Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিশ্বকাপের প্রতিটি আসরের সেরা গোলরক্ষকদের গল্প

ফুটবলে সবচেয়ে আন্ডাররেটেড কোন পজিশনের খেলোয়াড়েরা এই প্রশ্নের উত্তরে অধিকাংশের উত্তরই হবে গোলরক্ষক। গোলের খেলা ফুটবলে অধিকাংশ দর্শকই মাঠে যায় বেশি বেশি গোল দেখতে তাই যাদের কাজ গোল প্রতিহত করা তারা কিছুটা কম স্পটলাইট পাবে এটাই স্বাভাবিক। তবে স্পটলাইট যেমনই পাক, গোলরক্ষকদের কাজকে হেলাফেলা করার কিন্তু কোনো উপায় নেই।

গোলরক্ষকদের ছোট্ট একটা ভুল পুরো খেলার হিসাব মুহূর্তের মধ্যে এলোমেলো করে দিতে পারে। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে গোলরক্ষকদের দুর্দান্ত সব সেভ ম্লান হয়ে যেতে পারে শুধুমাত্র একটি ভুলের কারণেই। তাই অন্য পজিশনের খেলোয়াড়দের তুলনায় গোলরক্ষকদের অনেক বেশি সাবধানী হতে হয়। প্রতি বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষককে সম্মান জানাতেই ফিফা প্রতি আসর শেষে ঐ বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষকের নাম ঘোষণা করে। ১৯৯৪ সালে ফিফা এই পুরস্কারের নাম দেয় লেভ ইয়াসিন অ্যাওয়ার্ড। আর ২০১০ সাল থেকে প্রতি আসরের সেরা গোলরক্ষককে গোল্ডেন গ্লাভস দেওয়া শুরু করেছে ফিফা। আজ আমরা গত বিশটি আসরের সেরা গোলরক্ষকদের নিয়েই জানবো।

১৯৩০ বিশ্বকাপ: প্রথম আসরেই এনরিক ব্যালেস্তেরোর বাজিমাত

ঘরের মাঠে অনুষ্ঠেয় ১৯৩০ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় উরুগুয়ে। উরুগুয়ের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে বড় অবদান ছিল তাদের গোলরক্ষক এনরিক ব্যালেস্তেরোর। তার অসাধারণ গোলকিপিংয়ের কারণেই ফাইনালের আগে পুরো আসরে মাত্র একটি গোল হজম করেছিলো উরুগুয়ে। অসাধারণ সব সেভের কারণে এনরিক ব্যালেস্তেরো সেই আসরের সেরা গোলরক্ষক নির্বাচিত হন।

প্রথম আসরের সেরা গোলরক্ষক এনরিক ব্যালেস্তেরো; Image Source : Tumblr

১৯৩৪ বিশ্বকাপ: রিকার্ডো জামোরার অনন্য পারফর্মেন্স

অনেকের মতেই স্প্যানিশ ফুটবল ইতিহাসের সেরা গোলরক্ষক হচ্ছেন রিকার্ডো জামোরা। ১৯৩৪ বিশ্বকাপ পুরোটাই ছিল নক আউট ফরম্যাটের, সেখানে রাউন্ড অফ সিক্সটিনে ব্রাজিলকে ৩-১ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে যায় স্পেন। এ ম্যাচে ব্রাজিলের অনেকগুলো আক্রমণ একাই নস্যাৎ করে দেন স্পেনের গোলরক্ষক জামোরা। কোয়ার্টার ফাইনালে স্বাগতিক ইতালির মুখোমুখি হয় স্পেন। এ ম্যাচে দুই দলের খেলোয়াড়েরাই ভীষণ আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে খেলতে থাকে। অসাধারণ সব সেভ করতে থাকা জামোরা ইতালির এক খেলোয়াড়ের বাজে ট্যাকলের শিকার হয়ে মাঠ থেকে বের হয়ে যান। সেই ম্যাচ অতিরিক্ত সময় শেষেও ১-১ গোলে অমীমাংসিত থাকায় পরে পুনরায় ম্যাচের আয়োজন করা হয়। ইনজুরির কারণে জামোরা সেই ম্যাচে খেলতে পারেননি, স্পেনও আর ইতালির সাথে পেরে ওঠেনি। তবে মাত্র দুই ম্যাচ খেলেই এমন সব অসাধারণ সেভ জামোরা করেছিলেন যে, সেই আসরের সেরা গোলরক্ষক হিসেবে তার নামই ঘোষণা করে ফিফা।

