Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কার্ডিফ কীর্তি ও বাংলাদেশের অস্ট্রেলিয়া বধ কাব্য

সময়টা ২০০৫ সাল। ত্রিদেশীয় ন্যাট ওয়েস্ট সিরিজ খেলতে নবীন বাংলাদেশ দল গেল ইংল্যান্ডে। দলের অধিনায়ক তখন হাবিবুল বাশার সুমন। সিরিজের অন্য দুটি দল স্বাগতিক ইংল্যান্ড আর সেই সময়ে ক্রিকেটের অজেয় পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়া। স্টিভ ওয়াহ অস্ট্রেলিয়া দলকে যে অনন্য উচ্চতা রেখে গিয়েছিলেন পন্টিং যেন সেখান থেকেই আবার শুরু করেছিলেন। ক্রমেই ছাড়িয়ে যাচ্ছিলেন নিজেকে। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিপক্ষ তখন শুধু অস্ট্রেলিয়া নিজেই। কারণ ব্যাটে বলে বাইশ গজের এই লড়াইয়ে অজিদের হারাতে পারে এমন সাধ্যি তখন কার?

তাই সিরিজের সকল জল্পনা কল্পনা ক্রিকেটের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডকে ঘিরে। তার উপর ওয়ান ডে সিরিজের পর পরই শুরু হবে ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে অভিজাত দ্বৈরথ অ্যাশেজ। সেই ১৯৮৬/৮৭ মৌসুমে শেষবার অ্যাশেজ জয়ের স্বাদ পেয়ছিল ইংরেজরা তারপর শেষের দুই দশক যেন মাইটি অজিদের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি ইংলিশ লায়নরা।

১৮ জুন বাংলাদেশ মাঠে নামবে সিরিজে তাদের প্রথম ম্যাচ খেলার জন্য, প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশ ক্রিকেট ভক্তদের তখন হারানোর কিছুই নেই। সবার তখন শুধু একটাই চাওয়া আজ যেন ভালো খেলে বাংলাদেশ। হারবে সে তো জানা কথাই অন্তত লড়াই করে যেন হারে।

তবে সেদিন শুরুটা ছিল একটু অন্য রকম। ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই প্রতিপক্ষের উপর আঘাত হানলেন মাশরাফি। একদিনের ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ওপেনিং ব্যাটসম্যান অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে এল বি ডাব্লিউ এর ফাঁদে ফেলে শূন্য রানে ফেরালেন সাজ ঘরে। স্কোর বোর্ডে তখনও কোন দলীয় রান যোগ হয়নি অস্ট্রেলিয়ার। তারপর ষষ্ঠ ওভারই পতন ঘটল দ্বিতীয় উইকেটের। এবার রিকি পন্টিংকে এল বি ডাব্লিউ এর ফাঁদে ফেললেন তাপস বৈশ্য। দলীয় রান তখনও দুই অংকে পৌঁছায়নি।

গিলক্রিস্টকে শূন্য রানে আউট করে উচ্ছ্বসিত মাশরাফি

গিলক্রিস্টকে শূন্য রানে আউট করে উচ্ছ্বসিত মাশরাফি; Image Courtesy: Bangla Tribune 

তারপর ক্রিজে এলেন ডেমিয়েন মার্টিন। তাঁকে সাথে নিয়ে প্রাথমিক বিপর্যয় সামলে নিলেন আরেক কিংবদন্তী ওপেনার ম্যাথু হেইডেন। কিন্তু মাশরাফি, তাপস, নাজমুলদের নিয়ন্ত্রিত বোলিং সহজে রান তুলতে দিচ্ছিলনা তাদের। তাই রান রেট তখনও ৪ এর নিচে। খানিকটা চাপের মুখে ইনিংসের ১৬তম নাজমুলের বলে ক্লিন বোল্ড হলেন হেইডেন। দলীয় রান তখন ৫৭।

পন্টিংকে আউটের আবেদন তাপস বৈশ্যের

পন্টিংকে আউটের আবেদন তাপস বৈশ্যের; Image courtesy: ESPNcricinfo

নতুন ব্যাটসম্যান হিসাবে আসলেন মাইকেল ক্লার্ক। তাঁকে সাথে নিয়ে মার্টিন গড়লেন অসাধরণ একটি শত রানের জুটি কিন্তু মিডেল ওভারে আফতাব আহমেদ এবং মোহাম্মদ রফিকের টাইট বোলিংএর জন্য হাত খুলে খেলতে পারেননি দুজন। তবে শেষের দিকে মিস্টার ক্রিকেট মাইক হাসি আর সাইমন ক্যাটিচের ঝড় ইনিংসের উপর ভর করে ২৫০ রানের চ্যালেঞ্জিং টার্গেট ছুড়ে দিল অস্ট্রেলিয়া। ২০০৫ সালের ক্রিকেটীয় আইন এবং উইকেটের বিচারে ৫০ ওভারে ২৫০ টার্গেট মন্দ নয়। বিশেষ করে গ্লেন ম্যাগ্রা, জেসন গিলেস্পি আর ব্র্যাড হগের মত বোলাদের বিপক্ষে এই রান সংগ্রহ করা সত্যিই দুরূহ ব্যাপার ছিল।

