ক্রিকেটের ইতিহাস উল্টোতে গেলে অনেক বড় বড় সব মহারথীর নাম আসে, যাদের হাত ধরে খেলাটি আজ অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রতিটি পিতারই আকাঙ্ক্ষা থাকে, যেন তার সন্তান তার থেকেও ভালো কিছু করে। ক্রিকেটেও তেমনি পিতার অনুসারী পুত্রদের ক্রিকেটীয় অবদান নিয়েই আজকের লেখা।
লালা অমরনাথ ও মহিন্দর অমরনাথ
ক্রিকেট ইতিহাসে পিতা-পুত্রের খেলোয়াড়ি অবদানের কথা বলা হলে প্রথমেই চলে আসে অমরনাথ পরিবারের কথা। ১৯৩৩ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ভারতীয় হিসেবে অভিষেক টেস্টে শতরান করে অসামান্য কীর্তি করেন লালা অমরনাথ। স্বাধীন ভারতের পক্ষে প্রথম অধিনায়ক হিসেবে ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজ জয় করেন। বোলিংয়ের পাশাপাশি মাঝারি গতিতে বলও করতেন তিনি।
লালা অমরনাথের তিন ছেলে সুরিন্দর, মহিন্দর এবং রাজিন্দর ক্রিকেটের সাথে যুক্ত ছিলেন। তবে সুরিন্দর এবং মহিন্দর অমরনাথ ভারতের জাতীয় দলের হয়ে খেলেন। বাঁহাতি ব্যাটসম্যান সুরিন্দর ১৯৭৬ সালে বাবার মতোই অভিষেক টেস্টে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেন। অনেকটা কাকতালীয়ভাবে দুজনেই পরবর্তীতে আর কোনো টেস্ট সেঞ্চুরি পাননি। তবে ভারতীয় ক্রিকেটে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন তার আরেক পুত্র মহিন্দর অমরনাথ। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপের তার অসামান্য কীর্তির জন্য এখনো ভারতীয়দের কাছে সুপরিচিত নামটি। ব্যাট হাতে দক্ষ হলেও সেই বিশ্বকাপে বোলিংয়ে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছিলেন মহিন্দর অমরনাথ। সেমিফাইনাল এবং ফাইনালে অসামান্য বোলিংয়ের জন্যে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন।
সিনিয়র ও জুনিয়র পতৌদি
ভারতের গুরগাঁও জেলার শহর পতৌদির অষ্টম নবাব ছিলেন ইফতিখার আলি খান পতৌদি, পড়ালেখা করেছিলেন ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে। তিনিই একমাত্র ক্রিকেটার, যিনি ইংল্যান্ড এবং ভারত উভয় দলেই খেলেছিলেন। ১৯৩২ সালে ইংল্যান্ডের পক্ষে অভিষেক টেস্টে ১০২ রান করেছিলেন সিনিয়র পতৌদি। ১৯৪৬ সালে ভারতের ইংল্যান্ড সফরে ভারতের জাতীয় দলকে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন।
তবে তার পুত্র মনসুর আলী খান পতৌদি বা পতৌদি জুনিয়রের ক্রিকেটীয় জীবন আরো অনেক বেশি বর্ণাঢ্য ছিল। ডানহাতি ব্যাটসম্যান এবং মাঝারি গতির বোলার ছিলেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি ভারতের অধিনায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত মোট ৪৬টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন এই অসামান্য ক্রিকেটার। ১৯৬৯ সালে তখনকার জনপ্রিয় অভিনেত্রী শর্মিলী ঠাকুরকে বিয়ে করেন। পুত্র সাইফ আলী খান এবং কন্যা সোহা আলী খান ভারতীয় সিনেমা জগতের পরিচিত দু'টি নাম।
হানিফ মোহাম্মদ ও শোয়েব মোহাম্মদ
পাকিস্তানের সবচাইতে পরিচিত এবং বিখ্যাত ক্রিকেট পরিবার হলো ‘মোহাম্মদ পরিবার’। এই পরিবারের চার ভাই হানিফ, ওয়াজিব, মুশতাক ও সাদিক মোহাম্মদ পাকিস্তানের হয়ে অনেক টেস্ট ক্রিকেট খেলেন। তবে চার ভাইয়ের মধ্যে হানিফ মোহাম্মদের ক্রিকেটীয় অবদান ছিল উল্লেখ করার মতো।
১৭ বছরের দীর্ঘ ক্রিকেটীয় জীবনে তিনি প্রায় ৫৫টি টেস্ট ম্যাচ খেলেন, যার মধ্যে ১২টি শতক রয়েছে। ১৯৫৮ সালে ব্রিজটাউনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাটিং করার অনন্য কীর্তি স্থাপন করেন। প্রায় ৯৭০ মিনিট ধরে তিনি ব্যাটিং করেন, যা এখনো পর্যন্ত আর কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই ইনিংসে তিনি রান করেছিলেন ৩৩৭। হানিফ মোহাম্মদের ছেলে শোয়েব মোহাম্মদও টেস্ট ক্রিকেটে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। শোয়েব মোহাম্মদ ৪৫ টেস্ট খেলেন, যার মধ্যে ৭টি শতক ছিল।
