Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বব অ্যাপেলইয়ার্ড: নো কাওয়ার্ড সোল

ক্রিকেটার হিসেবে নামডাকওয়ালা কেউ ছিলেন না। ফ্রেড ট্রুম্যান, পিটার মে, ডেনিস কম্পটন, টেড ডেক্সটারদের সাথে তার নাম উচ্চারিত হয় না। সবাই তাকে তখন চিনতো না, এখনো ওভাবে চেনে না। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারও মাত্র নয় টেস্টের। তবুও ক্রিকেটের ইতিহাসে আলাদা একটা জায়গা নিয়ে আছেন তিনি। রবার্ট অ্যাপেলইয়ার্ড; রবার্ট থেকে কাটছাঁট হয়ে এখন বব অ্যাপেলইয়ার্ড। হ্যাঁ, নামটা আমাদের অনেকের কাছেই অপরিচিত। আমাদের কাছে অপরিচিত হলেও ইয়র্কশায়ার কিংবা ইংল্যান্ডের ক্রিকেটের ইতিহাসে তিনি অদ্বিতীয় এক নাম। আজ তারই জীবনের এক অবিশ্বাস্য গল্প বলব।

বাবা জন অ্যাপেলইয়ার্ড ছিলেন রেলওয়েম্যান। মা আর ছোটবোন মার্গারেটকে নিয়ে তাদের সুখের সংসার। সেই সুখের সংসারে আগুন লাগলো তার বয়স যখন সাত। মা তাদের ছেড়ে চলে গেলেন, সংসারে সৎ মা এলেন। তার কোল আলো করে এলো আরো দুই কন্যাসন্তান, ওয়েন্ডি ও ব্রেন্ডি। চলছিল বেশ ভালোই। আবারও ঝড় এলো অ্যাপেলইয়ার্ড পরিবারে। তখন ১৩’তে পা দিয়েছেন বব। ছোটবোন মার্গারেটকে হারালেন ডিপথেরিয়ায়।

এখানেই শেষ নয়। বছরদুয়েক পর আবারও ট্র্যাজেডি, খেলেন জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা। এক সকালে ঘরে ঢুকে বাবা, সৎ মা, আর দুই সৎ বোন ওয়েন্ডি-ব্রেন্ডির লাশ দেখতে পান। ঘরের সেই কক্ষটি ছিল গ্যাসে পরিপূর্ণ। ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরের জন্য এই ধাক্কা হজম করা কি সম্ভব? মানসিক ট্রমায় চলে যাওয়ার কথা।

বব এখানেই জয় করলেন সব। সেই ধাক্কা সামলে শুধু টিকেই থাকেননি; শৈশবে সব হারানো সেই মানুষটাই যৌবনে আরো সব ধাক্কা সামলে, রাজত্ব করেছেন ক্রিকেট মাঠে ইয়র্কশায়ারের হয়ে। 

ক্রিকেট, জীবন আর দুর্ভাগ্য

ববের জন্ম ইংল্যান্ডের ব্র্যাডফোর্ডে ২৭ জুন ১৯২৪, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ছয় বছর পর। ক্রিকেটে হাতেখড়ি ব্র্যাডফোর্ডের সেন্ট ম্যাথুজ স্কুলে। এর আগে সাত বছর বয়সেই জীবনের প্রথম ক্রিকেট ব্যাট হাতে পান বব। তখন তার বয়সী শিশুদের হাতে হাতে ব্যাট ছিল না। তাই ভারতে তৈরি সামনে হাতির ছবি লাগানো ব্যাটটা নিয়ে ছোট্ট বব বেশ খুশিই ছিলেন।  

কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে বল করছেন বব অ্যাপেলইয়ার্ড; Image Source: PA Photos

সময়টা ১৯৩৪। সেবারের সামারে ফিরতি অ্যাশেজ খেলতে অস্ট্রেলিয়া সফরে ইংল্যান্ড। হেডিংলির লিডসে চলছে অ্যাশেজের চতুর্থ টেস্ট। সেই টেস্ট দেখতে বব ও তার স্কুল টিমের বন্ধুরা তখন লিডসে। সাথে ছিলেন তাদের ক্রীড়া শিক্ষক। লিডসের ঘাসে বসে বব দেখলেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের দাপট। দ্বিতীয় ইনিংসে স্যার ডন ও বিল পন্সফোর্ড গড়েন ৩৮৮ রানের বিশাল জুটি। পন্সফোর্ড ১৮১-তে থামলেও ব্র্যাডম্যানের ব্যাট থামছিল না। সর্বকালের সেরা এই ব্যাটসম্যান থামেন ৩০৪ রানে। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইলেন বব। স্বচক্ষে দেখলেন স্যার ডনের দ্বিতীয় ট্রিপল সেঞ্চুরি। সেই লিডসেই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রিপল হাঁকিয়েছিলেন ব্র্যাডম্যান। অমন একটা ইনিংস দেখার পর বব কীভাবে বোলিং বেছে নিলেন, সেটা একটা প্রশ্ন হতেই পারে; যদিও শুরুর দিকে তিনি ব্যাটসম্যানই ছিলেন।

