Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্রিস কেয়ার্নস: নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের রুপকথার স্রষ্টা

শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলী, রাহুল দ্রাবিড়, কাম্বলী, যুবরাজ সিং, অনীল কুম্বলে, রবিন সিং, জহির খান– এই স্কোয়াড নিয়ে যদি ভারত কোনো টুর্নামেন্ট শুরু করে, তাহলে তাদেরকে ‘হট ফেভারিট’ বলাটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু সত্যি কথাটা হচ্ছে, এখানে যে টুর্নামেন্টটা নিয়ে কথা বলা হচ্ছে, সেখানে ভারতের শুরুটা হয়েছিল আন্ডারডগ হিসেবে এবং সেটি মনে না করাটাই ছিল ভুল। একমাত্র কারণ- টুর্নামেন্টটি ছিল নক আউট এবং প্রথম ম্যাচেই তাদের প্রতিপক্ষ ছিল এমন এক অস্ট্রেলিয়া, যে দলকে অনেকেই সর্বকালের সেরা দল মনে করে। ওয়াহ ব্রাদার্স, গিলক্রিস্ট, বেভান, মার্টিন, পন্টিং, ম্যাকগ্রা কিংবা ব্রেট লির মতো তারকায় ভরপুর দলটাকে হারানোর জন্য তখন একটা কাজই করতে হতো– সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা। ভারত সেটা করেছিল কিনা জানা নেই, তবে অস্ট্রেলিয়াকে তারা সেই টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় করে দিয়েছিল যুবরাজ সিং নামক এক তরুণের ব্যাটিং বীরত্বে। জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক ইনিংসে ব্যাটিং করতে নেমেই ৮০ বলে ৮৪ রানের একটা দুর্দান্ত ইনিংস খেলে অস্ট্রেলিয়ানদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিলেন হয়তো।

যুবরাজের ইনিংসটাই ভারতের জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছিল; Image Source: BookMyShow

তবে সেই অস্ট্রেলিয়ার কাছে ২৬৬ রানের টার্গেটও খুব বেশি ছিল না। কিন্তু ওই যে, সৃষ্টিকর্তার কৃপা সম্ভবত ছিল ভারতের সাথে। সেজন্য ২০ বল বাকি থাকতেই অস্ট্রেলিয়া অল আউট হয়ে গেল ২০ রান পেছনে থেকে। অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পরেই ভারত যেন নিজেদেরকে ফিরে পেল। সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৯৬ রানে হারিয়ে ২০০০ সালের নক আউটের ফাইনালে ফেভারিট হলো সেই ভারতই।

অস্ট্রেলিয়ার সেই দলটা ছিল অনন্য; Image Source: Cricket Australia

শুধু ফর্মের কারণেই নয়, ফাইনালের প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড, এও ফেভারিটের তকমা পাওয়ার আরেকটা যুক্তিযুক্ত কারণ। তখন পর্যন্ত নিউজিল্যান্ড তাদের ইতিহাসে ৩১টি টুর্নামেন্টের ৯টি ফাইনাল খেলেও একবারও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। দলগত শক্তিতে পিছিয়ে থাকাটা তো একটা বড় কারণ, তবে এর সাথে বড় ম্যাচে স্নায়ু শীতল রাখতে না পারাটাও যোগ হওয়াতে নিউজিল্যান্ডের ফাইনালে উঠতে পারাটাকেই ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা হয়তো যথেষ্ট কিছু মনে করতেন।

তবে সেই টুর্নামেন্টে নিউজিল্যান্ডও ভালো পারফর্মেন্স করেই ফাইনালে এসেছিল। কোয়ার্টার ফাইনালে জিম্বাবুয়ে সহজ প্রতিপক্ষ হলেও সেমিফাইনালে তারা হারায় ফেভারিট পাকিস্তানকে। সাঈদ আনোয়ার, ইনজামাম উল হক, মোহাম্মদ ইউসুফ, ওয়াসিম আকরাম, সাকলাইন মুস্তাক, আবদুল রাজ্জাক আর আজহার মাহমুদের মতো তারকাদের উপস্থিতি তো একটি কারণ, তবে একইসাথে সেই ম্যাচে সাঈদ আনোয়ারের সেঞ্চুরি করাটাও পাকিস্তানকে এগিয়ে রাখার আরেকটা কারণ ছিল। সাঈদ আনোয়ারের সেঞ্চুরি আর পাকিস্তানের জয় তখন ছিল মোটামুটি সমার্থক। তখন পর্যন্ত সাঈদ আনোয়ারের করা ১৯টি সেঞ্চুরির মাঝে কেবল মাত্র ১টি ম্যাচেই পাকিস্তানকে হারতে হয়েছে। সে কাজ করতে গিয়েও ঢাকার মাঠে ভারতকে তখনকার রান তাড়া করার বিশ্বরেকর্ড গড়তে হয়েছিল। সেই পাকিস্তানকে সাঈদ আনোয়ারের সেঞ্চুরি করার পরেও হারিয়ে ফাইনালে আসার পর তাই তাদেরকেও কেউ একেবারে ফেলে দিচ্ছিল না।

