১.
টেষ্টে সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে জয়ী দলের নাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০০৩ সালের সেই ম্যাচের প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া, বোলার হিসেবে ম্যাকগ্রা, ম্যাকগিল, ব্রেট লি, গিলেস্পি সবাই ছিলেন। তবে ম্যাচটা ছিল সিরিজের শেষ ম্যাচ, আগের তিন ম্যাচই উইন্ডিজ হেরে যাওয়ায় ম্যাচের গুরুত্ব খুব বেশি ছিল না। তবুও ৪১৮ রান তাড়া করতে গিয়ে সেই ম্যাচ উইন্ডিজ জিতে ফেলবে এমন আশা করাটা একটু বাড়াবাড়িই ছিল।
আচ্ছা, জয় বাদ দেওয়া যাক, সবচেয়ে বেশি রানের টার্গেট নিয়ে কোন দল খেলতে নেমেছিল? এটাও উইন্ডিজ; ১৯৩০ সালে ৮৩৬ রানের টার্গেট নিয়ে নামা সেই ম্যাচে উইন্ডিজ করেছিল ৪০৮ রান। ম্যাচটা শেষপর্যন্ত ড্র হয়।
আচ্ছা, এটাও বাদ দেওয়া যাক, চতুর্থ ইনিংসে সবচেয়ে বেশি কত রান হয়েছিল? ৬৫৪ রান, অবিশ্বাস্য তাই না? আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৬৯৬ রানের টার্গেটে নেমে সেই ম্যাচটি ইংল্যান্ড ড্র করেছিল।
অনেকেই হয়তো একটু বিরক্ত হচ্ছেন, তাই না? বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ের খেলায় অন্য খেলার কথা আনার প্রয়োজন কী? কেউ তো আর এত ইতিহাস জানতে চাইছে না।
তবে জানতে না চাইলেও ইতিহাস জানার প্রয়োজনীয়তা আছে।
চলমান টেস্টে বাংলাদেশের জয় পাওয়া কিংবা ড্র হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু এটা বলার আগে একটু বাংলাদেশের ইতিহাসটা জেনে নেওয়া যাক।
টেস্টে বাংলাদেশের জয় ১০টি। আগে ব্যাট করে জিতেছে সাতটি ম্যাচে, রান তাড়া করে জিতেছে মাত্র তিন ম্যাচ। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১০১ রান তাড়া করতে গিয়েও ৭ উইকেট পড়ে গিয়েছিল, আর উইন্ডিজের বিপক্ষে ২১৭ রান তাড়া করতে গিয়ে ৬ উইকেট পড়েছিল।
বাংলাদেশ ৪র্থ ইনিংসে সর্বোচ্চ কত রান করেছে এটা কি জানা আছে? রানটা মাত্র ৪১৩, তবে ৫২১ রানের টার্গেট থাকায় সেই ম্যাচও হেরে যেতে হয়েছিল।
৩২০ রানের বেশি টার্গেট নিয়ে ম্যাচ শুরুর ঘটনা রয়েছে ৫৮৬ বার। এর মধ্যে জয়ের ঘটনা রয়েছে মাত্র ২০ বার। ১৭৪টি ম্যাচ ড্র আর ১টি ম্যাচ টাই হওয়ায় বাকি ৩৯১টি ম্যাচে রান তাড়া করা দলটিকে হারতে হয়েছিল।
এখনো ম্যাচের দুই দিন বাকি থাকায় প্রাকৃতিক বিঘ্ন ব্যতিত অন্য কোনো কারণে এই ম্যাচ ড্র হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। টিকতে পারলে বাংলাদেশ এই ম্যাচ বের করে ফেলবে, নয়তো অল আউট হয়ে যাবে। এখন বাংলাদেশ কি ২১ তম দল হিসেবে জয়ের রেকর্ড গড়তে পারবে, নাকি ৩৯২ তম দল হিসেবে হেরে যাবে?
