২০১৪ বিশ্বকাপে জার্মানির কাছে ৭ গোলের অঘটন ব্রাজিলকে একটি শিক্ষা দিয়েছিল, যে শিক্ষা ইঙ্গিত করে পরিবর্তনের। যদিও পরবর্তী কার্লোস দুঙ্গার সময়েও ব্রাজিলের সে পরিবর্তন আসেনি। ২০১৫ কোপাতে ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বাদ পড়ে প্যারাগুয়ের কাছে হেরে। পরের বছর তো তারা গ্রুপপর্বও পেরোতে পারেনি। তবে ব্রাজিলের জাতীয় শিরোপা জেতার গল্প শুনতে খুব বেশি অতীতে যেতে হবে না। ১৯৯৭ থেকে ২০০৭ সালের ভেতর তারা এ শিরোপা ঘরে তুলেছে ৪ বার। তারপর কোপা আমেরিকাতে আর তেমন সাফল্য নেই সেলেসাওদের।
জার্মানির কাছে লজ্জাজনক হার এবং কোপাতে পরপর দুইবার অপমানের সাথে বাদ হবার পর সম্ভাবনা নিয়ে ব্রাজিলের কোচের আসনে বসলেন তিতে। তার চিন্তাভাবনা ছিল ভবিষ্যৎ ব্রাজিলকে ঘিরে। তাই ঢেলে দল সাজানোতে মনোযোগ দিলেন তিনি। বুড়িয়ে যাওয়া মধ্যমাঠ সরিয়ে জায়গা করে দিলেন তরুণদের। ব্রাজিলও ঘুরে দাঁড়াল, দুর্দান্ত খেলে রাশিয়া বিশ্বকাপে জায়গা করে নিলো তারা। তবে ভবিষ্যতের চিন্তা মাথায় রেখে সাজানো দলে তিতের কিছু ঘাটতি ছিল, ভুল ছিল তার ট্যাকটিক্সেও। বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্রাজিলকে নতুন রূপ দেবার কাজে মনোযোগ রাখলেন তিনি। তারই তিন বছরের ঐকান্তিক চেষ্টায় আজ বর্তমানের দুর্দান্ত ব্রাজিল দল। যারা নিজেদের মাঠে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া কোপা আমেরিকা জিতে পুনরায় ব্রাজিলের সেরা সময়ের শুরু রাঙিয়ে রাখতে চায়।
ব্রাজিল কোচ তিতে বহু পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন, স্থানীয় ক্লাব থেকে ইউরোপের আনাচেকানাচে থাকা খেলোয়াড়দের খেলা দেখেছেন স্বয়ং মাঠে গিয়ে, তাদের ভেতর থেকে সুযোগ করে দিয়েছেন অনেককে। তাই কোপা আমেরিকার জন্য ঘোষিত এই দলটি ব্রাজিলিয়ানদের বহু চাওয়া-পাওয়ার।
বর্তমান সময়ের সেরা দুই গোলরক্ষকই ব্রাজিলের ঘরের ছেলে। তাই গোলরক্ষক নির্বাচন করতে ব্রাজিল কোচের কোন বেগ পেতে হয়নি। লিভারপুলের অ্যালিসন ও ম্যানচেস্টার সিটির এডারসন থাকছেন এবারের স্কোয়াডে। তবে তিতের প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক হিসেবে কোপাতে অ্যালিসনই গোলবার সামলাবেন। তাই অ্যালিসনের ইনজুরি বা কোচের মর্জি না হলে এডারসনের খেলার সুযোগ কম।
তিতের সব থেকে পছন্দের ফর্মেশন হলো ৪-৩-৩। মাঝে ৪-১-২-৩ এবং ৪-৪-২ ব্যবহার করলেও ৪-৩-৩ ফর্মেশনেই ব্রাজিলকে বেশি খেলাতে দেখা গেছে। তাই তার দলে পরীক্ষিত রাইটব্যাক ও লেফটব্যাকের প্রয়োজন। ফর্মহীনতা ও বয়সের কারণে অনেকদিন পর ব্রাজিল দল কোনো গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্টে খেলবে মার্সেলোকে ছাড়া। কোপাতে তিতের প্রথম পছন্দের রাইটব্যাক থাকবেন জুভেন্টাসের অ্যালেক্স সান্দ্রো, তার বদলি খেলোয়াড় হিসেবে ফেলিপে লুইজ। পোর্তো'র আরেক রাইটব্যাক অ্যালেক্স তেলস এ মৌসুমে দুর্দান্ত ফর্মে থাকলেও তিতে তাকে বিবেচনা করেননি।