নিউজিল্যান্ডের রজার টুজ পরপর দুই ম্যাচে ৮৫ আর ৮৭ রানের দুটো ইনিংস খেলে ফর্মে থাকার ইঙ্গিত দিলেও ইনজুরির জন্য দলের সেরা অলরাউন্ডার ক্রিস কেয়ার্নসের অনুপস্থিতি নিউজিল্যান্ডকে মানসিকভাবে কিছুটা পিছিয়ে দিচ্ছিল। তবে শেষপর্যন্ত শুধু মাত্র ব্যাটিং করতে পারবে এই শর্তে কেয়ার্নস ফাইনালে ম্যাচে খেলতে নামলো। এত কিছুর জানার পর বুদ্ধিমান হলে আপনি নিজেও ফাইনাল শুরুর আগে ভারতকেই ফেভারিট মানবেন আশা করা যায়।

ফাইনালে টস জিতে নিউজিল্যান্ড ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেয়। “ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপের বিপক্ষে কোন স্কোরই নিরাপদ নয়”, এই চিরন্তন বাক্যটিই হয়তো মূল কারণ ছিল। তবে কারণ যা-ই হোক না কেন, সৌরভ গাঙ্গুলী আর শচীন টেন্ডুলকারের সূচনাটা হলো দুর্দান্ত।

গাঙ্গুলী আর শচীনের জুটি ছিল বিখ্যাত; Image Source: Cricketcountry

প্রথম ৬০ রান এলো মাত্র ৯  ওভারেই। রানের রাশটা থামানোর জন্য ইনজুরি নিয়েও বোলিং করতে আসলেন ক্রিস কেয়ার্নস। তার নিয়ন্ত্রিত বোলিং এই ভারতের রান রেট একটু কমলো, কিন্তু তাও যথেষ্ট ছিল ৫০ ওভার শেষে ৩০০+ স্কোর করার জন্য। ২৭ তম ওভারে শচীন টেন্ডুলকার যখন ৬৯ রানে রান আউট হলেন, তখন ভারতের সংগ্রহ ১৪১ রান। কিন্তু একপ্রান্তে গাঙ্গুলী আগলে রাখলেন। গাঙ্গুলীর সেঞ্চুরিতেই ভারত দলীয় ২০০ রান পেরুলো মাত্র ৩৯ তম ওভারেই। ৪২.৩ ওভারে গাঙ্গুলী যখন ব্যক্তিগত ১১৭ রানে আউট হলেন, তখন দলের সংগ্রহ ২২০ রান। এই জায়গা থেকে ভারতের সংগ্রহ যে মাত্র ২৬৪তেই থেমে গেল, তার পেছনে স্টাইরিস, নথান অ্যাসলে আর ক্রিস কেয়ার্নসের নিয়ন্ত্রিত বোলিংই মূল ভূমিকা রেখেছিল।

তবে ২৬৫ রানের টার্গেটও একেবারে কম নয়। বিশেষ করে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে, ‘৯৬ সালে তাদের সর্বশেষ ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৬১ রান তাড়া করতে গিয়ে একটা পর্যায়ে ২ উইকেটে ৮০ রান থাকলেও শেষ পর্যন্ত ১৪ ওভার বাকি থাকতেই ১১৯ রানে অল আউট হয় তারা। তাদের বিপক্ষে ২৬৫ রান তো তাই নির্ভরযোগ্যই বলা চলে। ম্যাচের হাইলাইটস:

নিউজিল্যান্ড ভালো খেলেও নার্ভের কাছে পরাজিত হচ্ছিল বারবার; Image Source: Times of India