সেন্ট ম্যাথুজ ছেড়ে বছরখানেক পর ভর্তি হন উইবসি মডার্ন স্কুলে। সেখানের স্কুল টিমে আরো প্রতিযোগিতা। বাকি সবার বয়সই ১৪, কেবল তারই ১১। তবুও দলে জায়গা হয় তার; পজিশন – সাত নম্বর ব্যাটসম্যান। উইবসিতে বছরখানেক কাটিয়ে চলে যান প্রিস্টম্যান সেন্ট্রাল স্কুলে। সেখানে গিয়েই বোলিং নিয়ে আরো সিরিয়াস হন। ইয়র্কশায়ার স্কুল টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই বাজিমাৎ। শেফিল্ডের বিপক্ষে পাঁচ রানে নেন পাঁচ উইকেট। টুর্নামেন্টশেষে তার মোট উইকেট ২২টি।  

ব্র্যাডফোর্ডের পার্ক অ্যাভিনিউ। যে মাঠ থেকে উঠে এসেছেন ইয়র্কশায়ার এবং ইংল্যান্ডের বহু ক্রিকেটার। লেন হাটন, বিল বোয়েস, হারবার্ট সাটক্লিফদের ক্রিকেটের শুরু ওখান থেকেই। গ্রীষ্মের ছুটিতে তাদের প্র্যাকটিস দেখতে যেতেন বব। স্কুল ক্রিকেটের অভিজ্ঞতা দিয়ে ডাক পেয়ে যান পার্ক অ্যাভিনিউর তৃতীয় দলে। সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় তৎকালীন ইয়র্কশায়ার স্পিনার স্ট্যানলি ডগলাসের। ডগলাস তাকে শেখাতেন কীভাবে অফস্পিন করতে হয়। ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবলও খেলা হতো পার্ক অ্যাভিনিউতে। সেখানেও অংশ নিতেন বব। জুনিয়র ফুটবলে তারই সতীর্থ ছিলেন ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা উইলিয়াম এলিয়ট, লেন শ্যাকেলটনরা।

ইয়র্কশায়ারের নেট প্র্যাকটিস; Image souce: The Cricketer International

ক্রিকেটের সাথে রসায়নটা বেশ জমে উঠেছিল ববের। পার্ক অ্যাভিনিউর তৃতীয় দল থেকে উন্নীত হন দ্বিতীয় দলে। ডাক পান হেডিংলির একটা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পেও। যেখানে সরাসরি তাদের কোচিং করিয়েছেন ইয়র্কশায়ার কিংবদন্তি জর্জ হার্স্ট। ক্রিকেটের সাথে ববের সেই দারুণ ছন্দে পতন হয়। বোন মার্গারেট মারা যান ডিপথেরিয়ায়।

এরপর মঞ্চের পেছনে বেজে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। ইংল্যান্ডের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নেভিল চেম্বারলিন ঘোষণা দেন, বিশ্বযুদ্ধে এসেছে আবার। এই ঘোষণার ঠিক দু’দিন পর ববের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। অন্তরে বসে যায় সবচেয়ে ভয়ানক ক্ষতের দাগটা।

ববের বয়স তখন ১৫। স্কুল ছেড়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দিকে ঝুঁকেছেন। কাজ করতেন ভবনের লিফট প্রস্তুতকারক এক প্রতিষ্ঠানে। প্রায়ই তার থাকা হতো দাদীর বাড়িতে। বিশ্বযুদ্ধ ঘোষণার দু’দিন পর কাজ সেরে দাদীর বাড়ি থেকে রওনা দেন নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে দরজা খুলে দেখতে পান, পুরো পরিবার নিথর পড়ে আছে। পাশে রাখা গ্যাসের সিলিন্ডার। কথিত আছে, বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা এড়াতেই এমনটা করেছিলেন জন। কারণ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পুরোটাই দেখেছেন তিনি। অনেকে এটাকে কেবল একটা দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখেন।

মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ববের ঠাই হয় তার সৎ মার বাড়িতে। শোক ভুলে কিংবা সাথে নিয়ে বেড়ে ওঠেন বব। ওদিকে পুরোদমে চলছে বিশ্বযুদ্ধ। সে যুদ্ধ কেড়ে নিল ববের ছয় বছর। টুকটাক ক্রিকেট খেলেছেন ব্র্যাডফোর্ডে, তবে সেটা বড় পর্যায়ে নিজেকে তুলে ধরার মতো পর্যাপ্ত ছিল না।মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার অধ্যায়ে আরো ক’টা পৃষ্ঠা বাকি ছিল ববের। নরম্যান নামের এক পুলিশ অফিসারের ভক্ত হয়ে ওঠেছিলেন তিনি। যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় পাইলট হিসেবে উপকূলীয় অঞ্চলে চলে যান নরম্যান। ১৯৪১ সালের পহেলা মে বিমানের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায় তার, ভূপাতিত হয়ে সলিল সমাধি। বিনা মেঘে বজ্রপাত ববের ওপর, কারণ ববও তার মতো পাইলট হতে চেয়েছিলেন।

সেই চাওয়ামতো বিমান বাহিনীতে যোগ দেন শতখণ্ড হয়ে যাওয়া হৃদয় নিয়ে। শুরু করলেন প্রশিক্ষণ। ক্রিকেটের সাথে ততদিনে একটা দুরত্ব তৈরি হয়ে গেছে তার। সেই দুরত্ব ঘুচলো তারই এক সহকর্মীর কল্যাণে। ব্র্যাডফোর্ডের বোলিং ওল্ড লেইন ক্রিকেট ক্লাবে ববকে নিয়ে গেলেন সেই সহকর্মী। সেখানে ক্রিকেট শুরুর পর দারুণ বোলিংয়ে সেবার শীতে নজর কাড়েন ওল্ড লেইন ও ইয়র্কশায়রের তৎকালীন চেয়ারম্যান আর্নেস্ট হোল্ডসওর্থের। আর্নেস্ট তাকে নিয়ে যান ইয়র্কশায়ারের নেট বোলার হিসেবে। কোচ হিসেবেও পান আর্থার মাইকেল, বিল বোয়েসের মতো কাউন্টি কিংবদন্তিদের।

