Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বর্ণান্ধদের বিশ্বকাপ দর্শন

পৃথিবীতে লাখ লাখ মানুষ বর্ণান্ধ। তারা অনেক রং আলাদা করে বুঝতে পারেন না। এই মানুষগুলো কী করে রঙ্গীন ফুটবল দুনিয়াকে দেখেন? তাদের কাছে বিশ্বকাপটা কেমন?

শিন হারগ্রেভ একজন আত্মস্বীকৃত ফুটবল পাগল। কিন্তু তিনি যখন ২০১৮ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ দেখতে বসলেন, বলতে পারছিলেন না যে, কোনটা কোন দল!

রাশিয়া-সৌদি আরব খেলাটা এমন দেখেছেন বর্ণান্ধরা; Image Source: REUTERS 

তিনি একাই এই সমস্যায় পড়েছিলেন, তা নয়। নিজের ড্রয়িং রুম থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া অবধি এই হতাশার চিৎকার উঠলো-রাশিয়া বনাম সৌদি আরব ম্যাচটা দেখা যাচ্ছে না!

কারণ কী?

কারণ, শিন একজন বর্ণান্ধ। তিনি মূলত লাল আর সবুজের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারেন না। বর্ণান্ধদের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত সমস্যা। ফলে একটি দল যখন রাশিয়ার মতো লাল পোশাক পরে এবং আরেকটি দল যখন সৌদি আরবের মতো সবুজ পোশাক পরে, তখন এই বর্ণান্ধ মানুষগুলোর খেলা দেখা সেখানেই শেষ হয়ে যায়। শিন বলছিলেন,

এটা অনেকটা ম্যাডোনা মঞ্চে উঠে বললেন, আমি আজ সোহায়িলি ভাষায় একটা গান করবো, এরকম একটি ব্যাপার।

বর্ণান্ধতা নানা ধরনের ও নানা মাত্রার হতে পারে। তবে যাদের সবুজ ও লাল নিয়ে বেশি সমস্যা আছে, তারা রাশিয়া ও সৌদি আরব ম্যাচটা এরকম দেখতে পেয়েছেন:

লাল-সবুজ বর্ণান্ধদের দেখা দৃশ্য; Image Source: AFP

সারা পৃথিবীতে ৩২০ মিলিয়নের বিশাল সংখ্যায় মানুষ বর্ণান্ধ। পরিসংখ্যানের হিসেবে প্রতিটি পুরুষ ফুটবল দলে একজন বর্ণান্ধ থাকার কথা। আর পৃথিবীতে যত মানুষ ফুটবল বিশ্বকাপ দেখবে বলে মনে করা হয়েছিলো, তার অর্ধেকই বর্ণান্ধ হওয়ার কথা। এদের অনেকেই ফিফার ওপর খুব ক্ষুব্ধ। কারণ, ফিফা এই মানুষগুলোর দেখা বা না দেখার হিসাব বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ হয়েছে।

বর্ণান্ধ ব্যক্তিদের বড় সমস্যা অবশ্যই দুই দলকে আলাদা করতে না পারা। বিশেষ করে ফুটবলের মতো দ্রুতগতির খেলায় এটা দারুণ একটি সমস্যা। হতে পারে দুই দলের মূল পোশাক একইরকম মনে হচ্ছে। অথবা রেফারি বা গোলরক্ষকের পোশাক আলাদা করতে পারছেন না কেউ; ফলে তাদেরও খেলোয়াড় মনে হচ্ছে। এই বিশ্বকাপে দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানি ম্যাচেও সবুজ-লাল সমস্যা হয়েছিলো। চিরায়ত সবুজ-লাল সমস্যার বাইরে কিছু বর্ণান্ধ মানুষ এসব সমস্যায়ও ভোগেন

