Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মোহাম্মদ সালাউদ্দিন: যে ‘গুরু’র পরশে তারকা হয় ক্রিকেটাররা

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) ২০১৬ আসরের কথা। কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে প্রথমে ম্যাচই পাচ্ছিলেন না সাকিব আল হাসান। যা পাচ্ছিলেন, ব্যাট হাতে একরকম সাদামাটা বনে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের এই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। এমন সময় হুট করে ঝটিকা সফরে ঢাকায় এলেন। তারপর আবার চলে গেলেন। পরের ম্যাচে সুযোগ পেয়েই ৪৯ বলে ৬৬ রানের ঝড় তোলা ইনিংস খেললেন এই বাঁহাতি ক্রিকেটার।

রহস্য খুঁজতে উন্মুখ স্থানীয় গণমাধ্যম। পরে জানা গেল, সাকিব এসেছিলেন তার ‘গুরু’ কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের কাছে। এসেছিলেন ব্যর্থতার প্রতিষেধক নিতে। সালাউদ্দিনও সাকিবকে একান্ত সময় দিলেন, ছাত্রকে মানসিক ও ব্যাটিংয়ের কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা হাতে করে ধরিয়ে দিলেন। ব্যস, মিলিয়ে গেল শঙ্কার মেঘ। সাকিব ফিরলেন  স্বরূপে। এই সাকিবের উঠে আসা সালাউদ্দিনের হাত ধরেই। যদিও সালাউদ্দিন নিজে তা অস্বীকার করেন।

শুধু সাকিবই নন। মুমিনুল হক, তামিম ইকবাল, নাসির হোসেন; সবাইকে শিখিয়েছেন সালাউদ্দিন। কোচ হিসেবে তার সুনাম দেশজুড়ে। কাজ করেছেন  বাংলাদেশ জাতীয় দলের সহকারী কোচ হিসেবে, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকে এনে দিয়েছেন শিরোপার স্বাদ। তার হাতে ঘরোয়া ক্রিকেটের শিরোপা জিতেছে একাধিক ক্লাব। সেই সালাউদ্দিন সম্পর্কে ক’জন জানে? তার উঠে আসার গল্পটাও যে বেশ রোমাঞ্চকর!

১.

ছোটবেলা থেকে খুব ইচ্ছে ছিল ফুটবলার হবেন। তাই বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) গেলেন ভর্তি হতে। তখন ক্রিকেটের চেয়েও ফুটবলের ‘ক্রেজ’ এ দেশে অনেক বেশি। পরীক্ষা দিলেন, সব ঠিকঠাক। ভর্তি হওয়ার সুযোগও পেলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ফুটবলে জায়গা হল না। পেলেন ক্রিকেট!

খুব মন খারাপ হয়েছিলে সালাউদ্দিনের। চেয়েছিলেন ছেড়ে দেবেন। আবার পরে ভাবলেন, ক্রিকেটেই ভর্তি হওয়া যাক। পরে ফুটবলে চলে গেলেই হবে। সেই যাওয়াটা হয়নি। ক্রিকেটেই ক্যারিয়ার গড়েছেন। সেটাও যতটা না ক্রিকেটার হিসেবে, তার চেয়েও বেশি ক্রিকেট কোচ হিসেবে। মজার ব্যাপার হলো, বিকেএসপি শেষ করে যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শুরু করলেন, তখন থেকেই বিকেএসপিতে নতুন রূপে পদচারণা শুরু হল তার। খণ্ডকালীন চাকরিতে কোচিং করানো শুরু করেন।

সেই গল্প বলতে গিয়ে অনেকটা পিছনে চলে গেলেন সালাউদ্দিন। বললেন,

“তখন তো ফুটবলের অনেক হাইপ। খুব উন্মাদনা। সে কারণেই ফুটবলের দিকে ঝোঁক ছিল। কিন্তু বিকেএসপিতে ফুটবল পেলাম না। ক্রিকেটে পরীক্ষা দিলাম, হয়ে গেল। তারপর ক্রিকেট খেলা। ঘরোয়াতে  প্রিমিয়ার ডিভিশন খেলেছি। বিশ্ববিদ্যলয়ে অনার্সে থাকা অবস্থাতেই বিকেএসপিতে পার্ট-টাইম কোচিং করাতাম। কোচিংয়ের শুরুটা এভাবেই আসলে।”

ফুটবলে যখন হলো না, সত্যি বলতে ক্রিকেটার হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিলেন সালাউদ্দিন। প্রিমিয়ার লিগের এক ম্যাচে ইনজুরি কেড়ে নিল সবকিছু। তাই কোচিংয়েই ডাল-ভাতের উপায় খুঁজলেন। বোধ হয় তখনও জানতেন না, এই কোচিংই তাকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে আসবে। যতটা হয়তো ক্রিকেটার হয়েও পারতেন না।

ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের কোচ হিসেবে কর্মরত সালাউদ্দিন; Source: Walton