এমসিসির বিপক্ষে ম্যাচের আগে বব অ্যাপেলইয়ার্ড; Image Source: PA Photos

পাঠক, আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, ববের এয়ারফোর্স ক্যারিয়ারের কী হলো? সেই কৌতুহল মিটবে এখনই। বিমান বাহিনীতে বব যোগ দেন ১৮ বছর বয়সে। তার দায়িত্ব ছিল তিনটা; পাইলট, নেভিগেটর, বোম্ব অ্যাইমার। সেই দায়িত্ব বেশ ভালোভাবেই পালন করেছিলেন তিনি। যুদ্ধের রেশ স্তিমিত হয়ে আসায় তাকে সরিয়ে দেয়া হয় সেখান থেকে। তবে যুদ্ধের পর নৌবাহিনীতে নিয়োগ পান স্পেশালিস্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে, যেহেতু কৈশোরলব্ধ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কিছু জ্ঞান ছিল। বিমান বাহিনী থেকে নৌবাহিনীতে যোগ দেয়ার মধ্যবর্তী সময়টাতে বব ক্রিকেট খেলেছেন ব্র্যাডফোর্ড লিগে। আর সপ্তাহের প্রতিটা ছুটির দিন কাটতো ব্যারি কনস্ট্যানটিন, লেস অ্যামিসদের নেটে বল করে। যেদিন তারা না থাকতেন, সেদিন ববের বল খেলতেন লেন হাটন।

ফিরে যাই ববের জাহাজী জীবনে। ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জাহাজে করে অনেক জায়গাতেই গিয়েছেন বব। কিন্তু ক্রিকেট খেলেছেন কেবল তিন জায়গায় – ডার্টমাউথ, কলম্বো ও সাইপ্রাস। যতটুকুই খেলেছেন, পর্যাপ্ত সুযোগ পাননি। কারণ রয়েল ফোর্সগুলোতে একাদশ নির্ধারিত হতো র‍্যাংকের ওপর ভিত্তি করে, ক্রিকেটীয় সামর্থ্য দিয়ে নয়। ববের র‍্যাংক ছিল নিচের দিকে, কাজেই ম্যাচ পেতেন কালেভদ্রে। কালেভদ্রে পাওয়া সেই ম্যাচে আবার জুটতো না বোলিংয়ের সুযোগ। নিজের ঊর্ধ্বতন অফিসারদের ওপর তো আর কথা বলা যায় না! যতখানি সুযোগ পেতেন, তা নিয়েই খুশি ছিলেন বব। বাড়ি থেকে দূরে এসে ক্রিকেটের সাথে থাকতে পারছেন, সেটাই ঢের ছিল তার কাছে।

সেবার কলম্বো থেকে দেশে ফেরার আগে একটা ম্যাচ খেলেছিলেন বব। তখন ম্যাচশেষে প্রায়ই দর্শকরা গ্যালারি থেকে ছুটে যেতেন মাঠে ক্রিকেটারদের দিকে। তেমন ঘটনাই ঘটেছিল সেদিন কলম্বোতে। ছুটন্ত এক দর্শকের মাথা গিয়ে আঘাত করে ববের বুকে। এক্সরে করে দেখা যায় চিড় ধরেছে পাঁজরে। প্রায় মাসখানেক বিশ্রামে ছিলেন বব। একটু জানিয়ে রাখি, এই ঘটনার বছর ছয়েক পর তার ফুসফুসে টিউবারকুলার ইনফেকশন মারাত্নক আকার ধারণ করে। সেই ইনফেকশনই তাকে বছরখানেকের জন্য ছিটকে দিয়েছিল মাঠের বাইরে।  

মিডিয়াম পেসের ক্যামোফ্ল্যাজে অফস্পিন

কেমন বোলার ছিলেন বব অ্যাপেলইয়ার্ড? রানআপ ছিল ১৬ গজের, মিডিয়াম পেসারসুলভ। কিন্তু বলের গ্রিপ ছিল একদম আলাদা। অফস্পিনাররা বল গ্রিপ করেন তর্জনী আর মধ্যমা দিয়ে; পেসার-মিডিয়াম পেসারদের গ্রিপ থাকে বরাবর বলের সিমে, সেই তর্জনী আর মধ্যমা। কিন্তু বব গ্রিপ করতেন মধ্যমা আর অনামিকা দিয়ে। তর্জনীতে ফোস্কা পড়ে যাওয়ায় তার এই গ্রিপবদল। প্রয়াত ব্রিটিশ সাংবাদিক ক্রিস্টোফার মার্টিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বব জানিয়েছিলেন গ্রিপ বদলের এই ঘটনা। গ্রিপ বদলে ফেলার সুফলও পেয়েছিলেন। জোরের ওপর করা স্টক বলগুলো অফস্টাম্পের বাইরে পিচ করে বিশাল টার্ন নিয়ে ভেতরে ঢুকতো। রানআপ থেকে শুরু করে বলের গ্রিপ, সবই আলাদা – যাকে কোনো ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় না। সে কারণেই সময়ের সাথে সাথে ইয়র্কশায়ারের জন্য স্পেশাল হয়ে উঠেছিলেন বব।

