Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

এক যুগ পর কোপা আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল

১২ জুন, ২০১৬।

কোপা আমেরিকায় বি গ্রুপের শেষ ম্যাচে পেরুর মুখোমুখি হয় ব্রাজিল। পরের রাউন্ডে যেতে হলে ড্র করাটাই যথেষ্ট ছিল সেলেসাওদের জন্য। হা হতোস্মি, রুই ডিয়াজের গোলে পেরুর কাছে ১-০ গোলে হেরে গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নেয় দলটি। ২০১৪ বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে সাত গোল খাওয়ার পর এমনিতেই ‘গেল গেল’ রব উঠেছিল, আর মহাদেশীয় আসরে গ্রুপপর্ব থেকে বাদ পড়ার পর তো ব্রাজিলের ফুটবলের ধ্বংসও দেখে ফেলেছিলেন অনেকে! দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় সিবিএফও নড়েচড়ে বসে, দুঙ্গাকে সাথে সাথে সরিয়ে দেওয়া হয় কোচের পদ থেকে। সব শর্ত মেনেই সবার পছন্দের টিটেকে নিয়ে আসা হয় কোচ হিসেবে।

এরপর যেন এক রূপকাঠির ছোঁয়ায় পুরো দলকে আমূল পাল্টে দিলেন এই ভদ্রলোক। যে দল বাছাইপর্বে ষষ্ঠ স্থানে ধুঁকছিল, তাদেরকেই সবার আগে এনে দিলেন বিশ্বকাপের টিকিট। কিন্তু বিশ্বমঞ্চে সেই আশার ফানুস উড়াতে ব্যর্থ তার দল, বেলজিয়ামের কাছে হারের জন্য সমালোচনার তীর আবারও ধেয়ে আসে সেলেসাওদের দিকে। তবে সিবিএফ আস্থা রাখল তার উপরই, কোচ হিসেবে তাকেই রেখে দেওয়া হল। সেই আস্থার প্রতিদান দেওয়ার সেরা সুযোগ ছিল ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত এবারের কোপা আমেরিকা। আগের চারবার স্বাগতিক হয়ে প্রতিবারই সেসব আসরের চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সেলেসাওরা, তাই ব্যর্থ হলে মিশন ২০২২ এ যাওয়ার সুযোগটা পাবেন না, এই কথা ভালোই জানতেন টিটে। 

যেনো এক রূপকাঠির ছোঁয়ায় পুরো দলকে পাল্টে দিয়েছিলেন টিটে; Image Source: Dhaka Tribune

সে কারণে নিজের আগের সব ভুল শুধরে দলকে আরো শক্তিশালী করে তৈরি করলেন। সেই দল এতটাই শক্তিশালী যে, দলের সেরা খেলোয়াড় নেইমার ইনজুরির জন্য ছিটকে গেলেও কোপা আমেরিকা জয়ের জন্য তারাই হট ফেভারিট হিসেবে বিবেচিত হতে লাগল। সেই মান অবশ্য ব্রাজিল রাখতে পেরেছে, ঐতিহাসিক মারাকানা স্টেডিয়ামে নাটকে ভরপুর এক ফাইনালে সেই ২০১৬ সালের হন্তারক পেরুকে ৩-১ গোলে হারিয়ে নবমবারের মতো কোপা আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সেলেসাওরা।

সেমিফাইনালে যে একাদশ খেলেছিল, সেই একাদশ অপরিবর্তিত রেখে দুই দলই ফাইনালে মাঠে নামে। দুই দলই খেলতে নামে ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে। তবে ব্রাজিলের খেলার কৌশল ছিল ছোট ছোট পাসে আক্রমণ সাজিয়ে পেরুর রক্ষণভাগকে ব্যতিব্যস্ত করা, আর পেরুর লক্ষ্য ছিল লং পাসের মাধ্যমে পাল্টা আক্রমণ শানিয়ে দলের সেরা তারকা পাওলো গুয়েরেরোর কাছে বল পাঠিয়ে কোনোমতে গোল আদায় করে নেওয়া।  

প্রথম দশ মিনিট অবশ্য পেরুভিয়ানদের খেলাই বেশি গোছালো লেগেছে, তবে দশ মিনিট পরই নিজেদের স্বরূপে ফিরে খেলার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কাছে নিয়ে নেয় ব্রাজিল। এর ফলও খুব দ্রুত পায় তারা, খেলার ১৫ মিনিটে পেরুর দুই ডিফেন্ডারের কড়া পাহারায় থাকা সত্ত্বেও অপর প্রান্তে আনমার্কড এভারটনের দিকে অসাধারণ এক ক্রস বাড়িয়ে দেন গ্যাব্রিয়েল জেসুস, আর সেখান থেকে গোল করতে ভুল করেননি এভারটন। 

