কম্পিউটারের নাম শুনলেই নাক-মুখ কুঁচকে ফেলেন সর্বকালের সেরা দাবাড়ু গ্যারি কাসপারভ। তিনি এই যন্ত্রটিকে একদমই পছন্দ করেন না। আর অপছন্দের ব্যক্তিকে কিংবা বস্তুকে পর্যদুস্ত করার মতো সুখকর অনুভূতি বুঝি আর নেই। এজন্যই গ্যারি কাসপারভ কম্পিউটারকে হারিয়ে বেশ তৃপ্ত হন। এই যেমন ধরা যাক ’৮৫ এর হামবুর্গের সেই ম্যাচের কথা। তখন পৃথিবীতে এখনকার মতো তথ্যপ্রযুক্তি এতটা উন্নত ছিল না। তবে এই খাতে আসন্ন বিপ্লবের হাওয়া ইতোমধ্যে বইতে শুরু করেছিল। মানুষ তখন বুদ্ধিমত্তায় মানুষকে হারাতে পারে এমন যন্ত্র বানাতে ব্যস্ত ছিল। আর সেই সক্ষমতা পরিমাপের মাপকাঠি হিসেবে তখন দাবাকে গণ্য করা হতো।
৬৪ ঘরের চারকোনা বোর্ডে ১৬ ঘুঁটির তীব্র লড়াইয়ে মানুষ তখন নিজের বুদ্ধির সর্বোচ্চ প্রয়োগ করে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতো। আর এই লড়াইয়ের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা কাসপারভকে হারাতে পারে এমন কম্পিউটার বানাতে পারা হবে সর্বোচ্চ সাফল্য। সেবার কাসপারভের সাথে কম্পিউটারের লড়াই হয়েছিল হামবুর্গ শহরে। কাসপারভও কম যাননি। তিনি একটি দুটি কম্পিউটারের সাথে খেলতে নারাজ। তাকে একা একটি কম্পিউটার হারাতে পারবে এই কথা তিনি বিশ্বাস করতেন না। তাই ৩২টি দাবা খেলায় বিশেষায়িত কম্পিউটারের বিরুদ্ধে খেলা শুরু করলেন তিনি।
রাউন্ড রবিন ফরম্যাটের সেই টুর্নামেন্ট স্থায়ী হলো মাত্র ৫ ঘণ্টা। সবগুলো কম্পিউটারকে এক কথায় নাস্তানাবুদ করে বিজয়ীর মালা গলায় দিয়ে মঞ্চ ত্যাগ করেছিলেন কাসপারভ। মানুষকে কম্পিউটার হারাবে- এমন বাণী সত্য হওয়া তখন বহুদূর। কিন্তু এই গল্পটি নতুন করে লেখা হয়েছে এই ঘটনার ঠিক এক যুগ পর। সেবার কাসপারভের মুখোমুখি হয়েছিল ডিপ ব্লু নামক একটি সুপার কম্পিউটার। আর তখন ঘটে গেল এক অবিশ্বাস্য ঘটনা।
ডিপ ব্লু এর ম্যাচের কথায় যাওয়ার আগে দাবাড়ু কাসপারভ সম্পর্কে জানা যাক। যারা টুকটাক দাবা খেলেন এবং খবর রাখেন, তাদের নিকট কাসপারভ নামটি একদম আপন। আজারবাইজানে জন্ম নেওয়া এই দাবাড়ুকে সর্বকালের সেরা হিসেবে অনেকেই একবাক্যে মেনে নিয়েছেন। আর এই কথার সত্যতা কাসপারভের বিপরীতে খেলতে বসা খেলোয়াড়রা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন।
১৯৬৩ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত আজারবাইজানের বাকুতে জন্ম নেন তিনি। শৈশব থেকেই তার দাবা প্রতিভা প্রকাশিত হতে থাকে। মাত্র ১২ বছরের মধ্যে তিনি প্রায় ২,৪০০ দাবা ম্যাচ খেলে ফেলেন। বলতে পারেন এর মধ্যে তিনি কয়টি ম্যাচ হেরেছেন? মাত্র ১৭০টি। শতকরায় যেটা মাত্র ৭টি। ১২ বছরের মধ্যেই তিনি সোভিয়েত অনূর্ধ্ব-১৮ দাবা চ্যাম্পিয়ন বনে যান। ১৭ বছর বয়সে তিনি অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব অর্জন করেন। ১৯৮৫ সালে ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে বিশ্বসেরার খেতাব অর্জন করেন। ২০০০ সাল পর্যন্ত মোট ৫ বার তিনি তার খেতাব ধরে রাখেন।