·      লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ ও বাদামী

·      লাল ও কালো

·      নীল, গোলাপি ও গাঢ় গোলাপি

সেনেগাল ও কলম্বিয়া ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো সবুজ ও হলুদ পোশাকে। এটা আবার কিছু সমর্থকের জন্য ঝামেলার ছিলো। একইরকম ইংল্যান্ড বনাম সুইডেন ম্যাচে ইংল্যান্ডের সবুজ পোশাক পরা গোলরক্ষক পিকফোর্ডকে সুইডেনের খেলোয়াড়দের থেকে আলাদা করা যাচ্ছিলো না। ম্যাচ পেনাল্টিতে গড়ালেও সমস্যা। সেখানে টিভির নিচে সবুজ আর লাল বৃত্তে মিস ও সঠিক শটের হিসাব দেখানো হয়; সেটাও বোঝা কঠিন হয় বর্ণান্ধ মানুষদের জন্য।

২৭ বছর বয়সী ক্যাটি মোরান একজন বর্ণান্ধ। তিনি অ্যাস্টন ভিলা মেয়েদের দলে খেলেন। তিনি বলছিলেন, তাকে কখনো কখনো খেলোয়াড়দের মোজার দিকে তাকিয়ে বুঝতে হয়, কে কোন দলের খেলোয়াড়। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন মোরান,

গত মৌসুমে আমাদের মিলওয়ালের সাথে খেলা ছিলো। ভিলা গাঢ় লাল রংয়ের পোশাক পরেছিলো। আর মিলওয়াল সম্ভবব গাঢ় নীল পরেছিলো। দুই দল মাঠে ঢোকার পর আমার মনে হলো, ভালো হয়েছে যে, আমি এই ম্যাচে খেলছি না। আর দুই দলই সাদা মোজা পরেছিলো।

তিনি বলছিলেন, এটা তার খেলাকেই শেষ করে দেয়,

এতে মাঠে অনেকটা সময় চলে যায় কে কোনটা এটা বের করতে। আমি যদি সেই ম্যাচ খেলতাম, আমার প্রতিক্রিয়া হতো খুব ধীরগতির। কারণ, আমি ঠিক করতে পারতাম না, কে আমার দলের খেলোয়াড় এবং কাকে আমার বল দিতে হবে।

ক্যাটি মোরান; Image Souce: ASTON VILLA FOOTBALL CLUB

ক্যাটি মোরান বলেছেন, তার এই বর্ণান্ধতার কারণে গড়ে প্রতি ৫টি ম্যাচের মধ্যে ১টি ম্যাচ টিভিতে দেখতে সমস্যা হয়। ডেনমার্ক দল রাশিয়া বিশ্বকাপে রওনা হওয়ার ৮ মিনিট আগে মিডফিল্ডার টমাস ডেলানি একটা ডেনিশ রেডিও স্টেশনে ফোন করেছিলেন। তিনি একজন বর্ণান্ধ ফোনকারীকে সমর্থন জানাতে চেয়েছিলেন। যিনি বলেছিলেন, তার বিশ্বকাপের আগে ডেনমার্ক ও মেক্সিকো ফ্রেন্ডলি ম্যাচ দেখতে সমস্যা হয়েছে।

নিজের কেবল টমাস নামটা উল্লেখ করে তিনি রেডিওতে বলেছিলেন,

আমি লাল-সবুজ (বর্ণান্ধ)। আমি বলবো না, এটা খুব খারাপ কিছু। কারণ এমনটা হয়ে থাকে। হ্যাঁ, সেদিন মাঠে আমারও খুব কঠিন সময় কেটেছে। কারণ আমিও বুঝতে পারছিলাম না কে আমার দলের আর কে অন্য দলের।

উপস্থাপক প্রশ্ন করেছিলেন,

আপনি লাল দলে ছিলেন, নাকি সবুজ দলে?

তিনি বলেছিলেন,

আমি লাল দলের।

আপনি কোন দলের হয়ে খেলেন, টমাস?