সবসময় ক্যাপ পড়েই গোলকিপিং করতেন রিকার্ডো জামোরা; Image Source : FIFA

১৯৩৮ বিশ্বকাপ: ফ্রান্তিসেক প্লানিকার বীরত্ব

১৯৩৮ বিশ্বকাপে চেকোস্লোভাকিয়ার গোলরক্ষক ছিলেন ফ্রান্তিসেক প্লানিকা। প্রথম ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের মুখোমুখি হয় চেকোস্লোভাকিয়া। সেই ম্যাচে অতিরিক্ত সময়ে তিন গোল করে ডাচদের ৩-০ গোলে হারায় চেকোস্লোভাকিয়া। আর এই ১২০ মিনিট দলের গোলবার সুরক্ষিত রাখেন প্লানিকা।

কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের মুখোমুখি হয় চেকোস্লোভাকিয়া। এ ম্যাচে ডান হাত ভেঙ্গে যাওয়া সত্ত্বেও মাঠ থেকে উঠে না গিয়ে ১২০ মিনিট পর্যন্ত দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গিয়েছিলেন তিনি। শেষপর্যন্ত ম্যাচটি ১-১ গোলে শেষ হয়। রি-ম্যাচে প্লানিকা খেলতে পারেননি, চেকোস্লোভাকিয়াও ২-১ গোলে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয়। তবে হার না মানা মানসিকতার জন্য সেই আসরের সেরা গোলরক্ষক নির্বাচিত হন প্লানিকা।

১৯৩৮ বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষক ফ্রান্তিসেক প্লানিকা; Image Source : Sportskeeda

১৯৫০ বিশ্বকাপ: শ্মশানের নিস্তব্ধতায় নায়ক রক ম্যাসপোলি

১৯৫০ বিশ্বকাপের কথা উঠলেই সবার আগে মনে পড়ে যায় মারাকানাজোর কথা। প্রায় দুই লক্ষ দর্শকের সামনে স্বাগতিক ব্রাজিলের ওই হার ফুটবল ইতিহাসেরই অন্যতম বড় ট্র্যাজেডি। তবে মারাকানাজো ব্রাজিলের জন্য ট্র্যাজেডি হলেও উরুগুয়ের জন্য সেটি কিন্তু অত্যন্ত গর্বের একটি ঘটনা ছিল। মারাকানার ফাইনালে ব্রাজিলের আক্রমণগুলো দারুণ দক্ষতায় রুখে দিয়েছিলেন উরুগুয়ের গোলরক্ষক ম্যাসপোলি। তার দৃঢ়তার কারণেই ব্রাজিল আর খেলায় ফিরতে পারেনি। সেদিন মারাকানাকে শ্মশানে পরিণত করে উরুগুয়েকে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ এনে দেওয়ার পুরস্কার হিসেবে সেই আসরের সেরা গোলরক্ষক হয়েছিলেন রক ম্যাসপোলি।

ম্যাসপোলি এমন সব সেভ না করলে মারাকানাজো নামক ট্র্যাজিক কাব্য তৈরিই হতো না; Image Source : Pinterest

১৯৫৪ বিশ্বকাপ: হাঙ্গেরির আক্ষেপনামায় সাক্ষী গ্রসিক্স

১৯৫৪ বিশ্বকাপের হাঙ্গেরি দলটা ছিল সর্বকালের অন্যতম সেরা দল। ফুটবলে বৈপ্লবিক এক পরিবর্তন এনেছিলো সেই দলটি। হাঙ্গেরির ওই দলটির গোলরক্ষক জিউলা গ্রসিক্সও সেসময়ের বাকি গোলরক্ষকদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। সেসময়ের গোলরক্ষকদের পাসিং একদমই সুবিধার ছিল না। গোলকিক নেওয়ার জন্যে আলাদা একজন খেলোয়াড়কে ডাকা লাগতো! কিন্তু গ্রসিক্স ছিলেন ব্যতিক্রম। বল পায়ে তিনি এতটাই ভালো ছিলেন যে হাঙ্গেরির অতিরিক্ত ডিফেন্ডারের কাজটা গ্রসিক্সই করে দিতেন!