মসৃণ রানআপ আর হাই আর্ম বোলিং অ্যাকশন। উচ্চতা ছয় ফুট এক ইঞ্চি, রিলিজ পয়েন্টও অনেক ওপরে। ইনসুইংটা সহজাত হওয়ায় নতুন বলে অধিনায়কও তাই ভরসা করতেন তাকে। ধীরে ধীরে বল পুরনো হতো, ভেলকি দেখাতে শুরু করতেন বব অ্যাপেলইয়ার্ড। বলের শাইন চলে যাওয়ার পর ইনসুইং, গতির তারতম্য, আলাদা একটা গ্রিপে রিলিজ হওয়া টার্নের মিশেলে বব হয়ে উঠতেন দূর্বোধ্য। ব্যাটসম্যানরা পড়ে যেতেন গোলকধাঁধায়। মিডিয়াম পেস আর স্পিনের এক সেতুবন্ধন হয়ে উঠেছিলেন বব অ্যাপেলইয়ার্ড।

ফ্রেড ট্রুম্যান ও বব অ্যাপেলইয়ার্ডের হাতে ক্যাপ তুলে দিচ্ছেন নরম্যান ইয়ার্ডলি; Image Source: The Cricketer International

কলম্বো থেকে দেশে ফিরে কিছুদিন ফেরি করে জিনিসপত্র বিক্রি করেছেন। সাথে চলেছে ব্র্যাডফোর্ড লিগের ক্রিকেট আর ইয়র্কশায়ারের নেটে বোলিং। এভাবে চলতে চলতে কাউন্টিতে ডাক এলো ববের। খেলার সুযোগ পেলেন ইয়র্কশায়ারের দ্বিতীয় একাদশে। বয়স তখন ২৬। বিশ্বযুদ্ধটা বাগড়া না দিলে হয়তো আরো আগেই এই ডাক শুনতে পেতেন।

প্রথম ম্যাচে ২৪ ওভার বল করে মাত্র ২৯ রান খরচায় নেন চার উইকেট। পরের ম্যাচে করলেন আরো দারুণ কিছু। স্ট্যাফোর্ডশায়ারের ব্যাটসম্যানরা সেদিন খাবি খেলেন, ববের মিডিয়াম পেসের ক্যামোফ্ল্যাজে থাকা জোরালো অফস্পিনে। প্রথম ইনিংসে ৪১ রানে পকেটে পুরলেন সাত উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে আরো ভয়ংকর তার বোলিং ফিগার; ২১ রানে আট উইকেট। ম্যাচশেষে বব হয়তো ভেবেছিলেন, প্রথম ইনিংসটা একটু খরুচেই ছিল!  

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে এক প্রীতি ম্যাচে। ইয়ার্কশায়ারের দ্বিতীয় একাদশের হয়ে সেখানেও আপন মহিমায় উজ্জ্বল বব অ্যাপেলইয়ার্ড, ৪১ রানে পাঁচ উইকেট। ওভালে সারের বিপক্ষে খেলছিল ইয়র্কশায়ার। ইনিংসের প্রথম ওভারে বল করলেন বব; ইনিংস শেষ করেন ৪৭ রানে চার উইকেট নিয়ে। সেই চার উইকেটের একটা ছিল পিটার মে। প্রথম মৌসুমে খুব বেশি ম্যাচ জোটেনি ববের ভাগ্যে। ম্যাচ পেলেও বল হাতে পেতেন না খুব একটা। কারণ, ইয়র্কশায়ার অধিনায়ক নরম্যান ইয়ার্ডলি স্পিনারদেরই ভরসা করতেন বেশি। ওদিকে ববকে তখনো মিডিয়াম পেসার হিসেবেই গণ্য করা হয়। কারণ, জেনুইন স্পিন তখনো রপ্ত করেননি। আউটফিল্ড ফিল্ডিং করার সময় ড্রেসিংরুমে বসে বব একটা চিন্তাই করতেন, কীভাবে মিডিয়াম পেসের সঙ্গে স্পিনের সংযোগ ঘটানো যায়।

১৯৪৮ সাল থেকে ইংলিশ ক্রিকেটের সালতামামি হয় প্রতি বছরই। ‘প্লেফেয়ার ক্রিকেট অ্যানুয়াল’ এর ১৯৫০ সালের সংখ্যায় ববকে ডানহাতি মিডিয়াম পেসার হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। কিন্তু বব ছিলেন মিডিয়াম পেসারের থেকে কিঞ্চিৎ কম, অফস্পিনার থেকে বেশি কিছু। ইন্টারেস্টিংই বটে।

‘সামার অফ ফিফটি ওয়ান’

“Oh, when I look back now
That summer seemed to last forever
And if I had the choice
Yeah, I’d always wanna be there
Those were the best days of my life.”

