Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বডিলাইনের ব্যবচ্ছেদ: প্রথম পর্ব

তারপর তো পেরিয়ে গিয়েছে আটাশি বছর। বিশ্ব দেখেছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, পৃথিবীতে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে প্রায় দেড়শ’টি। ভারতবর্ষে অবসান ঘটেছে ইংরেজ শাসনের, তারও বেশ কয়েক বছর পরে বাংলাদেশ পেয়েছে স্বাধীনতা। কেবল ক্রিকেটের গণ্ডিতেই আলোচনা স্থির রাখলেও দিনবদলের গান শোনা যায় জোরেশোরে। ১৯৭১ সালে এসেছে একদিবসী ক্রিকেট, টি-টোয়েন্টি (গৌতম ভট্টাচার্যের ভাষায় ‘কু-কুড়ি’) নামের রংচঙে নায়ে চেপে ধরায় এসেছে দশ ওভারের ক্রিকেটও।

বৃত্তের ব্যাসার্ধ আরও কমিয়ে যদি স্থির করা হয় টেস্ট ক্রিকেটে, সেখানেও তো রোমাঞ্চের কমতি নেই। আটাশি বছরে টেস্ট ম্যাচ হয়েছে আরও ২,১৬৩টি; টেস্ট দেখেছে টাই ম্যাচ, দেখেছে এজবাস্টন আর হেডিংলি রূপকথা। কিন্তু ঘটনে-অঘটনে-দুর্ঘটনে ১৯৩২-৩৩ সালের অ্যাশেজকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, এমন কিছু ক্রিকেট আর দেখেনি। ১৯৩২ অ্যাশেজ, ‘বডিলাইন সিরিজ’ বললেই যাকে চেনা যায় সহজে।

বডিলাইন সিরিজ, শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তেও যার আবেদন কমেনি একটুও; Image source: imdb.com

‘বডিলাইন’ নিয়ে লেখা হচ্ছে জানতে পারলে অবশ্য ডগলাস জার্ডিন, হ্যারল্ড লারউড কিংবা বিল ভোস মিলে আপত্তি তুলতেন প্রথমেই। তাদের আপত্তি তো এই বডিলাইন শব্দেই। সে সিরিজের পরে যে কয়দিন জীবিত ছিলেন, পুরো সময়টা জুড়ে তারা তিনে মিলে দাবি করে এসেছেন, ‘ওসব বডিলাইন-ফডিলাইন কিচ্ছু নয়, সমস্তই অস্ট্রেলীয়দের চাল। আমরা লেগ থিওরি থেকে একচুলও সরিনি।’

লেখার শুরুতেই ‘বডিলাইন’, ‘লেগ থিওরি’ জাতীয় শব্দের ব্যবহারে খটকা লাগতে পারে। বডিলাইন আর লেগ থিওরির পার্থক্য কোথায়, জাগতে পারে এই প্রশ্নও। লেগ থিওরির সংশয়টিই আগে ভাঙা যাক।

যে বছরের ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া লড়াই নিয়ে এত কথা, লেগ থিওরি বা লেগ অ্যাটাকের চল ক্রিকেটে এর আগে থেকেই ছিল। ব্যাটসম্যানের লেগসাইডে বেশ কয়েকজন ফিল্ডারকে দাঁড় করিয়ে দাও, এরপর ইনসুইং করিয়ে লেগ স্ট্যাম্প টার্গেট করো, মোটামুটিভাবে লেগ থিওরির সংজ্ঞাটি ছিল এমনই। অন্যদিকে, অক্সফোর্ড ডিকশনারি ঘেঁটে বডিলাইনের যা সংজ্ঞা পাওয়া যাচ্ছে, তা হচ্ছে:

“Persistent short-pitched fast bowling on the leg side, threatening the batsman’s body, especially as employed by England in the Ashes series in Australia in 1932–33.”

