Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নেই ফুলের তোড়া, নেই কোলাহল

সকাল থেকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। ২৭শে আষাঢ়ে প্রায় দিনভরই ক্রন্দনরত ছিল ঢাকার আকাশ। বাদলমুখর দিনটার পড়ন্ত বিকেল নগরবাসীর জীবনে বাড়তি উত্তেজনার সঞ্চার করেনি। আর সব দিনের তুলনায় কোনো ভিন্নতা ছিল না। নিত্যদিনের মতোই কেটেছে। কেউ হয়তো বাসায়-অফিসে বসে টিভিতে চোখ রেখেছেন, কেউ বা বাসে যাত্রাপথে তথা চলাচলের ব্যস্ততার মাঝে অর্ন্তজাল দুনিয়ায় দেশের খবরাখবরের সর্বশেষ দেখছিলেন।

এমন নিস্তরঙ্গ আবহেই ২৭শে আষাঢ় (গত ৭ জুলাই) দেশে ফিরেছিল বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। প্রায় আড়াই মাসের ইউরোপ সফর শেষে মাতৃভূমিতে ফিরেছেন ক্রিকেটাররা। কিন্তু হযরত শাহ জালাল (রাঃ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ছিল না গণমানুষের ভিড়। বিশ্বকাপের রঙ্গমঞ্চ থেকে বিরস বদনে ফেরা ক্রিকেটারদের জন্য ছিল না ফুলের তোড়া। জনাপঞ্চাশেক সংবাদকর্মী ছাড়া বিমানবন্দরে টাইগারদের অপেক্ষায় ছিল না কেউই। বিসিবির বড় কর্তাদের চেহারাও দেখা যায়নি।

নয় ম্যাচের তিনটিতে জয়, পাঁচটিতে হার, একটি ম্যাচ বৃষ্টিতে পন্ড হয়েছিল। সেমিফাইনালে খেলার স্বপ্নের সমাধি রচিত হয়েছিল ভারতের কাছে হেরে। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ মিশনকে ‘ব্যর্থ’ ট্যাগ দেয়াটা তাই ভুল হবে না। সফলতার পর বিমানবন্দরে দুধের মাছি’র ভীড় জমে যায়, এরাই আবার ব্যর্থতার গন্ধ পেলে পালিয়ে যায়। ৭ জুলাই তাই ক্রিকেটারদের দেশে ফেরাটা ছিল সাদামাটাই। অথচ এবারের ইউরোপ সফরের শুরুর দিকে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ জিতেছিল বাংলাদেশ। দেশের ইতিহাসে প্রথমবার বহুজাতিক টুর্নামেন্টে ট্রফি জয়ের ইতিহাস গড়েছিল টাইগাররা।

Image Credit: Firoz Ahmed / The Daily Star

বিশ্বকাপে ব্যর্থতার স্রোতে হারিয়ে গেছে ওই অনন্য অর্জন। সেমিফাইনালের লড়াই থেকে ছিটকে পড়ার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রীতিমতো মুণ্ডুপাত হচ্ছিল ক্রিকেটারদের। অর্ন্তজালে কথার তুবড়ি ছোটানো, সমালোচনার হুল ফোটানো, স্তুতি করতে অনেক সময় গিয়ে সীমা অতিক্রম করে ফেলা সমর্থকদের দলটাও ছিল না এদিন বিমানবন্দরে। পছন্দের ক্রিকেটারের সঙ্গে সেলফি তোলা, সই শিকারীদের দেখা যায়নি। আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইয়ান-বিয়ানদের অভাব নেই। কোটি কোটি ক্রিকেট ফলোয়ার রয়েছে দেশে, তবে বিমানবন্দরে ক্রিকেটাদের ফেরার সময়ে তাদের উপস্থিতি ছিল না। এটুকু হয়তো নির্জলা সত্য যে, এসব সমর্থকরা অনেকেই আসলে সুসময়ের সঙ্গী, অসময়ে তারকাদের ছায়াও মাড়ান না তারা।

বাঘের ডোরাকাটা বস্ত্র জড়ানো, সঙ্গে লাল-সবুজ পতাকা হাতে নিয়ে বিমানবন্দরে এসেছিলেন ‘সবেধন নীলমনি’ এক সমর্থক। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হাড্ডিসার পারফরম্যান্সের ন্যায় এই সমর্থকও ছিলেন ম্রিয়মান। পুরোটা সময় ইতি-উতি ঘুরে বেড়িয়েছেন। বিমানবন্দরের উৎসুক কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তোলা, কয়েকবার পতাকা দোলানোতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন তিনি। ক্রিকেটারদের কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করেও সফল হননি জনৈক ওই সমর্থক।