এই ১৫ বছরের যাত্রায় তিনি দাবার ইতিহাসে এক অনন্য কাব্যের জন্ম দেন, যার ছন্দের নান্দনিকতায় চিরকাল দাবাপ্রেমীরা মুগ্ধ থাকবে। দাবার বোর্ডে কাসপারভ এক কথায় ছিলেন ক্ষুধার্ত এবং হিংস্র। প্রতিপক্ষকে লড়াইয়ের সামান্য অবকাশ দিতে নারাজ এই দাবাড়ুর বিপক্ষে ঘাম ছুটেছে বড় বড় খেলোয়াড়ের। তবে এতসবের বাইরে কাসপারভকে ইতিহাস মনে রাখবে ’৯৭ এর সেই অবিস্মরণীয় ম্যাচের কারণে। কারণ, সেই ম্যাচের ফলাফলে ইতিহাসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গল্প এক নতুন মোড় নিয়েছিল, যার প্রভাব জারি থাকবে হাজার বছর পর্যন্ত।
দাবা খেলাকে কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা বহু আগে থেকে মানুষের বুদ্ধিমত্তার মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করে আসছেন। এই খেলায় যে পরিমাণ চিন্তাভাবনা এবং মস্তিষ্কের ব্যায়াম হয়, তা আর অন্য খেলায় হয় না। তাই তারা এমন একটি যন্ত্র তৈরি করার প্রচেষ্টায় ছিলেন যা মানুষকে দাবার মঞ্চে হারিয়ে দেবে। ১৯৭০ সালে এই প্রচেষ্টার প্রথম প্রয়াস হিসেবে দাবা ক্যালকুলেটর নির্মিত হলো। এর এক দশক পর ‘ডিপ থট’ নামে একটি দাবা বিশেষায়িত কম্পিউটার নির্মাণ করা হয়েছিল। নির্মাতা ছিল কার্নেগি-মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র। এই কম্পিউটার এক গ্র্যান্ড মাস্টারকে পরাস্ত করে রীতিমতো হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল।
কিন্তু ১৯৮৯ সালে গ্যারি কাসপারভ দুই গেমের এক খেলায় ডিপ থটকে হারিয়ে দিলেন। ডিপ থটের নির্মাতারা আশাহত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু একদল ছাত্রের এই অসাধারণ নির্মাণ মনে ধরেছিল কম্পিউটার খাতের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান আইবিএম-এর। আইবিএম সেই গবেষক দলকে নিজেদের দলে টেনে আনে। তাদের প্রয়োজনীয় পরিবেশ, অর্থ এবং গবেষণাগারের ব্যবস্থা করে আরও উন্নত দাবাড়ু কম্পিউটার নির্মাণের প্রকল্প দেওয়া হয়। সেই গবেষক দলের পরবর্তী চমক ছিল ‘ডিপ ব্লু’।
RISC System/6000 এর উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছিল সুপার কম্পিউটার ডিপ ব্লু। POWER এবং PowerPC ভিত্তিক মাইক্রোপ্রসেসর ব্যবহার করা কম্পিউটারগুলোর মধ্যে প্রথম ছিল এই ডিপ ব্লু। প্রায় ৩ হাজার টন ভরের এই কম্পিউটারের সাথে গ্যারি কাসপারভের প্রথম টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালে। ৬ ম্যাচের সেই টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই কাসপারভকে কোণঠাসা করে ফেলে ডিপ ব্লু। রীতিমতো ঘাম ঝরানো সেই ম্যাচে কাসপারভ হেরে গেলেন।