অর্থাৎ, এমন বোলিং, যা স্ট্যাম্প নয় বরং ব্যাটসম্যানদের শরীর তাক করে ছোঁড়া হচ্ছে। কিন্তু ক্রিকেট ঐতিহাসিক ডেভিড ফ্রিথ লেগ থিওরির ব্যাপারে বলছেন, যখন ইয়র্কশায়ারের জর্জ হার্স্ট এমন লেগ স্ট্যাম্প লাইনে বল করতেন এবং কিছু বল ব্যাটসম্যানদের অ্যাবডোমিনাল গার্ডেও লাগতো, তবুও ব্যাটসম্যানরা এ নিয়ে আপত্তি তুলতেন না। কেননা, তারা নিশ্চিত জানতেন, হার্স্টের লক্ষ্য তাদের শরীর নয়।

ঊনবিংশ শতকে লেগ স্ট্যাম্প লাইনে কিংবা লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে বল করে বোলার ব্যাটসম্যানের কাছে ক্ষমা চাইছেন, এমন দৃশ্যের অবতারণাও ঘটেছে ক্রিকেট মাঠে। আরও অবাক করা ব্যাপার, নটিংহ্যামের জর্জ পার কিংবা গ্লস্টারশায়ারের ই. এম. গ্রেস ক্রিকেট খেলতে শুরু করবার আগে লেগ সাইডে বল পাঠাতে রাজ্যের অনীহা দেখাতেন ব্যাটসম্যানরাও।

অবশ্য ওই চরম মাত্রায় অফসাইড ক্রিকেটের সময়টাতেও বোলারের আঘাতে ব্যাটসম্যান আহত হচ্ছেন, বোলার ব্যাটসম্যানের মাঝে আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন, এমন দৃশ্য দেখা গিয়েছে; যদিও এর সবই ঘটেছিল লেগ থিওরির ব্যবহারে।

কার হাত ধরে লেগ থিওরির আবির্ভাব, তা একদম ঠিক ঠিক জানা না গেলেও ইতিহাস ঘেঁটে আলফ্রেড মিনের নামটিই পাওয়া যায় প্রথমে। পরবর্তীতেই আসে জন ম্যারকন নামে চার্চের এক মন্ত্রীর কথা, বল ছুঁড়ে যিনি এক ব্যাটসম্যানের পা ভেঙে ফেলেছিলেন। ধারাবাহিকতায় আসে জন জ্যাকসন আর জর্জ ট্যারান্টের নাম, প্রথম দিককার আন্তঃরাষ্ট্রীয় সফরগুলোতে তারা অস্ট্রেলিয়াকে বুঝিয়েছিলেন, ফাস্ট বোলিংটা ঠিক কাকে বলে। নাম নেয়া যায় ‘দুই জর্জ’ হাউয়িট আর ফ্রিম্যানেরও, পরেরজনকে ‘তার সময়ের সেরা’ বলে আখ্যা দিয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং ডব্লিউ জি গ্রেস। নিজে ডাক্তার ছিলেন বলেই গায়ে বল লাগার যন্ত্রণাটা বোধহয় সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা করতে পেরেছিলেন ক্রিকেটের ওই অমর বুড়োই,

“যখন বল শরীরে আঘাত করে, মনে হয় যেন কেউ ছুরি দিয়ে জায়গাটা কেটে দিয়েছে।”

জ্যাক ক্রসল্যান্ড কিংবা আর্থার মোল্ড (পরবর্তীতে দুজনই অবশ্য চাকিংয়ের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন), ক্যারিয়ারের প্রথম দিকের ফ্রেড স্পফোর্থ, টম রিচার্ডসন কিংবা বিল লকউড (যারা দু’জনে মিলে গড়েছিলেন ইংল্যান্ডের প্রথম বিখ্যাত বোলিং জুটি), এসেক্সের চার্লস কর্টরাইট, অস্ট্রেলিয়ার আর্নি জোন্স (যিনি বলের আঘাতে এক ব্যাটসম্যানকে শয্যাশায়ী করে দিয়েছিলেন দিন পনেরোর জন্যে), আলবার্ট টিবি কটার, অথবা দক্ষিণ আফ্রিকার ইয়োহান কোটজে; ক্যারিয়ারের কোনো না কোনো সময়ে লেগ থিওরির প্রয়োগে ব্যাটসম্যানদের শরীর-মনে ত্রাস ছড়িয়েছিলেন অনেক বোলারই। এমনকি মারকাটারি ব্যাটিংয়ের জন্যে ক্রিকেট ইতিহাসে আলাদা জায়গা করে নেওয়া গিলবার্ট জেসপ, যিনি নিজেও বিরোধিতা করেছিলেন বডিলাইন বোলিংয়ের, সেই তিনিও এক ভার্সিটি ম্যাচে রাউন্ড দ্য উইকেট বোলিংয়ে আহত করেছিলেন প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের, এমনকি অজ্ঞান করে দিয়েছিলেন নিজ দলের উইকেটরক্ষককেও। আর এসব ভীতি ছড়ানোর ঘটনা ঘটেছিল বিংশ শতাব্দীর আগেই।