দ্য ডেনিশ ন্যাশনাল টিম।

ডেলানির এই নির্দোষ স্বীকারোক্তির ফলে ডেনমার্ক ও অস্ট্রেলিয়া গ্রুপ ‘সি’-এর ম্যাচে দুই দলই অ্যাওয়ে কিট পরে মাঠে নেমেছিলো। ‘টোট্যালি ফুটবল শো পডকাস্ট’-এর ভাষ্যমতে, অস্ট্রেলিয়ার গাঢ় সবুজ তাদের প্রচলিত হলুদের চেয়ে আলাদা করা সহজ হয়।

টমাস ডেলানি; Image Source: Rueters

বর্ণান্ধদের জন্য কাজ করা সংস্থা ‘কালার ব্লাইন্ড অ্যাওয়ারনেস’-এর প্রতিষ্ঠাতা ক্যাথরিন অ্যালবেনি-ওয়ার্ড বলছিলেন, টমাস ডেলানির এই স্বীকৃতি একটি নতুন যুগের শুরু,

তিনিই প্রথম খেলোয়াড় যিনি সেরা একজন খেলোয়াড় হয়েও নিজের বর্ণান্ধতা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বললেন। আমার মনে হয় না, তিনি বুঝতে পারছেন যে, তিনি কত বড় একটি কাজ করেছেন।

বেশিরভাগ মানুষ এ নিয়ে কথা বলতে চায় না। কারণ তারা ভয় পান যে, বর্ণান্ধতার কথা জানলে তাদের মান সম্মান চলে যাবে। তারা ভয় পান যে, তাদের কী আর আদৌ খেলতে দেওয়া হবে, নাকি বেঞ্চে বসিয়ে দেওয়া হবে। এমনটা হওয়া উচিত নয়। কিন্তু তারা এই ভয়টাই পান।

সোশ্যাল মিডিয়া আজকাল বর্ণান্ধতার কথা বলার একটা জায়গা তৈরি করে দিয়েছে। পরস্পরের সাথে তারা অভিজ্ঞতাটা ভাগাভাগি করে নিতে পারছেন। কালার ব্লাইন্ড অ্যাওয়ারনেস সংস্থা গত নয় মাস ধরে ইউরোপের বিভিন্ন স্টেডিয়াম, যেখানে ২০২০ উয়েফা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হবে, সেগুলোতে কাজ করছে। তারা প্রবেশ-বাহির সংকেত, নিরাপত্তা সংকেত; এগুলো যাতে সব বর্ণান্ধ মানুষ সমানভাবে দেখতে পান, তা নিয়ে কাজ করছে।

গত বছর তারা ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এফএ)-এর সাথেও কাজ করেছে। উয়েফার সাথে তারা কাজ করেছে এবং কিছু সুপারিশও তৈরি করেছে যে, কিভাবে বর্ণান্ধদের জন্য খেলা দেখার অভিজ্ঞতা আরও সহজ করে তোলা যায়। কিছু ব্রিটিশ প্রিমিয়ার লিগ ক্লাব আগের চেয়ে এ ব্যাপারে অনেক সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে। টটেনহ্যাম তাদের ওয়েবসাইট ও মৌসুমী টিকিট এমনভাবে ডিজাইন করেছে যে, বর্ণান্ধদের কাছে এটা কম জটিল মনে হবে।

এসব উন্নতি দেখে কি ২০২২ সালে বর্ণান্ধদের জন্য অনুকূল একটি বিশ্বকাপ আশা করা যায়?

অ্যালবানি-ওয়ার্ড বলছিলেন,

আমি জানি, ফিফা এখন বেশ সচেতন। অবশ্য এটা জানি না, তাদের সেই সচেতনতাটা কত দূর। তবে তাদের উয়েফার সুপারিশ অনুযায়ী সচেতনতাটা দেখানো উচিত।

তারা অন্যান্য দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ করছে। তারা অন্ধ ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ ধারাভাষ্য চালাচ্ছে। শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ করছে। ফলে বর্ণান্ধরা তাদের তালিকায় থাকা উচিত।

স্টেডিয়ামে যে পরিমাণে দর্শক থাকেন, তার চেয়ে অনেক বেশি বর্ণান্ধ দর্শক রয়েছেন। বিশ্ব জুড়ে লাখ লাখ মানুষ এই সমস্যায় ভুগছেন। তারা চাইলে এই মানুষগুলোর ভেতর যে নেতিবাচক আক্ষেপ আছে ফুটবল নিয়ে, সেটা বদলে দিতে পারেন।

মূল প্রতিবেদনটি বিবিসি ডট কমে প্রকাশিত।

Related Articles