শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড় এবং ভিভিএস লক্ষণ। গত শতকের নব্বইয়ের দশক এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপের স্তম্ভ ছিলেন তারা। ভারতের ক্রিকেটবিশ্বে রাজত্ব করার দিনগুলো শুরু হয় তাদের হাত ধরেই। এই তিন ব্যাটসম্যান কয়েক বছরের ব্যবধানে ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন। রাহুল দ্রাবিড় এবং ভিভিএস লক্ষণ ২০১২ সালে এবং শচীন টেন্ডুলকার ২০১৩ সালে টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন। তাদের বিদায়ের পর ভারতের ব্যাটিং লাইনআপে যে শূন্যতা দেখা দিয়েছিল, তার স্থায়িত্ব বেশিদিন ছিলো না। এই তিন কিংবদন্তি ব্যাটসম্যানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরও তিনজন প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান নিজেদের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নেন।
চেতেশ্বর পূজারা এসে রাহুল দ্রাবিড়ের জায়গায় নিজের মতো করে দ্রাবিড়ের দায়িত্বগুলো পালন করেন। টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুতে বিরাট কোহলি কিছুটা বিবর্ণ থাকলেও সময়ের সাথে সাথে নিজেকে লাল বলের সাথে মানিয়ে নেন। মিডল অর্ডারে তিনি এখন পর্যন্ত শচীন টেন্ডুলকারের অভাব বোধ করতে দেননি ভারতকে। আর অজিঙ্কা রাহানে যেন ভিভিএস লক্ষণের প্রতিচ্ছবি। নিয়মিত বড় ইনিংস খেলতে না পারলেও দলের প্রয়োজনে হয়ে ওঠেন লক্ষণের মতো ভেরি ভেরি স্পেশাল।
চেতেশ্বর পূজারা, বিরাট কোহলি এবং অজিঙ্কা রাহানে বর্তমানে তাদের ক্যারিয়ারে যে অবস্থানে আছেন, একই সময় রাহুল দ্রাবিড়, শচীন টেন্ডুলকার এবং ভিভিএস লক্ষণ কোন অবস্থানে ছিলেন, সেটা পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখে আসা যাক।
রাহুল দ্রাবিড় এবং চেতেশ্বর পূজারা
চেতেশ্বর পূজারার টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ২০১০ সালের ৯ অক্টোবর। তিনি তার অভিষেক টেস্ট খেলেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। এই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই সদ্য সমাপ্ত টেস্ট সিরিজে তিনটি শতক হাঁকিয়ে নিজের ক্যারিয়ারকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যান তিনি। রাহুল দ্রাবিড়ের ক্যারিয়ারেও এমন ঘটনা ঘটেছিলো। তার টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিলো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তার ক্যারিয়ারেরও নতুন করে রূপ বদলায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২০০২ সালের টেস্ট সিরিজে। তিনি ইংল্যান্ডের মাটিতে টানা তিনটি শতক হাঁকিয়েছিলেন। এই দুজনই ম্যাচগুলো খেলেছিলেন নিজেদের ক্যারিয়ারে ৬০-৭০ টেস্টের মধ্যকার সময়ে।
চেতেশ্বর পূজারা এখন পর্যন্ত ৬৮টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ৫১.১৮ ব্যাটিং গড়ে ৫,৪২৬ রান সংগ্রহ করেছেন। তিনি ২০টি অর্ধশতকের বিপরীতে ১৮টি শতক হাঁকিয়েছেন। রাহুল দ্রাবিড় তার ৬৮ ম্যাচ শেষে ৫,৫৬৬ রান করেছিলেন। রান সংখ্যার ব্যবধান খুব বেশি না হলেও দ্রাবিড়ের ব্যাটিং গড় ছিলো ৫৪.০৩। তবে শতকের দিক থেকে পূজারা এগিয়ে আছেন। রাহুল দ্রাবিড় ৬৮ ম্যাচ শেষে ১৪টি শতক এবং ২৮টি অর্ধশতক শতক হাঁকিয়েছিলেন।
ব্যাটিংয়ের ধরনের দিক দিয়ে দুজন প্রায় একই প্রকৃতির। রাহুল দ্রাবিড় যেমন অনেক সময় পর্যন্ত ক্রিজে টিকে থাকতেন, তেমনি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের যুগে এসেও ধীরগতিতে ব্যাটিং করতে ক্লান্ত হন না পূজারা। রাহুল দ্রাবিড় তার ৬৮তম টেস্ট ম্যাচ শেষে ১৩,৬২২ বল মোকাবেলা করেছিলেন। অন্যদিকে পূজারা খেলেছেন ১১,৬৮২ বল। ঘরের বাইরে রান তোলার দিক দিয়েও দ্রাবিড়ের চেয়ে বেশ পিছিয়ে আছেন পূজারা। ৬৮ ম্যাচ শেষে দ্রাবিড়ের অ্যাওয়ে সিরিজে ব্যাটিং গড় ছিলো ৫৮.৪৯। সেখানে পূজারার ব্যাটিং গড় ৪০.৯০। তবে সদ্যসমাপ্ত অস্ট্রেলিয়া সিরিজে দুর্দান্ত ব্যাটিং করে জানান দিয়ে রেখেছেন, তিনিও অ্যাওয়ে সিরিজে বড় ইনিংস খেলতে পারেন।