***

১৯৩২ অ্যাশেজের আগে ডগলাস জার্ডিন বডিলাইন বোলিংয়ের ‘ফিল্ড সেটিং কেমন হওয়া উচিৎ’, তা নিয়ে পরামর্শ করেছিলেন ফ্র‍্যাংক ফস্টারের সাথে। সেই ফস্টার আর সিডনি বার্নস মিলে অস্ট্রেলীয়দের শরীরে লেগ থিওরির দাগ রেখে এসেছিলেন ১৯১১-১২ মৌসুমেই। দু’জনের একের পর এক ইনসুইংয়ের বিষে ভিক্টর ট্রাম্পারের বাঁ উরু হয়ে গিয়েছিল নীল, যা নিয়ে আম্পায়ারের কাছে অভিযোগও জানিয়েছিলেন তিনি। জবাবে আম্পায়ার বব ক্রোজেট জানিয়েছিলেন,

‘বল সুইং করছে, আর ওরা তোমার স্ট্যাম্পকেই লক্ষ্য করছে।’

সেবারের সফরে ফস্টার যে ৬২ উইকেট পেয়েছিলেন, তার একটিও এলবিডব্লিউর বদৌলতে নয়, তা জেনে অবশ্য আম্পায়ারকেই সঠিক মনে হবে আপনার।

ফ্র‍্যাংক ফস্টার, বডিলাইন ফিল্ডিংয়ের দিকনির্দেশক; Image source: Bodyline Autopsy 

 

ফস্টার অবশ্য লেগ থিওরির প্রয়োগ দেখিয়েছিলেন এরও আট বছর আগের সফরেই, পেলহাম ওয়ার্নারের অধিনায়ক হিসেবে প্রথম সফরে (পরবর্তীকালে বডিলাইন সিরিজে ইংল্যান্ড দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন এই ওয়ার্নারই)। দর্শকপ্রিয়তা না পেলেও বোলাররা ঠিকই সাফল্য পাচ্ছিলেন এই লেগ অ্যাটাকের ব্যবহারে। দক্ষিণ আফ্রিকার বাসিল মেলে তিন শর্ট লেগ নিয়ে ইনসুইং করিয়ে ১৯০৮-০৯ মৌসুমের কারি কাপের শিরোপা জিতিয়েছিলেন ওয়েস্টার্ন প্রোভিন্সকে। উইলিয়াম গ্রেসওয়েলও একইভাবে স্কুল দলের হয়ে উইকেট নিয়েছিলেন শত শত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত হওয়া আর্থার জ্যাকস ১৯১৪ সালের কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে উইকেট নিয়েছিলেন ১১২টি, ওই লেগ থিওরির সফল প্রয়োগেই।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সেই দশকে লেগ থিওরির প্রয়োগ দেখা গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়াতেও। জ্যাক গ্রেগরি আর টেড ম্যাকডোনাল্ডের বোলিং কাঁপিয়ে দিয়েছিল সফরকারী ইংল্যান্ডকে, যার ভেতরে বেশ কিছু বল ছিল লেগ থিওরির নিদর্শন রেখে।

