আশুতোষ আমান।
নামটা খুব একটা পরিচিত নয় বটে, তবে তিনি রঞ্জি ট্রফিতে বিহারের অধিনায়ক। ভারতের রঞ্জি ট্রফি নিয়ে যারা খোঁজখবর রাখেন, তারাও কয়েক মাস আগে তার সম্পর্কে খুব বেশি জানতো না। তার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেই অভিষেক ঘটেছিলো ২০১৮-১৯ মৌসুমের রঞ্জি ট্রফির মধ্য দিয়ে। নিজের প্রথম রঞ্জি ট্রফিতেই রেকর্ড গড়ে বসলেন বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনার আশুতোষ আমান। বিষেণ সিং বেদীর এক মৌসুমে ৬৪ উইকেট শিকারের ৪৪ বছরের রেকর্ড ভেঙে এক মৌসুমে ৬৮ উইকেট শিকারের রেকর্ড গড়েন।
রঞ্জি ট্রফিতে তার দল বিহারের শেষ ম্যাচে এসে তিনি এই রেকর্ড গড়েন। সাত ম্যাচে ৫৭ উইকেট নিয়ে বেদীর চেয়ে সাত উইকেট দূরে ছিলেন। মনিপুরের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে চার উইকেট এবং দ্বিতীয় ইনিংসে সাত উইকেট শিকার করে তিনি এই রেকর্ড গড়েন। মনিপুরের মিডল-অর্ডার ব্যাটসম্যান সাগাতপম সিংকে এলবিডব্লিউ-এর ফাঁদে ফেলে তিনি বেদীকে টপকে যান।
ভারতের সাবেক অধিনায়ক বিষেণ সিং বেদী ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে দিল্লীর হয়ে ৮.৫৩ বোলিং গড়ে ৬৪ উইকেট শিকার করেছিলেন। আশুতোষ আমান ২০১৮-১৯ মৌসুমে আট ম্যাচের মধ্যে সাত ম্যাচে বোলিং করে নয়বার ইনিংসে পাঁচ উইকেট এবং পাঁচবার ইনিংসে দশ উইকেট শিকার করে ৬.৪৮ বোলিং গড়ে ৬৮ উইকেট শিকার করেছেন, যার ফলে রঞ্জি ট্রফিতে এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারের রেকর্ড গড়েন তিনি।
আশুতোষ আমান ব্যাট হাতেও সফল ছিলেন। ১০ ইনিংসে ব্যাট করে একটি শতক এবং একটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৮.১৪ ব্যাটিং গড়ে তিনি ৩৩৭ রান সংগ্রহ করেছিলেন। রঞ্জি ট্রফি এবং প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজের অভিষেক ম্যাচে উত্তরাখণ্ডের বিপক্ষে দুই ইনিংসে চার উইকেট এবং ১২ রান করে নজর কাড়তে পারেননি। তার খেলা দ্বিতীয় ম্যাচ মাঠে গড়ানোর আগেই পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এরপর থেকে দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন তিনি। পরবর্তী ১২ ইনিংসে নয়বার ইনিংসে পাঁচ বা ততোধিক উইকেট শিকার করেন, এবং দুইবার ইনিংসে চার উইকেট শিকার করেন।
আশুতোষ আমান ক্রিকইনফোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
'যখন আমি ৫০ এর কাছাকাছি উইকেট নিলাম, তখন আমার সতীর্থরা বলে, আমি এই রেকর্ড ভাঙার খুব কাছাকাছি অবস্থান করছি। আমি যখন জানতে পেরেছি, তখন আমার হাতে দুই ম্যাচ ছিল। এরপর আমি নিজেই নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়াই। আমি যেহেতু রেকর্ড গড়ার এত কাছাকাছি, তাহলে আমি যদি অতিরিক্ত পরিশ্রম করি। তাহলে আমি এই রেকর্ড ভাঙতে পারবো। আমি খুবই খুশি এই রেকর্ড নিজের করে নিতে পাওয়ার কারণে। অবশ্যই স্যার বেদী একজন কিংবদন্তি ক্রিকেটার, তার সাথে কোনো তুলনা হয় না। আমি শুধুমাত্র এই রেকর্ড গড়তে পেরে আনন্দিত।'
