Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বোজান কিরকিচ: জ্বলে উঠেই ঝরে পড়া এক নক্ষত্রগাঁথা

“আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে

অবিশ্রান্ত; একে একে হয় জড়ো,

এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে

এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো।”

‘আঠারো বছর বয়স’, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের অমর সৃষ্টি। কবিতাটিতে তার কলমে ফুটে উঠেছে বয়ঃসন্ধিকালের নানা দিক। তিনি এতে শেষ পর্যন্ত আঠারো তথা বয়ঃসন্ধিকালের জয়ধ্বনি গাইলেও সেই সাথে আঠারোর নেতিবাচক দিকগুলোও তুলে ধরেছেন। বলেছেন, এই বয়সে ক্রমাগত আঘাত আসে, আসে যন্ত্রণা। সেগুলো প্রতিহত করেই একজন তরুণকে সাফল্যের পথে এগিয়ে যেতে হয়। এতে কেউ সফল হন, কেউ হন বিফল।

আজ আমরা এমন একজনের কথা জানব, যিনি আঠারোর কাছে শেষ পর্যন্ত হার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন এবং চেষ্টা করব এই পরাজয়ের নেপথ্যে কী ছিল তা খোঁজার।

গল্পের শুরুটা ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে। পশ্চিম কাতালুনিয়ার লিনইয়োলাতে যুগোস্লাভিয়ান বোজান কিরকিচ সিনিয়র ও স্প্যানিয়ার্ড মারিয়া পেরেজের ঘর আলোকিত করে জন্ম নেন বোজান কিরকিচ জুনিয়র। জুনিয়রের বাবা সিনিয়র নিজেই এককালে ছিলেন পেশাদার ফুটবলার। কখনো মূল জাতীয় দলের হয়ে খেলার সৌভাগ্য না হলেও যুগোস্লাভিয়ার অনুর্ধ্ব-২১ দলের হয়ে খেলেছেন দু’ম্যাচ। তাই, স্বভাবতই তার ছেলেরও শিরায়-উপশিরায় বইছিল ফুটবলের রক্ত। তাই হয়তো মাত্র ৮ বছর বয়সে ১৯৯৯ সালে বার্সেলোনায় অবস্থিত ‘ফুটবলের আঁতুড়ঘর’-খ্যাত লা মাসিয়ায় ভর্তি করানো হয় তাকে। সেখানে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলের হয়ে ২০০৬ পর্যন্ত খেলাকালীন ৯০০-এরও বেশি গোল করে ভেঙে দেন লিওনেল মেসির সব রেকর্ড, বনে যান লা মাসিয়ার ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা। (উল্লেখ্য, ২০১১ সালে জানা যায় যে বোজান কিরকিচ সম্পর্কে লিওনেল মেসির ফোর্থ কাজিন হন, যা এর পূর্বে অজানা ছিল।)

মেসি ও বোজান এক ফ্রেমে; Image source: MANU FERNANDEZ/Associated Press

২০০৬ সালে বার্সা বি’র হয়ে অভিষেক হওয়ার পর ২০০৭ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর ওসাসুনার বিপক্ষে লিগ ম্যাচে ৭৮তম মিনিটে জিওভানি ডস সান্টোসের বদলি হিসেবে নেমে আনুষ্ঠানিকভাবে বার্সার মূল দলের হয়ে মাত্র ১৭ বছর ১৯ দিনে বয়সে অভিষেক ঘটে তার। এর মধ্য দিয়ে সবচেয়ে কম বয়সে বার্সার হয়ে লিগে অভিষেক হওয়ার দিক থেকেও মেসিকে ছাড়িয়ে যান তিনি। এর ৩ দিন পর মেসির বদলি হিসেবে অলিম্পিক লিওঁর বিপক্ষে নেমে চ্যাম্পিয়নস লিগে অভিষেক ঘটে বোজানের। লিগে বার্সার হয়ে নিজের গোলের খাতা খুলতে মাত্র ১ মাস সময় নেন তিনি। ভিয়ারিয়ালের সাথে ২০ই অক্টোবর তার করা গোলটি তাকে বানায় বার্সার ইতিহাসে সবচেয়ে কমবয়সী গোলদাতা। পরের বছর এপ্রিলের প্রথম দিন চ্যাম্পিয়নস লিগে গোল করার মধ্য দিয়ে ৯০’র দশকে জন্ম নেওয়া প্রথম ফুটবলার হিসেবে অর্জন করেন চ্যাম্পিয়নস লিগে গোল করার গৌরব। সব মিলিয়ে তিনি বার্সার মূল দলের হয়ে নিজের প্রথম মৌসুম গোল করেন ১২টি এবং অ্যাসিস্ট ৬টি। লা লিগায় নিজের অভিষেক মৌসুমে ১০ গোল করে ভেঙে দেন রাউল গঞ্জালেসের রেকর্ড। মৌসুমজুড়ে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স করার দরুণ বোজান লা লিগার ‘ব্রেকথ্রু প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হন।