লেগ-অ্যাটাক বোলিং, ব্যাট করছেন জার্ডিন; Image source: Bodyline Autopsy 

১৯২৫ সালে শেফিল্ড শিল্ডের এক ম্যাচে ল্যান্স গানকে তার অধিনায়ক ভিক রিচার্ডসন নির্দেশ করেছিলেন অনসাইডে সাতজন ফিল্ডার রেখে ক্রমাগত শর্ট বল করে যেতে। পরের দিন ‘অ্যাডিলেড অ্যাডভার্টাইজার’ নামে এক পত্রিকায় যাকে আখ্যা দেয়া হয়েছিল ‘ডায়াগনাল বোলিং’ বলে। সাথে সাথে তারা এটাও জানিয়ে দেয়, ক্রিকেট এমন কিছু আগে কখনো দেখেনি। তাদের বোধহয় জ্ঞাত ছিল না, খোদ অস্ট্রেলিয়াতেই ১৯১১-১২ মৌসুমে সফরে আসা এমসিসি দলের জ্যাক হবস, উইলফ্রেড রোডস, জর্জ গানের বিপক্ষে জ্যাক স্কট বেশ দ্রুতগতির কিছু শর্ট বল করেছিলেন। এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই হওয়া অ্যাশেজগুলোতে জ্যাক গ্রেগরি আর টেড ম্যাকডোনাল্ড মিলে লেগ থিওরির ব্যবহারে ইংলিশ শিবিরে বইয়ে দিয়েছিলেন ভয়ের চোরাস্রোত।

১৯২০-২১ মৌসুমের মেলবোর্ন টেস্টে ইংলিশ উইকেটরক্ষক হার্বার্ট স্ট্রুডউইককে বেশ কয়েকবার হৃৎপিণ্ডের আশেপাশে আঘাত করেছিলেন গ্রেগরি। ১৯২১ সালের ট্রেন্টব্রিজ টেস্টে গ্রেগরির বলেই সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান ইংলিশ ব্যাটসম্যান আর্নেস্ট টাইলডেসলি। কিছু বছর বাদে ইংল্যান্ডে স্থায়ী হওয়া ম্যাকডোনাল্ড লেগ থিওরির এই ত্রাস চালিয়েছিলেন কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপেও। পরিহাসই বলতে হবে, ম্যাকডোনাল্ডের লেগ থিওরির বিরুদ্ধে প্রথম যিনি মুখ খুলেছিলেন, তার নাম ডগলাস জার্ডিন।

গ্রেগরির বলে লুটিয়ে পড়ছেন টাইলডেসলি; Image source: Bodyline Autopsy 

লারউডের মনে লেগ-থিওরির বীজ ছিটিয়ে দেবার দায় অবশ্য চাপবে ফ্রেড রুটের কাঁধে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের হ্যারল্ড লারউডের অভিষেক ঘটেছিল ১৯২৬ অ্যাশেজে, লর্ডসে। তার সামনেই রুট বোলিংয়ে নেমেছিলেন ফাইন লেগ থেকে মিড অনের মধ্যে পাঁচজন ফিল্ডার রেখে, মিতব্যয়ী বোলিংয়ে চার উইকেট তুলে নিয়ে প্রমাণ করেছিলেন স্বীয় কৌশলের সার্থকতার। লর্ডসের সাফল্যে ওল্ড ট্র‍্যাফোর্ডে এগিয়ে গিয়েছিলেন আরেক ধাপ। ফাইন লেগে তিনজন রেখেছিলেন দুই গজের ভেতরে; স্কয়ার লেগ, ডিপ স্কয়ার লেগ, শর্ট লেগ আর ওয়াইড মিড-অন — ফিল্ডার ছিল সবখানেই। ৫২ ওভার বল করে রান দেননি ২৭ ওভারেই, ৮৪ রানে উইকেট তুলে নিয়েছিলেন চারটি। রুটের ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ছিল সেটিই, তবে শিষ্যের মনে দাগ কাটবার জন্যে যথেষ্ট ছিল ওই দুই ম্যাচই। কেমন করে লারউডের ক্যারিয়ারে তিনি প্রভাব রেখেছিলেন, তা রুট নিজেই জানিয়ে গিয়েছেন তার ‘A Cricket Pro’s Lot’ বইতে,

“লর্ডসে এমনও হয়েছে, প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে নার্সারি প্রান্ত থেকে ও (লারউড) অফস্ট্যাম্পের বাইরে বল করে গিয়েছে, আর অস্ট্রেলিয়ার বিল উডফুল বল ছেড়ে গিয়েছে। বার্ট স্ট্রুডউইক আর লারউড ছাড়া আমরা বাকি নয়জন বেগার খাটছি, এমনও মনে হচ্ছিল কখনো কখনো।”