বড় রান তাড়া করার সময় ব্যাটিং পক্ষের লক্ষ্য থাকে পাওয়ার প্লে এর সুবিধা কাজে লাগিয়ে এবং উইকেট যতটা সম্ভব কম হারিয়ে স্কোরবোর্ডে কিছু রান যোগ করে ফেলা। আর বোলিং পক্ষের লক্ষ্য থাকে খুব দ্রুত কিছু উইকেট তুলে নেওয়া, যাতে করে ব্যাটিং পক্ষ চাপে পড়ে রানের গতি কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই স্পেয়ারম্যানকে আউট করে ভারত কিছুটা এগিয়ে যায়। তবে আরেকপ্রান্তে রানের গতিটাকে ধরে রাখেন নথান অ্যাসলে। মাঝে স্টিফেন ফ্লেমিং আউট হলেও ফর্মে থাকা রজার টুজ আর অ্যাসলের তাণ্ডবেই ৭.১ ওভারে ৫০ রান পেরিয়ে যায় নিউজিল্যান্ড। কিন্তু ১৫ তম ওভারের শেষ বলে অ্যাসলে আউট হলে রানের গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে যায়। এরপর ১৯ তম ওভারে মাত্র ৩১ রানে রজার টুজ অনীল কুম্বলের বলে আউট হলে ম্যাচটা পুরোপুরিই ভারতের দিকে হেলে যায়। এরমধ্যে ম্যাকমিলান শচীন টেন্ডুলকারের শিকারে পরিণত হলে নিউজিল্যান্ড একেবারে ব্যাকফুটে চলে যায়। ২৫তম ওভার শেষে নিউজিল্যান্ডের স্কোর যখন ৫ উইকেটে ১৩৫ রান, তখন নিউজিল্যান্ডের ঘোর সমর্থকেরাও হয়তো ম্যাচ জয়ের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন।

ফর্মে থাকলেও ফাইনালে ব্যর্থ ছিলেন টুজ; Image Source: Getty Images

কিন্তু কেয়ার্নস মোটামুটি এক হাতে ম্যাচটাকে ধরে রাখেন। কিছুটা ধীর স্থির ভাবেই ব্যক্তিগত ৫০ রান করেন ৬৩ বলে যাতে ৫ টি চারের মার ছিল। পরবর্তী ৫০ রান করেন ৪৭ বলে, যেখানে ৩টি চারের সাথে ছিল আরো দু’টি বিশাল ছক্কা। সাথে ক্রিস হ্যারিস দেন যোগ্য সাহচর্য। একটা পর্যায়ে আস্কিং রান রেট আটের উপরে চলে গেলেও দুজনেই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছেন। এই দু’জনের ১৪৪ বলে ১২২ রানের জুটিই নিউজিল্যান্ডকে আবার ম্যাচে ফিরিয়ে আনে। ব্যক্তিগত ৪৬ রানের সময় যখন ক্রিস হ্যারিস আউট হন, তখন নিউজিল্যান্ডের প্রয়োজন ৯ বলে ১১ রান।

কেয়ার্নস মোটামুটি একাই খেলে গিয়েছিলেন; Image Source: ESPNcricinfo

জয়সূচক রানটা শেষ পর্যন্ত ক্রিস কেয়ার্নসের ব্যাট থেকেই আসে। হয়তো ভাগ্যেই লেখা ছিল যে নাটকের সমাপ্তিটা তার হাত ধরেই আসুক। লেগ সাইটে ফ্লিক করে আনন্দের উল্লাসে মেতে ওঠেন ক্রিস কেয়ার্নস আর পুরো নিউজিল্যান্ড দল। ক্রিস অপরাজিত থাকেন ১০২ রানে

হ্যারিস দিয়েছিলেন যোগ্য সাহচর্য; Image Source: Twitter

যে কোন দেশেরই প্রথম শিরোপা জয় একটা বিশেষ কিছুই। আর সেই বিশেষ কিছুটা যার হাত ধরে আসে, সেই মানুষটাও সবসময়ের জন্য বিশেষ হয়েই থাকেন সে দেশের ইতিহাসে। নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের প্রথম টুর্নামেন্ট জয়ের নায়ক হিসেবে স্মরণীয় হয়েই আছেন ক্রিস কেয়ার্নস। গত শতাব্দীর সেরা ওয়ানডে ইনিংসের তালিকায় ইনিংসটার অবস্থান ২২ নম্বরে। এই ইনিংস ছাড়াও কেয়ার্নস ক্রিকেট ইতিহাসের নায়ক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন, তবে এই ইনিংসের মাধ্যমে তিনি নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসেরও মহানায়ক হিসেবে মানুষের মনে জায়গা করে নেন।

টুর্নামেন্ট জয়ের পর উল্লাসরত নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দল, Image Source: CricketCountry com

Featured photo: sportswallah.com

Related Articles