অসম্ভব না হলেও জয়ী হবার কাজটা নিঃসন্দেহে অনেক কঠিন। তবে ম্যাচ বের করতে হলে কোনো ব্যাটসম্যানকে অতিমানবীয় কিছু করে দেখাতে হবে।
ইতিহাস বলছে, জয় পাওয়া ২০টি ম্যাচের ১৯টিতেই জয়ী দলের অন্তত একজন ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করেছেন, কোনো কোনো ম্যাচে দুজন। কেবলমাত্র ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শ্রীলংকার ৩৯১ রান তাড়া করে জয় পাওয়া ম্যাচে কেউ সেঞ্চুরি করেনি। তবে সেই ম্যাচে ৩ জন ব্যাটসম্যান খেলেছিলেন যথাক্রমে ৮১, ৮০ আর ৬৬ রানের ইনিংস। এছাড়াও আরেকজন ব্যাটসম্যান খেলেছিলেন ৪৯ রানের একটি ইনিংস।
এই ম্যাচকে ব্যতিক্রম ধরলে বলা যায় যে বাংলাদেশকে জয় পেতে হলে অন্তত একজন ব্যাটসম্যানকে সেঞ্চুরি করার সাথে সাথে অন্য আরেকজন ব্যাটসম্যানকেও বড় একটি ইনিংস খেলতে হবে। এখন সম্ভাবনার বিচারে সেই আশা করাটা কতটুকু যৌক্তিক?
২.
চতুর্থ ইনিংসে ব্যাটিং করা সবসময়ই কঠিন। উইকেটের আচরণ পাল্টে যায়, তিন-চারদিন খেলার পর খেলোয়াড়েরাও তুলনামূলক দুর্বল থাকে, তাছাড়া রান তাড়া করার একটা অদৃশ্য চাপ তো থাকেই। এসব ফ্যাক্টর তখনই জয় করা যায় যখন দলে রান তাড়া করার মতো পর্যাপ্ত অভিজ্ঞ এবং দক্ষ ব্যাটসম্যান থাকে। কিন্তু তামিম ইকবাল এবং সাকিব আল হাসানের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ দলে এমনিতেই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানের সংকট চলছে।
টেস্ট জয়ের একটি সাধারণ সূত্র হচ্ছে, আপনাকে প্রথম ইনিংসেই বেশ ভালো একটা লিড নিয়ে নিতে হবে। জিম্বাবুয়েকে অল্প রানে অলআউট করেও নিজেদের ব্যাটিং ব্যর্থতায় সেই সুযোগটা হেলায় হারিয়েছে বাংলাদেশ। এ কারণে দ্বিতীয় ইনিংসে জিম্বাবুয়েকে আরো অল্প রানে অলআউট করে দিলেও নিয়ন্ত্রণটা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি নিজেদের হাতে নিতে পারেনি বাংলাদেশ। নিয়ন্ত্রণটা নিজেদের হাতে নেওয়ার সুযোগটা নিতে চাইলেও চতুর্থ ইনিংসে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের রেকর্ড কিন্তু বিপক্ষে কথা বলছে।
টপ অর্ডারে লিটন দাসের চতুর্থ ইনিংসে মাত্র ৪টি ইনিংস খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেই ৪ ইনিংসে তার সংগ্রহ মাত্র ৮৪ রান, সর্বোচ্চ ৩৫। ইমরুল কায়েস, যিনি কি না অনেকদিন পর দলে সুযোগ পেয়ে মোটামুটি ভালোই খেলে চলেছেন, তার অবস্থাও করুণ। ১৪ ইনিংসে ১৮ গড়ে রান মাত্র ২৫২, সর্বোচ্চ ৪৩। বাংলার ব্র্যাডম্যান খ্যাত মমিনুল হক সেই তুলনায় কিছুটা ভালো। ১১টি ইনিংসে ৩৯.২২ গড়ে তার সংগ্রহ ৩৫৩, শত রানের ইনিংসও আছে একটি। তবে হতাশার কথা হচ্ছে, মমিনুল হক অনেকদিন যাবতই ফর্মে নেই। সর্বশেষ ৭টি ইনিংসে তার সংগ্রহ মাত্র ৬০ রান, যার মাঝে তিনটি শূন্য রানের ইনিংসও রয়েছে। এই ইনিংস খারাপ খেললে দল থেকে বাদ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে– এমন চাপে থাকা ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে বড় ইনিংস আশা করাটা যথেষ্ট সাহসের পরিচায়ক।