অপরপ্রান্তে লেগ অ্যাটাকের নিদর্শন রেখে রুট উইকেট নিচ্ছেন, আর তিনি অফ-অ্যাটাকে মাথা কুটে মরছেন, এমন কিছু দেখে লারউডের মনেও অনুরূপ কিছু করবার বাসনা হওয়াটা অমূলক নয়। আর বোলারদের লেগ থিওরিমুখী হবার অন্য কারণও তো ছিল। তখনকার এলবিডব্লিউর যে আইন, তাতে কেবলমাত্র বল স্ট্যাম্পের লাইনে পড়লেই ব্যাটসম্যান এলবিডব্লিউর ক্যান্ডিডেট হিসেবে বিবেচিত হতেন; যার সুযোগ নিয়ে স্ট্যাম্পের বাইরের বলকে পা দিয়ে খেলাই নিয়ম বানিয়ে ফেলেছিলেন অনেকে।

বোলারদের জন্যে মুমূর্ষু সে অবস্থায় লেগ অ্যাটাক তাই এসেছিল ‘লাইভসেভিং ড্রাগ’ রূপে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে আবির্ভাবের পর লারউড নিজেও তার অনুসরণ করেছিলেন সময়ে সময়ে, কয়েক বছরের পরিক্রমায় জার্ডিন যাকে বদলে দিয়েছিলেন বডিলাইনে।

***

ছবিটি তোলা হয়েছিল ১৯৩২-৩৩ অ্যাশেজ শুরুর আগে, প্লাম(বাঁয়ে) আর জার্ডিনের এই হাসিখুশি চেহারা আর দেখা যায়নি সিরিজ চলাকালীন; Image credit: Getty Images   

গাবি অ্যালেন, বব ওয়াইটের মতো অ্যামেচার ক্রিকেটাররা থাকলেও পেলহাম ওয়ার্নারের (পরবর্তী অংশে যাকে ডাকনাম ‘প্লাম’ বলেই অভিহিত করা হবে) সুপারিশে এমসিসি (তখনকার ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল পরিচিত ছিল এ নামেই, ক্রিকেট খেলার নিয়মনীতিও নির্ধারিত হতো মেরিলিবন ক্রিকেট ক্লাবের কর্তাদের হাতেই) তাদের পরবর্তী সফরের জন্যে জার্ডিনকে অধিনায়ক হিসেবে বেছে নিয়েছিল ১৯৩১ সালে। পারিবারিক ব্যবসার কারণে ১৯৩২ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরে জার্ডিন যাবেন কি না, এ নিয়ে সংশয় জাগলে জার্ডিন সিনিয়রের সঙ্গে কথা বলে তা মিটিয়ে দেন প্লাম। নেভিল কার্ডাস যে নির্বাচন নিয়ে নিজের অসন্তুষ্টির কথা জানিয়ে দেন তার পাঠকদের। তার মতে,

“অস্ট্রেলিয়ায় জয়ী হতে দরকার এমন অধিনায়ক, যে অস্ট্রেলীয়দের ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দেবার পর তৃপ্তির হাসি হাসবে। জার্ডিনের সঙ্গে যে প্রুসিয়ান জাংকার আর ডক্টর সুইচেমের সঙ্গে তুলনা টানা হচ্ছে, তা হাস্যকর।”

আজ অবশ্য আপনি জানেন, কার্ডাস নিজেই ভুল ছিলেন। জার্ডিনের সংস্পর্শে যারাই এসেছেন, তারা প্রত্যেকেই দাবি করেছেন, এর চাইতে বেশি রহস্যময় চরিত্র আর হতে পারতো না। কেউ তাকে বলছেন প্রচণ্ড আমুদে এক চরিত্র, যার ভেতরে রসবোধ ছিল দারুণ। আবার গাবি অ্যালেনের মতো কেউ কেউ বলছেন,

এমন দিন আসে, যখন ওকে আমার মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে।’

তবে একটা বিষয়ে তারা মোটামুটি সবাই কোরাস তুলছেন,

‘অস্ট্রেলিয়ানদের আপনি ঘৃণা করতে পারেন, তবে জার্ডিনকে ছাড়তে পারবেন না।’