বিকেএসপিতে চাকরি চলছিল। এর মধ্যেই এলো পেশাদার ক্লাবের কোচিং করানোর প্রস্তাব। বয়স কম হলেও সেটাকে লুফে নিতে পিছপা হননি। দায়িত্ব নিলেন ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের। এই দায়িত্ব পাওয়াটাও বেশ নাটকীয়।

সে কথা নিয়ে সালাউদ্দিন বলেন,

‘প্রথম পেশাদার কোচিং শুরু করি ২০০২ সালে। ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। সেবার মূল কোচ মারা গেলেন। তখন বন্ধু শিপন (বর্তমানে নির্বাচক) আমাকে কোচিং করানোর জন্য বললেন। রাজি হয়ে গেলাম।’

রাজি তো হলেনই, সঙ্গে তাক লাগালেন। ওই ২০০১-০২ মৌসুমে তার হাতে চ্যাম্পিয়ন হল ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব। পরের মৌসুমেও চ্যাম্পিয়ন। এই মুহূর্তে কাজ করছেন গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের হয়ে। চলতি মৌসুমে অনেকটা ঠেলেঠুলে সুপার লিগে জায়গা পেয়েছে তার দল। কিন্তু এই দলকেই সর্বশেষ আসরে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন তিনি।  কাজ করছেন কাজী গ্রুপের ক্রিকেট অ্যাকাডেমির হয়েও।

২.

১৯৯৯ সালে বিকেএসপিতে তার চাকরি স্থায়ী হয়, যেখানে ১৯৮৬ সালে ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। এখনও কাজ করছেন সেখানে। আঙুলের কড়া গুনে সেই সময় পা দিল ১৯ বছরে। এর মধ্যেই কোচ হিসেবে সেরা প্রস্তাবটা আসে ২০০৫ সালে। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান তিনি। মোট ৪ বছর অর্থাৎ, ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) হয়ে মাশরাফি বিন মুর্তজা, হাবিবুল বাশার সুমনদের শিখিয়েছেন সালাউদ্দিন। কাজ করেছেন দুই কোচ ডেভ হোয়াটমোর ও জেমি সিডন্সের সঙ্গে। সহকারী কোচের সঙ্গে এক বছর অতিরিক্ত ফিল্ডিং কোচ হিসেবেও কাজ করা হয়েছে তার।

মুমিনুলের ফিরে আসা; Source: AP

বিসিবির সঙ্গে চুক্তি শেষে চলে যান মালয়েশিয়ায়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচ হিসেবে কাজ করেছেন ৫ বছর। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাড়তে চায়নি সালাউদ্দিনকে। কিন্তু দেশে এসে কাজ করার ইচ্ছায় একরকম জোর করেই চলে আসতে হয়েছে তাকে। এসে আবারও বিকেএসপিতে ও ঘরোয়া লিগে ক্লাবের কোচিং করানো শুরু করলেন।

২০১৫ সালে দায়িত্ব নিলেন বিপিএলে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের। প্রথমবারেই জেতালেন শিরোপা। তারও আগে ২০১৩ সালে বিপিএলে সিলেট রয়্যালসের কোচ ছিলেন তিনি। ২০১৫ সালের পর আবারও জাতীয় দলে  কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন সালাউদ্দিন। কিন্তু যে বিসিবি তাকে প্রস্তাব দিয়েছিল, তারাই ডেকে নিয়ে ‘না’ করে দেয়। গেল বছর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের জন্য ব্যাটিং পরামর্শক হিসেবে কাজ করার জন্য ডেকে আনা হয় তাকে। কিন্তু ঈদের ছুটির মধ্যেই তাকে ডেকে এনে ‘না’ করে দেওয়া হয়।

যদিও বিসিবি শুরু থেকেই জাতীয় দলে স্থানীয় কোচদের সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারে খানিকটা নাক সিটকানো ভাব দেখিয়ে আসছে। সালাউদ্দিনের মতে, স্থানীয় কোচরা বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ হওয়ার যোগ্য কিনা সেটা বুঝতে হবে।

তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের কোচরা এখনও সেভাবে নিজেদের উন্নতি করতে পারেনি বলেই বিসিবি এখনও এ ব্যাপারে অনাগ্রহী। ফলাফল, বিদেশি কোচে ভরসা খুঁজতে হচ্ছে।

এর প্রমাণ হিসেবে বিপিএলকে উদাহরণ হিসেবে টানলেন সালাউদ্দিন। সর্বশেষ আসরে চারটি ফ্র্যাঞ্চাইজি স্থানীয় কোচদের উপর ভরসা রেখেছিল। কিন্তু সে অনুযায়ী ফলাফল দিতে পারেনি বাংলাদেশি কোচরা।

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের কোচ সালাউদ্দিন; Source: Comilla Victorians

দেশের সফলতম কোচদের একজন মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে শুরু করে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টুর্নামেন্টগুলোতে নিজের নাম উপরের দিকেই লিখিয়েছেন। জাতীয় দলের কোচিং স্টাফ হিসেবেও কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। সেই সালাউদ্দিন জাতীয় দলের কোচ হিসেবে নিজেকে সামর্থ্যবান মনে করেন না। চলমান ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন,

‘আমার মনে হয় জাতীয় দলের কোচ হওয়ার মতো অতো সামর্থ্য আর গুনাবলী আমার নেই। ওই জায়গায় যেতে হলে আমাকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হবে, শিখতে হবে, জানতে হবে, বাড়াতে হবে দক্ষতা। নিজের উন্নতির জন্য করতে হবে অনেক কিছু।’

৩.

