বিশ্বকাপে হেড কোচের ইংলিশ কন্ডিশনের অভিজ্ঞতা কতটা সাহায্য করবে বাংলাদেশ দলকে? বিশ্বকাপের জন্য দেশ ছাড়ার আগে গত এপ্রিলে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের হেড কোচ স্টিভ রোডসকেই করা হয়েছিল এই প্রশ্নটি। রোডসের উত্তরটা ছিল এমন,
‘আমি মনে করি, হয়তো কিছু সুবিধা আমি পাবো কিছু মাঠের কিউরেটর-কোচদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কারণে। আমার কোচিং ও এসব মাঠে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। নির্দিষ্ট দিনে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে। আমি এসব অনেকটাই জানি, কিন্তু খেলোয়াড়দেরই ব্যাটে-বলে ভালো কিছু করতে হবে।’
এই অতৃপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই। খেলোয়াড়দের মূল দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিলেও রোডসের কথায় কিছুটা আশা, আস্থার সঞ্চার হতেই পারে সবার মনে।
কিন্তু বিস্ময়ের খবর হলো, বিশ্বকাপের মঞ্চে কি না উইকেটের ভাষা পড়তে ভুল করেছে বাংলাদেশ! এই খবর উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমে। বিষয়টা শুনে বা ঘটনার সবিস্তার পড়তে গিয়ে হয়তো আপনার চক্ষু ছানাবড়া হতে পারে। তবে বাস্তবতা কিন্তু এমনই।
বিশ্বকাপে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডের বিরুদ্ধে উইকেটের ভাষা পড়তে না পারার খেসারত দিয়েছিল বাংলাদেশ। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অসাধারণ জয়ে বিশ্বকাপ শুরু করেছিল টাইগাররা। ওভালে দ্বিতীয় ম্যাচে 'ব্ল্যাক ক্যাপস'দের বিরুদ্ধে মাঠে নামে বাংলাদেশ। অনেক লড়াই, ২২ গজে ও ফিল্ডিংয়ে ভুলভ্রান্তি পেরিয়ে ২ উইকেটে হেরেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সেই হারের নেপথ্যে টিম ম্যানেজেমেন্টের উইকেটের ভাষা বুঝতে না পারার দায়ও ছিল। ড্রেসিংরুমে ইংলিশ কন্ডিশনের এত বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রোডস থাকার পরও উইকেট নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে থাকল বাংলাদেশ। একটা পেশাদার, আন্তর্জাতিক দলের জন্য এটি পরিতাপের বিষয় বটে।
গত ৫ জুন ওভালের উইকেটের ভাষা বুঝতে ভুল করেছিল টিম ম্যানেজমেন্ট। তাই ইনিংসের মাঝের ওভারে ব্যাটসম্যানদের কাছে পাঠানো হয়েছিল ভুল বার্তা। এর মাশুলও দিতে হয়েছে কড়ায়-গণ্ডায়। স্কোরবোর্ডে আসেনি বড় পুঁজি। ২৪৪ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। বোলারদের প্রাণান্ত চেষ্টার পরও নিউ জিল্যান্ডকে হারাতে পারেনি বাংলাদেশ। উইকেট নিয়ে বোঝাপড়ায় সেই ম্যাচে টিম ম্যানেজমেন্টের মধ্যে যে দ্বিমত হয়েছিল, তার আভাস কিছুটা ম্যাচের পরপরই মিলেছিল। সেটা নেহায়েত গুঞ্জন, ফিসফাসের মতো। কিন্তু টন্টনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগের দিন (গত ১৬ জুন) সেই ভুলের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা।
ওভাল, বাংলাদেশ-নিউ জিল্যান্ড ম্যাচ