অস্ট্রেলিয়া-বিদ্বেষের সূচনাটা খুব সম্ভবত ১৯২১ সালের ইংলিশ গ্রীষ্মে, যেদিন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় দলের হয়ে জার্ডিন নেমেছিলেন অস্ট্রেলিয়ানদের বিপক্ষে। টেস্টের আগে ক্রিকেটারদের বাড়তি একদিন বিশ্রাম দরকার, এই যুক্তিতে তিনদিনের ম্যাচকে ওয়ারউইক আর্মস্ট্রং বানিয়ে নিয়েছিলেন দু’দিনের। ব্যাটসম্যানের স্কোর কত, তা জানবারও কোনো সুযোগ ছিল না সে মাঠে। তাই দ্বিতীয় দিন যখন শেষ হয়েছিল, নিজের অজান্তেই জার্ডিন দাঁড়িয়েছিলেন ৯৬ রানে। সেঞ্চুরি হাতছাড়া করবার কষ্ট রূপান্তরিত হয়েছিল ক্ষোভে, দায় চাপিয়েছিলেন অজিদের কাঁধে। যদিও উইজডেনের মন্তব্য পড়লে জার্ডিনের মাত্রাতিরিক্ত ধীরগতির ব্যাটিংকেই দায়ী মনে হয় সেঞ্চুরি না পাবার পেছনে।

“With a little more energy, Jardine might have had the satisfaction of getting his 100.”

‘সময় সব ক্ষত শুকিয়ে দেয়’ প্রবাদে জার্ডিনের বিশ্বাস ছিল না বোধকরি। ১৯২৮ সফরে অজি সমর্থকদের তাকে ঘিরে অসন্তোষের খবর জানিয়েছিলেন প্যাটসি হেনড্রেন। ‘অসন্তোষটা পারস্পরিক’ বলে মুখ ঘুরিয়ে চলে গিয়েছিলেন জার্ডিন।

পরবর্তী অস্ট্রেলিয়া সফরে অধিনায়ক হয়ে যাচ্ছেন নিশ্চিত হয়েই জার্ডিন বসে গিয়েছিলেন কৌশল নির্ধারণে। আগেরবার ঘরের মাঠে ২-১ ব্যবধানে খোয়ানো অ্যাশেজ ফেরত আনা চাই যেকোনো মূল্যে। আর ফেরত আনবার পথে সবচেয়ে বড় বাধাটির নাম যে ডন ব্র‍্যাডম্যান, জার্ডিন জানতেন তা-ও।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ডন ব্র‍্যাডম্যান নামের মহাবিস্ময় ততদিনে পার করেছেন মোটে চার গ্রীষ্ম। তাতেই এমন সব অর্জন যে পুরো অস্ট্রেলিয়ার দুঃখ-সুখের ভার যেন অর্পিত হয়েছিল ওই ৫’৭” ফুট মানুষটির ব্যাটে। ১৯২৭ সালের ডিসেম্বরে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হয়েছিলেন ১১৮ রানের ইনিংসে, কুইন্সল্যান্ডের সঙ্গে পরের বছরই পেয়েছিলেন ম্যাচে জোড়া শতকের দেখা। মধুচন্দ্রিমার সেই পর্বটুকু বজায় রয়েছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও। সাত নাম্বারে ব্যাট করে অভিষেক ম্যাচে করেছিলেন ১৮ আর ১, খেলেননি এর পরের টেস্ট। তবে সিরিজের বাকি তিন টেস্টেই দুই সেঞ্চুরির পরে ঘরোয়া ক্রিকেটেও দেখা পেয়েছিলেন ট্রিপল সেঞ্চুরির, ‘ধুমকেতুর মতো আবির্ভাব’ শব্দবন্ধের সৃষ্টি যেন হয়েছিল তাকে বর্ণনেই। এবং এই অস্ট্রেলীয় ধুমকেতুর সঙ্গে যে হ্যালির কোনো সম্পর্ক নেই, তা প্রমাণ করতেই যেন ১৯২৯-৩০ মৌসুমটা কাটয়েছিলেন রেকর্ড ভাঙা-গড়ার খেলায়। এক মৌসুমে ১,৫৮৬ রান খুব সম্ভবত পুরোটা বোঝাতে পারে না, যদি না সাথে ১১৩.২৯ গড়ের পাদটীকা জুড়ে দেয়া হয়।