আধুনিক যুগের সুইপার গোলকিপারের ধারণা প্রতিষ্ঠায় গ্রসিক্সের অবদান ছিল অনন্য। ১৯৫৪ বিশ্বকাপে পুরোদস্তুর আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলা হাঙ্গেরির ফ্লুইড পাসিং ফুটবলে গ্রসিক্সের বেশ বড় ভূমিকা ছিল। এ কারণে ঐ আসরে গ্রসিক্সের হজম করা গোলসংখ্যা তুলনামূলক বেশি হলেও সবমিলিয়ে তার পারফর্মেন্স বেশ ভালো ছিল। সবকিছুই ঠিকঠাক যাচ্ছিলো, ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে পরিষ্কার ফেভারিট ছিল হাঙ্গেরিই। কিন্তু এক নিমিষে সবকিছু উলটপালট হয়ে যায়! পশ্চিম জার্মানির কাছে ৩-২ গোলে হেরে অসাধারণ ফুটবল খেলেও বিশ্বকাপ না জিতেই ঘরে ফিরতে হয় হাঙ্গেরিকে। ওরকম অসাধারণ একটি দল নিয়েও বিশ্বকাপ জিততে না পারার যে আক্ষেপ, তার কাছে গ্রসিক্সের সেরা গোলরক্ষক হওয়ার অর্জন হয়তো কিছুই না।

১৯৫৪ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে গ্রসিক্স; Image Source : FIFA

১৯৫৮ বিশ্বকাপ: নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের রূপকথায় নায়ক হ্যারি গ্রেগ

১৯৫৮ বিশ্বকাপে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে এসেই কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছিলো উত্তর আয়ারল্যান্ড। নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপেই গ্রুপপর্বে চেকোস্লোভাকিয়া, আর্জেন্টিনা ও পশ্চিম জার্মানির মতো তিন বড় দল থাকায় উত্তর আয়ারল্যান্ড খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে এটাই সবাই ভেবেছিলো। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আর্জেন্টিনা ও চেকোস্লোভাকিয়াকে টপকে গ্রুপ রানার্স আপ হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে চলে যায় উত্তর আয়ারল্যান্ড। তাদের এই সাফল্যে বড় অবদান ছিল গোলরক্ষক হ্যারি গ্রেগের। গ্রুপপর্বের প্রতি ম্যাচেই দুর্দান্ত সব সেভ করে দলের ত্রাণকর্তা হয়েছিলেন হ্যারি। তাই দল কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিলেও সেই আসরের সেরা গোলরক্ষক নির্বাচিত হন তিনিই। 

পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে হ্যারি গ্রেগ; Image Source : Football Programme Centre

১৯৬২ বিশ্বকাপ: ভিলিয়াম স্কর্ফের পারফর্মেন্সে রানার্স আপ চেকোস্লোভাকিয়া

১৯৬২ বিশ্বকাপে সাদামাটা দল নিয়েও চেকোস্লোভাকিয়ার রানার্স আপ হওয়ার মূল কারণ ছিল তাদের গোলরক্ষক ভিলিয়াম স্কর্ফের দুর্দান্ত পারফর্মেন্স। বিশেষ করে গ্রুপপর্বে ব্রাজিলের সাথে গোলশূন্য ড্র ও কোয়ার্টার ফাইনালে হাঙ্গেরির বিপক্ষে দলের ১-০ গোলের জয়ে অসাধারণ সব সেভ করে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন স্কর্ফ। কিন্তু ফাইনালে তার ভুলেই ব্রাজিল দুটি গোল করায় তার এই দাপুটে পারফর্মেন্স কিছুটা হলেও ম্লান হয়ে যায়। যদিও সেই আসরের সেরা গোলরক্ষক তিনিই নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৬২ বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষক ভিলিয়াম স্কর্ফ ; Image Source : Twitter

