বিশ্বকাপের পর্দা নেমেছে আগেই। উদযাপন আর আফসোসের হা-হুতাশ অবশ্য থেমে নেই। চলছে পারফরম্যান্সের কাঁটাছেঁড়া। সবকিছু মিলিয়ে এখনও বিশ্ব ক্রীড়াক্ষেত্রের মূল আকর্ষণ ক্রিকেট বিশ্বকাপ। এরই মধ্যে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি ঘোষণা করেছে আইসিসি'র বিশ্বকাপ একাদশ। পুরো টুর্নামেন্টে যারা ব্যাটে-বলে আলোকিত করেছে, সেই সেরাদের নিয়েই আইসিসির মূল একাদশ। দেখে নিন, আপনার তৈরি একাদশের সাথেও মিলে যায় কি না!
রোহিত শর্মা (ভারত)
একদিনের ক্রিকেটের ব্যাটিং র্যাংকিংয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন ভারতীয় ব্যাটসম্যান রোহিত শর্মা। কেন তিনি এই দ্বিতীয় শীর্ষস্থান দখল করে আছেন, তা বিশ্বকাপে রেকর্ড গড়েই বুঝিয়ে দিয়েছেন। ডানহাতি এই ওপেনার ভারতের পক্ষে একাধিক ম্যাচে জয়ের কাণ্ডারি হয়েছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অপরাজিত সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। মাত্র শেষ হওয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় এই টুর্নামেন্টে রোহিতের ব্যাটে ভারত পেয়েছে পাঁচটি সেঞ্চুরি। ইংল্যান্ড, বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পরপর তিন ম্যাচেই শত রানের ইনিংস খেলেছেন। এক বিশ্বকাপে পাঁচটি সেঞ্চুরি করার মাধ্যমে গড়েছেন নতুন রেকর্ড। এক আসরে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি এর আগে ছিল চারটি, যা করেছিলেন শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান কুমার সাঙ্গাকারা। ২০১৫ বিশ্বকাপে এই রেকর্ড গড়েন সাবেক এই লঙ্কান অধিনায়ক।
ইনজুরির কারণে নিয়মিত ওপেনার শিখর ধাওয়ানের বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেলে রোহিত শর্মার দায়িত্ব বেড়ে যায় বহুগুণ। সেই রোহিত শর্মা পুরো টুর্নামেন্টে নয় ইনিংসে তোলেন ৬৪৮ রান, যা কি না টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ। এই রান তুলতে গিয়ে তিনি প্রায় ভেঙেই দিচ্ছিলেন স্বদেশী কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকারের ২০০৩ বিশ্বকাপের রেকর্ড। সেবার টেন্ডুলকার ৬৭৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন, যা এ যাবৎকালে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহের রেকর্ড।
জেসন রয় (ইংল্যান্ড)
ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপজয়ী দলে পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে দারুণ ভূমিকা রেখেছেন ওপেনার জেসন রয়। শ্রীলঙ্কার ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পরপর দুই ম্যাচে হার; সব মিলিয়ে দলের প্রয়োজনে দারুণ খেলেছেন এই ব্যাটসম্যান। বলে রাখা ভালো, যে দুই ম্যাচে ইংল্যান্ড হেরেছে, সেই দুই ম্যাচেই জেসন রয় হ্যামস্ট্রিংয়ের ইনজুরিতে ভুগছিলেন। তার অভাবটা ভালোই টের পেয়েছিল ইংল্যান্ড। সেমিফাইনালে জনি বেয়ারস্টো'র সাথে শতরানের জুটি তাদের ফাইনালের পথকে প্রশস্ত করেছে। পুরো টুর্নামেন্টে সাত ইনিংসে ৪৪৩ রান করেছেন, স্ট্রাইকরেট ছিল ১১৫.৩৬। সবকিছু মিলিয়েই বিশ্বকাপ একাদশের ওপেনিং জুটিতে রোহিত শর্মার পাশে জায়গা হয়েছে তার।
কেন উইলিয়ামসন (অধিনায়ক, নিউ জিল্যান্ড)