আশুতোষ আমান মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার জেলার হয়ে খেলা শুরু করেন। সেখানে তিন বছর খেলার পর দিল্লীতে পাড়ি জমান উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য। কারণ তখন তার রাজ্য বিহার রঞ্জি ট্রফি খেলতো না। দিল্লীতে বিমানবাহিনীর হিসাবরক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন তিনি। বিমানবাহিনীতে যোগ দেওয়ার কারণে সার্ভিসের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে খেলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু সার্ভিসের রঞ্জি দলে সুযোগ পাওয়া বেশ কঠিন ছিল, তিনি রঞ্জি দলে ডাক না পেলেও সার্ভিসের হয়ে ২০১৪ সালে 'লিস্ট এ' ক্রিকেট খেলেন। এরপর ২০১৭-১৮ মৌসুমেও সার্ভিসের হয়ে 'লিস্ট এ' ক্রিকেট খেলেন। কিন্তু সার্ভিসের হয়ে তার রঞ্জি খেলার স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
বিসিসিআই ২০১৮-১৯ মৌসুমে বিহারসহ নতুন নয়টি দলকে রঞ্জি ট্রফিতে খেলার সুযোগ দেয়। আশুতোষ আমান এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। নিজের স্বপ্নপূরণ করার জন্য বিহারে ফিরে আসেন। সেখানে জেলা পর্যায়ে পারফর্ম করার পর বিজয় হাজারে ট্রফিতে সুযোগ পান। সেখানে তার পারফরম্যান্স ছিল অনবদ্য। আধুনিক ক্রিকেটে যেখানে ওভারপ্রতি গড়ে ছয়ের নিচে রান দিলেই দলের অধিনায়ক সন্তুষ্ট হন, সেখানে তিনি আট ম্যাচে ওভারপ্রতি গড়ে ২.১০ রান খরচায় ১৪ উইকেট শিকার করেন। তার নৈপুণ্যে বিজয় হাজারে ট্রফিতে বিহার গ্রুপপর্বে সব ম্যাচেই জয় তুলে নিয়েছিলো। শেষপর্যন্ত তাদের জয়যাত্রা থামে শক্তিশালী মুম্বাইয়ের বিপক্ষে কোয়ার্টার-ফাইনালে।
বিজয় হাজারে ট্রফিতে দুর্দান্ত বোলিং করার পর রঞ্জি ট্রফিতে সুযোগ পাওয়াতে তার জন্য সহজ হয়ে পড়ে। রঞ্জি ট্রফিতে সুযোগ পাওয়া নিয়ে তিনি বলেন, “আমি সবসময় চেয়েছিলাম প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতে। কিন্তু সার্ভিসের হয়ে সুযোগ খুব সীমিত ছিলো। যখন বিহার রঞ্জি ট্রফিতে অন্তর্ভুক্ত হয় তখন আমি রাজ্যের অ্যাসোসিয়েশনের কথা বলি। তারা আমাকে জানায়, আমি যদি জেলা পর্যায়ে ভালো করতে পারি, তাহলে আমাকে রাজ্য দলে সুযোগ দিবে। আমি জেলা পর্যায়ে যথেষ্ট ভালো নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিলাম। যার কারণে আমাকে বিজয় হাজারে ট্রফিতে সুযোগ দেওয়া হয়। সেখানেও আমার ইকোনমি রেইট সবচেয়ে ভালো ছিলো, এতে করে আমি রঞ্জি খেলার সুযোগ পাই।”
বিহার এই মৌসুমে প্লেট পর্বে রঞ্জি খেলার সুযোগ পায়। সেখানে আট ম্যাচে ছয় জয়ে মোট ৪০ পয়েন্ট অর্জন করেছিলো তারা। মাত্র চার পয়েন্টের জন্য গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি বিহার। যদি প্লেট চ্যাম্পিয়ন হতে পারতো, তাহলে এই মৌসুমে নক আউট পর্বে সুযোগ পাওয়ার পাশাপাশি আগামী মৌসুমে এলিট গ্রুপে জায়গা করে নিতে পারতো তারা। আশুতোষ আমানের উইকেটগুলোর মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক ব্যাটসম্যান ছিলো আন্তর্জাতিক মানের। এর মধ্যে তার প্রিয় উইকেট কোনটি জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,