লাইনগুলো বেশ পরিচিত লাগছে? হ্যাঁ, কানাডিয়ান সঙ্গীতশিল্পী ব্রায়ান অ্যাডামসের বিখ্যাত সেই গান ‘সামার অফ সিক্সটি নাইন’ এর কয়টা লাইন। ১৯৮৪ সালে মুক্তি পাওয়া সেই গানে অ্যাডামস ফিরে যেতে চেয়েছেন সত্তর দশকের শেষ গ্রীষ্মে। ঠিক তেমনি বব অ্যাপেলইয়ার্ডও ফিরতে চাইবেন বারবার ১৯৫১ সালের ইংলিশ সামারে, যখন অবাক করে দেয়া রেকর্ডের মালিক হয়েছিলেন তিনি।

ইয়র্কশায়ারের প্রথম একাদশের হয়ে পুরো মৌসুম খেলে নিয়েছিলেন ২০০ উইকেট! ভাবা যায়? ২৭ বছর বয়সী এক বোলার, যাকে তেমন কেউই চিনতো না, ছিল না আলাদা কোনো পরিচয়। অথচ এক মৌসুমে যা করলেন, তা অভূতপূর্ব, রোমাঞ্চকর। এখন পর্যন্ত কাউন্টিতে এক ইংলিশ সামারে ২০০ উইকেট নিয়েছেন মোট সাতজন বোলার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তা করতে পেরেছেন কেবল তিনজন। সেই তিনজনের একজন বব অ্যাপেলইয়ার্ড।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ‘৫১ সালে প্রথম একাদশের হয়ে খেলার কথা ছিল না ববের। ব্রায়ান ক্লোজ আর অ্যালেক কক্সনকে নিয়ে ছিল ইয়র্কশায়ারের স্পিন অ্যাটাক। কিন্তু মৌসুমের শুরুতেই কক্সন চলে যান লিগ ক্রিকেট খেলতে। ওদিকে ক্লোজ তখন কর্মরত ব্রিটিশ আর্মিতে। প্রথম একাদশে ডাক পেলেন আগের মৌসুমে ভেলকি দেখানো বব অ্যাপেলইয়ার্ড। কে ভেবেছিল, সেই অজানা-অচেনা বোলারই গোটা মৌসুমে দাপট দেখিয়ে ক্লাবকে তুলে দেবে পয়েন্ট টেবিলের দ্বিতীয় স্থানে!

মৌসুমের শুরু থেকেই হয়ে উঠেছিলেন ‘আনপ্লেয়েবল’। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে ২৬ রানে চার উইকেট নিয়ে শুরু। ইংল্যান্ড সফরে আসা দক্ষিণ আফ্রিকা টালমাটাল হলো তার ৩৬ রানে ছয় উইকেটের স্পেলে। গ্লস্টারশায়ারের বিপক্ষে ম্যাচ চলাকালীন তার হলো ডায়রিয়া। কোচ আর্থার মাইকেল বাদামি রঙের কিছু একটা পানীয় খেতে দিলেন তাকে, কাজে দিল সাথে সাথে। যখন মাঠের বাইরে যান, তখন গ্লস্টারশায়ারের স্কোরবোর্ড ছিল ৮১/২। বব সুস্থ হয়ে মাঠে ফেরার পর আমূল বদলে গেল গ্লস্টারশায়ারের চেহারা। মাত্র তিন রানের ব্যবধানে নেই আরো পাঁচ উইকেট। স্কোরকার্ডে ৮৪ রানে সাত উইকেট!

আগের অনুচ্ছেদের শুরুতে বলেছি ‘আনপ্লেয়েবল’। আসলেই ব্যাটসম্যানদের কাছে তাই হয়ে উঠেছিলেন বব। কেবল বলই গ্রিপ করতেন না বব, একেকটা দুর্বোধ্য ডেলিভারি দিয়ে অন্তরাত্মায় কাঁপন ধরিয়ে দিতেন ব্যাটসম্যানদের। ধেয়ে আসা একেকটা রহস্যময় ডেলিভারির কোনো উত্তরই জানা ছিল না তাদের। হ্যারল্ড গিমব্লেট ইংলিশ কাউন্টির সেরা ওপেনারদের একজন। রান করেছেন প্রায় ২৪ হাজার। তার মতো জিনিয়াসও খাবি খেয়েছেন ববের বিপক্ষে। সমারসেটের বিপক্ষে খেলছে ইয়র্কশায়ার। স্ট্রাইকে ছিলেন গিমব্লেট। বল হাতে ববকে দেখে ‘Oh, that’s buggered it’ বলার পর প্রথম ডেলিভারিটাই ছিল লং হপ। সেই লং হপেই কুপোকাত গিমব্লেট।

ইয়র্কশায়ার একাদশে বব অ্যাপেলইয়ার্ড (উপরের সারি, বাম থেকে তিন নম্বর); Image Source: getty images

সেই সামারের শেষ ম্যাচটা খেলতে ইয়র্কশায়ার তখন স্কারবরাতে। এক প্রদর্শনী ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ এমসিসি। ববের পকেটে তখন ১৮৯ উইকেট। সেই ম্যাচে ঠিক ১১টা উইকেটই পেয়েছিলেন। ১৩২৩ ওভার বল করে ১৪.১৪ গড়ে রান দিয়ে মৌসুম শেষ করেছিলেন ২০০ উইকেট নিয়ে। ইয়র্কশায়ারের অসংখ্য সমর্থক সেদিন সেখানে ছিলেন তাদের নতুন দিনের নায়ককে বরণ করে নিতে। অমন পারফর্ম্যান্সের পর বব একটা টেলিগ্রাম পেয়েছিলেন উইলফ্রেড রোডসের কাছ থেকে। সে বছর উইজডেনের সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের একজন হওয়া ববের কাছে একটা চিঠিও এসেছিল জর্জ হার্স্টের লেখা।