শচীন টেন্ডুলকার এবং বিরাট কোহলি
ক্যারিয়ারের শুরুতে বিরাট কোহলি সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দুর্দান্ত ব্যাটিং করলেও টেস্ট ক্রিকেটে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী ব্যাট করতে পারেননি। প্রতিনিয়ত তার ব্যাটিংয়ে দুর্বলতা ফুটে উঠতো। ভারতের টেস্ট অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার সম্পূর্ণ নতুন রুপে দেখা যায় বিরাটকে। এখন পর্যন্ত ভারতের হয়ে ৭৭টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন তিনি। ৭৭ ম্যাচে ৫৩.৭৬ ব্যাটিং গড়ে ৬,৬১৩ রান সংগ্রহ করেছেন তিনি। ২০টি অর্ধশতকের বিপরীতে শতক হাঁকিয়েছেন ২৫টি। এর মধ্যে অধিনায়ক হিসেবে খেলেছেন ৪৬ ম্যাচ। এই ৪৬ ম্যাচের মধ্যে ১৮টি শতক এবং ১০টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬২.৭০ ব্যাটিং গড়ে ৪,৫১৫ রান সংগ্রহ করেছেন।
টেস্ট ক্রিকেটে চার নাম্বার ব্যাটিং পজিশনে শচীন টেন্ডুলকারের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবেই আবির্ভাব ঘটেছে কোহলির। কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকার তার ৭৭তম ম্যাচ শেষে ৫৫.০৩ ব্যাটিং গড়ে ৬,০৫৪ রান সংগ্রহ করেছিলেন; শতক হাঁকিয়েছিলেন ২২টি এবং অর্ধশতক ২৪টি। তিনি যখন ২০১৩ সালে টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানান, ঠিক সেখান থেকেই যেন কোহলির পথচলা শুরু হয়।
দুজনেই অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সফল ছিলেন। বিরাট কোহলি তার ২৫টি টেস্ট শতকের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সাতটি, ইংল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পাঁচটি করে শতক হাঁকিয়েছেন। অন্যদিকে শচীনও তার প্রথম ৭৭টি টেস্ট ম্যাচের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পাঁচটি, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ছয়টি এবং ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চারটি শতক হাঁকিয়েছিলেন।
শচীন টেন্ডুলকার দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এবং নিউ জিল্যান্ডে দুর্দান্ত ব্যাটিং করতেন। দলের অন্যান্য ব্যাটসম্যানরা ব্যর্থ হলেও তিনি একপাশে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেন। বিরাট কোহলিও এই দেশগুলোতে দলের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। কয়েকবছর আগে ইংল্যান্ডের মাটিতে তার ব্যর্থতা নিয়ে অনেক কথা হয়েছিলো। কোহলির এখনও ইংল্যান্ডের মাটিতে নিজেকে প্রমাণ করা বাকি রয়েছে। এমনটিই বলতেন তাকে সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান না মানা সমালোচকরা। কোহলি গতবছর সেটিও করে দেখালেন। ইংল্যান্ডের মাটিতে দুটি শতক এবং ৯৭ রানের ইনিংস সহ তিনটি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন তিনি।
বিরাট কোহলি বর্তমানে যে ফর্মে রয়েছেন, এভাবে খেলতে পারলে তিনি একদিন হয়তো শচীনের সব কীর্তিই নিজের দখলে নিয়ে আসবেন। গত বছর যেভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ব্যাটিং করেছেন, এতে করে তার ব্যাটিংয়ের দুর্বল দিকগুলো প্রতিপক্ষের বোলাররা খুঁজতে সব প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েও ব্যর্থ হচ্ছে।
ভিভিএস লক্ষণ এবং অজিঙ্কা রাহানে
ভিভিএস লক্ষণ এবং অজিঙ্কা রাহানে দুজনেই চাপের মুখে নিজেদের সেরা ব্যাটিং করেন। লক্ষণের কলকাতা টেস্টে খেলা ২৮১ রানের ইনিংসটি এখনও ভারতের টেস্ট ক্রিকেটে অন্যতম সেরা ইনিংস। বিশ্ব ক্রিকেটেও চাপের মুখে এমন ইনিংস খেলার ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। ইতিমধ্যে বিদেশের মাটিতে দলের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে রাহানের নামডাক হয়ে গেছে।