নিউ জিল্যান্ডের অসামান্য সাফল্যের পিছনে দলটির অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। ব্যাট হাতে উইকেটে কিংবা মাঠের নেতৃত্বে, প্রতিপক্ষকে কৌশলগতভাগে পরাস্ত করতে উইলিয়ামসন ছিলেন এক কথায় অপরাজিত। বিশ্বকাপ একাদশের অধিনায়ক হিসেবে তাকে নির্বাচিত করার অনেকগুলো কারণ আছে। তার নেতৃত্বগুণ, নির্ভরতা, দলকে একটি 'দল' হিসেবে এগিয়ে নেওয়া, সর্বোপরি তার 'স্পোর্টসম্যানশিপ' তাক লাগিয়েছে পুরো বিশ্বকে। ব্যাট হাতে ৮২.৫৭ গড়ে টুর্নামেন্ট জুড়ে ৫৭৮ রান করেছেন, জিতে নিয়েছেন 'প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট' পুরষ্কার, যার দাবিদার ছিলেন আরও কয়েকজন। মূলত তার আচরণ, তার ব্যক্তিত্ব, পারফরম্যান্স আর নেতৃত্বগুণ তাকে বিশ্বকাপ একাদশের নেতৃত্বে রাখতে সাহায্য করেছে।
জো রুট (ইংল্যান্ড)
চলতি বছরে জো রুট ইংলিশ দলের রানমেশিন হয়ে থেকেছেন। বিশ্বকাপের আসরেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। ইয়র্কশায়ারের এই ব্যাটসম্যান এবারের টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহের তালিকায় পাঁচ নম্বরে অবস্থান করছেন। তার সংগ্রহ ১১ ইনিংসে ৫৫৬ রান। অসাধারণ ব্যাটিংশৈলী আর মারকুটে ব্যাটিংয়ের কারণে ইংলিশ দলের ব্যাটিং লাইনআপে চার নম্বরে নিজের জায়গাটা পোক্ত করেছেন জো রুট।
সাকিব আল হাসান (বাংলাদেশ)
বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের আলোকবর্তিকা হয়ে থেকেছেন সাকিব আল হাসান। ব্যাটিং-বোলিং, দুই'য়ে অসাধারণ নৈপুণ্যের ধারাবাহিকতায় বিশ্বকাপ একাদশে তার নাম এসেছে খুব সহজে। বলা যায়, এবারের বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে সবচেয়ে মূল্যবান ক্রিকেটার। এবারের আসরে দারুণ এক রেকর্ড গড়েছেন এই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। তিনিই একমাত্র ক্রিকেটার, যিনি বিশ্বকাপের এক আসরে ৫০০ রান ও ১০ উইকেট নেওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। বাংলাদেশ দলের তিন নম্বর পজিশনের সফলতম এই ব্যাটসম্যান পুরো টুর্নামেন্টে ৮৬.৫৮ গড়ে সংগ্রহ করেছেন ৬০৬ রান। বাঁহাতি এই ক্রিকেটার দলের টপ অর্ডারে ছিলেন সেরা ফর্মে।
বেন স্টোকস (ইংল্যান্ড)
প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতেছে ইংল্যান্ড। আর সেই বিশ্বকাপের শুরু থেকে ফাইনালে জয়ের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন ইংলিশ অলরাউন্ডার বেন স্টোকস। পুরো টুর্নামেন্টে তার লড়াকু মনোভাব, আক্রমনাত্মক ব্যাটিং-বোলিং তাকে যেমন সাফল্য দিয়েছে মুঠোভরে, তেমনই দল পেয়েছে জয়ের মালা। শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পরপর দুই হারের ম্যাচে যখন টপ অর্ডার বিধ্বস্ত, তখন মিডল অর্ডারে যথাক্রমে অপরাজিত ৮২ ও ৮৯ রানের ইনিংস খেলেছেন স্টোকস। ফাইনালের ফলাফল মূলত বেন স্টোকসের হাত ধরেই সুপার ওভার পর্যন্ত গেছে। নিজের দারুণ মিডিয়াম পেস বোলিংয়ের সাথে অসাধারণ ব্যাটিং বিশ্বকাপের সেরা অলরাউন্ডারের তালিকায় তাকে রেখেছে দ্বিতীয় অবস্থানে, রয়েছেন সাকিবের পরেই।
অ্যালেক্স ক্যারি (উইকেটরক্ষক, অস্ট্রেলিয়া)
জস বাটলার, মহেন্দ্র সিং ধোনিদের যুগেও ২০১৯ বিশ্বকাপে দারুণ কিছু উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যানের দেখা মিলেছে। শাই হোপ এবং মুশফিকুর রহিমের কথাও মনে রাখতে হবে। তারপরও, অ্যালেক্স ক্যারি নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ্বকাপে নজর কেড়েছেন তার ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দিয়ে। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে যখন অস্ট্রেলিয়া ৯২ রানে ৫ উইকেট হারাল, তখন দলকে টেনে তুলেছিলেন এই অ্যালেক্স, ৭২ বলে খেলেছিলেন ৭১ রানের ইনিংস। সেমিফাইনালেও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভালো অবস্থানে ছিলেন অ্যালেক্স। জোফরা আর্চারের বাউন্সারে চোয়ালে আঘাত নিয়েও ৭০ বলে ৪৬ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলে গেছেন। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে নয় ইনিংসে ৩৭৫ রান করে বিশ্বকাপ শেষ করেছেন এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান।