শৈশব-কৈশোরের দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে বব তখন একটু ধাতস্থ হয়েছেন। ইংলিশ সামারের সেই উৎসবমুখর ক্রিকেট মাঠের ছোঁয়া লেগেছে তার জীবনেও। সেবার বসন্তে শুরু করলেন জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস। বিয়ে করলেন কোনি লেডগার্ডকে, যার সাথে ব্র্যাডফোর্ডের এক ক্লাবে দেখা হয়েছিল ববের। সেখান থেকেই পরিচয়, এরপর পরিণয়। সুযোগ দিলে এমন সামার তো বারবার ফিরে পেতে চাইবেনই বব অ্যাপেলইয়ার্ড। জীবদ্দশায় সেই সামারকে ফিরে পেতে চেয়েছেন কি না, কে জানে। সেই সামারেই তো চাকরি হয়েছিল ইংল্যান্ডের বিখ্যাত শর্ট লিফট কোম্পানিতে। ব্রায়ান অ্যাডামস তো সুরে সুরে জানিয়েছেন তার আকুতি, বব তো কিছু বলে যাননি।

মৃত্যুর ছায়া

১৯৫২ সাল। ভারত সফরে যাচ্ছে ইংল্যান্ড। লেগস্পিনার ডাস্টি রোডস সেই সফরের দল নেই। রিপ্লেসমেন্ট খুঁজছিল টিম ম্যানেজমেন্ট। প্রথম নামটা ছিল বব অ্যাপেলইয়ার্ড। ওদিকে অধিনায়ক নাইজেল হাওয়ার্ড চাচ্ছিলেন লেগস্পিনার, যে কারণে ববের পরিবর্তে ডাক পান এডি লিডবেটার। বব তখন ভুগছেন টিউবারকুলোসিসে। ফুসফুসে ইনফেকশন হয়েছে, যদিও তখনো টের পাননি। ভারত সফরে যেতে না পারা তার জন্য শাপেবর হয়েছিল।

টন্টনে খেলছিলেন বব। বোলিংয়ের এক ফাঁকে ড্রেসিংরুমে গিয়ে বসলেন লম্বা সময়ের জন্য। কাশছিলেন খুব মারাত্মকভাবে। পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছিল তার। কাশির দমকে যেন ভেতরের সকল প্রত্যঙ্গ বেরিয়ে আসতে চাইছে। শরীরের এমন অবস্থা নিয়েই ১৬ ওভার বল করলেন সেদিন। হোটেলে ফিরলেন ১০৩ ডিগ্রী জ্বর নিয়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে সতীর্থ ফ্রাংক লসন ডাক্তার ডাকলেন। সেই ডাক্তার বললেন, ভালো কোনো বক্ষব্যধি স্পেশালিস্ট ডাক্তারকে দেখাতে।

ইয়র্কশায়ার প্রেসিডেন্ট টিএল টেলর ববকে বললেন লিডসে যেতে। যেখানে বক্ষব্যধি চিকিৎসক জিওফ্রে ওলার তার চিকিৎসা করবেন। ঝুম বৃষ্টিতে ২৭০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে ব্র্যাডফোর্ডে পৌঁছালেন বব অ্যাপেলইয়ার্ড। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে গেলেন ডাক্তার জিওফ্রের কাছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর হাসপাতালের চেয়ারে স্ত্রীর হাত ধরে বসেছিলেন বব। শঙ্কায় পড়ে গেছে তার জীবন, ভবিষ্যত, আর ক্রিকেট ক্যারিয়ার। ডাক্তার জিওফ্রে স্থির গলায় জানালেন, তার ফুসফুসে ইনফকেশন হয়েছে, যেটা সারাতে করতে হবে সার্জারি।

ফিরছেন ড্রেসিংরুমে; Image Source: The Cricketer International

ডাক্তারের কাছে বব জানতে চেয়েছিলেন, আবারও ক্রিকেট খেলতে পারবেন কি না। উত্তরে ডাক্তার জিওফ্রে বলেছিলেন,

‘আপনি আবার খেলতে পারবেন মিস্টার অ্যাপেলইয়ার্ড। হেডিংলিতে আমি আপনার খেলা দেখতে আসব।’

সেই সার্জারির পর টানা ১১ মাস বিশ্রামে ছিলেন বব, যার মধ্যে টানা পাঁচ মাস কেবল এক শুয়ে ছিলেন একটানা। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই খবর পেলেন, তার মেয়ে হয়েছে। স্ত্রী এসে এক ফাঁকে একটা স্পঞ্জের বল দিয়ে গেছিলেন, যেটায় গ্রিপ করে করে হাতের শক্তি ফেরানোর চেষ্টা করেন বব।

বাম ফুসফুসের উপরের অংশে পচন ধরে যাওয়ায় পুরোটাই কেটে ফেলে দিতে হয়েছিল। সৌভাগ্যবশত, নিচের অংশ অক্ষত ছিল; তা না হলে ববের বেঁচে থাকাটাই প্রশ্নের সম্মুখীন হতো। ধীরে ধীরে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হলো। শক্তি ফিরে পেতে আশ্রয় নিলেন যোগব্যায়ামের, ফল পেতে শুরু করলেন। তবে ঝামেলা পোহাতে হলো হাঁটতে গিয়ে। শরীর এতই দুর্বল যে নতুন করে তাকে হাঁটা শিখতে হয়েছে। দ্বারস্থ হলেন ফিজিওথেরাপিস্ট জিম রাইটের, যার তত্ত্বাবধানে ছিলেন বোলি বোয়েস। তারই পরামর্শে সাতার আর ধীরে ধীরে শুরু হলো ববের জগিং।

