Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ডেভিড আস্তোরির অকাল প্রয়াণ ও ক্লাব ফিউরেন্তিনার ভালোবাসা

২০১৭ সালের ৭ জানুয়ারি ৩১ বছর বয়সে পা দেন তিনি। সপ্তাহ দুয়েক আগেই পেয়েছিলেন প্রথম পিতৃত্বের স্বাদ। ৪ মার্চ নিশ্চয়ই ঘুমাতে গেছিলেন একজন গর্বিত পিতা হবার আনন্দে। কিছুদিনের মধ্যেই তার ক্লাবের সাথে নতুন চুক্তি সাইনের প্রস্তুতি চলছিল। ফিউরেন্তিনার দলের ক্যাপ্টেন তিনি, হয়তো ঘুমাতে যাবার আগেই ভেবেছিলেন পরবর্তী উদিনেসের সাথে ম্যাচ নিয়ে, ভেবে রেখেছিলেন তাদের বিপক্ষে খেলার কৌশল। কিন্ত মানুষ কখনোই জানতে পারে না তাদের ভবিষ্যত। দাভিদে আস্তোরিও বুঝতে পারেননি জীবন চলার শেষ সিঁড়িতে তিনি চলে এসেছেন এবং তিনি যে ঘুমাতে যাচ্ছেন, এ ঘুম যে আর তার কোনদিনই ভাঙবে না। ক্লাব ফিউরেন্তিনা ও ইতালির ডিফেন্ডার ডেভিড আস্তোরি গত রবিবার ঘুমের মধ্যে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন।

ফিউরেন্তিনার মাঠে ডেভিড আস্তোরি; Source: Twitter

ডেভিড আস্তোরি আমাদের কাছে কোনো আহামরি ফুটবলার নন, ইতালির নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার হিসেবে তার তেমন নামডাক নেই। খেলতেন ইতালির ক্লাব ফিউরেন্তিনাতে, ইতালির বাইরে যে ক্লাবের ফ্যানবেজ খুবই সীমিত। ফিউরেন্তিনা ক্লাবের দলনেতা ছিলেন তিনি, সবার চোখে সেখানে তিনি ছিলেন একজন ফুটবলার হিরো। শুধুমাত্র দলের রক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নয়, একজন ভালো মানুষ হিসেবে ইতালিতে তার সুনাম ছিলো অগাধ। নিজের ক্যারিয়ারের অর্জন তেমন বড় না হলেও সবার ভালোবাসার অর্জনের ঝুলিটা পরিপূর্ণ ছিলো তার। তাই দলনেতার অকাল প্রয়াণে ফিউরেন্তিনা সমর্থকদের হৃদয়ে বেদনা সবার বোঝার কথা নয়। তবে ইতালি অখ্যাত এক ক্লাবের প্লেয়ার হিসেবে নয় একজন ফুটবলারের এভাবে হুট করে চলে যাওয়ায় বেদনার সাগরে ভাসছে সমগ্র ফুটবল বিশ্ব।

২০১৫-১৬ সিজনে নাপোলি ম্যাচে আস্তোরি, তখন তিনি রোমা থেকে লোনে খেলতেন; Source: News.com

ডেভিড আস্তোরির ফুটবল ক্যারিয়ার ও খুব বর্ণাঢ্য নয়। ইতালির সান জিওভানি বিয়ানকোতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮৭ সালে। স্থানীয় ক্লাব পন্তিসোলা’র যুব দলের হয়ে ২০০১ সালে শুরু হয় তার ফুটবল ক্যারিয়ার। সে বছরই মিলানে যোগ দেন। ২০০৬ সাল পর্যন্ত সেখানে কাটানোর পর তার সিনিয়র ক্যারিয়র শুরু হয় মিলান থেকে পিজ্জিগোঠান এ লোনে খেলার মাধ্যমে। তার পজিশন ছিলো রক্ষণের সেন্ট্রাল ডিফেন্সে। ছয় ফিট দুই ইঞ্চির বিশালদেহী ও শক্তিগত দিক থেকে যথেষ্ট ভালো হবার কারণে দলের রক্ষণের কাজটা তার জন্য আরো সহজ হতো। পিজ্জিগোঠানে লোন চুক্তি শেষ হবার পর তিনি একে একে খেলেছেন ক্রেমোনেসে, ক্যাগলিয়ারি, রোমাতে। রোমা থেকে ফিউরেন্তিনায় ২০১৫-২০১৬ মৌসুম ধারে খেলেন তিনি এবং পরবর্তী সিজনে দলে স্থায়ী হয়ে যান সাথে পান ফিউরেন্তিনার অধিনায়কের দায়িত্ব। ইতালি জাতীয় দলে তিনি সেভাবে নিয়মিত সুযোগ পাননি। তার অভিষেক হয় ২০১১ সালে ইউক্রেনের বিপক্ষে। জাতীয় দলের হয়ে ১৪ ম্যাচ খেলেছেন তিনি, একটি গোলও আছে তার।