রক্ষণে অবশ্যই পুরনো সৈনিক থিয়াগো সিলভা, সাথে রক্ষণসঙ্গী মার্কুইনোস। আর মিরান্ডার বেঞ্চে থাকার সম্ভাবনা বেশি। তবে তিতের একাদশে এখানে একটু চমকের দেখা পাওয়ার সম্ভবনা আছে। ব্রাজিলের আরেক ডিফেন্ডার এডার মিলিতাওকে তিতে সেন্টারব্যাক ডিফেন্ডার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এবং সেসব ম্যাচে এডার হতাশ করেনি। কিন্তু আদতে এডার একজন পুরোদমে রাইটব্যাক। পোর্তোতে নিয়মিত সে পজিশনে খেলে আসছেন তিনি। ঐদিকে তিতে রাইটব্যাক হিসেবে দলে নিয়েছেন ফ্যাগনার ও দানি আলভেজকে। হয়তো কোপা আমেরিকায় রাইটব্যাকের দায়িত্বে দানি আলভেজ থাকবেন। তবে এডার মিলিতাও'য়ের পজিশন নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যায়।
ব্রাজিলের রক্ষণ ও আক্রমণ বরাবরই ভালো ছিল। সমস্যা ছিল আক্রমণের সাথে কোনো সম্পর্ক না থাকা ভঙ্গুর মধ্যমাঠের। তিতে দায়িত্ব হাতে নিয়ে এখানে সব থেকে বেশি কাজ করেছেন। লুকাস লিমা, রদ্রিগো কাইয়ো, ডগলাস সান্তোস বা রেনাতো আগুস্তোর মতো আনকোরা খেলোয়াড় এখন আর দলে নেই। তিতে মাঝে পাউলিনহো বা রেনাতো আগুস্তোর মত মধ্যমমানের খেলোয়াড় দিয়ে মধ্যমাঠ সাজালেও বর্তমানে গড়ে তুলেছেন এক দুর্গ, যার শুরু হয় ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার পজিশনে থাকা ক্যাসেমিরোর মাধ্যমে। বার্সেলোনার হয়ে নিজেকে প্রমাণ করা আর্থুর মেলোর মিডফিল্ডে থাকার সম্ভাবনা নিশ্চিত। বিপরীতে ফিলিপে কৌতিনহো বরাবরই তিতের একাদশে মধ্যমাঠের বামপাশে খেলে এসেছেন। তবে বার্সেলোনার এ মৌসুমে তার ফর্ম বিবেচনায় আনলে হয়তো কৌতিনহো এবার না-ও থাকতে পারেন ব্রাজিল একাদশে। সেখানে এসি মিলানের তরুণ মিডফিল্ডার লুকাস পাকেতাকে দেখার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়াও এদের বদলি হিসেবে অ্যালান ও ফার্নান্দিনহো তো থাকছেনই।
ব্রাজিল দলের আক্রমণের বামপাশের দায়িত্ব থাকতো নেইমারের দখলে। কোপা আমেরিকার জন্য ঘোষিত দলেও ছিলেন তিনি। কিন্তু কাতারের বিপক্ষে নির্বিষ এক প্রীতি ম্যাচে খেলতে নেমে লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে তার। পায়ের চোটের কারণে এ মৌসুমের অর্ধেক সময় মাঠের বাইরে ছিলেন তিনি, কাটিয়েছেন বিতর্কিত সময়ও। একমাত্র আশা ছিল কোপা আমেরিকা, সেটাও হাত থেকে ফসকে গেল।
তিতে নেইমারের ছিটকে যাওয়া নিয়ে সমর্থকদের চিন্তা না করতে বলেছেন। কিন্তু দলের সব থেকে বড় তারকাকে হারিয়ে ব্রাজিল কিন্তু ঠিকই বিপাকে পড়েছে। নেইমারের মতো একজন তারকা খেলোয়াড় দলে থাকা মানে শুধু গোলের সহায়তা নয়, মানসিকভাবে স্বস্তিও। রিয়াল মাদ্রিদের ভিনিসিয়ুস জুনিয়রও তিতের প্রাথমিক দলে ছিলেন, ছিলেন ডগলাস কস্তা ও লুকাস মৌরাও। তবে মৌরা বা কস্তার উপর ভরসা পাননি ব্রাজিল কোচ। ভিনিসিয়ুস এর ফিনিশিংয়ের কোন উন্নতি নেই। তাই এ মৌসুমে সেভাবে ফর্ম না থাকলেও ব্রাজিল দলে ডাক পেয়েছেন চেলসির উইংগার উইলিয়াস। তবে নেইমারের পরিবর্তে যে-ই খেলুক, কোপা আমেরিকায় নেইমারের শূন্যতা সেলেসাওদের নিশ্চিত ভোগাবে।