Image source: Getty Images

একে তো মেসির মতো দৈহিক গড়ন, খেলার ধরনও অনেকটা মেসির মতো, আবার লা মাসিয়ায় মেসির সব রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার পর মূল দলে এসেই প্রতিনিয়ত ভালো পারফর্ম করার কারণে শীঘ্রই বোজান পেয়ে যান ‘পরবর্তী মেসি’ তকমা এবং একইসাথে মিডিয়া তাকে অভিহিত করে লা মাসিয়ার ‘নেক্সট বিগ থিং’ হিসেবে। কিন্ত, একজন কিশোরের থেকে এতটা প্রত্যাশা করা যে সেই কিশোরের উপর কতটা চাপ সৃষ্টি করতে পারে, সেটা শুধুমাত্র সেই কিশোরই জানে। এবং এই চাপ যে মোটেও উপকারে আসে না, বরং সেই কিশোরের জীবনীশক্তিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে পারে, সেটাই বা ক’জন মানেন?

বোজানের ভাষ্যমতে, ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। ফেব্রুয়ারিতে স্পেন জাতীয় দল থেকে ডাক আসার পরও সেরকম কিছু। কিন্ত ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচের দিন সাজঘরে ঢোকার পরপরই জীবনে প্রথমবারের মতো অ্যাংজাইটি অ্যাটাকের সম্মুখীন হতে হয় তাকে। ফলে শেষ পর্যন্ত তাকে একাদশের বাইরে রাখা হয়। একাদশের বাইরে রাখার কারণ হিসেবে দেখানো হয় গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিসকে, যেখানে আসল কারণটা ছিল মানসিক। ব্যাপারটা বোজান মেনে নিতে পারেননি, তবুও তিনি এ ব্যাপারে তখন কোনো কথা বলেননি। অবশেষে ২০১৮ সালে এসে ব্রিটিশ সাংবাদিক সিড লোয়িকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

ফেব্রুয়ারিতে সেই যে অ্যাংজাইটি অ্যাটাকের শুরু, এরপর গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত তা চলতে থাকে। ইউরোর জন্য বোজানকে যখন স্পেন জাতীয় দল থেকে ডাকা হয়, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ইউরোতে খেলা তখন তার পক্ষে সম্ভব নয়; স্পটলাইট থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকতে চেয়েছিলেন তিনি। বোজানের মানসিক অবস্থার কথা স্পেনের কোচ লুইস আরাগোনাস থেকে শুরু করে ফেডারেশনের সকলে জানতেন। পরিচালক ফার্নান্দো হিয়েরো প্রতি সপ্তাহে একবার করে বোজানের খোঁজখবর নিতেন। ইউরোর জন্য দল ঘোষণার আগের দিন বোজান যখন গাড়িতে করে ক্যাম্প ন্যু’তে অনুশীলনে যাচ্ছিলেন, তখন স্পেন ফেডারেশন থেকে কল আসে। তারা বোজানকে বলেন, তারা তাকে দলে ডাকবেন। কিন্ত বোজান তাদের মানা করেন।

ক্যাম্প ন্যুতে পৌছানোর পর অভয় দেওয়ার জন্য পুয়োল বোজানকে ডেকে বলেন, “বোজান, আমি সবসময় তোমার পাশে থাকব।” প্রতিউত্তরে বোজান বলেন, “পুয়ি, আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি মেডিকেশনে আছি, আমার একদমই ভালো লাগছে না।”

দল ঘোষণার দিন বোজানকে নিয়ে হেডলাইন হয়, স্পেন বোজানকে ডাকলেও বোজান তাদের মানা করে দিয়েছেন। বোজানের মানসিক অবস্থার কথা স্পেন ফেডারেশনের সবাই জানা সত্ত্বেও এরকম হেডলাইন দেখায় বোজান স্বাভাবিকভাবেই ব্যথিত হন। সে সময়টায় নিজেকে তার বড্ড একা মনে হয়েছিল, যা ১০ বছর পর তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানান।