ঐ যে আগেই বলেছিলাম বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তদের প্রত্যাশা তখনও সম্মানজনক হার পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। তাই খুব কম মানুষই আসলে আশাবাদী ছিলেন এই টার্গেট চেজের ব্যাপারে। অনেকেই ভেবেছিল উইকেটই বোধ হয় বোলার ফ্রেন্ডলি।

তাদের কথার প্রমাণ কিন্তু মিলল বাংলাদেশের ইনিংসের শুরুতেই। ম্যাগ্রা-গিলেস্পি জুটির সামনে মোটেও সুবিধে করতে পারছিলনা টাইগার ওপেনাররা। অষ্টম ওভারে দলীয় মাত্র ১৭ রানের মাথায় জেসন গিলেস্পির বলে কট বিহাইন্ড হলেন নাফিস ইকবাল। তারপর বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের সেনসেশন তুষার ইমরানকে সাথে নিয়ে জাভেদ ওমর আস্তে আস্তে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। স্বাচ্ছন্দে খেলতে থাকা তুষার ইমরান আউট হয়ে গেলেন ব্র্যাড হগের বলে। দেখে শুনে খেলতে থাকা জাভেদ ওমর বেলিমও কিছুক্ষণ পর আউট হয়ে ফিরে গেলেন সাজঘরে। অপর প্রান্তে তখন দলীয় অধিনায়ক হাবিবুল বাশার। ততক্ষণে ২১ ওভারের খেলা শেষ কিন্তু বাংলাদেশের রান মাত্র ৭২! এরকম সময়ে ক্রিজে আসলেন মোহাম্মদ আশরাফুল।

ঠিক তখন পর্যন্ত এই ম্যাচটা আর দশটা সাধারণ ম্যাচের চেয়ে বেশি ছিলনা। বাংলাদেশের ব্যাটিং মানেই তখন ভাল খেলতে খেলতে হঠাৎ করে ধ্বসে পড়া। যারা সেটা ভেবে তখনই হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন তারা আসলে অনুমানও করতে পারেননি কি হতে চলেছে সামনের দেড় ঘন্টায়।

আশরাফুল স্বভাব সুলভ সাবলীল ব্যাটিং করে যাচ্ছিলেন আর হাবিবুল ছিলেন কিছুটা রক্ষণাত্মক। মোটামুটি ৩০ ওভার পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছিল দুজনের কেউই জয়ের কথা ভেবে খেলছেন না, শুধু স্বাভাবিকটা ঠান্ডা মাথায় দিয়ে যাচ্ছেন। ৩১ ওভার শেষে দলীয় রান ১০২, দরকার আরও ১৪৮ রান। হাতে বাকি মাত্র ১৯ ওভার! টি ২০র জামানা তখনও আসেনি। তাই ১৯ ওভারে ১৪৮ রান করা অনেক বড় ব্যাপার সেই সময়ের বাংলাদেশের জন্য।

কিন্তু আশরাফুল বোধ সেদিন ব্যাপারটাকে মোটেও বড় করে দেখেন নি। হয়ত সেজন্যই ৩২তম ওভার থেকে খেলার মোমেন্টাম অন্যদিকে সরে যেতে শুরু করল। একে একে আশরাফুলের ব্যাট থেকে বেরিয়ে আসছিল চমৎকার সব শট। অবাক বিস্ময়ে সারা পৃথিবী দেখল বাংলাদেশের লিটল মাস্টার আশরাফুলের সেই বিখ্যাত স্কুপ প্যাডেল। ধারাভাষ্যকার আতাহার আলী খানের ভাষায় যেটা “চিকি শট”। তরতর করে সামনে এগিয়ে যেতে থাকল বাংলাদেশের রানের চাকা। হাবিবুল বাশারের কথা না বললে বোধ এই মহাকাব্য অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। তিনি ঠান্ডা মাথায় গাইড করে যাচ্ছিলেন আশরাফুলকে আর চমৎকার ভাবে পালন করেছিলেন তাঁর সাপোর্টিং রোল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে মিসফিল্ডিং থেকে অতিরিক্ত রান নিতে গিয়ে রান আউট হয়ে গেলেন তিনি। মাত্র তিন রানের জন্য মিস করলেন অর্ধশতক। দলীয় রান তখন ৪৪ ওভারে ২০২।

জয়ের জন্য দরকার ৪৮। প্রয়োজন ওভার প্রতি ৮ রানের। সেট ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ আশরাফুল হিসাব করেই এগুচ্ছিলেন। ৪৭ তম ওভারের শেষ বলে তুলে নিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম শতক। সম্ভবত পরিস্থিতির বিচারে এখন পর্যন্ত যেকোন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানের খেলা সেরা ইনিংস ছিল সেটি। তবে সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে পরের বলেই আউট হয়ে ফিরে গেলেন তিনি।