‘অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংবান্ধব পিচেই তার জারিজুরি’ জাতীয় কথাবার্তা বলে কেউ কেউ চেয়েছিলেন তাকে দমিয়ে দিতে। কিন্তু প্রতিভা এবং রানক্ষুধার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বর যে তাকে অদম্য মানসিক শক্তিও দিয়েছিলেন! বিলেত গিয়েছিলেন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তৎকালীন রেকর্ড ৪৫২ করে, আর দেশে ফিরেছিলেন ইংল্যান্ডে প্রথম সফরেই ২,৯৬০ রানের কীর্তি গড়ে। ১০ শতক, যার অর্ধেকই রূপান্তর করেছিলেন ডাবলে; ব্যাটিং গড় একশো ছুঁইছুঁই, এখন অব্দি যেকোনো টেস্ট সিরিজে সর্বোচ্চ ৯৭৪ রান করার কৃতিত্ব — সংখ্যার এসব কচকচানি ব্র‍্যাডম্যান-বীরত্বের পুরোটা বলতে না পারলেও অনেক কিছুই বলে।

ওয়ালি হ্যামন্ড, জ্যাক হবস কিংবা বিল পন্সফোর্ডের ত্রিপক্ষীয় (জর্জ হেডলিকে জুড়ে দিলে চতুর্পক্ষীয় হয়, কিন্তু তখন তো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ততটা খেলারই সুযোগ পেত না) সেরার লড়াইও যেন ফুরিয়েছিল এতদিনে। হেডিংলিতে যেদিন তার ব্যাট থেকে বেরিয়েছিল ৩৩৪ রানের ইনিংস, এর পরদিনই প্লাম তার ‘মর্নিং পোস্টের’ কলামে লিখেছিলেন,

“এই ডনগিরি থেকে উদ্ধার পেতে ইংল্যান্ডকে নতুন কিছু ভাবতেই হবে। হয়তো বা নতুন কোনো ট্যাকটিক্সের কথা, কিংবা নতুন কোনো বোলারের কথা!”

ভাবনার খোরাক ডন মিলিয়ে দিয়েছিলেন সে সফরেই।

ব্র‍্যাডম্যান তখন এমনই সিংহাসনে আসীন, ছবিটি ৪৫২ করবার পরে তোলা; Image credit: Getty Images   

***

১৯৩২ অ্যাশেজের পূর্ব অব্দি ব্র‍্যাডম্যান আর লারউড মুখোমুখি হয়েছিলেন ১৭ ইনিংসে। তাতে নেলসন ১১১ গড়ে ডন রান করেছিলেন ১,৫৬৪। বিপরীতে লারউড তাকে আউট করতে পেরেছিলেন মোটে একবার, সেটিও ১৯৩০ অ্যাশেজে ওভালের বুকে ২৩২ করবার পর (ব্র‍্যাডম্যান অবশ্য পরবর্তীতে দাবি করেছিলেন, সেই উইকেটটিও এসেছিল আম্পায়ারের বদান্যতায়; উইকেটরক্ষক ক্যাচ লোফার আগে তার ব্যাটে নাকি কোনোরকম স্পর্শই লাগেনি)। দ্বিশতকের পথে আর্চি জ্যাকসনকে সাথে নিয়ে ব্র‍্যাডম্যান জুটি গড়েছিলেন ২৪৩ রানের, ম্যাচের (কিংবা ১-১ সমতায় থাকা সিরিজের) গতিপথ অস্ট্রেলিয়ার পানে ঘুরে গিয়েছিল তাদের জুটিতেই। কিছুকাল পর যে ক্রিকেটের গতিপথই ঘুরিয়ে দেবে এই জুটি, তা কে জানত!

সেদিনে দু’জনের জুটির মধ্যভাগে বৃষ্টি নেমেছিল লন্ডনে, টেস্টের তখন চতুর্থ দিন। চতুর্থ দিনে আর খেলা হচ্ছে না, এ ভেবে যখন দর্শকেরা ধরছেন বাড়ির পথ, তখনই স্থানীয় সময় ৬:২৫ বাজতেই আম্পায়াররা জানিয়েছিলেন, খেলা হবে আরও কিছুক্ষণ। সেই সন্ধ্যায় খেলা হলো আরও ১৩ বল, বৃষ্টিভেজা স্টিকি উইকেটে লেংথ বলগুলোও উঠতে শুরু করেছিল কোমর-বুকে-কাঁধে। বৃষ্টিবিরতির আগ পর্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যে খেলতে থাকা ব্র‍্যাডম্যান হঠাৎই যেন অস্বস্তিতে, যা বজায় রয়েছিল পরদিন সকালেও। জ্যাকসনের গায়ে বল লেগেছিল বেশ কয়েকবার; লারউড, এমনকি হ্যামন্ডের বলও আঘাত করেছিল ব্র‍্যাডম্যানের বুকে। লারউড পরবর্তীতে তার আত্মজীবনীতে দাবি করেছেন, সেদিন বল খেলবার আগে ভয়ার্ত ব্র‍্যাডম্যানকে পিছিয়ে যেতে দেখেছিলেন তিনি।