চমকে গেল দাবাড়ুরা। কী সর্বনাশ! কাসপারভ প্রথম খেলাতেই হেরে গেলেন। সবাই ভাবলো, এবার বুঝি আর নিস্তার নেই। সবার মনে তখন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর যন্ত্র বিপ্লবের ঐকতান হুমকি দিচ্ছিল। কিন্তু কাসপারভও দমে যাননি। দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের প্রত্যাবর্তন হলো দাপুটে ভঙ্গিমায়। পরের ম্যাচে ডিপ ব্লুকে এক কথায় বিধ্বস্ত করে দিলেন তিনি। সেই টুর্নামেন্টে ২ ড্র, ১ ডিপ ব্লু এবং ২ কাসপারভ ফলাফল হয়। কাসপারভের পরবর্তী ম্যাচ দেখে মনে হচ্ছিল প্রথম ম্যাচে দূর্ঘটনাবশত হেরেছিলেন তিনি। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল কাসপারভের সমর্থকরা।
কাসপারভকে নিয়ে যখন উদযাপন চলছিল, তখন আইবিএম শিবিরে নতুন করে কাজ শুরু করার পরিকল্পনা চলছে। ডিপ ব্লু এর ম্যাচগুলো পর্যবেক্ষণ করে বেশকিছু ভুল বের করেছেন গবেষকগণ। তাদের বিশ্বাস ছিল, অল্প কিছু জায়গা সংস্কার করলেই কাসপারভকে ধরাশায়ী করা যাবে। এই বিশ্বাসের জোরেই শুরু হলো ডিপ ব্লু এর দ্বিতীয় সংস্করণ নির্মাণের কাজ। নতুন কম্পিউটারের সামগ্রিক কার্যক্ষমতা দ্বিগুণ করা হলো। সাধারণ প্রসেসর এবং দাবা খেলার জন্য বিশেষ চিপস ব্যবহারের কারণে এটি একটি হাইব্রিড কম্পিউটার হিসেবে আবির্ভূত হলো। সুপার কম্পিউটার ঘুঁটি চাল দেওয়ার বিষয় তদারকি করতো। জটিল সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতো চিপস। এর ফলে ডিপ ব্লু প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১০০ থেকে ২০০ মিলিয়ন চাল বিশ্লেষণ করতে পারতো।
আইবিএম-এর সেরা সিদ্ধান্ত ছিল ডিপ ব্লু দলে জুয়েল বেঞ্জামিন নামক এক গ্র্যান্ড মাস্টারকে অন্তর্ভূক্ত করা। একটি সুপার কম্পিউটারও দাবা খেলায় সহজে হেরে যেতে পারে যদি না তার শুরুর চাল যুতসই হয়। জুয়েল বেঞ্জামিন কম্পিউটারের শুরুর চাল নিয়ে একটি লাইব্রেরি নির্মাণের কাজে সহায়তা করেন। এভাবে নতুন সংযোজন এবং লাইব্রেরি নিয়ে ডিপ ব্লু এক চৌকস দাবাড়ু যন্ত্রে রূপান্তরিত হলো। এবার মঞ্চ হলো প্রস্তুত, বাকি ছিল শুধু এক জমজমাট প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
১৯৯৭ সালের মে মাসে পুনরায় ডিপ ব্লু’র মুখোমুখি হন গ্যারি কাসপারভ। এবারের ভেন্যু ছিল মার্কিন মুলুকের নিউ ইয়র্ক শহর। ম্যাচ শুরু হওয়ার বহু আগে থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে এই ম্যাচ। নিছক বিনোদনের বাইরে এই ম্যাচ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌড় পরীক্ষার এক সুবর্ণ সুযোগ ছিল। বেতার এবং টেলিভিশনে এই ম্যাচ সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পত্রিকার পাতায় চটকদার শিরোনামে খবর ছাপিয়ে ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনা বহুগুণে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিজ্ঞাপন আর আলোচনার হিড়িকে মনে হচ্ছিল এ যেন দাবা খেলা নয়, বরং ‘সারাহ কনর’ বনাম ‘টার্মিনেটর’ এর মধ্যে রক্তক্ষয়ী ম্যাচ চলছে। কাসপারভ হেরে গেলেই যেন মানব সভ্যতার যবনিকাপাত ঘটবে।