১৯৬৬ বিশ্বকাপ: ইংলিশদের প্রথম বিশ্বজয়ে নায়ক গর্ডন বাঙ্কস

ইংল্যান্ডের কিংবদন্তী গোলরক্ষক গর্ডন বাঙ্কসকে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক মানা হয়। কেন বাঙ্কস সর্বকালের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক তার প্রমাণ ১৯৬৬ বিশ্বকাপেই তিনি দেন। সেই আসরে টানা ৭২১ মিনিট ইংলিশ গোলবার সুরক্ষিত রেখেছিলেন বাঙ্কস!

পর্তুগালের বিপক্ষে বাঙ্কস যে গোলটি হজম করেছিলেন সেটি ইউসেবিও পেনাল্টি থেকে করেছিলেন। তার এই অবিশ্বাস্য পারফর্মেন্সে ভর করেই ফাইনালে চলে যায় ইংল্যান্ড। ফাইনালে দুই গোল হজম করলেও ইংল্যান্ড ৪-২ গোলে জিতে নেয় ম্যাচটি। আর গোলরক্ষকদের বিশ্বকাপ ইতিহাসে অন্যতম সেরা পারফর্মেন্স উপহার দিয়ে সেই আসরের সেরা গোলরক্ষক নির্বাচিত হন তিনি।

বিশ্বকাপ হাতে গর্ডন বাঙ্কস; Image Source : The Sun

১৯৭০ বিশ্বকাপ: লাদিসলাও মাজিরকিউইকের চমক

১৯৭০ বিশ্বকাপে গোলরক্ষকদের পারফর্মেন্সের কথা বললে সবার আগে আমাদের গর্ডন বাঙ্কসের সেই অসাধারণ সেভের কথা মনে পড়ে যায়। তবে সেই আসরের সেরা গোলরক্ষক কিন্তু বাঙ্কস ছিলেন না। উরুগুয়েকে সেমিফাইনালে তুলতে বড় অবদান রাখায় সেই আসরের সেরা গোলরক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলেন লাদিসলাও মাজিরকিউইক। সেমিফাইনালের আগপর্যন্ত অসাধারণ সব সেভ করে পুরো আসরে মাত্র একটি গোল খেয়েছিলেন মাজিরকিউইক। যদিও সেমিফাইনালে উরুগুয়ে ৩-১ গোলে ব্রাজিলের কাছে হেরে গিয়েছিলো, কিন্তু মাজিরকিউইক ঠিকই সেই আসরের সেরা গোলরক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

জার্ড মুলারের বিপক্ষে উরুগুয়ের লাদিসলাও মাজিরকিউইক; Image Source : FIFA

১৯৭৪ বিশ্বকাপ: পশ্চিম জার্মানির বিশ্বজয়ে নায়ক সেপ মায়ার

জার্মানির সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক হিসেবে বিবেচনা করা হয় সেপ মায়ারকে। জাতীয় দলের জার্সিতে মায়ার নিজের সেরাটা দিয়েছিলেন ১৯৭৪ বিশ্বকাপে। মায়ারের দুর্দান্ত সব সেভের কারণেই ওই আসরে ফাইনালের আগে মাত্র তিন গোল হজম করেছিলো পশ্চিম জার্মানি! ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে মাত্র দুই মিনিটেই পেনাল্টি থেকে গোল হজম করলেও বাকিটা সময় দারুণ দক্ষতায় ডাচদের সব আক্রমণ রুখে দিয়েছিলেন মায়ার। শেষপর্যন্ত নেদারল্যান্ডসকে ২-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় পশ্চিম জার্মানি। আর দলের বিশ্বজয়ে বড় অবদান রাখায় টুর্নামেন্টের সেরা গোলরক্ষক হন মায়ার।    

জার্মানির সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক সেপ মায়ার; Image Source : Sportkeeda

