টেস্টে এই বছরেই ওয়েস্ট ইন্ডিজে সফর করেছিল বাংলাদেশ। সেবার ওয়ানডেতে সিরিজ জিতলেও, সাদা পোশাকের দুই টেস্টে লজ্জার হারের রেকর্ড নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন সাকিব-তামিমরা। এরপর চলতি ডিসেম্বরে সেই ক্যারিবিয়ানদেরই বাংলাদেশের মাটিতে এনে টেস্টে হারালো সেই সাকিবরাই। শুধু তাই নয়, ওয়ানডেতেও সিরিজ জয়ের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছেন মাশরাফি বিন মুর্তজারা। টি-টোয়েন্টিতে এখন পর্যন্ত তিন ম্যাচের সিরিজে ১-১ ড্র।
এ তো গেল বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প। পরিস্থিতির উল্টো পিঠ বলছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যর্থতার গল্প। শুধু বাংলাদেশের বিপক্ষে নয়, দীর্ঘ সময় ধরে প্রায় সব প্রতিপক্ষের বিপক্ষেই বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে জেসন হোল্ডার-শেই হোপদের দলটি। বোর্ডের সঙ্গে শীতল সম্পর্কের কারণে মাঠের বাইরে আছেন ক্রিস গেইল-মারলন স্যামুয়েলসরা। প্রায় প্রতি সিরিজেই আসছে একাধিক নতুন মুখ। সব মিলিয়ে বিপাকে একসময়ের এই বিশ্বসেরা এই দল। সাবেক কোচ স্টুয়ার্ট ল'য়ের পদত্যাগের পর দলের হাল ধরেছেন তৎকালীন সময়ের ফিল্ডিং কোচ নিক পোথাস। তারপর থেকেই দলের সেরাটা বের করে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তাতে করে যে খুব বেশি সুবিধা করতে পারছেন এই অন্তর্বর্তীকালীন কোচ, তেমনটাও নয় । রয়েছে একাধিক বাধা-বিপত্তি, রয়েছে সম্ভাবনার সূর্যোদয়। সব কিছু নিয়েই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে, নিজের কোচিং নিয়ে ক্রিকবাজে এক সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন সাবেক এই দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার।
আপনি শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুই দলেই ফিল্ডিং কোচ হিসেবে কাজ শুরু করেছেন, তারপর অন্তর্বর্তীকালীন হেড কোচের দায়িত্ব পেয়েছেন। তো একটার আংশিক দায়িত্ব থেকে পুরো দায়িত্ব পাওয়াটা আপনি কিভাবে দেখেন?
দু'টির মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। দুই দলেই আমি সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করেছি। তারপর যখন আমাকে প্রধান কোচের দায়িত্ব দেওয়া নিয়ে কথা উঠেছে, আমি নিজেকে মানিয়ে নিয়েই ভেবেছি। এটা কেবল গ্রাহাম ফোর্ড অথবা স্টুয়ার্ট ল’য়ের পদটাতে নিজেকে দেখা।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে কোচিং করানোর সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার কোনটি?
সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বিষয় হলো, ক্রিকেটারদের দলে নিয়মিত আসা-যাওয়ার ঘটনা। আপনি একাধিক সফর কিংবা সিরিজের জন্য একই দল আর পাবেন না। কিছু ছেলে যদি এই সিরিজে থাকে, পরের সিরিজে তারা থাকবে না। এটা খুব কঠিন একটা ব্যাপার। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা ভালো। যেমন তরুণরা দলে আসছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ পাচ্ছে। আবার এটাও সত্যি যে, আপনি যদি সবাইকে একসাথে নিয়ে টানা খেলতে না পারেন, তাহলে দলের যে একটা ‘ব্র্যান্ড’ ব্যাপার থাকে সেটা তৈরি হবে না। আপনি যদি বাংলাদেশের দিকে তাকান, তারা প্রায় প্রতি ম্যাচে প্রতি সিরিজে একই দল মাঠে নামায়। এটা দলের শক্তি বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপটার দিকে খেয়াল করুন, 'ওয়েল সেট'। যখন আপনি দলে সিনিয়র ক্রিকেটার পাবেন, কোচ হিসেবে আপনার কাজটা সহজ হয়ে যাবে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের কোন কোন জায়গাগুলোতে উন্নতির প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন?
আমাদের দলের অনেক জায়গায় কাজ কররার প্রয়োজন রয়েছে। দল হিসেবে আমরা মনে হয় কিছুটা পিছিয়ে আছি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ধারাবাহিক পারফর্মারের অভাব আছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য প্রয়োজনীয় 'হার্ড-পারফরম্যান্স' পরিবেশের অভাব আছে। আমি জানি, দলের সবাই এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। সেক্ষেত্রে ঘরোয়া ক্রিকেট, বিশেষ করে প্রতিযোগিতামূলক প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের নিয়মিত আয়োজন এবং পেশাদার ক্রিকেটারদের জন্য আরও বেশি একাডেমি তৈরির দরকার আছে।
কথার কথা, যে ছেলেটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছে, তার এই উচ্চতায় অনুশীলনের ব্যাপারে, স্বাস্থ্যের ব্যাপারে, গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে, এই ধরণের সফরে কি ধরণের ক্লান্তি আসতে পারে, সেক্ষেত্রে এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কি; এগুলো যদি তাদেরকে তরুণ বয়স থেকে সেই পরিবেশ দিয়ে শিখিয়ে আনা হয়, সেই সুযোগ করে দেওয়া হয়, তাহলে অবশ্যই ভালো ফল পাওয়া যাবে।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয় যে ইংল্য্যান্ডের হেডিংলিতে দারুণ এক টেস্ট জিতেছিল ক্যারিবিয়ানরা। আপনার কি মনে হয় তারা এখন সঠিক পথে আছে?