যথাসময়ে শুরু হলো সেই বহুল অপেক্ষিত টুর্নামেন্ট। কিন্তু প্রথম ম্যাচে কাসপারভ অনায়াসে জিতে গেলেন। নতুন ডিপ ব্লুকে তখন আগের চেয়েও বেশি ফিকে দেখাচ্ছিল। এরপর দ্বিতীয় ম্যাচে কাসপারভ বেশ জটিল চাল দিয়ে কম্পিউটারকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করলেন। খেলার একপর্যায়ে এমন অবস্থা দাঁড়ালো যে, ডিপ ব্লুকে হয় রাজার চাল দিয়ে পেছনে এক ঘর যেতে হবে, নয়তো নিজের সৈন্য খুইয়ে দিতে হবে কাসপারভের কাছে। এই ম্যাচের আগে কাসপারভ বহু কম্পিউটারের সাথে লড়েছেন। তিনি জানতেন কম্পিউটার সাধারণত কোনো ঘুঁটি বিসর্জন দিতে চায় না। তাই তিনি ধরে নিয়েছিলেন ডিপ ব্লু রাজার চাল দেবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে যন্ত্রটি সৈন্য বিসর্জন দিয়ে দিল।
এই চাল দেখে কাসপারভ স্তম্ভিত হয়ে যান। এমন তো হওয়ার কথা নয়! তিনি যেন খেই হারিয়ে ফেললেন। তার সন্দেহ হতে লাগলো, ডিপ ব্লু’র মুখোশ পরে আইবিএম আড়ালে একজন গ্র্যান্ড মাস্টারের বিপক্ষে তাকে খেলতে বসিয়েছে। যেন বিজ্ঞাপনের অজুহাতে পুরো নাটক সাজানো হয়েছে। এই চিন্তা থেকে কি না জানা নেই, কাসপারভ আর ১০ চাল পরে খেলায় পরাজয় মেনে মঞ্চ ত্যাগ করেন। অথচ এই খেলা তখনও তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি। তার এমন আচরণে সবাই অবাক হয়ে গেল। এরপর যথারীতি বাকি ৪ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলো। এদের মধ্যে ৩টি ম্যাচ ড্র হলো। কাসপারভ আর কখনোই ডিপ ব্লুকে হারাতে পারলেন না।
শেষ ম্যাচে কাসপারভকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করলো ডিপ ব্লু। টুর্নামেন্টের শেষ চালের সময় ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল কাসপারভের অসহায়ত্ব। সেবার প্রথমবারের মতো মানুষকে দাবা টুর্নামেন্টে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল একটি যন্ত্র। ডিপ ব্লু রাতারাতি পত্রিকা এবং গণমাধ্যমে তারকাখ্যাতি অর্জন করলো। এই খ্যাতি এসেছিল দুই কারণে। প্রথমত, ডিপ ব্লু স্পষ্ট জানান দিয়েছিল, যন্ত্র খুব শীঘ্রই মানুষকে ছাড়িয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, গ্যারি কাসপারভ আইবিএম-এর দিকে প্রতারণার অভিযোগ তুলেছিলেন। তিনি ডিপ ব্লু’র খেলার ধরন যন্ত্রসুলভ ছিল না বলে অভিযোগ তুলেন।
ডিপ ব্লু’র খ্যাতির উপর ভর করে আইবিএম এর স্টক মূল্য ৩.৬% বৃদ্ধি পায়। আইবিএম এর উদ্দেশ্য ছিল যন্ত্র মানুষকে হারাতে পারে তা প্রমাণ করা। সেই ম্যাচের পর তারা ডিপ ব্লু প্রকল্পের ইতি টানে। গ্যারি কাসপারভ পুনরায় ম্যাচ খেলতে চাইলে তা নাকচ করে দেয় আইবিএম। এর ফলে কাসপারভের সাথে ডিপ ব্লু অধ্যায়ের এখানেই সমাপ্তি ঘটে। তবে কাসপারভের অভিযোগ নিয়ে তখনও আলোচনা হচ্ছিল। আইবিএম কি আসলেই প্রতারণা করেছে?