মুশফিকুর রহিমের রেকর্ডও ভালো। ২০ ইনিংসে ৩৭.৪৪ গড়ে রান ৬৭৪, শত রানের ইনিংস রয়েছে ১টি। কাজেই মিস্টার ডিপেন্ডেবলের কাছ থেকে একটা বড় ইনিংস প্রত্যাশা করা যেতেই পারে। এই ম্যাচে অধিনায়ক হিসেবে খেলা মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের টেস্ট রেকর্ডই তুলনামূলক খারাপ, চতুর্থ ইনিংসে ১৬ ইনিংসে ১৭.৪৪ গড়ে ২৫৮ রানের হিসাব ধরলে সেটা আরো বাজে হয়ে যায়।
নাজমুল হোসাইন শান্তকে এখন পর্যন্ত চতুর্থ ইনিংসে ব্যাটিং করতে হয়নি, আর আরিফুল ইসলামের তো সবেমাত্র অভিষেক হলো। আরেক অলরাউন্ডার মেহেদি হাসান মিরাজের ৭ ইনিংসে ১৭.২০ গড়ে মাত্র ৮৬ রান। বাকি বোলারদের ইতিহাস জানাটা হয়তো আর খুব বেশি প্রয়োজনীয় নয়। এই ব্যাটিং লাইন আপ নিয়ে চতুর্থ ইনিংসে তিন শতাধিক রান করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিংই বলা চলে।
৩.
তবে ক্রিকেটে অতীতেও অনেক অসম্ভব মনে হওয়া কাজ সম্ভব হয়েছে। ইতিহাস কখনো না কখনো পাল্টা য়। ইতিহাস পাল্টানোর সামর্থ্য এই বাংলাদেশ দলেরও রয়েছে। প্রয়োজন কেবলমাত্র সামর্থ্যের প্রয়োগ ঘটানো। প্রথম ইনিংসে পিছিয়ে থেকেও দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস অনেক দলেরই রয়েছে। বাংলাদেশ দল সেই জায়গা থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজতে পারে।
বড় দল হতে হলে সহজ অবস্থা থেকে ম্যাচ জেতার সাথে সাথে কঠিন অবস্থা থেকে ফিরে এসে ম্যাচ জেতার অভ্যাসটাও গড়ে তুলতে হবে। আর এই সুযোগটা বর্তমান জিম্বাবুয়ের মতো দলের বিপক্ষে কাজে লাগানোটাই তুলনামূলক সহজ ক্রিকেটের অন্যান্য পরাশক্তির তুলনায়। খুব বড় ধরনের অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে আজকের দিনেই ম্যাচটা শেষ হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশের সমর্থকরা সকালবেলা আশা নিয়েই দিনটা শুরু করবেন, যাতে দিনের শেষ হাসিটা তারাই হাসতে পারেন।
আর বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরাও জানেন, এই ম্যাচে একমাত্র জয়ই পারে সমর্থকদের মুখে হাসি ফোটাতে। একমাত্র জয়ই পারে প্রথম ইনিংসের ব্যর্থতা ভুলিয়ে দিতে। সেই জয় পাওয়ার জন্য অন্তত দুজন ব্যাটসম্যানকে পরিপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে খেলতে হবে।
দেখার বিষয় হলো, সেই দায়িত্বটা কে কাঁধে তুলে নেয়?
This article is in Bangla language. It discusses about the ongoing test series between Bangladesh & Zimbabwe.
Feature Image: Sports-nova