১৯৭৮ বিশ্বকাপ: আর্জেন্টিনার নতুন ইতিহাসে সাক্ষী ফিওল

ঘরের মাঠে অনুষ্ঠেয় ১৯৭৮ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতে নেয় আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনার এই বিশ্বজয়ের কথা উঠলে মারিও কেম্পেসের মুখটা সবার আগে মনে পড়লেও সেই বিশ্বজয়ে আরেকজন খেলোয়াড়েরও বড় অবদান ছিল। তিনি আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক ফিওল।

গ্রুপপর্বে তিনগোল খেলেও দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রতিটি ম্যাচে আর্জেন্টিনার গোলবার সুরক্ষিত রেখেছিলেন তিনি। ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ৩-১ গোলে জয়ের ম্যাচেও বেশ কিছু ভালো সেভ করেছিলেন। এ কারণেই সেই আসরের সেরা গোলরক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলেন ফিওল।

১৯৭৮ বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষক ফিওল; Image Source : Getty Images

১৯৮২ বিশ্বকাপ: ডিনো জফের বুড়ো হাড়ের ভেলকি

সাধারণত খেলোয়াড়দের ৩৫ বছর পার হলেই ফুটবলে সেসব খেলোয়াড়দের বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৮২ বিশ্বকাপে ইতালির গোলরক্ষক ডিনো জফের বয়স ছিল ৪০ বছর! তিনি শুধু ঐ দলের গোলরক্ষকই ছিলেন না, ছিলেন অধিনায়কও। এই বুড়ো বয়সে জফ কতটুকু কি করতে পারবেন তা নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ ছিল। কিন্তু সব সন্দেহ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন জফ। বিশেষ করে দ্বিতীয় রাউন্ডে ব্রাজিলের সাথে মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের অন্তিম মুহুর্তে তার অসাধারণ এক সেভের কারণেই ইতালি সেমিফাইনালের টিকিট পেয়েছিলো। সেবার ইতালির বিশ্বজয়ের মাধ্যমে জফ সবচেয়ে বয়স্ক খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড গড়েন। সাথে সেই আসরের সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কারটাও জিতে নেন।

৪০ বছর বয়সে বিশ্বজয়! Image Source : Sempreinter

১৯৮৬ বিশ্বকাপ: জাঁ মারি ফাফের চমক

১৯৮৬ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে খেলে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলো বেলজিয়াম। বেলজিয়ানদের এই তাক লাগানো সাফল্যের নেপথ্য কারিগর ছিলেন তাদের গোলরক্ষক জাঁ মারি ফাফ। সেই আসরে বেলজিয়ামের হজমকৃত গোলসংখ্যা দেখে ফাফের পারফর্মেন্স নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ করতে পারেন। কিন্তু যারা ম্যাচগুলো দেখেছিলেন তারা জানেন বেলজিয়ামের সেমিফাইনালে ওঠার পিছনে ফাফের সেভগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে স্পেনের বিপক্ষে টাইব্রেকারে ফাফের পেনাল্টি সেভের কারণেই সেমিফাইনালে চলে যায় বেলজিয়াম। এ কারণেই সেই আসরের সেরা গোলরক্ষক হন ফাফ।

১৯৮৬ বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের সেমিফাইনাল খেলার পেছনে বড় অবদান ছিল ফাফের; Image Source : Getty Images

১৯৯০ বিশ্বকাপ: সার্জিও গয়কোচিয়ার বীরত্ব

১৯৯০ বিশ্বকাপে সেরা গোলরক্ষক হয়েছিলেন দুজন। একজন কোস্টারিকার লুইস গ্যাবেলো কনেজো ও অপরজন আর্জেন্টিনার সার্জিও গয়কোচিয়া। তবে এই দুইজনের মধ্যে সার্জিও গয়কোচিয়া সেই আসরে যে কীর্তি গড়েছিলেন তা রূপকথার গল্পকেও হার মানাবে।