১৯৫৩ সালের পুরোটাই কাটিয়েছেন নিজেকে ক্রিকেটের জন্য ফিট করে তুলতে। খেলতে না পারলেও ব্র্যাডফোর্ডের মাঠে ঠিকই খেলা দেখতে যেতেন। একদিন নেটের পাশে দাঁড়িয়ে প্র্যাকটিস দেখছিলেন। তখন একটা বল তার দিকে গড়িয়ে আসে। কী মনে করে নুইয়ে বলটা হাতে নিয়ে একটা ডেলিভারিও করে বসলেন। নিজের ওপর হারানো আত্মবিশ্বাসটা ফিরে পেয়েছিলেন তখনই। সেই অ্যাকুরেসি, লাইন-লেন্থ গুলিয়ে যায়নি তবে! 

অ্যাশেজ ও পুনর্জন্ম

ম্যাচ খেলার মতো ফিটনেস অর্জন করেননি তখনো। তবে শর্ট লিফটের সেই চাকুরিটায় আবারও যোগদান করেন। ঘরে আসে তার দ্বিতীয় কন্যাসন্তান। তার সবই ঠিকঠাক, বাকি ছিল কেবল ক্রিকেট মাঠে ফেরা। সেটার তোড়জোড় শুরু করলেন নতুন করে। ফুসফুসে বিশাল ধকল যাওয়ায় ববের চিন্তা ছিল কীভাবে শক্তি বাঁচিয়ে রাখা যায়। আগের সেই ১৬ স্টেপের রানআপে বল করলেও গতি কমেছিল দৌড়ের, বদলে ফেলতে হয়েছিল সেই গ্রিপও। লেগ কাটার, শার্প টার্ন বাদ দিয়ে জোর দিলেন ফ্লাইট ডেলিভারিতে। সেই বছরই ইয়র্কশায়ারে হয়ে মাঠে ফিরলেন বব। অবশ্য হৃদয় যার আশা আর সাহসে ভরা, অর্ধেক ফুসফুসে তার কী আসে-যায়!

ক্রিকেট মাঠে ববের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হলো লর্ডসে, এমসিসির বিপক্ষে। তার করা শর্ট বলে বিল এডরিখের ক্যাচ দিলেন রে ইলিংওর্থের হাতে। অধিনায়ক নরম্যান বলে উঠলেন,

‘ওয়েল ডান! অনলি ১৯৯ টু গো।’  

প্রথম ম্যাচে ৪৫ রানে পেলেন দুই উইকেট। তৃতীয় ম্যাচে প্রতিপক্ষ সমারসেট, ভেন্যু সেই টন্টন – যেখান থেকে অসুস্থ হয়ে অপারেশনের টেবিলে গেছিলেন তিনি। সমারসেট দেখলো ববের সংহারমূর্তি। আবির্ভাব (কিংবা প্রত্যাবর্তন) হলো ভয়াবহ, তাণ্ডব বইয়ে দেয়া। দুই ইনিংসে বল করে ৮৮ রানে ১২ উইকেট। বব দেখিয়ে দিলেন, এভাবেও ফিরে আসা যায়। পার্ক অ্যাভিনিউতে হ্যাম্পশায়ারকে উড়িয়ে দিলেন ৩৫ রানে সাত উইকেট নিয়ে।

সবচেয়ে দুর্দান্ত খবরটা বব পেলেন তার ৩০তম জন্মদিনে। জাতীয় দলের দরজা খুলে গেল তার জন্য। দেশের মাটিতে অভিষেক, পাকিস্তানের বিপক্ষে। যেখানে বব নিজেই ভাবেননি কখনো ক্রিকেট খেলতে পারবেন, সেখানে আগুনে পারফর্ম্যান্স করে জাতীয় দলের হয়ে ম্যাচ খেলা; অবিশ্বাস্য, রূপকথা। সারাজীবন যে স্বপ্নে বিভোর ছিলেন, তা চলে এলো হাতের মুঠোয়। সেই রূপকথা সত্যি হলো। রূপকথার চেয়ে বেশি কিছু মনে হলো, যখন অভিষেক টেস্টেই পাঁচ উইকেট পেয়ে গেলেন। ম্যাচটাও ইংল্যান্ড জিতেছিল বিশাল ব্যবধানে। সেই সিরিজে আরো একটা ম্যাচ খেলেছিলেন বব, সেটায় দুই উইকেট পেয়েছিলেন। সেই মৌসুমে ২০০ উইকেট পাননি বব। ১৪.৪২ গড়ে ১৫৪ উইকেট নিয়ে থেমেছিলেন। অর্ধেক ফুসফুস, নতুন গ্রিপ আর অ্যাকশন নিয়ে বল করেছিলেন মোট ১,০২৭ ওভার।

ক্রিস্টমাস পার্টিতে ইংল্যান্ড ক্রিকেটাররা; Image souce: Fairfax Media /Getty Images