টসে হেরে সেদিন আগে ব্যাট করেছিল বাংলাদেশ। ৬০ রানে দুই ওপেনার সৌম্য সরকার ও তামিম ইকবাল বিদায় নিয়েছিলেন। সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিমের তৃতীয় উইকেট জুটিটা এদিনও জমে উঠেছিল। কিন্তু দলীয় ১১০ রানে দু'জনের ভুল বোঝাবুঝিতে রানআউট হন মুশফিক, ১৯ রান করেন তিনি। হাফসেঞ্চুরি করেছিলেন সাকিব, ৩১তম ওভারে তিনি আউট হন ৬৪ রান করে। তখন দলের রান ১৫১।
তারপর ড্রেসিংরুম থেকে মিঠুন-মাহমুদউল্লাহদের কাছে বার্তা আসে মেরে খেলতে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, সেদিন টিম ম্যানেজমেন্টের উচ্চ পর্যায়ের এক-দু'জন রেডিও ধারাভাষ্য শুনে উইকেট নিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন। মাঝের ওভারে ব্যাটসম্যানদের তাই মেরে খেলার বার্তা দেওয়া হয়েছিল, যে সিদ্ধান্তে সায় ছিল না অধিনায়কের। ওই বার্তাই পরে হিতে বিপরীত হয়ে যায়। ব্যাটসম্যানরা মারতে গিয়ে তড়িঘড়ি সফল হননি, দ্রুত ফিরেছেন সাজঘরে। তাতেই রানটা পৌঁছায়নি ভালো অবস্থানে। ২৪৪ রানে থামে বাংলাদেশ, ইনিংসের চার বল বাকি থাকতে।
অথচ ম্যাচ শেষে সবাই অনুভব করেছেন, ২০-৩০ রান বেশি হলেই হয়তো ম্যাচের ভাগ্যটা অন্যরকম হতে পারতো। কারণ, নিউ জিল্যান্ডও এই রান পাড়ি দিতে গিয়ে আট উইকেট হারিয়েছিল। তারা ম্যাচটাও জিতেছিল ১৭ বল আগে। উইকেট অনুযায়ী কত রান আসলে ওই দিন ওভালের উইকেটে পার স্কোর ছিল, সেটা অনুমান করতেই ভুল করে ফেলেছিল বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট। যার কারণেই হাতের কাছে এসেও ফসকে গেছে নিউ জিল্যান্ডরে হারানোর সুযোগ। আর ওই ম্যাচ জিতলে টাইগারদের সেমি'র স্বপ্নটা তখনই চওড়া হয়ে যেত।
ধারাভাষ্যকারদের কথা শুনে উইকেট বোঝার চেষ্টা
উইন্ডিজ ম্যাচের আগে টন্টনের উইকেট নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল মাশরাফিকে। উইকেট পর্যবেক্ষণে নিউ জিল্যান্ড ম্যাচে করা ভুলের কথা তুলে ধরে অধিনায়ক বলেছেন,
‘এটা আসলে একটা ম্যাচের হার-জিত ঠিক করে দেয়। আমার কাছে মনে হয়, যেটা আমরা নিউ জিল্যান্ড ম্যাচে করতে পারিনি। আমরা যদি উইকেট ঠিকমতো ধরতে পারতাম, তাহলে চিন্তা করতাম ২৭০ বা ২৬০ ওই ম্যাচে জেতার মতো রান, যে পর্যবেক্ষণটা খুব প্রয়োজন।’
সেদিন টিম ম্যানেজমেন্টের কেউ কেউ ধারাভাষ্যকারদের কথায় প্রভাবিত হয়ে উইকেট সম্পর্কে বার্তা পাঠিয়েছিলেন ব্যাটসম্যানদের কাছে। কারো নাম উল্লেখ না করেই মাশরাফি বলেছেন,
‘ধারাভাষ্যকারদের কথা শুনে উইকেট মূল্যায়ন করা সহজ না। ধারাভাষ্যকাররা তো বলবেই, মনে হচ্ছে এই, মনে হচ্ছে ওই। আল্টিমেটলি খেলা যেভাবে চলবে, কমেন্ট্রি ওইভাবেই হবে।’
তবে উইকেট বোঝার দায়িত্বটা ক্রিকেটারদের উপরই ছেড়ে দিতে চান অধিনায়ক। কোচ বা টিম ম্যানেজমেন্টের কাউকে দোষ দিতে চান না মাশরাফি। তিনি বলেছেন,