আজকের বিশ্বসেরা সাকিবকে নিজে হাতে গড়েছেন সালাউদ্দিন। বিকেএসপিতে ছোট্ট সাকিবকে দেখেই জহুরির চোখ দিয়ে বুঝে নিয়েছিলেন যা বোঝার। তারপর থেকেই আলাদা করে নজর দিয়েছেন সাকিবের দিকে।

যদিও সালাউদ্দিন সাকিবের মহা তারকা হওয়ার পিছনে নিজের অবদানকে সেভাবে দেখতে চান না। সাকিবের উত্থানের কৃতিত্বটা সাকিবকেই দিতে চান ‘গুরু’ সালাউদ্দিন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন,

‘সাকিবকে আমি গড়েছি এ কথাটা ভুল। এটা ঠিক নয়। সাকিব নিজেই অনেক কিছু। ওকে আমি প্রথম দেখি ১৫-১৬ বছরে। বিকেএসপিতে। তখন রাবিদ ইমাম (বিসিবির বর্তমান  মিডিয়া ম্যানেজার) আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল আগামী পাঁচ বছরে বিশ্ব ক্রিকেট শাসন করবে এমন কেউ আছে কিনা বাংলাদেশের। তখন আশরাফুল ছিল তারকা। ওর নাম বলেছিলাম আর সাকিবকে দেখিয়েছিলাম। আমি জানতাম ও পারবে।’

শুধু সাকিব নয়, মুমিনুল, তামিম, নাসির, এমনকি যারা বিকেএসপির বাইরের ক্রিকেটার তারাও কোনো না কোনোভাবে সালাউদ্দিনের কাছে গিয়েছেন। তার পরামর্শ নিয়েছেন, কাজে লাগিয়ে সফল হয়েছেন।

এই তো শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্টের আগের কথা। চান্দিকা হাতুরুসিংহে যুগে অবহেলিত ছিলেন দেশের অন্যতম সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান মুমিনুল হক। হাতুরুসিংহে পদত্যাগ করলেন, তারপরও মুমিনুল যেন নিজের ব্যাটিংয়ে কিছুটা সমস্যা খুঁজে পাচ্ছিলেন। তারপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টের আগে নিজের ছেলেবেলার কোচ সালাউদ্দিনের কাছ থেকে সফলতার টোটকা নিয়ে ফিরলেন। সাগরিকায় ওই ম্যাচেই দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করে রেকর্ড গড়ে ফেললেন! নিজের ছাত্রদের শিক্ষকের চেয়ে কে-ই বা বেশি চেনে! সেই প্রমাণটা যেন সালাউদ্দিন বারবার দিয়ে গেছেন।

২০১৩ বিপিএলে সিলেট রয়্যালসের কোচ ছিলেন সালাউদ্দিন; Source: BCB

শুধু ক্রিকেটার গড়ার কাজই নয়, ক্রিকেটারদের অধিকার নিয়েও সোচ্চার তিনি। ঘরোয়া লিগে প্লেয়ার বাই চয়েজের কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছে ক্রিকেটাররা। সালাউদ্দিন এই ব্যবস্থার তুমুল সমালোচনা করে আসছেন শুরু থেকে। এবারও তিনি বলেছিলেন,

‘আমি মনে করি এটা কোনো সিস্টেমের মধ্যেই পড়ে না। গেলবারও পাপন ভাই (বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন) বললেন, এই ব্যাপারটা উঠিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু তারপরও থেকে গেল। আমার কাছে মনে হয় এভাবে ক্রিকেটারদের ক্ষতি হচ্ছে। কারণ একজন ক্রিকেটার হয়তো আগের মৌসুমে তার পছন্দের পজিশনে ব্যাটিং পায়নি, হতে পারে তার অফিসিয়াল, কোচ পছন্দ হয়নি। সে দলবদল করবেই। প্লেয়ার বাই চয়েজের মাধ্যমে যে শুধু তাদেরকে টাকার দিক থেকেই ক্ষতি করে দেওয়া হলো তা-ই নয়, তাদের পারফরম্যান্স ও স্বাধীনতাতেও হস্তক্ষেপ করা হল। এটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য অনেক বড় ক্ষতি।’

কারিগর বোধ হয় এমনই হন। শুধু গড়েন না, রক্ষা করার পক্ষেও কাজ করেন। সালাউদ্দিন ক্রিকেটার গড়ার কারিগর। মহা তারকা গড়ার কারিগর।

 

ফিচার ইমেজ- Prothom Alo

Related Articles