Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সাইকেলে চেপে কেরালা থেকে বিশ্বকাপ

ক্লিফিন ফ্রান্সিস তখন দক্ষিণ ভারতে তার বাড়িতে বসে কিছু একটা পরিকল্পনা করছিলেন। সেই সময় তার এক বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি এবার বিশ্বকাপের খেলা দেখবেন কি না।

“অবশ্যই”, ফ্রান্সিস জবাব দিয়েছিলেন, “এমনকি আমি রাশিয়াতেই যেতে পারি এবারের বিশ্বকাপ উৎসব দেখার জন্য।”

সেটা ছিলো আগস্ট মাসের ঘটনা। কিন্তু এই কথা ফ্রান্সিস যখন বলছেন, তখনও তিনি জানেন না যে, কেরালা থেকে রাশিয়ায় যাওয়ার বিমানের টিকিট কিভাবে সংগ্রহ করবেন তিনি।

ফ্রান্সিস হলেন ভারতের দক্ষিণ অঞ্চলের কেরালা শহরের একজন বাসিন্দা। পেশায় তিনি একজন গণিত শিক্ষক। তারা প্রতিদিনের আয় ৪০ ডলারের মতো। এ দিয়ে আর যা-ই হোক, বিমানের টিকিট কেটে রাশিয়া যাওয়ার স্বপ্ন দেখা কঠিন।

ফ্রান্সিস বলছিলেন, “আমি বুঝতে পারলাম যে, আমার কাছে রাশিয়ায় বিমানে যাওয়া এবং এক মাস থাকার মতো যথেষ্ট অর্থ নেই। আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, এই ভ্রমণের সবচেয়ে সহজ উপায় কী হতে পারে? উত্তর পেলাম, বাই সাইকেল।”

বন্ধুরা তাকে বিশ্বাস করলো না। কিন্তু তিনি মন ঠিক করে ফেললেন।

২৩ ফ্রেব্রুয়ারি; এক মহাকাব্যিক যাত্রা শুরু করলেন ফ্রান্সিস। প্রথমে বিমানে চড়ে গেলেন দুবাই। সেখান থেকে ফেরিতে ইরানে, যেখান থেকে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর দূরত্ব প্রায় ৪,২০০ কিলোমিটার। এই পথটা তিনি পাড়ি দিলেন বাই সাইকেলে।

শেষ অবধি এই কঠোর পরিশ্রমের তিনি একটিই পুরষ্কার চাচ্ছেন, তার নায়ক, তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসির একটু সাক্ষাত।

ফ্রান্সিস বলেছেন, ”আমি সাইক্লিং ভালোবাসি। আর ফুটবল নিয়ে আমি পাগল। আমি স্রেফ আমার এই দুটো আবেগকে এবার একসাথে মিলিয়ে দিয়েছি।“

ইরানের পথে; সোর্স: ক্লিফিন ফ্রান্সিস

ফুটবল ও চলচ্চিত্র

তার প্রথম পরিকল্পনা ছিলো পাকিস্তান হয়ে সরাসরিই সাইকেলে চেপে যাওয়ার। কিন্তু পাকিস্তানের সাথে ভারতের রাজনৈতিক শীতল সম্পর্কের কারণে সেটা হয়ে ওঠেনি।

এই পরিকল্পনা বদলে ফ্রান্সিসের অবশ্য খরচ অনেকটাই বেড়ে গেলো। যেটা তিনি কল্পনা করেননি, ”পরিকল্পনা বদল আমার খরচ অনেক বাড়িয়ে দিলো। আমার নিজের সাইকেল আমি দুবাই নিয়ে যেতে পারিনি। ফলে ওখানে আমাকে একটা সাইকেল কিনতে হলো, যেটার দাম পড়েছিলো ৭০০ ডলার। সাইকেলটা লম্বা পথে চালানোর জন্য সেরা ছিলো না। কিন্তু আমি এর চেয়ে দামী সাইকেল কিনতে পারতাম না।“

তবে এই সামান্য ধাক্কা ফ্রান্সিস ভুলে গেলেন ইরানিয়ান বন্দরে পৌঁছানোর পর। ১১ মার্চ তিনি পৌঁছালেন বন্দন আব্বাসে।

ইরানের অভিজ্ঞতা এখনও মুগ্ধ করে রেখেছে এই গণিত শিক্ষককে, “এটা বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর দেশ। মানুষজন এত অতিথিপরায়ন! আমি এই দেশে ৪৫ দিন কাটিয়েছি। কিন্তু হোটেলে থেকেছি মাত্র দুদিন।“