সেই আসরে গোলরক্ষক হিসেবে আর্জেন্টিনার প্রথম পছন্দ ছিলেন নেরি পাম্পিডো। কিন্তু গ্রুপপর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে পাম্পিডো ইনজুরিতে পড়লে রিজার্ভ গোলকিপার গয়কোচিয়াকে মাঠে নামান আর্জেন্টিনার কোচ বিলার্দো। পাম্পিডোর মতো অভিজ্ঞ গোলরক্ষক ইনজুরিতে পড়ায় সবার মাথায় চিন্তার ভাঁজ পড়ে গিয়েছিলো কিন্তু সব চিন্তা দূর করে দেন গয়কোচিয়া।

টাইব্রেকারের হিরো গয়কোচিয়া; Image Source : FIFA

রাউন্ড অফ সিক্সটিনে ব্রাজিলের সব আক্রমণ একাই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন গয়কোচিয়া। তার দাপুটে পারফর্মেন্সের কারণেই সারা ম্যাচে কোণঠাসা থেকেও ব্রাজিলকে ১-০ গোলে হারায় আর্জেন্টিনা। কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালে গয়কোচিয়ার কারণেই আর্জেন্টিনা টাইব্রেকারে ম্যাচ দুটি জিতে। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষেও আর্জেন্টিনার লক্ষ্য ছিল গোল না খেয়ে কোনোমতে খেলাটা টাইব্রেকারে নিয়ে যাওয়া।

কিন্তু এবার আর শেষরক্ষা হয়নি। রেফারির বিতর্কিত এক সিদ্ধান্তে পেনাল্টি থেকে গোল করে আর্জেন্টিনাকে কান্নায় ভাসান পশ্চিম জার্মানির ব্রেহমি। তবে রিজার্ভ গোলকিপার হিসেবে খেলতে এসে গয়কোচিয়ার ঐ পারফর্মেন্স ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নেয়।

১৯৯৪ বিশ্বকাপ: মিশেল প্রিউদহোমের চমক

১৯৯৪ বিশ্বকাপ থেকে ফিফা প্রতি আসরের সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কারকে লেভ ইয়াসিন অ্যাওয়ার্ড  নাম দেয়। অধিকাংশ ফুটবল বিশ্লেষকের মতে, সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক লেভ ইয়াসিনের প্রতি সম্মান জানাতেই এই উদ্যোগ নেয় ফিফা। আর প্রথম লেভ ইয়াসিন অ্যাওয়ার্ড জিতে নেন বেলজিয়ামের গোলরক্ষক মিশেল প্রিউদহোম। প্রিউদহোম বিশ্বকাপ ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় যার দল রাউন্ড অফ সিক্সটিনে বাদ পড়া সত্ত্বেও তিনি ঐ আসরের সেরা গোলরক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলেন। 

১৯৯৪ বিশ্বকাপের লেভ ইয়াসিন অ্যাওয়ার্ডজয়ী গোলরক্ষক মিশেল প্রিউদহোম: Image Source : FIFA

১৯৯৮ বিশ্বকাপ: ফ্যাবিয়ান বার্থেজের অনন্য রেকর্ড

১৯৯৮ বিশ্বকাপে সবচেয়ে কম গোল হজম করে বিশ্বজয়ের রেকর্ড গড়ে ফ্রান্স। ফরাসিদের এই রেকর্ড গড়ায় বড় অবদান ছিল তাদের গোলরক্ষক ফ্যাবিয়ান বার্থেজের। পুরো আসরে সাত ম্যাচে মাত্র দুটি গোল হজম করেছিলো বার্থেজের ফ্রান্স! অর্থাৎ পাঁচ ম্যাচেই ক্লিনশিট রেখেছিলেন বার্থেজ। তার অসাধারণ পারফর্মেন্সের কারণেই ঘরের মাঠে প্রথমবারের মতো বিশ্বজয়ের স্বাদ পায় ফ্রান্স। আর স্বাভাবিকভাবেই সেই আসরের লেভ ইয়াসিন অ্যাওয়ার্ড তিনিই জিতেছিলেন।

পুরো আসরে মাত্র দুই গোল হজম করে নতুন রেকর্ড গড়েছিলেন ফ্রান্সের ফ্যাবিয়ান বার্থেজ; Image Source : FIFA