গোলের পর উল্লসিত এভারটন; Image Source: Natacha Pisarenko/AP

এগিয়ে যাওয়ার পর আরো ঠাণ্ডা মাথায় খেলতে থাকে ব্রাজিল। কোণঠাসা পেরু নিজেদের রক্ষণ সামলে গোলশোধের চেষ্টা চালালেও ব্রাজিলের রক্ষণদুর্গের সামনে কোনো আক্রমণই তেমন পাত্তা পাচ্ছিল না। এমন সময়ে মারাত্মক এক ভুল করে বসেন ব্রাজিলের অভিজ্ঞ সেন্টারব্যাক থিয়াগো সিলভা, পেনাল্টি বক্সে কুয়েভাকে ট্যাকল করতে গিয়ে বল হাতে লাগিয়ে ফেলায় পেনাল্টি পায় পেরু। ৪৪ মিনিটে সেই পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে সমতায় ফেরান পাওলো গুয়েরেরো। পুরো আসরে এটি ছিল ব্রাজিলের হজমকৃত প্রথম গোল।

তবে সেই সমতা নিয়ে অবশ্য প্রথমার্ধ শেষ করতে পারেনি পেরুভিয়ানরা, প্রথমার্ধের ইনজুরি সময়ের একদম শেষদিকে মাঝমাঠে পেরুর ডিফেন্ডারের পা থেকে অসাধারণ এক ট্যাকলের মাধ্যমে বল কেড়ে নিয়ে তা আর্থারের দিকে বাড়িয়ে দেন রবার্তো ফিরমিনো। সেই বল টেনে পেনাল্টি বক্সের কাছাকাছি নিয়ে যান এই বার্সা মিডফিল্ডার, এদিকে ততক্ষণে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের ফাঁকি দিয়ে আনমার্কড হয়ে গেছেন গ্যাব্রিয়েল জেসুস। ঠাণ্ডা মাথায় তার দিকে বল বাড়িয়ে দেন আর্থার আর সেখান থেকে আলতো এক শটে দলকে এগিয়ে দেন গ্যাব্রিয়েল জেসুস। 

বিশ্বকাপে সুপার ফ্লপ জেসুস এই আসরে এসেছেন দলের ত্রাণকর্তা হয়ে; Image Source: Víctor R Caivano/AP

দ্বিতীয়ার্ধে গোলশোধের জন্য মরিয়া হয়ে ওঁঠে পেরু। আর এই সুযোগে পাল্টা আক্রমণে বারবার পেরুর রক্ষণভাগকে কাঁপাতে থাকে ব্রাজিল। কিন্তু ফিলিপে কৌতিনহোর ‘স্বার্থপর’ আচরণে তিন-তিনটা ভালো সুযোগ নষ্ট হয় ব্রাজিলের। এর মধ্যে একবার অবশ্য ফিরমিনোর কাছে বল গিয়েছিল, কিন্তু সেবার তার শটও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়। খেলায় যখন ব্রাজিলের একক আধিপত্য চলছে, তখন ৭০ মিনিটে হুট করে জেসুসকে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেন রেফারি। অথচ রিপ্লেতে দেখা গেছে, ফাউলের মাত্রা খুবই সামান্য ছিল।

ফাইনালে ব্রাজিলের সেরা খেলোয়াড় ছিল এই জেসুসই তাই তাকে হুট করে হারিয়ে বেশ বিপাকে পড়ে যায় সেলেসাওরা, বাধ্য হয়ে ট্যাকটিসে পরিবর্তন আনেন টিটে। ফিরমিনোকে উঠিয়ে নিয়ে শারীরিকভাবে শক্তিশালী রিচার্লিসনকে নামান ব্রাজিল কোচ, আর কৌতিনহোকে উঠিয়ে নিয়ে নামান ডিফেন্ডার এডার মিলিতাওকে। দশজন নিয়ে জানপ্রাণ বাজি রেখে ডিফেন্ড করতে থাকে পুরো ব্রাজিল দল, একজন বেশি নিয়েও সেই রক্ষণভাগে কিছুতেই চিড় ধরাতে পারছিল না পেরুভিয়ানরা। উল্টো পাল্টা আক্রমণে রিচার্লিসন ও এভারটন মিলে পেরুকে ব্যস্ত রাখতে থাকেন। 

জয় নিশ্চিতের পর বাঁধভাঙা উল্লাসে মাতোয়ারা রিচার্লিসন; Image Source: Sergio Moraes/Reuters

৮৭ মিনিটে এমনই আক্রমণে বাঁ প্রান্ত থেকে কাট-ইন করে বজ্রগতিতে পেনাল্টি বক্সে ঢুকে যান এভারটন, বিপদ দেখতে পেয়ে তাকে ধাক্কা মেরে বসেন পেরুর ডিফেন্ডার জামব্রোনা। সাথে সাথে পেনাল্টির বাঁশি বাজান চিলিয়ান রেফারি রবার্তো তোবার। পুরো স্টেডিয়াম তখন প্রার্থনায় মশগুল, এই মহাগুরুত্বপূর্ণ পেনাল্টি নেওয়ার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন ২২ বছর বয়সী রিচার্লিসন, যিনি কি না মাম্পসে আক্রান্ত হয়ে টুর্নামেন্টের সিংহভাগ অংশ মিস করেছেন। তবে নায়ক হওয়ার সুযোগটা অবশ্য নষ্ট করেননি রিচার্লিসন, নিখুঁত এক শটে গোল করে পুরো মারাকানাকে উন্মাতাল করে দেন এই উদীয়মান তারকা।