ইরানে পৌঁছানোর পর ফ্রান্সিসের প্রতিদিনের বাজেট ছিলো ১০ ডলার করে। এতেই তাকে থাকতে হতো এবং খেতে হতো। কিন্তু তিনি বলছেন, ইরানের যেখানেই গেছেন না কেন, লোকেরা তাকে নিজেদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। নিজেদের বাড়িতে রেখেছেন এবং খাবার খাইয়েছেন।

এই বাড়িতেও ছিলেন; সোর্স: ক্লিফিন ফ্রান্সিস

ইরান নিয়ে যে পূর্ব ধারণা ফ্রান্সিসের ছিলো তা সব বদলে গেছে এই সফরের ফলে, “আমার ইরান নিয়ে যে ধারা ছিলো, তা বদলে গেছে। আমি একটা ব্যাপার বুঝেছি যে, কোনো একটা দেশ নিয়ে স্রেফ ভূ-রাজনীতির কারণে একটা ধারণা আগে থেকে তৈরি করে রাখা উচিত না।”

ইরানের নাটকীয় দৃশ্যপটের বিস্তারিত সব বর্ণনা মনে আছে ফ্রান্সিসের। তিনি বলছিলেন, এই দেশটিতে মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি করায় তাতে এগিয়ে দিয়েছে বলিউডের চলচ্চিত্র, “ইরানের অতি সুন্দর কান্ট্রিসাইডের দৃশ্য আমার সাইকেল চালানোর কষ্ট কমিয়ে দিয়েছিলো। আমি অবশ্যই আবার ওখানে ফিরে যাবো। ইরানের লোকেরা আমাকে দিয়ে প্রতিশ্রুতি করিয়েছেন যে, বিশ্বকাপে গিয়ে আমি যেন ইরানের হয়ে চিৎকার করি। তারা বলিউডের সিনেমা পছন্দ করে। ফলে লোকেদের সাথে প্রথম আলাপের বরফটা ভাঙতে এই জিনিসটা আমাকে বেশ সহায়তা করেছে। এটা সত্যি যে, ফুটবল আর চলচ্চিত্র দুনিয়াকে এক করে দেয়।”

বরফ ঢাকা পথে; সোর্স: ক্লিফিন ফ্রান্সিস

সাইক্লিংয়ে চেহারা বদল

ফ্রান্সিসের পরের গন্তব্য ছিলো আজারবাইজান। এখানে বর্ডারে তিনি পড়লেন এক বিপদে। বর্ডার পুলিশ কিছুতেই তাকে পাসপোর্টের লোকটি বলে মানতে চাচ্ছিলো না। কারণ এই দীর্ঘ সময় সাইক্লিং করে অনেক ওজন কমিয়ে ফেলেছিলেন ফ্রান্সিস।

এই ঘটনা মনে করে তিনি বলছিলেন, “আমাকে আমার পাসপোর্টের ছবির মতো দেখা যাচ্ছিলো না। পুলিশ প্রায় ৮ ঘন্টা সময় নিলো আমার সবকিছু পরীক্ষা করে দেখার জন্য। অবশ্য তারা খুব ভালো ব্যবহার করেছে।”

আজারবাইজানেও হোটেলে থাকার মতো টাকা ফ্রান্সিসের হাতে ছিলো না। সেখানে ইরানের মতো ভাগ্যও প্রসন্ন হয়নি। ফলে তাকে কোনো পার্ক বা জীর্ন জায়গা দেখে তাবু টানিয়ে থাকতে হয়েছে এখানে। ফ্রান্সিস বলছিলেন, “এখানেও লোকজন চমৎকার। কিন্তু বাইরের লোকের সামনে উন্মুক্ত হতে একটু সময় নেয় তারা। দেশটির রাজধানী বাকুতে আমি কিছু ভারতীয় পরিবার খুঁজে পেয়েছিলাম। তাদের সাথে দু-এক রাত কাটিয়েছি।”

পথ, কেবলই পথ; সোর্স: ক্লিফিন ফ্রান্সিস

নো-ম্যানস ল্যান্ডে ফ্রান্সিস

জর্জিয়ার সীমান্তে যখন ফ্রান্সিস পৌঁছালেন, তখন তিনি তার লক্ষ্যের প্রায় অর্ধেক পার করে ফেলেছেন। কিন্তু এখানেই ঘটলো সবচেয়ে বড় বিপদ। জর্জিয়ার সীমান্ত পুলিশ তাকে ফিরিয়ে দিলো এবং তাকে পরিকল্পনা আবার বদলাতে হলো।

সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে ফ্রান্সিস বলছিলেন, “আমার কাছে সব কাগজপত্র ছিলো। তারপরও আমি জানি না, কেন আমাকে ঢুকতে দিতে তারা আপত্তি করলেন। এটা আমাকে খুব অনিশ্চিত একটা পরিস্থিতিতে ঠেলে দিলো। কারণ, আমার হাতে আজারবাইজানের কেবল সিঙ্গেল এন্ট্রি ভিসাই ছিলো।”

ফ্রান্সিস তখন আক্ষরিক অর্থে একদিন ধরে জর্জিয়া ও আজারবাইজানের মাঝে নো-ম্যানস ল্যান্ডে আটকে রইলেন। শেষ অবধি আজারবাইজান কর্তৃপক্ষ তাকে সহানুভূতি দেখালো। তারা দ্রুত একটি পুনঃপ্রবেশের ভিসা জোগাড় করে দিলো ফ্রান্সিসকে।

ফ্রান্সিস বলছিলেন, “আমাকে তখন রাশিয়া ঢোকার অন্য কোনো একটা পথ খুঁজে বের করতে হলো। একজন আমাকে বললেন, আজারবাইজানের সাথে রাশিয়ার একটা স্থলসীমানা আছে। সেটা রাশিয়ার ডাগেস্টন অঞ্চলের দিকে। আমি এটা জানতাম না যে, ওই অঞ্চলটা নিরাপদ না। না জেনেই আমি ওদিকে চললাম। আসলে এছাড়া আমার ফিরে যাওয়ার কোনো উপায় ছিলো না। আমি ৫ জুন ডাগেস্টন দিয়ে রাশিয়ায় প্রবেশ করলাম।”

ফ্রান্সিস বলছিলেন, ডাগেস্টনে একটা বড় সমস্যা হলো ভাষা। ওখানে লোকজন ইংরেজী খুব একটা বলে না, “লোকজন খুব অবাক হলো, যখন তারা দেখলো একজন ভারতীয় একটা সাইকেলে চেপে তাদের এলাকায় চলে এসেছে। আবারও আমি ফুটবল আর ফিল্মের আন্তর্জাতিক ভাষা ব্যবহার করা শুরু করলাম। লোকজন আমার সাথে খোলাখুলিভাবে মিশতে শুরু করলো।”

পথে সঙ্গীও পেয়েছেন; সোর্স: ক্লিফিন ফ্রান্সিস

মিস্টার ফ্রান্সিস মস্কো থেকে মাত্র ৪৬০ কিলোমিটার দূরে আছেন। তার সর্বশেষ চ্যালেঞ্জ ছিলো ২৬ জুনের আগে মস্কোতে পৌঁছানো। কারণ ঐদিন হয়ে যাওয়া ফ্রান্স-ডেনমার্কের ম্যাচটা তাকে দেখতে হবে। ফ্রান্সিস বলছিলেন, “পুরো বিশ্বকাপে আমি ওই একটা ম্যাচেরই টিকিট জোগাড় করতে পেরেছি। তবে আমি সাপোর্ট করি আর্জেন্টিনাকে। লিওনেল মেসি আমার ফেবারিট; আমি তার পূজা করি। আমার স্বপ্ন হলো তাকে একটাবার দেখা এবং আমার সাইকেলে তার সই নেওয়া।”

ফ্রান্সিরের এই স্বপ্নটা ছোট একটা স্বপ্ন। কিন্তু তার বুকের মধ্যে আরও বড় কিছু স্বপ্ন আছে। তিনি বলছিলেন, “আমি চাই, ভারত একদিন বিশ্বকাপ খেলুক। আর সেটা তখনই হবে, যখন দেশের শিশুরা অনেকে বেশি ফুটবল খেলতে চাইবে। আমি আশাবাদী ২০ বছরের মধ্যে আমাদের একটা সুযোগ আসবে। আমি এটাও আশা করি যে, লোকেরা আমার এই গল্প জানার পর সাইক্লিং শুরু করবে।”

সাইক্লিংয়ের মাহাত্ম্য বলতে গিয়ে ফ্রান্সিস বলছিলেন, “সাইক্লিং আপনাকে মানবজাতির আদিমতম প্রয়োজনগুলোর কাছে নিয়ে যাবে। দিনশেষে আপনার গোসল করতে ইচ্ছে হবে, একটা ভালো তাবুতে থাকবেন এবং কিছু খাবার খাবেন। তাতেই নিজেকে সুখী মনে হবে। আমার এই ভ্রমণ যদি ভারতে একটা শিশুকেও ফুটবলের প্রতি আগ্রহী করে তোলে তাহলেই আমি খুশি।”

লেখাটি বিবিসি ডট কম থেকে অনুদিত

Related Articles