আমরা টেস্ট সিরিজ জিতেছিলাম, খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। আমরা ঘরের মাঠে সিরিজ ড্র করেছিলাম, একটা সিরিজ জিতেছিলামও (শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের বিপক্ষে)। কিন্তু আমরা যখনই উপমহাদেশে খেলতে আসি, তখনই আমরা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাই। তাছাড়া এই কন্ডিশনে নিজেদের তৈরি করাটাও অনেক কঠিন। মূল সিরিজ শুরু করার আগে বাংলাদেশ, ভারত কিংবা শ্রীলঙ্কার কন্ডিশনে অন্তত দুই থেকে তিন সপ্তাহ ক্যাম্প করা উচিত। এখানে খেলা অনেক কঠিন। আপনি যদি এখানে দু'টি টেস্ট ম্যাচ খেলেন, তাহলেও এর মধ্যে জায়গা করে নেওয়া কঠিন হয়ে যায়। অর্থাৎ, টেস্ট দলটা এমন দোলাচলের মধ্যে দিয়ে যায়। আবার টি-টোয়েন্টি দল একেবারে শক্ত দল, যারা জানে কীভাবে এখানে খেলতে হয়।
ভারত ও বাংলাদেশ সফরকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আপনি যখন ভারতে খেলতে আসবেন, তখন যদি সফরে আপনার অর্জন নিয়ে কথা বলতে যান, তাহলে প্রতিবারই দেখবেন আপনি খুশি নন। অর্থাৎ ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, ভারতে খেলতে চলো আর ভালো ক্রিকেটার হয়ে ফিরে আসো; ভুলেও তোমার অর্জনকে জয় আর পরাজয়ের হিসেব দিয়ে বিচার করতে যেও না। কিন্তু যখন বাংলাদেশে খেলতে আসবেন, তখন অবস্থাটা ভিন্ন। আমি যেহেতু শ্রীলঙ্কা দলের কোচিং করিয়েছি, আমি জানি অবস্থাটা। এশিয়ায় ক্রিকেট বোর্ড এবং বোর্ড প্রেসিডেন্টদের কাছ থেকে অনেক চাপ আসে। এখানে প্রতিপক্ষের জন্য যেমন উইকেট হবে, তা দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এখানকার ট্রেনিংয়ের সুযোগ দেখেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। আপনি এবং আপনার দল যদি এদিকে খুব নিয়মিত সফর না করেন, তাহলে আপনাদের কপালে নিশ্চিত দূর্গতি আছে। আবারও সেই ভারতের কথাই আসবে পুরো এশিয়ার ক্ষেত্রে। যদি আপনি এখানে অনেকবার আসেন, তাহলে আপনি একজন ভালো মানুষ ও ভালো ক্রিকেটার হয়ে এখান থেকে বিদায় নিতে পারবেন।
একেকটি সিরিজের প্রস্তুতির ব্যাপারে দক্ষিণ আফ্রিকা অনেক বেশি পদ্ধতিগত ও বিশ্লেষণমূলক নিয়ম মেনে চলে। অন্য্যদিকে, শ্রীলঙ্কা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ এ ব্যাপারে স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধির উপর নির্ভর করে। এই যে আলাদা দুই ধরণের পথ, আপনি কিভাবে গ্রহণ করতে পেরেছেন?
দুই মাধ্যম আপনাকে মিশিয়ে ফেলতে হবে। ভিন্ন ভিন্ন দলকে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ও পরিবেশে কোচিং করাতে গেলে আপনাকে সময় নিতে হবে, বুঝতে হবে। কারণ আপনি চাইলেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিংবা শ্রীলঙ্কায় দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট সংস্কৃতি টেনে আনতে পারবেন না, কাজে লাগাতে পারবেন না। তো আমরা যেটা করতে পারি, তা হলো নতুন সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে তাদের সহজাত ব্যাপারগুলো ঠিক রাখার পাশাপাশি খানিকটা প্রযুক্তি, খানিকটা বিশ্লেষণ যোগ করে দলকে এগিয়ে নিতে পারি। ভারত এই কাজটা সবচেয়ে ভালো করছে। আমি গ্যারি কারস্টেনের সঙ্গে এ নিয়ে অনেক কথা বলেছি, তার কাছ থেকে শিখেছি এবং তার বুদ্ধি গ্রহণ করেছি। আপনি যদি বর্তমানের ভারতীয় ক্রিকেট দলকে দেখেন, তারা যেভাবে কাজ করছে সেই দক্ষতা তাদের অনেক আগে থেকেই ছিল।
আপনার কি মনে হয়, ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক ক্রিকেট ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে?
আমি এই মুহূর্তে এই বিষয়ে কথা বলার সেরা অবস্থানে নেই। তবে আমি যেটা বলতে পারি তা হলো, দলের সেরা ক্রিকেটার ছাড়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অনেক কঠিন। এটুকু বলেই হয়তো আমি বুঝাতে পারছি যে আসলে দলে কী হচ্ছে।
This is an interview of Nic Pothas, the interim coach of West Indies national cricket team. Here, he discussed the present and the future of WI cricket.
Feature Photo: AFP