মলিন মুখে একের পর এক ক্রিকেটাররা বিমানবন্দর ছেড়েছেন। সবার আগে তামিম ইকবাল বের হন। দ্রুতবেগে গাড়ি চড়েই গ্লাস তুলে দেন তিনি। সংবাদকর্মীরা ঘিরে ধরলেও কথা বলেননি বাঁহাতি এই ওপেনার। তারপর একে একে মোহাম্মদ মিঠুন, রুবেল হোসেন, সৌম্য সরকার, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, মুস্তাফিজুর রহমান বের হয়ে আসেন। সবাই মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। গাড়িতে উঠতে উঠতে মোসাদ্দেক দু’টি বাক্য ব্যয় করেছেন অবশ্য। হতাশ কন্ঠে এই তরুণ অলরাউন্ডার বলেছেন, ‘মন খুব খারাপ, ভাই সবার মন খারাপ।’

কাছে এগিয়ে যেতেই ভ্রমণক্লান্তিতে বিধ্বস্ত মিঠুন বলে উঠেছেন, ‘ভাই, আমি এখন কথা বলতে পারবো না।’ ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, চেনা-পরিচিত সাংবাদিকদের চোখের দিকেও তাকাননি ক্রিকেটাররা। নিজেদের গাড়িতে চেপে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন হতাশার বিশ্বকাপ শেষে ফেরা ক্রিকেটাররা। সবার পরে বিমানবন্দর ত্যাগ করেন মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। তারাও মিডিয়ার সামনে কথা বলতে রাজি হননি।

বিমানবন্দরে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের একাংশ; Image Credit: AFP

সাকিব আল হাসান, লিটন দাস, সাব্বির রহমান ও মেহেদী হাসান মিরাজ ছাড়া দলের সব ক্রিকেটারই ফিরেছিলেন একই সাথে। আবু জায়েদ রাহী অবশ্য বাড়ি না ফিরে ব্যাঙ্গালোরে উড়াল দিয়েছিলেন। দলটার সঙ্গে ঢাকায় ফিরেছেন হেড কোচ স্টিভ রোডস। এছাড়া কোচিং স্টাফের আর কোনো সদস্য ফিরেননি।

অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা অবশ্য সতীর্থদের মতো মুখ লুকিয়ে অকুস্থল ত্যাগের সুযোগ ছিল না। দলের পক্ষ মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। হতাশার ছাপ স্পষ্ট ছিল নিজের ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ খেলে আসা মাশরাফির চোখে-মুখেও।

ব্যর্থতার দায় নিয়েছেন মাশরাফি

ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের মাপকাঠিতে উজ্জ্বল ছিলেন সাকিব আল হাসান। কিন্তু বিশ্বকাপে দলগতভাবে ব্যর্থই বলতে হবে বাংলাদেশ দলকে। র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের পর অবস্থান করা ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আফগানিস্তানকে হারিয়েছিল টাইগাররা। বড় দলগুলোর মাঝে শুধু দক্ষিণ আফ্রিকাকেই হারাতে সক্ষম হয়েছে মাশরাফি বাহিনী।

সময়ের সেরা দল, সবচেয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দল নিয়ে বিশ্বকাপে গিয়েও ফিরতে হলো ভগ্ন মনঃরথে। বিশ্বকাপে ব্যর্থতার দায়ভার নিয়েছেন মাশরাফি। বিমানবন্দরে ওয়ানডে অধিনায়ক বলেছেন,

‘প্রথম তো অধিনায়ক হিসেবে দলকে সেই জায়গায় যখন না নিতে পারব, তখন সমালোচনা আমাকে নিতে হবে এবং পুরো দলের দায়ভার নিতেই হবে। আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে তাকেও নিতে হতো। আমি অবশ্যই সেই দায়ভার নিচ্ছি। আর সমালোচনা সারা বিশ্বে টুর্নামেন্টের সময় হয়, বিশ্বকাপে তো আরও বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। বলতে চাই, কিছু জিনিস আমাদের পক্ষে গেলে আমাদের দল আজ অন্য জায়গায় থাকতে পারত।’

Image Credit: AFP

প্রত্যাশা মেটাতে না পারার আক্ষেপ

বিশ্বকাপে ছয়বার অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপ অভিষেকে দু’টি জয়, ২০০৩ বিশ্বকাপে জয়শূন্য ছিল বাংলাদেশ। পরের তিন আসরে (২০০৭, ২০১১, ২০১৫) তিনটি করে জয় নিয়ে ফিরেছিল টাইগাররা। অতীতকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আশায় এবার গিয়েছিল মাশরাফির দল। কিন্তু আগের তিন আসরের মতোই এবারও তিন জয় নিয়েই ফিরতে হলো বাংলাদেশকে। সেমি’র স্বপ্ন তিমিরে হারিয়েছে।