মিচেল স্টার্ক (অস্ট্রেলিয়া)
২০১৫ আসরের টুর্নামেন্ট সেরা হয়েছিলেন মিচেল স্টার্ক। আগুনে বোলিংয়ের সাথে ডিসিপ্লিনের সমন্বয়ে জিতেছিলেন সবচেয়ে সম্মানিত এই পুরস্কার। এই আসরে ১০ ম্যাচে নিয়েছেন ২৭ উইকেট, যা আসরের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত উইকেট। শুধু তা'ই নয়, ২০০৭ সালে গ্লেন ম্যাকগ্রার ২৬ উইকেটের রেকর্ড ভেঙে বিশ্বকাপের এক আসরে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের নতুন রেকর্ডও গড়েছেন স্টার্ক। বাঁহাতি এই ফাস্ট বোলার পুরো টুর্নামেন্টজুড়েই ধারাবাহিক ছিলেন, দলের প্রয়োজনে বারবার কার্যকরী ভূমিকা রেখেছেন।
জোফরা আর্চার (ইংল্যান্ড)
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বার্বাডোজে জন্মগ্রহণকারী আর্চার বিশ্বকাপ দলে ইংল্যান্ডের পেস বোলিং আক্রমণের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। বিশ্বকাপের আগে থেকেই তাকে নিয়ে আলোচনা ছিল তুঙ্গে। স্বাভাবিক বোলিং, রিদমিক রান-আপ, গতি আর ডিসিপ্লিন, সবকিছুই ছিল তার অনুকূলে। নিজের কাজটাও বিশ্বকাপে ঠিকমতোই করেছেন। ডেথ ওভারে দারুণ কার্যকরী ছিলেন। পুরো টুর্নামেন্টে ২০ উইকেট নিয়েছেন। ইংল্যান্ডের হয়ে ফাইনালের সুপার ওভারও করেছিলেন তিনি। তার ওভারে নিউ জিল্যান্ড সমান রান তুলতে পারলেও কম বাউন্ডারির কারণে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব হাতছাড়া করে।
লকি ফার্গুসন (নিউ জিল্যান্ড)
যদিও নিউ জিল্যান্ড নতুন বলের পুরো দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল ট্রেন্ট বোল্ট এবং ম্যাট হেনরির হাতে, তারপরও লকি ফার্গুসনের কাজটা স্ট্রাইক বোলারের মতোই ছিল। গতির ধারে বিশ্বকাপে ফাফ ডু প্লেসি, ডেভিড ওয়ার্নার এবং স্টিভেন স্মিথের মতো নামকরা সব ব্যাটসম্যানকে কুপোকাত করেছেন, নয় ম্যাচে ২১ উইকেট নিয়ে এবারের বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকায় নিজের নাম লিখিয়েছেন দুই নম্বরে।
জসপ্রীত বুমরাহ (ভারত)
সাবেক ব্ল্যাক ক্যাপস অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালাম জসপ্রীত বুমরাহকে অভিনন্দিত করেছিলেন 'সব ফরম্যাটের সেরা বোলার' অভিহিত করে। লাইন, লেন্থ আর গতির সমন্বয়ে বুমরাহ সাফল্যের খাতায় পেয়েছেন 'এ প্লাস' নম্বর। ওয়ানডে ফরম্যাটে তাকে রাখা হয়েছে বোলার র্যাংকিংয়ের এক নম্বরে। টুর্নামেন্টে উইকেট নিয়েছেন ১৮টি।
টুয়েলভ ম্যান : ট্রেন্ট বোল্ট (নিউজিল্যান্ড)
নিজের ট্রেডমার্ক ইনসুইংয়ের কারণে বিশ্বকাপে নিউ জিল্যান্ডের পেস বোলার ট্রেন্ট বোল্ট বরাবরই বেশ আলোচনায় ছিলেন। এই টুর্নামেন্টের দু'টি হ্যাটট্রিকের একটি এসেছে তার ওভারে। রান খরচে কৃপণতা, আঁটসাঁট বোলিং; সবকিছু মিলিয়ে দারুণ অবস্থানে ছিলেন বোল্ট। মূল একাদশে জায়গা না হলেও তাকে আইসিসি রেখেছে বিশ্বকাপ একাদশের দ্বাদশ ক্রিকেটার হিসেবে।
This is a Bangla article about WC2019 best eleven choose by ICC. All necessary links have been hyperlinked.
Feature Photo: AFP