২০০২ বিশ্বকাপ: ইতিহাস গড়লেন অলিভার কান

লেখার শুরুতেই বলা হয়েছে, ফুটবলের সবচেয়ে আন্ডাররেটেড পজিশনের একটি হচ্ছে গোলরক্ষক। তাই গোলরক্ষকদের পক্ষে পুরো আসরের সেরা খেলোয়াড় হওয়াটা আসলেই বেশ দুরূহ। এই কঠিন কাজটিই ২০০২ বিশ্বকাপে করে দেখিয়েছিলেন জার্মানির অলিভার কান।

বেশ গড়পড়তা দল নিয়ে সেই বিশ্বকাপে খেলতে এসেছিলো জার্মানি। এমন দল নিয়েও ওই জার্মানি দলের ফাইনালে খেলার বড় কারণ ছিল অলিভার কানের অবিশ্বাস্য সব সেভ। ফাইনালের আগে পুরো আসরে জার্মানি গোল হজম করেছিলো মাত্র একটি। পুরো আসর জুড়ে দুর্দান্ত সব সেভের সাথে যেরকম আগ্রাসী ভঙ্গিতে অলিভার কান খেলেছিলেন, সেটা এককথায় অবিশ্বাস্য।

ফাইনালের প্রথমার্ধেও দুর্দান্ত সব সেভ করে ব্রাজিলের বাঘা বাঘা ফরোয়ার্ডদের ঠেকিয়ে রেখেছিলেন কান। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে রিভালদোর দুর্বল শট কান ঠিকমত গ্রিপ করতে না পারায় ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা রোনালদো সহজেই গোল করে বসেন! পুরো টুর্নামেন্টের নায়কের শেষটা হয়ে গেলো ট্র‍্যাজিক! তবে দল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন না হলেও গোলকিপিংকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ায় সেই আসরের সেরা গোলরক্ষক হওয়ার সাথে অলিভার কান জিতে নেন গোল্ডেন বলের পুরস্কারও।

বিশ্বকাপ ইতিহাসের একমাত্র গোলরক্ষক হিসেবে গোল্ডেন বল জয়ের রেকর্ড অলিভার কানের দখলে; Image Source : Zimbio

২০০৬ বিশ্বকাপ: আজ্জুরিদের টেট্রা জয়ের নায়ক বুফন

২০০৬ বিশ্বকাপে ইতালির বিশ্বজয়ের সবচেয়ে বড় কারণ ছিল তাদের দুর্ভেদ্য ডিফেন্স। পুরো আসরে মাত্র দুটি গোল হজম করেছিলো ইতালির ডিফেন্স। ইতালির এমন ডিফেন্সিভ পারফর্মেন্সে বড় অবদান ছিল তাদের গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি বুফনের।

ইতালি যে দুটি গোল হজম করেছিলো তার একটি ছিল আত্মঘাতী গোল ও আরেকটি জিদান ফাইনালে পেনাল্টি থেকে করেছিলেন। পুরো আসর জুড়েই দুর্দান্ত সব সেভ করেছিলেন বুফন। বিশেষ করে ফাইনালে জিদানের হেড বুফন যেভাবে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তা এককথায় অবিশ্বাস্য! বুফন ঐ সেভটা করেছিলো বলেই ফ্রান্স বনাম ইতালির খেলা টাইব্রেকারে গড়ায়। টাইব্রেকারে ফ্রান্সকে ৫-৩ গোলে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয় ইতালি। আর ১৯৯৮ সালে বার্থেজের গড়া পুরো টুর্নামেন্টে সবচেয়ে কম গোল হজম করার রেকর্ডে ভাগ বসিয়ে লেভ ইয়াসিন অ্যাওয়ার্ড জিতে নেন বুফন।

বিশ্বকাপে চুমু খাচ্ছেন বুফন; Image Source : squawka

২০১০ বিশ্বকাপ: ফাইনালে ক্যাসিয়াসের অবিশ্বাস্য সেভ

২০১০ বিশ্বকাপ থেকে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়কে গোল্ডেন গ্লাভস দেওয়া শুরু করে ফিফা। সেই আসর হট ফেভারিট হিসেবেই শুরু করেছিলো স্পেন। কিন্তু প্রথম ম্যাচেই সুইজারল্যান্ডের কাছে ০-১ গোলে হেরে বেশ বড় ধাক্কা খায় স্প্যানিশরা। সেই ম্যাচে স্পেনের হজম করা গোলে ক্যাসিয়াসের ভুল থাকায় সমালোচনার ঝড় উঠেছিলো।