ব্র‍্যাডম্যানকে নিয়ে লারউডের গবেষণা চলছিল এর আগে থেকেই। চোখকে মাঠের আলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে ব্র‍্যাডম্যান ব্যাটিংয়ে নামবার সময় উইকেটে আসেন অর্ধবৃত্তাকার পথে, ব্যাকরণ না মেনে ব্যাট রাখেন দুই পায়ের মাঝে, লারউড লক্ষ্য করেছিলেন সবই। সাত টেস্টের চেষ্টায় অবশেষে ব্র‍্যাডম্যানকে কিছুটা ভড়কে দিতে পেরে লারউড স্বীয় উচ্ছ্বাস জানিয়ে থাকবেন তার সতীর্থদেরও। এ কান-ও কান হয়ে পার্সি ফেন্ডারের মাধ্যমে তা পৌঁছেছিল ডগলাস জার্ডিনের কর্ণকূহরে, নিজের ব্যবসাকে প্রাধান্য দিয়ে যিনি নাম তুলে নিয়েছিলেন ১৯৩০ ওভাল টেস্ট থেকে। অধিনায়ক নির্বাচিত হবার পর জার্ডিন তার পুরো সময়টায় কাটিয়ে দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়া-বধের পরিকল্পনা আঁটতে, যার প্রায় পুরোটাই আবর্তিত হচ্ছিল ব্র‍্যাডম্যানকে ঘিরে। কখন-কোথায়-কীভাবে আউট হচ্ছিলেন ব্র‍্যাডম্যান, তা নিয়ে চলছিল বিস্তারিত গবেষণা। পার্সি ফেন্ডারের সঙ্গে চিঠি চালাচালি চলছিল নিয়মিত, যিনি তার অস্ট্রেলিয়ান বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আলাপ করে জানিয়েছিলেন, ডনের বিপক্ষে সফলতার জন্যে ফাস্ট বোলিং ছাড়া কোনো গতি নেই।

জার্ডিন তার ‘ইউরেকা মোমেন্ট’ যেন পেয়ে গিয়েছিলেন ফেন্ডারের ওই এক কথাতেই। ইংল্যান্ডের অস্ট্রেলিয়াগামী বহরটা হয়েছিল তাই অভূতপূর্ব। পাঁচ-পাঁচজন ফাস্ট বোলার নিয়ে কোনো দল ঘোষণা করেছে স্কোয়াড, এমন কিছু ক্রিকেট আগে দেখেনি।

ভিডিও-রিলের দুষ্প্রাপ্যতার সেই যুগেও ওভালে ব্র‍্যাডম্যানের ছটফটানি সংরক্ষিত ছিল এক রিলে। এমসিসির এক অন্ধকার ঘরে বসে জার্ডিন নিজেও তা দেখেছিলেন। কর্ণ আর চক্ষুর অপূর্ব সমন্বয়ে জার্ডিন পৌঁছেছিলেন তার সিদ্ধান্তে। তলব পড়েছিল লারউড আর ভোসের, নটিংহ্যামের হয়ে কাউন্টি ম্যাচ খেলতে দু’জনেই তখন লন্ডনে।

ক্রিকেটকে বদলে দেবার ছক কাটা হয়েছিল ওই সাক্ষাতেই।

This article is in Bangla language. This article is on the cricket's most sensational test series, 1932-33 ashes. Necessary images are attached inside.

Featured image © Getty Images

Background Image ©  Getty Images

Reference:

1. David Frith (2002); Bodyline autopsy: The full story of the most sensational test cricket series Australia vs England 1932-33 (1st ed.); Aurum Press Ltd, 74-77 White Lion Street, London N1 9PF; ABC Books for the Australian Broadcasting Corporation.

2. Duncan Hamilton (2009); Harold Larwood (Paperback ed.); 21 Bloomsbury Square, London WC1A 2NS; Quercus.

Related Articles