এর উত্তর মিললো ১৫ বছর পর। ২০১২ সালের দিকে আইবিএম-এর গবেষক মারে ক্যাম্পবেল থেকে জানা গেলো ডিপ ব্লু’র সৈন্য বিসর্জনের রহস্য। তিনি সোজা কথা বলে দিলেন, পুরো ব্যাপারটি একটি ‘গলদ’। ডিপ ব্লু’র প্রোগ্রামে একটি গলদ থেকেই নাকি এই চাল এর উৎপত্তি হয়েছিল! তিনি খোলাসা করে বলেন যে, ডিপ ব্লু’র প্রোগ্রামে একটি ভুল ছিল। যার ফলে সেই পরিস্থিতিতে ডিপ ব্লু সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খাচ্ছিল। একপর্যায়ে যন্ত্রের নির্দেশিত লুপ ভেঙে যায় এবং এটি কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া একটি চাল দিয়ে বসে। এর পেছনে কোনো জটিল পরিকল্পনা বা নকশা ছিল না। আর কম্পিউটারের সেই এলোমেলো চালেই কাসপারভের পরিকল্পনা ভেস্তে গিয়েছিল। যার ফলে তিনি ম্যাচ হেরে গিয়েছিলেন।
এরপর প্রশ্ন উঠলো, এর মানে কি ডিপ ব্লু স্রেফ ভাগ্যের জোরে ম্যাচ জিতেছিল? এর উত্তর হবে ‘না’। প্রথম জয়ের পর প্রকৌশলী দল সেই গলদ শুধরে দিয়েছিল। ৬ষ্ঠ ম্যাচে কাসপারভকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে ডিপ ব্লু প্রমাণ করেছে, সে কোনো খেলনা নয়। বরং এটি একটি বুদ্ধিমান দাবাড়ু যন্ত্র। গ্যারি কাসপারভ কয়েকদিন পর তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। সেই ঐতিহাসিক ম্যাচের ২০ বছর পর তিনি তার অনুভূতি ব্যক্ত করে জানিয়েছেন,
“হেরে যাওয়া অবশ্যই খারাপ। এজন্য আমার বেশ খারাপ লাগছিল। আমার মনে হচ্ছিল আমি আমার জীবনে প্রথম দাবা খেলায় হেরে গেলাম। আমি আমার বইয়ে বহুবার স্বীকার করেছি আমি সেদিন বাজে খেলেছি। এজন্য আমার মন খারাপ ছিল। যদিও আমি এখনও আইবিএম-এর বিরুদ্ধে আনা কিছু অভিযোগে অটল রয়েছি, এর মানে এই নয় আমি তাদের কৃতিত্বকে অস্বীকার করছি।”
গ্যারি কাসপারভ তার ‘ডিপ থিঙ্কিং’ বইয়ে ডিপ ব্লু সম্পর্কে একটি মজার মন্তব্য করেছেন,
“আদতে ডিপ ব্লু ছিল একটি অ্যালার্ম ঘড়ি; বুদ্ধিমান অ্যালার্ম ঘড়ি। তবে সত্যি বলতে ১০ মিলিয়ন ডলারের অ্যালার্ম ঘড়ির কাছে হেরে যাওয়াকে আমি একদমই ভালোভাবে নিতে পারিনি।”
ডিপ ব্লু’র পরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বহুদূর এগিয়ে গেছে। এমনকি কাসপারভ নিজেও পরবর্তীতে আরো উন্নত দুটি দাবাড়ু যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়েছেন এবং প্রতিবারই তিনি ড্র করেছেন। এতকিছুর পরেও যেন দাবাড়ু যন্ত্রের অগ্রগতি একটি নির্দিষ্ট সীমানায় এসে থমকে গেছে। একের পর এক সংস্করণে এই যন্ত্র উন্নত হতে থাকলেও এখন পর্যন্ত মানুষের মতো ভাবতে পারা যন্ত্র তৈরি হয়নি। তবে অনেকের মতামত, সেরকম কিছু না হওয়াই ভালো। কারণ, মানুষ তার অনুভূতি দিয়ে বিচার করে সিদ্ধান্ত নেয় বলেই ভুল করে। কিন্তু যন্ত্রের ভুল করার অবকাশ নেই। তারপরেও মানুষের মতো ভাবার উপযোগী যন্ত্র তৈরির কাজ এগিয়ে চলছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এমন যন্ত্রের মুখোমুখি হয়েও যেতে পারি আমরা। তবে সেই অগ্রযাত্রা সর্বদা কৃতজ্ঞ থাকবে ক্যাসপারভ বনাম ডিপ ব্লু’র সেই ৬ ম্যাচের টুর্নামেন্টের প্রতি।
This is a Bangla article about the legendary chess match between Grand Master Garry Kasparov and Super-computer Deep Blue. The match is defined as one of the finest and defining moments in the history of artificial intelligence.
References: All the references are hyperlinked.
Feature Image: AFP
Background Image: Linkmesh