মারকানার সেই বাঁধভাঙা উল্লাসের সামনে রিচার্লিসনের জার্সি খুলে উদযাপনটাও তাই অযৌক্তিক বলে মনে হয় না, এমন নাটকীয় ম্যাচে জয় নিশ্চিতের পর এই উচ্ছ্বাসই তো স্বাভাবিক। বাকিটা সময় নিজেদের রক্ষণভাগ সামলে ৩-১ গোলের জয় নিশ্চিত করে দীর্ঘ একযুগ পর আবারও লাতিন আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট মাথায় তুললো সেলেসাওরা। 

ট্রফি হাতে উল্লসিত সেলেসাওরা; Image Source: CBF

পুরো আসরজুড়ে সবচেয়ে গোছানো ফুটবলটা ব্রাজিলই খেলেছে, আর সেটা ব্যক্তিগত পুরস্কারের ঝুলি দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। তিন গোল ও এক অ্যাসিস্ট করে গোল্ডেন বুট জিতেছেন এই আসরের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার এভারটন। পুরো আসরে দুর্দান্ত ডিফেন্ডিংয়ের পাশাপাশি রাইট উইং দিয়ে আক্রমণের ফোয়ারা বইয়ে দেওয়ার পুরস্কার হিসেবে ৩৬ বছর বয়সী দানি আলভেস জিতেছেন আসরের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। পুরো আসরে মাত্র এক গোল হজম করার পুরস্কার হিসেবে গোল্ডেন গ্লাভস জিতেছেন অ্যালিসন। পরিচ্ছন্ন ফুটবল খেলার পুরস্কার হিসেবে ফেয়ার প্লে ট্রফিটাও জিতেছে ব্রাজিল। 

গোল্ডেন বুট, গ্লাভস, বল – সব পুরস্কারই গেছে ব্রাজিলের দখলে; Image Source: Sport TV

২০১৪ সালের সেই ৭-১ ট্র্যাজেডির পর থেকে ব্রাজিলের ফুটবলারদের মাঝে আত্মবিশ্বাসের বড্ড অভাব অনুভূত হচ্ছিল। এমনকি ২০১৮ বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের বিপক্ষে ম্যাচেও সেই ‘জুজু’ খেলোয়াড়দের মনে তাড়া করে বেড়িয়েছে। ‘জুজু’ কাটাতে একটা ট্রফি জেতা বড্ড জরুরী ছিল ব্রাজিল দলটার জন্য। ঘরের মাঠে কোপা আমেরিকার ট্রফি জিতে সেই কাজটা ভালোভাবেই সেরে নিল তারা। এছাড়া দলের সেরা খেলোয়াড় নেইমারের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়ার কারণেই সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হতে হয়েছে দলটিকে, এবার সেই তারকাকে ছাড়াই ট্রফি ঘরে রেখে দিয়ে দল হিসেবে নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণও দিয়ে দিল সেলেসাওরা। 

এমন জয়ের পর টিটেকে তো এই উঁচুতেই মানায়! Image Source: CBF

শুরু করেছিলাম শেষ কোপা আমেরিকায় ব্রাজিলের ভরাডুবি দিয়ে, সেই কথা টেনে এনেই শেষ করি।

সেদিন যে ধ্বংসস্তুপে নানা অনিশ্চয়তা সামনে রেখে ব্রাজিলের কোচের হটসিটে বসেছিলেন টিটে, ঠিক তিন বছর পর সেই কোপা আমেরিকার ট্রফি জিতিয়ে সব অনিশ্চয়তা যেন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন ব্রাজিল বস। ভিনিসিয়াস, ডগলাস কস্তা কিংবা লুকাস মৌরাকে দলে না নিয়ে বিশ্বকাপে ডাহা ফেইল মারা জেসুস কিংবা আনকোরা এভারটনকে দলে নেওয়ায় অনেক সমালোচনার শুনতে হয়েছে তাকে। অথচ সেই এভারটন আর জেসুসই শিরোপা জয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন।

এই শিরোপা জয়ের আত্মবিশ্বাসকে জ্বালানি হিসেবে নিয়ে ২০২২ বিশ্বকাপ জয়ের ফানুস উড়ানোর পরিকল্পনা করবেন টিটে, সেটাই সবার প্রত্যাশা। কারণ দিনশেষে ব্রাজিলিয়ানদের কাছে ওই ২২ ক্যারেটের ট্রফিটাই যে শেষ কথা, সেটি জেতাতে না পারলে সব অর্জনই তুচ্ছ। তবে আপাতত সেসব কথা না-হয় তোলা থাক, একযুগের বন্ধ্যাত্ব ঘুচিয়ে মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্ব পুনরুদ্ধারের উৎসবটা যে এখনো শেষ হয়নি!   

This article is in Bangla language. It's an analysis about the Copa America Final bwtween Brazil & Peru. For references please check the hyperlinks inside the article.

Featured Image: CBF

Related Articles