের।

ক্যারিয়ারের প্রান্তলগ্নে ডি সিলভা; Source : scoreline.asia

ওদিকে ওয়ানডে থেকে ২০০৩ বিশ্বকাপ খেলে অবসরের ঘোষণা দেন ডি সিলভা। এর আগে ২০০২ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে শ্রীলঙ্কাকে যুগ্মভাবে চ্যাম্পিয়ন করতে বেশ বড় ভূমিকা রাখেন। উদ্বোধনী ম্যাচে পাকিস্তানকে হারানোর পথে করেন অপরাজিত ফিফটি আর সেমিফাইনালে অজিদের বিপক্ষে ১০ ওভারে মাত্র ১৬ রান দিয়ে এক উইকেট তুলে নিয়ে হন ম্যান অব দ্য ম্যাচ।

২০০৩ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের শেষম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে মুখোমুখি হয় দক্ষিণ আফ্রিকা আর শ্রীলঙ্কা। সেই ম্যাচে ৭৮ বলে ৭৩ রান করেন ডি সিলভা আর ম্যাচটি টাই হয়। পরের ম্যাচে সুপার সিক্স রাউন্ডে অজিদের বিপক্ষে তিনি ৯৪ বলে ৯২ রান করলেও লংকানরা হেরে যায় ৯৬ রানে। সেমিফাইনালে অজিদের বিপক্ষে বল হাতে জ্বলে ওঠেন ডি সিলভা, ১০ ওভারে মাত্র ৩৬ রান খরচায় তুলে নেন দুই উইকেট। কিন্তু ব্যাটিংয়ে মাত্র ১১ রান করেই রান আউটের শিকার হন আর ম্যাচে শ্রীলঙ্কা ডিএল মেথডে ৪৮ রানে হেরে গেলে ওই ম্যাচটাই হয়ে যায় ডি সিলভার শেষ ওয়ানডে ম্যাচ। এর মধ্য দিয়েই তার দীর্ঘ ১৯ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটে।  ক্রিকেট থেকে অবসরের পর শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলে নির্বাচক হিসেবে ছিলেন ২০১১ বিশ্বকাপে, কিন্তু বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারতের কাছে হারার পর নির্বাচকের পদ থেকে সরে দাঁড়ান অরবিন্দ ডি সিলভা।

নির্বাচক থাকাকালীন জয়াবর্ধনে ও সাঙ্গাকারার সাথে গেমপ্ল্যানে মগ্ন ডি সিলভা; Source: indiatoday.in

খালি চোখে যদি কেউ ডি সিলভার সামগ্রিক পরিসংখ্যান দেখে, তবে টেস্টে ৪২ গড়ে ৬,৩৬১ রান কিংবা ওয়ানডেতে ৩৪.৯ গড়ে ৯,২৮৪ রান হয়তো মাহেলা জয়াবর্ধনে কিংবা সাঙ্গাকারার তুলনায় আকর্ষণীয় কিছু লাগবে না। কিন্তু একজন ডি সিলভাকে শুধুমাত্র পরিসংখ্যান দিয়ে কখনোই বিচার করা যাবে না। ডি সিলভাকে বিচার করতে গেলে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে ইডেন গার্ডেনে ওই কাউন্টার অ্যাটাকিং ৬৬ রানের গুরুত্ব বুঝতে হবে, বুঝতে হবে একটি আন্ডারডগ টিমকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্বকাপ জেতানোর মাহাত্ম্য।

অরবিন্দ ডি সিলভার মতো সাহসী ব্যাটসম্যান সেসময়ে খুব কমই ছিল। তার পুল আর হুক শট দেখে মুগ্ধ হননি এমন মানুষ পাওয়া খুবই মুশকিল। এজন্যই পরিসংখ্যানে এগিয়ে থাকলেও এখনো অনেকেই সাঙ্গাকারার চেয়ে ডি সিলভাকেই শ্রীলঙ্কার সেরা ব্যাটসম্যানের তালিকায় এগিয়ে রাখেন। যতদিন ক্রিকেট বেঁচে থাকবে, ততদিন ক্রিকেট বিশ্ব মনে রাখবে আন্ডারডগ হয়েও শ্রীলঙ্কার বিশ্বজয়ের কাহিনী, আর মনে রাখবে অরবিন্দ ডি সিলভাকে, যিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে ওই ইতিহাস তৈরিতে রেখেছিলেন সবচেয়ে বড় ভূমিকা।

ফিচার ইমেজ: Cricketcountry.com

Related Articles