কিন্তু সব সমালোচনা দুর্দান্ত পারফর্মেন্স দিয়ে থামিয়ে দেন ইকার ক্যাসিয়াস। পুরো বিশ্বকাপে মাত্র দুটি গোল হজম করেছিলেন ক্যাসিয়াস। তার চেয়েও বড় কথা- নকআউট স্টেজে একটিও গোল খায়নি ক্যাসিয়াসের স্পেন! বিশ্বকাপ ইতিহাসে এমন ঘটনা আগে কখনোই ঘটেনি। ফাইনালে ক্যাসিয়াস তো নিজেকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন, অ্যারিয়ান রোবেনকে দুবার ওয়ান টু ওয়ানে পরাস্ত করেছিলেন। তার এই দুটি সেভের কারণেই ফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে ১-০ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো স্পেন। স্বাভাবিকভাবেই সেই আসরের সেরা গোলরক্ষক নির্বাচিত হন ক্যাসিয়াস।

গোল্ডেন গ্লাভস হাতে ইকার ক্যাসিয়াস (ডানে); Image Source : FIFA

২০১৪ বিশ্বকাপ: গোলকিপিংয়ের সংজ্ঞা নতুনভাবে লিখলেন নয়্যার

গোলরক্ষকের মূল কাজ গোল প্রতিহত করা, পেনাল্টি এরিয়া থেকে গোলরক্ষকরা বের হয়ে আসবে এমন কথা আগে কেউই ভাবতো না। কিন্তু এই ধারণা সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দেন জার্মানির গোলরক্ষক ম্যানুয়েল নয়্যার। ২০১৪ বিশ্বকাপে দলের প্রয়োজনে বারবার পেনাল্টি বক্স থেকে বের হয়ে এসেছিলেন নয়্যার। সাথে গোলরক্ষকের মূল দায়িত্ব, মানে গোল ঠেকানোর কাজটাও করে গিয়েছিলেন দুর্দান্ত সব সেভের মাধ্যমে। নয়্যারের এই অসাধারণ পারফর্মেন্সের কারণে নকআউট স্টেজে মাত্র একটি গোল খেয়েছিলো জার্মানি। সুইপিং গোলকিপিং দিয়ে জার্মানির টেট্রা জয়ে বড় অবদান রাখায় সেই আসরে গোল্ডেন গ্লাভস জিতে নেন নয়্যারই।

গোল্ডেন গ্লাভস হাতে ম্যানুয়েল নয়্যার; Image Source : FIFA

এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হওয়া বিশটি বিশ্বকাপের মধ্যে দশবার চ্যাম্পিয়ন দলের গোলরক্ষক সেই আসরের সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার জিতেছেন। শেষ তিনটি আসরে চ্যাম্পিয়ন দলের গোলরক্ষকই গোল্ডেন গ্লাভস জিতেছেন। এছাড়া সবচেয়ে বেশিবার সেরা গোলরক্ষক হয়েছেন উরুগুয়ে ও জার্মানির খেলোয়াড়েরা; দুদল থেকেই তিনজন গোলরক্ষক এই পুরস্কার জিতেছেন।

এবারের আসরে গোল্ডেন গ্লাভস কে জিতবেন এটা নিয়েও অনেক জল্পনা কল্পনা চলছে। ডেভিড ডে হেয়া, ম্যানুয়েল নয়্যার, হুগো লরিস কিংবা এলিসনদের মতো প্রতিষ্ঠিত কেউই কি গোল্ডেন গ্লাভস জিতে নিবেন? নাকি ১৯৯০ বিশ্বকাপের গয়কোচিয়ার মতো একদম নতুন কেউ এসে বাজিমাত করে দেবেন? সব প্রশ্নের উত্তর পেতে চোখ রাখতে হবে রাশিয়া বিশ্বকাপের দিকে। 

ফিচার ইমেজ : FIFA

Related Articles