ইতালির হয়ে ডেভিড আস্তোরি; Source: Bein Sports

মৃত্যুতে জীবন ও ক্যারিয়ার উভয়ের ইতি টেনেছেন তিনি। তবে তার মৃত্যুতে প্রবল শোকতাপের পাশাপাশি ফুটবলের সেই মানবতা রূপ যেন ফিরে এসেছে। যা বর্তমানের মাঠে শক্তির ফুটবল ও বাইরের কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করার মতো ট্রলের ভিড়ে তেমন দেখা যায় না। ক্লাবকে নিচে নামানোর প্রচেষ্টা, প্রতিপক্ষের প্লেয়ারকে দোষাদোষি করার জোয়ারে ফুটবলের যে আসল রূপ হুট করে দৃশ্যপটে আসলো, তা অভাবনীয়। তার মৃত্যুতেই যেন পৃথিবী নতুন করে আবিষ্কার করেছে একটি ক্লাবের সাথে কোনো ফুটবলারের সম্পর্ক কতটা মধুর হতে পারে। নিয়মিত জাতীয় দলে না খেলা ফুটবলারের সাথে সবার কেমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে পারে!

আস্তোরি যেদিন মারা যান, সেদিন সিরি এ তে ছিলো ২৭তম রাউন্ডে খেলা, প্রবল উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ মিলান ডার্বি। তার মৃত্যুসংবাদ যখন আসে, তখন প্রায় শুরু হয়ে গিয়েছিলো ক্যাগলিয়ারি বনাম জেনোয়া ম্যাচ। দুই দলের প্লেয়ার নিজেদের মাঠে ঝালিয়ে নিচ্ছিল। আস্তোরির মৃত্যুসংবাদ আসা মাত্র মাঠে গড়ানো ম্যাচ সাথে সাথে বাতিল করা হয় পরে একে একে বাতিল করা হয় সেদিনের বাকি সকল ম্যাচ। এমনকি উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ মিলান ডার্বিও। যখন আস্তোরির পুরো পরিবার মৃত্যুশোকে কাতর, ফিউরেন্তিনা উপহার দিয়ে বসে মানবতার ফুটবলের একাংশ। ফিউরেন্তিনা ঘোষণা করে ডেভিড আস্তোরির সাথে হতে যাওয়া চুক্তিটা আজীবন পর্যন্ত করা হয়েছে। তার মাসিক বেতন তুলে দেওয়া হবে তার স্ত্রী ও সন্তানকে, এ ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পর মিডিয়াকে জানানো হয়, তার ১৩ নম্বর জার্সি অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছে ফিউরেন্তিনা, ফুটবলের মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে যাওয়া আস্তোরির পরিহিত জার্সি নম্বরও থাকবে চির অবসরে।