দলের এমন পারফরম্যান্সে অধিনায়কও হতাশ। মাশরাফি বিমানবন্দরে বলেছেন,

‘যে প্রত্যাশা নিয়ে গিয়েছিলাম, সেই জায়গা থেকে অবশ্যই হতাশ। পুরো দলই হতাশ। কিন্তু যদি পুরো বিশ্বকাপ দেখেন, কিছু জায়গায় ভাগ্য যদি আমাদের পক্ষে থাকতো, আমরা সেমিফাইনালে যেতে পারতাম। কিন্তু ওভারঅল খেলার ধরন যেমন ছিল, সেটা ইতিবাচক ছিল।’

Image Credit: Getty Images

শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বৃষ্টিতে পন্ড হওয়া ম্যাচটি ক্ষতি করেছে বাংলাদেশের। ভারতের কাছে হারের আগ পর্যন্ত সেমির আশায় ছিল গোটা দল। মাশরাফি বলেছেন,

‘হয়তো ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগ পর্যন্ত সেমিফাইনালের অফিসিয়ালি চান্স ছিল। সাকিব এবং মুশফিক ছাড়া কেউই তেমন ধারাবাহিক ছিলেন না। ভাগ্যও আমাদের পক্ষে ছিল না। একই সাথে বৃষ্টি অনেক বড় ক্ষতি করেছে কয়েকটি ম্যাচে। শুধু আমাদের না, অনেক দলই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আবার অনেকের সুবিধা হয়েছে। শেষ ম্যাচ জিততে পারলে হয়তো পাঁচে যাওয়ার সুযোগ ছিল। সবার আশা ছিল, সেমিফাইনাল খেলবো। পাঁচে থাকলে হয়তো আলাদা জিনিস হতো। কিন্তু শেষ চারে যদি না থাকতে পারি, এই বিশ্বকাপের মিনিং কিন্তু এখানেই শেষ।’

ব্যর্থতার এই মিছিলেও ব্যাটে-বলে ঈর্ষণীয় পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন সাকিব। ৬০৬ রান ও ১১ উইকেট নিয়ে কার্যত বাংলাদেশের আশার মশাল জ্বালিয়ে রেখেছিলেন তিনি। মুশফিকুর রহিম, মুস্তাফিজুর রহমান, সাইফউদ্দিনদের ব্যক্তিগত কিছু পারফরম্যান্স ছিল বিশ্বকাপে; যার প্রশংসা করেছেন মাশরাফি। তিনি বলেছেন,

‘প্রথমত, সাকিব আউটস্ট্যান্ডিং ক্রিকেট খেলেছে। মুস্তাফিজ, সাইফ, মুশফিক খুবই ভালো করেছে। বাকি সবাই ইন অ্যান্ড আউট পারফর্ম করেছে, আমার কাছে মনে হয়। কিন্তু এই চারজন আমার কাছে মনে হয় এক্সট্রাঅর্ডিনারি পারফরম্যান্স করেছে।’

চোখ ঝলসে না দিলেও আলো ছড়াতে ভোলেননি মুস্তাফিজ; Image Credit: UNB

তরুণদের কাঁধে মাশরাফির হাত

গত কয়েক বছরে দলের ব্যর্থতায় তরুণদের কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে বারবার। এবারও বিশ্বকাপে সৌম্য সরকার, সাব্বির রহমানরা নিজেদের মেলে ধরতে পারেননি। তবে মুস্তাফিজ, সাইফউদ্দিন, মোসাদ্দেক, মিরাজ খারাপ করেননি। এবার বিশ্বকাপে ব্যর্থতার মিছিলে অবশ্য সিনিয়রদের মধ্যে মাশরাফি, মাহমুদউল্লাহ, রুবেল, তামিমদের নামও রয়েছে। তাই শুধু তরুণদের দুষতে রাজি নন অধিনায়ক।

তরুণদের পাশে দাঁড়িয়ে মাশরাফি বলেছেন,

‘তরুণ ক্রিকেটারদের সবসময় এক নাগাড়ে দোষারোপ করা হয়। আমি মনে করি আজকে যারা সিনিয়র তারাও এক সময় তরুণ ছিল। সে সময় ওতটা ধারাবাহিক ছিল না। আজকের তরুণ যতটুকু ধারাবাহিক খেলেছে এবং অনেক চাপের মাঝেও যেমন খেলছে, আমরা যখন তরুণ ছিলাম সে সময় আমরা এটা পারিনি। এক তরফা তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারাও অনেক চেষ্টা করেছে। এই মঞ্চ অনেক বড় তাই এতটা সহজ না। আমি আশা করি অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আজকের সাকিব, মুশফিক, তামিমদের মতো এরাও হবে।’

This article is in Bangla language. It is a feature story about the nature of our goldfish memory, 2019 world cup disaster and quotes of Mashrafe Bin Mortaza on how the world cup could've turned out. 

Featured Image: Saiful Islam / Prothom Alo

Related Articles