‘একটা ম্যাচে যখন খেলা চলতে থাকে, উইকেটের আচরণ কিন্তু পরিবর্তন হয়। ওভালে বেশিরভাগ সময় আপনি ধরে রাখবেন, সাড়ে তিনশ' রান বা ৩৩০ করতে হবে। ওইটা ভাবনায় থাকে। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আমাদের হিসাবনিকাশ ঠিক ছিল। নিউ জিল্যান্ডের সঙ্গেও আমরা ঠিক পথে আগাচ্ছিলাম। হয়তো সাকিব আউট না হলে আমরা ওইদিকেই যাচ্ছিলাম। মিঠুন-রিয়াদ যখন ব্যাট করছিল, তখনও ঠিক জায়গায় ছিলাম, ২৭০ করার মতো অবস্থায় ছিলাম। আসলে উইকেটে যারা এতক্ষণ ব্যাট করছে, তাদের উইকেট অ্যাসেস করা বেশি দরকার বাইরের থেকে করার (পর্যবেক্ষণ) চেয়ে। একেকদিন একই উইকেটকে আপনি বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন রূপে দেখতে পারেন।’
ইংলিশ কন্ডিশনে রোডসের অভিজ্ঞতা
ইংলিশ কাউন্টি সার্কিটে স্টিভ রোডস দারুণ খ্যাতিমান কোচ। উস্টারশায়ারে সফলভাবে কাজ করেছেন। কোচিং অভিজ্ঞতাও অনেক বছরের, নানা সময়ে কাজ করেছেন ইংল্যান্ড জাতীয় দলের সঙ্গে।
৫৫ বছর বয়সী এই কোচের জন্ম ইয়র্কশায়ারে, খেলোয়াড়ি জীবনও ইংল্যান্ডেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের হয়ে ১১ টেস্ট, ৯টি ওয়ানডে খেলেছেন তিনি। ৪৪০টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ, ৪৭৭টি লিস্ট-এ ম্যাচ খেলেছেন রোডস এই কন্ডিশনে।
উস্টারশায়ারে প্রায় ২০ বছরের খেলোয়াড়ি জীবনশেষে ২০০৬ সালে এই কাউন্টিতেই শুরু করেন কোচিং ক্যারিয়ার। টানা দায়িত্বে ছিলেন প্রায় এক যুগ। হেড কোচের এই অভিজ্ঞতার ভান্ডারও ইংলিশ কন্ডিশনের বিভ্রান্তি দূর করতে যথেষ্ট হচ্ছে না। উইকেটের ভাষা পড়তে না পারার মতো ভুলের কারণে বিশ্বকাপের মঞ্চে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বাংলাদেশ দলকে। নিন্দুকেরা যদি এখন বলে ওঠেন, নিজের দেশে, এত চেনা আলো-বায়ু-হাওয়ায় যদি উইকেটই বুঝতে না পারেন, তাহলে এত টাকায় এই ইংলিশ কোচ রেখে লাভ কি। আর এমনটা বলে বসলে অবশ্য খুব অত্যুক্তি হবে না।
তবে বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্টে এখন অধিনায়ক, কোচ ছাড়াও ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ সুজনও জড়িত আছেন। নির্বাচকরা সে অর্থে দল নির্বাচনের পর আর কোনো সংশ্লিষ্টতায় থাকেন না, অন্তত একাদশ নির্বাচনের ক্ষেত্রে। উইকেট পড়তে না পারার ভুলের দায় পুরোটা কোচের উপর চাপালেও টিম ম্যানেজমেন্টের অংশ হিসেবে অধিনায়ক, ম্যানেজার তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তাই সামগ্রিকভাবে এর দায় তাদের ঘাড়েও বর্তায়। আর উইকেটে থাকা ব্যাটসম্যানদের বোধবুদ্ধি প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়। কারণ বাইরে থেকে বার্তা আসলেও যারা ব্যাটিং করছিলেন, তারা হয়তো উইকেটের আচরণ ও সম্ভাব্য স্কোরের ধারণা পেয়েছিলেন। ড্রেসিংরুম থেকে বার্তা আসলেও নিজেদের অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা কাজে লাগানো প্রয়োজন ছিল, যা করতে ব্যর্থ হয়েছেন ব্যাটসম্যানরাও।
এটুকু সত্য, ২২ গজের যেকোনো ভুল-ব্যর্থতার চেয়ে উইকেট বুঝতে না পারার হতাশাটা একটু বেশিই অনুভূত হওয়ার কথা যেকোনো দলে।
This article is in bangla language. It is about the rumours about Steve Rhodes, where he was accused of being unable to read the English wickets properly.
Featured Image: Getty Images