ফিউরেন্তিনার ১৩ নম্বর জার্সি পরিহিত ডেভিড আস্তোরি; Source: Bein Sports

অসংখ্য টুইট আসছে তার নামে। তার আত্মার শান্তি কামনা করছে তার ভক্ত, তার শুভাকাঙ্ক্ষী, তার প্রাক্তন সতীর্থরা। আন্দ্রেয়া পিরলো টুইট করেছেন, “ভালো মানুষজন দ্রুত স্বর্গে চলে যায়।”  আস্তোরির ক্যাগলিয়ারি ও রোমার সতীর্থ রাদজা নাইংগোলান খেলেছেন ক্যাগলিয়ারি ও রোমায়। তিনি টুইট করেছেন, “দারুণ একজন প্লেয়ার, তার চেয়েও সুন্দর একজন মানুষ। আমরা একসাথে ক্যাগলিয়ারিতে অনেক লড়াই লড়েছি, যা অব্যাহত ছিলো রোমাতে। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। সবসময় আস্তোরির পরিবারের পাশে আছি। ভালো থেকো বন্ধু।‘’

রাদজা নাইংগোলান ও ডেভিড আস্তোরি, ক্যাগলিয়ারিতে খেলার সময়; Source: european pressphoto

ডেভিড আস্তোরির মৃত্যুর পর গতকাল প্রথম ম্যাচ খেলেছে ফিউরেন্তিনা। তার শূন্যতা ও বিদায়ের বেদনা কাটিয়ে উঠতে যে ফিউরেন্তিনা আরো সময় লাগবে সেটা বলাই বাহুল্য। ফিউরেন্তিনা বনাম বেনেভেন্তো ম্যাচটি যেন ছিলো আস্তোরির সম্মানের জন্য। স্টেডিয়ামের প্রায় সকলের হাতে ছিলো আস্তোরির ছবি, পুরোটা সময় স্টেডিয়ামে চলেছে তার নামের জয়জয়কার। ম্যাচের ১৩তম মিনিটে তার সম্মানে ম্যাচ থামানো হয় পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে তখন ‘ডেভিড’ শব্দে কান পাতা দায়। ১৩তম মিনিটটি সবাই অতিক্রম করলেন চোখের পানি মুছে আর আস্তোরিকে স্মরণ করে। ২৫ মিনিটে  এ ম্যাচে জয়সূচক গোল করেন ফিউরেন্তিনা ডিফেন্ডার ভিক্টর হুগো, যিনি স্বয়ং ডেভিড আস্তোরির স্থানে খেলতে নেমেছিলেন।

জয়সূচক গোল করে ভিক্টর হুগো আবেগ ধরে রাখতে পারেননি, দৌড়ে ছুটে যান ডাগ আউটের দিকে আস্তোরির ছবি আঁকানো জার্সির সামনে স্যালুট করার জন্য। শুধু এটুকুই নয়, ম্যাচ শেষে কেউই মাঠে আর ৯০ মিনিট ধরে রাখা চাপা কষ্ট সামলাতে পারেনি, শেষ মিনিটের বাঁশি বাজার সাথে সাথে কান্নায় ভেঙে পড়ে সবাই। আস্তোরির শূন্যতার ছোঁয়ায় ভেসে গেছে ফিউরেন্তিনার মাঠের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত। তবে সম্ভবত সবথেকে বেশি কষ্ট পেয়েছেন মিলান বাদেল। আস্তোরি চলে যাবার পর তিনিই যে প্রথম ফিউরেন্তিনার আর্ম ব্যান্ড ধারণ করলেন।

বামে গোল করার পর ভিক্টর হুগো, ডানে ফিউরেন্তিনা বনাম বেনেভেন্তো ম্যাচ শেষে ফিউরেন্তিনার ফুটবলারদের কান্না; Source: 90min

একপাশে আস্তোরির বিদায়ের শোক, অন্যদিকে ফিউরেন্তিনা ক্লাবের মানবতার উদাহরণ ও সবার অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। মাঠের বলের লড়াইয়ের বাইরে এটাই তো ফুটবল। যেখানে যেকোনো শক্তি হার মেনে যায়। আস্তোরি বিহীন ফিউরেন্তিনা তাদের মনোবল ফিরে পেতে আরো কিছু সময় লাগবে। তবে ইতালির ফুটবল, ফিউরেন্তিনা ক্লাবের সাথে তিনি সবসময়ই  মিলেমিশে থাকবেন। ফুটবল বিশ্ব তাকে মনে রাখবে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে।

Featured photo: Evening Standard

Related Articles