পিটার পোলক ও শন পোলক
দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক প্রাচীন ক্রিকেটীয় ইতিহাস রয়েছে। পিটার পোলক এবং ছোট ভাই গ্রায়েম পোলক দক্ষিণ আফ্রিকার দু’জন প্রতিভাবান ক্রিকেটার ছিলেন। ১৯৬৫ সালে ট্রেন্টব্রিজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০ উইকেট শিকার করে এক অসাধারণ জয় ছিনিয়ে আনেন। পোলক ২৮ টেস্ট ম্যাচ খেলে ১১৬ উইকেট দখল করেন। কিন্তু ১৯৭০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার ঘোষণা করে, তারা শুধু শ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্র ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউ জিল্যান্ডের সাথে খেলবে। এই বর্ণবাদ নীতির ফলে আইসিসি দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ক্রিকেট খেলায় নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে। এই কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটারেরই আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হয়নি।
পিটারের সন্তান শন পোলক ক্রিকেটে এক অনন্য প্রতিভা। পিতার মতো তিনিও বোলিং অলরাউন্ডার ছিলেন। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ১০৮টি টেস্ট এবং ৩০৩টি ওয়ানডে খেলেন। ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সাউথ আফ্রিকার প্রতিনিধিত্ব করেন। ৪২১টি উইকেট শিকার করে শন পোলক টেস্ট ক্রিকেটে সাউথ আফ্রিকানদের মধ্যে শীর্ষস্থানে অবস্থান করছেন।
ল্যান্স কেয়ার্নস ও ক্রিস কেয়ার্ন্স
নিউ জিল্যান্ডের ব্যাটিং অলরাউন্ডার ল্যান্স কেয়ার্নসের একজন মারকুটে এবং সুইং বোলার হিসেবে বিশেষ খ্যাতি ছিল। ১৯৮৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২১ বলে অর্ধশত করে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ঐ বছরেই হেডিংলিতে টেস্ট ম্যাচে তার ১০ উইকেট শিকারের কারণে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের মাটিতেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়লাভ করে নিউ জিল্যান্ড।
কেয়ার্নস ৪৩টি টেস্ট এবং ৭৮টি ওয়ানডে খেলেন। লেন্সের পুত্র ক্রিস কেয়ার্নস ক্রিকেট জগতে বেশ পরিচিত একটি নাম। পিতার মতো তারও মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসেবে খ্যাতি ছিল। তার খেলোয়াড়ি জীবনে ৬২টি টেস্ট ম্যাচে ৮৭টি ছক্কা হাঁকান। ২০০৪ সালে অবসরগ্রহণ করেন অনবদ্য এই ক্রিকেট অলরাউন্ডার।
ক্রিস ব্রড ও স্টুয়ার্ট ব্রড
ব্রায়ান ক্রিস্টোফার ব্রড বা ক্রিস ব্রড ছিলেন ইংল্যান্ড জাতীয় ক্রিকেট দলের উদ্বোধনী বামহাতি ব্যাটসম্যান। একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে চল্লিশেরও অধিক গড় ছিল তার। ১৯৮৬-১৯৮৭ মৌসুমে অ্যাশেজ সিরিজে ধারাবাহিকভাবে পরপর তিনটি শতক করে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি।
ক্রিস ব্রডের সন্তান স্টুয়ার্ট ব্রডও ইংল্যান্ডের ক্রিকেট দলের এক অনন্য নাম। ডানহাতি ফাস্ট বোলার এবং বামহাতি ব্যাটসম্যান এই খেলোয়াড়। টেস্ট ক্রিকেটে ৯ নম্বরে ব্যাটিং করতে নেমে ১৬৯ রান করে ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের খ্যাতি লাভ করেছেন তিনি।
ওয়াল্টার হ্যাডলি ও রিচার্ড হ্যাডলি