স্পেন জাতীয় দলের হয়ে নিজের প্রথম ও একমাত্র ম্যাচে বোজান; Image source: EFE

২০০৮-০৯ মৌসুম শুরু হলে বার্সায় রাইকার্ডের জায়গায় নতুন কোচ হিসেবে আসেন পেপ গার্দিওলা। রাইকার্ড বোজানের উপর যতটা ভরসা পেতেন, ততটা ভরসা গার্দিওলা পাননি। ফলে বোজানের গেমটাইম কমে আসতে থাকে।

বার্সার জার্সি গায়ে নিজের প্রথম মৌসুমে যে ঝলক তিনি দেখিয়েছিলেন তা পরবর্তী তিন মৌসুমের কোনোটিতেই তিনি দেখাতে পারেননি। যতটুকু সময় তিনি গার্দিওলার অধীনে পেয়েছিলেন, তাতে একে তো নিজের সেরাটা দিতে পারেননি, তার উপরে খেলায়ও তেমন উন্নতির ছাপ সেভাবে চোখে পড়েনি। তাই বেঞ্চই হয় তার ঠিকানা।

কিন্ত বেঞ্চে থাকতে তিনি রাজি হননি। তাই ২০১১ সালে পাড়ি জমান ইতালির রোমে। সেখানেও সুবিধা করতে পারেননি। এরপর একে একে খেলেছেন মিলান, আয়াক্স, স্টোক সিটি, মেইঞ্জ, আলাভেজ, এবং মন্ট্রিয়েল ইমপ্যাক্টের হয়ে। বর্তমানে খেলছেন জাপানি ক্লাব ভিসেল কোবে’তে। কিন্ত সত্যি বলতে কি, কোথাও সেই আগেকার বোজানের দেখা মেলেনি। বয়স ২০ পার হওয়ার আগেই ১৫০ ম্যাচ খেলে ফেলেছিলেন যিনি, তিনিই কি না পরবর্তী ১০ বছরেও ১৫০ ম্যাচ খেলতে পারেননি। যিনি মাত্র ১৯ বছর বয়সেই ৪০ গোল করেছিলেন, তিনিই কি না পরবর্তী ১০ মৌসুম মিলিয়ে ৩০ গোল করতে পারেননি।

গার্দিওলার মন জয় করতে পারেননি বোজান; Image source: as.com

তার আকস্মিক আগমন গোটা ফুটবল বিশ্বকে যেন জানান দিয়েছিল, তিনি দীর্ঘ সময়ের জন্য ফুটবল বিশ্বে রাজত্ব করতে আসছেন। অথচ শেষ পর্যন্ত হলোটা কী?

অত্যধিক প্রত্যাশার চাপ, মানসিক অসুস্থতা আর সঠিক পরিচর্যার অভাব – তিনে মিলে একটি সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ারকে বিকশিত হওয়ার আগেই ধ্বংস করে দিল। যেখানে বিশ্ব ফুটবলে আজও মানসিক স্বাস্থ্য একটি স্টিগমা, সেখানে আজ থেকে ১৩-১৪ বছর পূর্বের অবস্থা কীরকম ছিল, সেটা আঁচ করা তেমন কঠিন হওয়ার কথা নয়। বোজান নিজেই ২০১৮ সালে বলেছেন,

“আমাকে অ্যাংজাইটি অ্যাটাকের সম্মুখীন হতে হয়। কিন্ত কেউই সেটা নিয়ে কথা বলতে চান না, ফুটবল এ ব্যাপারে আগ্রহীই নয়।”

২০১৫ সালে ফিফপ্রো -র করা একটি জরিপের তথ্যমতে পেশাদার ফুটবলারদের মধ্যে ৩৮% ফুটবলারদের ভেতর ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেয়েছে। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, কোভিড পরবর্তী সময়ে ফুটবল বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্যকে কিছুটা হলেও আগের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। 

ভক্ত-সমর্থকরা বোজানের ক্যারিয়ার নিয়ে অখুশি, হতাশ হলেও বোজান নিজে কিন্ত তার ক্যারিয়ার নিয়ে অখুশি নন। তার কথা দিয়েই লেখাটি শেষ করা যাক,

“আমি ফুটবলকে ভালোবাসি এবং কেউই আমার কাছ থেকে সেই অনুভূতিটা কেড়ে নিতে পারবে না। আমি আমার ক্যারিয়ার নিয়ে গর্ববোধ করি, গর্ববোধ করি আমার জীবনের মুহূর্তগুলো নিয়ে। এই বছরের মতো জীবনে কঠিন মুহূর্ত আসলেও আপনাকে সবসময় শক্ত থাকতে হবে। আমি সবসময় ফুটবলকে ভালোবাসবো, সবসময়।”

Related Articles