'শেষ ম্যাচে আমি যশপাল সিংয়ের উইকেট শিকার করেছিলাম, যা আমি খুব উপভোগ করেছিলাম। তিনি এই পর্যায়ের ক্রিকেটে নামকরা ব্যাটসম্যান এবং স্পিনারদের বিপক্ষে খুব ভালো ব্যাটিং করেন। আমার মনে হয় তিনি কিছুদিন আগে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নয় হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রম করেছিলেন। আমি তার উইকেট প্রথম ইনিংসে শিকার করেছিলাম এবং কি দ্বিতীয় ইনিংসেও তার উইকেট পেয়েছিলাম, যখন তিনি আমাদের হাত থেকে ম্যাচ বের করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি তাকে বোল্ড করেছিলাম, তার উইকেটটি খুব-ই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসেছিলো।'
নিজের প্রথম রঞ্জি মৌসুমে দুর্দান্ত বোলিং করার পর আশুতোষ আমান আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখছেন না। তাছাড়া তিনি রঞ্জির সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলেননি সেটাও অকপটে বলেছেন। এমন নৈপুণ্যের পর তিনি তার কোচ সুব্রত ব্যানার্জী এবং অধিনায়ক প্রজ্ঞান ওঝাকে কৃতিত্ব দেন। তিনি বলেন,
'সুব্রত স্যার খুবই অভিজ্ঞ, এবং তিনি ম্যাচ খুব ভালোভাবে পড়তে পারেন। তিনি আমার সাথে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট শেয়ার করেছিলেন, যেগুলো বেশ কার্যকরী ছিল।'
'আমি ওঝা ভাইয়ের (প্রজ্ঞান ওঝা) কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। তিনি ভারতের হয়ে খেলেছেন এবং তিনি অনেক বড় মানের ক্রিকেটার। তাই আমি প্রথমে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম তার সান্নিধ্য কীভাবে পাবো। কিন্তু তিনি অনেক বিনয়ী, তিনি নিজে নিজে আমার কাছে আসলেন এবং আমার বোলিং নিয়ে কথা বললেন।'
আশুতোষ আমান রঞ্জি ট্রফির শেষভাগে দলের অধিনায়কের দায়িত্বও পেয়েছিলেন। ৩২ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার নিজেকে খুব সাধারণ একজন মনে করেন। তিনি আরও বেশি সাদা বলের ক্রিকেট খেলে ভবিষ্যতে আইপিএল খেলার আশা ব্যক্ত করেন।
নিজ রাজ্যের সীমাবদ্ধতার কারণে দিল্লীতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে শুধুমাত্র রঞ্জি ট্রফি খেললেন না, উলটপালট করে দিয়েছেন ইতিহাসের পাতা। যদি বিহার এইবার রঞ্জি খেলার সুযোগ না পেতো, তাহলে হয়তো বিমানবাহিনীর হিসাবরক্ষক হিসেবেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হতো। ভাগ্যদেবী কার দিকে কখন কীভাবে হাসেন, বোঝা দুষ্কর বৈকি!
This article is in Bangla language. It is about Ashutosh Aman's new record in Ranji trophy. Please click on the hyperlinks to look for references.
Featured Image: Ashotosh Aman