ডাক পান অ্যাশেজ সিরিজের দলেও। সেবার অস্ট্রেলিয়ায় বসেছে অ্যাশেজের মেলা। মেলবোর্নে প্রথম টেস্ট ইংল্যান্ড হারে ইনিংস ও ১৫৪ রানের ব্যবধানে। দ্বিতীয় টেস্টেই ফিরে আসে ইংলিশরা। সিডনিতে অস্ট্রেলিয়াকে তারা হারায় ৩৮ রানে। প্রথম টেস্টে না খেললেও সিরিজের বাকি চার টেস্টে খেলেন বব। সিডনি টেস্টে দুই ইনিংসে ১৩ ওভার বল করে পান এক উইকেট। তিন উইকেট নেন মেলবোর্ন টেস্টে। নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেন অ্যাডিলেড টেস্টে। ৭১ রানে নেন ছয় উইকেট। সিডনিতে সিরিজের পঞ্চম ও শেষ টেস্টে পান এক উইকেট। ৩-১ ব্যবধানে সেবার অ্যাশেজ জিতে ফিরেছিল ইংল্যান্ড।

এরপর আরো পাঁচটি টেস্ট খেলেছেন বব অ্যাপেলইয়ার্ড। যার মধ্যে চারটিই জিতেছে ইংল্যান্ড। সব মিলিয়ে নয় টেস্টে ববের দখলে ৩১ উইকেট। কেবল শারীরিক সুস্থতার জন্যই তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা লম্বা হয়নি। তবে কাউন্টি ক্রিকেটে আট বছরের ক্যারিয়ারে প্রায় পাঁচ হাজার ওভার বল করেছেন ১৫২ ম্যাচে। সেই ১৫২ ম্যাচে ১৫.৪৮ গড়ে রান দিয়ে ঝুলিতে পুরেছেন ৭০৮ উইকেট। চোখ কপালে তোলা এক রেকর্ড ফিগারসমৃদ্ধ এই ক্রিকেটার জাতীয় দলের হয়ে কখনো হারেননি। জীবনের যুদ্ধ কিংবা বিশ্বযুদ্ধ যাকে হারাতে পারেনি, ক্রিকেট তাকে কীভাবে ফেরায় খালি হাতে! নয় টেস্টের সাতটিতেই মাঠ ছেড়েছেন জয় নিয়ে, বাকি দুটো হয়েছে ড্র।

১৯৯৫ সালে উইজডেন ডিনারে বব অ্যাপেলইয়ার্ড; Image Source: Patrick Eagar/Popperfoto

ব্রিটিশ ভদ্রলোক না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন ২০১৫ সালে। ছিলেন বেশ নিষ্প্রভ, নির্লিপ্ত, নীরব। তাকে নিয়ে অত নাড়াচাড়াও হয়নি আধুনিক ক্রিকেটে। ইংল্যান্ডের ‘ফরগটেন হিরো’ তাকে বলা যায় কি? ইংল্যান্ডের সকল নামিদামি ক্রিকেটারেরই আত্মজীবনী আছে, আছে খেলোয়াড়ি জীবন নিয়ে প্রকাশ করা বই। ববের কোনো বই ছিল না, যতদিন না স্টিভেন চক তা লিখেছেন। ‘নো কাওয়ার্ড সোল: দ্য রিমার্কেবল জার্নি অফ বব অ্যাপেলইয়ার্ড’ ২০০৮ সালে প্রকাশিত হওয়া এই বইয়ে উঠে এসেছে বব অ্যাপেলইয়ার্ডের জীবন আর ক্রিকেটের জার্নি। বইয়ের নামকরণ সার্থক। কত ঝড় এসেছে, তবুও পালিয়ে যাননি – না ক্রিকেট মাঠ থেকে, না জীবনের ময়দান থেকে; সবখানেই বুক চিতিয়ে লড়ে গেছেন তিনি। 

ইয়র্কশায়ারের স্যুভেনির হাতে; Image source: Yorkshire post 

রূপকথার গল্প ফুরোয়। সহস্র রজনীর আরব্য উপাখ্যানের শেষ লাইনেও একটা ফুলস্টপ পড়েছিল। সময়ের সাথে খানিকটা মিলিয়ে গেলেও পুরোপুরি ফুরোয় না কষ্টগুলো। বেরিয়ে আসে আগ্নেয়গিরির ফুটন্ত লাভা হয়ে। মানব-সন্তানদের হৃদয় যে পরিমাণ মান-অভিমান-অনুযোগ আর কষ্ট নিয়ে এগিয়ে চলে, কোনো স্রোতস্বিনী নদীতে সে পরিমাণ জল ধরে কি না, কে জানে! বব অ্যাপেলইয়ার্ডেরও ছিল সে পরিমাণ কষ্ট, হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা। টেমস নদীর পাড়ে কখনো তিনি দাঁড়িয়েছিলেন কি না, বলা দুষ্কর। দাঁড়ালে বোধহয় তুলনাটা করে ফেলতে পারতেন।

সকল না পাওয়া একপাশে নিয়ে যেভাবে এগিয়ে গেছেন বব, তা অবিশ্বাস্য। পরিবার হারানো, বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা, এরপরেও ক্রিকেটকে এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল হতে না দেয়া… ক্রিকেট তার এমন এক পূজারীকে অনন্তকাল ধরে মনে রাখুক। ইয়র্কশায়ার, ব্র্যাডফোর্ড, পার্ক অ্যাভিনিউ – সবখানেই গায়েবি হরফে লেখা থাকুক ‘নো কাওয়ার্ড সোল’।

This article is in Bangla language. The article shows the struggling life journey of an Ex-England চricketer named Robert Appleyard. He survived & served England during the second world war. In 1951 he took 200 wickets in one English summer. One of the finest bowlers of the 50th century. He played for Yorkshire County & England National Cricket Team. 

Featured Image: Yorkshire Post

Related Articles