সেই মহাকাব্যিক সেঞ্চুরির পর মোহাম্মদ আশরাফুল

সেই মহাকাব্যিক সেঞ্চুরির পর মোহাম্মদ আশরাফুল; Image courtesy: Egiye_Cholo

চারদিকে তখন টানটান উত্তেজনা। বাংলাদেশ কি পারবে? এতক্ষণ যে স্বপ্ন হাবিবুল এবং আশরাফুল মিলে দেখিয়েছেন সেটা শুরুতে কেউ কল্পনাও করার সাহস পায়নি। কিন্তু স্বপ্নজয়ের এত কাছাকাছি এসে যদি স্বপ্নভঙ্গ হয়? মানুষ কি পারবে সেটা সহ্য করতে? ইংল্যান্ডে তখনও দিন তবে বাংলাদেশে সময় রাত সাড়ে ৯টার মত। রাস্তায় রাস্তায়, বাড়িতে বাড়িতে কোটি মানুষের চোখ তখন টিভির দিকে।

মোহাম্মদ রফিক এবং আফতাব মিলে পরের দুই ওভারে তুলে নিলেন ১৬ রান। শেষ ওভারের সমীকরণ দাঁড়াল তাই ৬ বলে ৭ রান। সবাই যখন ভাবছিল সিঙ্গেল নিয়ে নিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছাবার কথা সেই সময়ে টিনএজার আফতাব হয়ত ভাবছিলেন অন্যকিছু। ওভারের প্রথম বলটিকেই বোলার গিলেস্পির মাথার উপর দিয়ে সোজা পাঠিয়ে দিলেন মাঠের বাইরে! এর সাথেই বাইরে পাঠিয়ে দিলেন অজিদের মান বাঁচানোর শেষ আশাটুকুও। পরের বলেই এল সেই বহুল কাঙ্খিত সিঙ্গেলটি।  বাংলাদেশ পৌঁছে গেল স্বপ্নজয়ের বন্দরে। আজও আফতাবের সেই ছক্কাটা আপ্লুত করে কোটি কোটি ক্রিকেট পাগল বাংলাদেশীকে। খুব বেশি লম্বা ক্যারিয়ারের মালিক না হলেও বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা আজও এই হার্ড হিটারকে মনে রেখেছেন ঐ ছক্কার জন্য।

অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার জন্য রাতটা ছিল ভয়ানক রকমের আতংকের এবং হতাশার। রিকি পন্টিং এই হারকে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে হার বলেছিলেন। তবে অজি অধিনায়কের এই দম্ভোক্তি আসলে বেশিদিন আর স্থায়ী হয়নি। সেবার আসন্ন অ্যাশেজেই সমাপ্তি ঘটে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের অপরাজেয় যুগের। বিশ বছর পর  ২-১ হেরে তাদের অ্যাশেজে হাত ছাড়া হয়।

বিমর্ষ পন্টিং

হারার পর বিমর্ষ পন্টিং; Image Courtesy: ESPNcricinfo

সেই রাতে মানুষের অনুভূতি কেমন ছিল সেটা বোধ হয় লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কারণ সেই রাতটি ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটপ্রেমীদের স্বপ্ন পূরণের রাত। ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকার রাত। যে ইতিহাস শুধু একটি ম্যাচ জয়ের নয়, একটি স্বপ্ন পূরণের। যে ইতিহাস রচনা করবে একটি মহাকাব্যের। যে মহাকাব্যের নাম অস্ট্রেলিয়া বধকাব্য! যার নায়ক হিসাবে কোটি ভক্তের হৃদয়ে আশরাফুল, হাবিবুল আর আফতাবরা বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে।

অস্ট্রেলিয়া বধের পর টাইগারদের উদযাপন

অস্ট্রেলিয়া বধের পর টাইগারদের উদযাপন; Image Courtesy: ESPNcricinfo

বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায় এই সংবাদটা ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম বড় আপসেট হিসাবে প্রচার করা হলেও ততক্ষণে সারা পৃথিবী শুনতে পেয়েছে বাঘের গর্জন। বিশ্ববাসী বুঝতে পেরেছিল আচিরেই এক নতুন শক্তির আগমন ঘটতে চলেছে ক্রিকেট বিশ্বে!

সেই মহাকাব্যিক ম্যাচটির পর কেটে গেছে আরও প্রায় একযুগ। এখন ক্রিকেটের মাঠে বাংলাদেশ আর সেই আগের বাংলাদেশ নেই। আমরা লড়তে শিখেছি, জিততে শিখেছি। একের পর এক ওডিআই সিরিজ জিতেই চলেছি। কিন্তু কোটি কোটি ক্রিকেট প্রেমীর মনে কার্ডিফ কীর্তির আবেদন এত টুকুও কমেনি। তাই তো সুযোগ পেলে আজও আমাদের বারবার পড়তে ইচ্ছে করে অস্ট্রেলিয়া বধের সেই অজর কাব্য।

This article is in Bangla. It is about a famous win of Bangladesh cricket team against Australia.

Featured Image: Daily Pakistan

Related Articles