একটা সময় তিতের প্রথম পছন্দের স্ট্রাইকার ছিলেন গ্যাব্রিয়েল জেসুস। তখন রবার্তো ফিরমিনোর মতো খেলোয়াড় দুর্দান্ত ফর্মে থাকলেও তিতে তাকে সুযোগ কমই দিয়েছেন। কিন্তু ক্রমেই জেসুস আস্থা হারাচ্ছেন। বিশ্বকাপে সেভাবে জ্বলে উঠতে পারেননি, ম্যানচেস্টার সিটিতে পেপ গার্দিওলার একাদশেও জায়গা হারিয়েছেন। বিশ্বকাপ-পরবর্তী প্রীতি ম্যাচগুলোতেও পেয়েছেন কম সুযোগ । তাই তিতের একাদশের জেসুসের স্থান একদম নিশ্চিত নয়। স্ট্রাইকার হিসেবে এবার রবার্তো ফিরমিনোকে দেখার সম্ভবনা আছে। ফিরমিনো ছাড়া আরেকটি বিকল্প রিচার্লিসন। যদিও তিতে রিচার্লিসনকে দেখছেন উইংগারের ভূমিকায়।
ব্রাজিল দলে এবার জায়গা হয়নি ডগলাস কস্তার। ফর্ম হারিয়ে ফেলা উইলিয়ানও জায়গা হারিয়েছেন। আয়াক্সকে হারিয়ে স্পার্সকে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে তোলা লুকাস মৌরাও নেই ২৩ দলের সদস্যের তালিকায়। এদের বদলে তিনি আস্থা রেখেছেন আনকোরা দুইজনের উপর; সদ্য জ্বলে ওঠা আয়াক্স তারকা ডেভিড নেরেস এবং এভারটন তারকা রিচার্লিসনকে। নেরেস আগাগোড়া উইঙ্গার। রিচার্লিসনও তাই, তবে এভারটনে তিনি উইংয়ের একটু নিচে নেমে খেলেন। কিন্তু ব্রাজিল কোচ কী মনে করে তাকে স্ট্রাইকার হিসেবে দলে দেখতে চেয়েছেন।
একটি পূর্ণাঙ্গ স্কোয়াড গড়তে তিতে বেশ কিছু ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছেন। প্রথমটি ফাবিনহোকে উপেক্ষা করে এবং বুড়িয়ে যাওয়া ফার্নান্দিনহোর উপর ভরসা রেখে। লিভারপুলের হয়ে ফাবিনহো সাফল্যে ভরা একটি মৌসুম কাটিয়েছেন। প্রতিপক্ষের আক্রমণ নষ্ট করে দেওয়া ও খেলোয়াড়দের মার্কিং করে রাখায় ভীষণ দক্ষ তিনি। হয়তো তার এই দক্ষতাকে প্রয়োজন হতে পারে কোপার ম্যাচগুলোতে। রিচার্লিসন একজন উপযুক্ত উইঙ্গার। কিন্তু তিতে তাকে স্ট্রাইকার পজিশনে খেলানোর চেষ্টা করছেন, যা খেলোয়াড়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। অথচ রিচার্লিসনের গতি বা পাস দেবার সক্ষমতার জন্য তাকে রাইট উইংয়ে ব্যবহার করাটাই ঠিকঠাক হতে পারতো। লুকাস মৌরাও হতে পারতেন দারুণ বিকল্প। কিন্তু এদের অগ্রাহ্য করে তিতে রাইট উইংয়ের দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন নেরেসের হাতে।
কোপা আমেরিকার গ্রুপপর্ব পার হতে না পারার জন্য কার্লোস দুঙ্গা চাকরি হারিয়েছিলেন। তারপর তিতে সেলেসাও'দের দায়িত্ব পেয়ে এই দলটি ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন। ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনও তার উপর ভরসা করে নিশ্চুপ ছিল। তবে এবারের কোপা আমেরিকাকেই নিশ্চিত হয়ে যাবে, তিতের গোছানো ব্রাজিল দল শুধু দেখতেই শক্তিশালী, নাকি তারা শিরোপা জিততেও জানে।
This article is in Bangla language which is about the national team of Brazil in Copa America tournament 2019. References are hyperlinked inside the article.
Feature Image : Getty Image
Feature Source:
1.https://www.google.com/amp/s/www.beinsports.com/us/copa-america/news/brazil-announce-2019-copa-america-squad/1194962/amp