রাহানের টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে ২০১৩ সালের ২২ মার্চ। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দিল্লিতে নিজের অভিষেক টেস্ট ম্যাচে দ্যুতি ছড়াতে না পারলেও নিজের প্রথম অ্যাওয়ে সিরিজে দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শন করে আলোচনায় আসেন। তিনি ঐ সিরিজে দলের বিপর্যয়ের মুখে ৪৭, অপরাজিত ৫১ এবং ৯৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। এরপর নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েলিংটনে ১১৮ রান এবং ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডসে ম্যাচজয়ী ১০৩ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। এছাড়া অ্যাওয়ে সিরিজে আরও বেশ কয়েকটি ইনিংসে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তিনি।
অজিঙ্কা রাহানে ভারতের মাটিতে প্রথম টেস্ট শতক হাঁকিয়েছিলেন ২০১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দিল্লি টেস্টে। ঐ টেস্টে তিনি শুধুমাত্র প্রথম শতক হাঁকিয়েই ক্ষান্ত হননি, একই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে শতক হাঁকিয়ে জোড়া শতক হাঁকান তিনি। ঐ সিরিজে ব্যাটসম্যানদের অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছিলো। সেখানে রাহানে দুই ইনিংসেই শতক হাঁকিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের শুরুতে জোহানসবার্গ টেস্টে ৪৮ রানের ইনিংসটি রানের দিক দিয়ে খুব বড় সংখ্যা না হলেও এর গুরুত্ব কম ছিলো না। রাহানে প্রতিনিয়তই দলের বিপর্যয়ের মুখে এমন সব দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন। তিনি এখন পর্যন্ত ৫৬টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। এর মধ্যে ৯টি শতক এবং ১৭টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪০.৫৫ ব্যাটিং গড়ে ৩,৪৮৮ রান সংগ্রহ করেছেন।
ভিভিএস লক্ষণ তার প্রথম ৫৬ টেস্টে ৭টি শতক এবং ১৯টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৪.৩৫ ব্যাটিং গড়ে ৩,৬৩৭ রান সংগ্রহ করেছিলেন। রাহানে এবং লক্ষণের মধ্যে আরেকটি কাকতালীয় মিল হলো, তারা দুজনেই তাদের প্রথম ৫৬ টেস্টে ছাব্বিশবার অর্ধশতাধিক রানের ইনিংস খেলেছেন এবং ছয়বার শূন্য রানে সাজঘরে ফিরে গিয়েছিলেন। রাহানে এখন পর্যন্ত অ্যাওয়ে টেস্টে ছয়টি শতক এবং ১৩টি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন। হোম এবং অ্যাওয়ে টেস্টে তার ব্যাটিং গড়ের মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে। হোম টেস্টে তার ব্যাটিং গড় যেখানে ৩৪.৫০, সেখানে অ্যাওয়ে টেস্টে তার ব্যাটিং গড় ৪৪.৩০।
ভিভিএস লক্ষণ তার সাতটি শতকের মধ্যে চারটি শতক হাঁকিয়েছিলেন অ্যাওয়ে টেস্টে। অবশ্য হোম এবং অ্যাওয়ে টেস্টে তার ব্যাটিং গড়ে খুব বড় পার্থক্য নেই। তবে তিনি হোম টেস্টে যেসব ম্যাচে রান তুলেছিলেন, ঐসব ম্যাচে দুই দলের ব্যাটসম্যানরাই খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। কলকাতা টেস্টে তার ২৮১ রানের অতিমানবীয় ইনিংসটি এখনও দর্শকদের হৃদয়ে গেঁথে আছে।
ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটে এর আগের যুগে কিংবদন্তি রাহুল দ্রাবিড়, শচীন টেন্ডুলকার এবং ভিভিএস লক্ষণ যেমন দলকে লড়াই করতে শিখিয়ে গেছেন, ক্যারিয়ার শেষে নিজেদেরকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, তেমনই বর্তমান যুগের বিরাট কোহলি, চেতেশ্বর পূজারা এবং অজিঙ্কা রাহানের মতো ব্যাটসম্যানরাও নিজেদের ক্যারিয়ার শেষে কিংবদন্তি তকমা নিজেদের নামের পাশে লাগিয়ে ক্রিকেটকে বিদায় জানাবেন এবং তারাও ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে উদাহরণ হিসেবে থেকে যাবেন।
This article is in Bangla language. It is about two periods of India's batting line up. Please click on the hyperlinks to look for references.
Featured Image : Getty Images