তবে ক্রিকেটীয় পরিবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি স্থান নিয়ে আছে নিউজিল্যান্ডের হ্যাডলি পরিবার। স্যার রিচার্ড হ্যাডলিকে নিউ জিল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার বিবেচনা করা হয়। তিনি টেস্ট ক্রিকেটে নিউ জিল্যান্ডের জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেছিলেন। তার ক্রিকেটীয় জীবনে মোট ৪৩১টি টেস্ট উইকেট নিয়েছিলেন, যা এখন পর্যন্ত কিউইদের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারীর রেকর্ড হয়ে আছে। এমনকি তিনিই প্রথম টেস্টে ৪০০ উইকেটের মাইলফলকে পৌঁছানোর কৃতিত্ব অর্জন করেন।
হ্যাডলির বাবা ওয়াল্টার এবং ভাই ডেলেও নিউ জিল্যান্ডের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ওয়াল্টার হেডলি ১১টি টেস্ট ম্যাচে ১৯টি ইনিংস খেলে ৫৩৪ রান করেন। জাতীয় পর্যায়ের খেলায় তিনি কখনো এক অংকের ঘরে আউট হননি।
বিজয় মাঞ্জরেকার ও সঞ্জয় মাঞ্জরেকার
ভারতীয় ক্রিকেট দলের এক অন্যতম নাম বিজয় মাঞ্জেকার। ১৯৫১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত মোট ৫৫টি টেস্ট ম্যাচে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৫২ সালে হেডিংলিতে মাত্র ২০ বছর বয়সে ইংল্যান্ডে বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করেন। টেস্ট জীবনে ৭টি শতক ও ১৫টি অর্ধশতক করে সর্বমোট ৩২০৮ রান করেন তিনি।
বিজয় মাঞ্জরেকারের পুত্র সঞ্জয় মাঞ্জরেকার তার খেলোয়াড়ি জীবন এবং ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ হিসেবে বেশ পরিচিত একটি নাম। ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ভারতের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন। ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান ৩৭টি টেস্ট এবং ৭৪টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেন। বর্তমানে তিনি ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার হিসেবে অধিক জনপ্রিয়।
জিওফ মার্শ ও শন মার্শ
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে ডানহাতি উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলেছেন ১৯৮৫ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত। এই অল্প সময়ের ক্রিকেটীয় জীবনে ৫০টি টেস্ট এবং ১১৭টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন। ১৯৮৭ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার মূল দলে ছিলেন। নিউ জিল্যান্ডের সাথে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তিনি অপরাজিত ১২৬ রান করেন।
১৯৯৯ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে তিনি অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের কোচের ভূমিকা পালন করেন। তার দুই পুত্র শন মার্শ এবং মিচেল মার্শ বিভিন্ন সময়ে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলের পক্ষে হয়ে খেলছেন। দুজনেই ব্যাটিং অলরাউন্ডার হিসেবে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের সাথে জড়িত আছেন।
ক্রিকেটের ইতিহাসে পিতা-পুত্রে যুগলবন্দীতে আরো অনেকেই আছেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারতের সুনীল গাভাস্কার ও তার ছেলে রোহান গাভাস্কার, রজার বিনি ও স্টুয়ার্ট বিনি, যুগরাজ সিং ও যুবরাজ সিং, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জর্জ হ্যাডলি ও রোনাল্ড হ্যাডলি, পাকিস্তানের মাজিদ খান ও বাজিদ খান, ইংল্যান্ডের জেফ জোন্স ও সাইমন জোন্সসহ আরো অনেকে। অন্যান্য অনেক গুণের মতো ক্রিকেট খেলাও যে বংশানুক্রমে প্রতিভার ধারক হতে পারে, তার এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত আলোচ্য নামগুলো।
This article is a Bengali article. This story is about the contribution of both father and son to the cricket. All the sources are hyperlinked into the article.
Featured Image: www.icc-cricket.com