Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কাতালোনিয়া স্বাধীন হলে কী হতে পারে বার্সেলোনার?

১৭ মিনিট ১৪ সেকেন্ড, বার্সেলোনার মাঠ ক্যাম্প ন্যুতে খেলা চলছে। হঠাৎ শুরু হলো গর্জন- ‘ইন্ডিপেন্ডেনসিয়া’, ‘ইন্ডিপেন্ডেনসিয়া’। গত কয়েক বছর ধরে প্রতি ম্যাচেই হয় এই গর্জন, তবে এল ক্লাসিকোর সময় তা হয়ে উঠে আরো প্রকট। কেন এই গর্জন? চলুন একটু পেছনে ফিরে যাই।

১১৬৪ সাল অবধি কাতালোনিয়া ছিল স্বাধীন ও স্বতন্ত্র্য এক রাষ্ট্র। কাতালোনিয়া বরাবরই সমৃদ্ধ এক অঞ্চল ছিল। কালের পরিক্রমায় এটি যুক্ত হয় অ্যারাগনের সাথে। কিন্তু ১৪৬৯ সালে অ্যারাগনের রাজা ফার্দিনান্দ ও স্পেনের রানী ইসাবেলার বিবাহবন্ধনের মধ্য দিয়ে স্পেনের সঙ্গে মিলন ঘটে অ্যারাগন ও কাতালোনিয়ার। আসল ধাক্কাটা আসে ১৭১৪ সালে। জাত্যাভিমানী স্প্যানিশ শাসকরা বরাবরই ক্যাথলিক প্রাধান্যে বিশ্বাসী ছিলেন। কাতালান, গ্রানাডা, বাস্ক এসব প্রদেশের উপর নেমে এলো তাই নিপীড়ন। শাসক স্প্যানিশরা ১৭১৪ সালে কাতালান রাষ্ট্রকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। পরাধীন হয়ে পড়ে কাতালানরা। সেই ১৭১৪ সালকে আজও ভোলে নি কাতালানরা। এখনো বার্সার মাঠে ম্যাচ হলেই ঠিক এই সময়েই উঠে স্বাধিকারের গর্জন।

ক্যাম্প ন্যু তে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্সিয়া’ ব্যানার; Source:El Confidencial

বার্সেলোনাই কেন কাতালান স্বাধিকারের কেন্দ্রস্থল

কাতালানদের রাষ্ট্র বিলুপ্তির পর তাদের উপর অত্যাচার চলতেই থাকে। কাতালান সংস্কৃতি প্রচুর সমৃদ্ধ হলেও, তাদের নিজস্ব আচার-আচরণে বাধা দিতে থাকে স্প্যানিশ শাসকেরা। তবে সেটা চূড়ান্ত রূপ পায় জেনারেল ফ্রাংকোর আমলে। ১৯৩৯-৭৫ সময়টা কাতালানদের জন্য ছিল বিভীষিকার। ফ্রাংকোর বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ শুরু হয় কাতালোনিয়ায়, তাই সেই বিদ্রোহ কাটিয়ে উঠার পর এর কোপটা পড়ে কাতালোনিয়ার উপর। কাতালান ভাষা নিষিদ্ধ করা হয় আইন করে, তাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদিতে আরোপিত হয় নিষেধাজ্ঞা।

ফ্রাংকো প্রশাসনের কোপানল থেকে বাঁচতে তারা বেছে নেয় ফুটবলকে, আরেকটু স্পষ্ট করে বললে বার্সেলোনা ক্লাবকে। ফ্রাংকো প্রশাসনের মাদ্রিদের ক্লাবগুলোর দিকে আগ্রহ কোনো লুকনো বিষয় ছিল না। তাই কাতালানরাও একত্র হয় বার্সেলোনার পতাকাতলে। তাদের স্টেডিয়াম ক্যাম্প ন্যু হয়ে উঠে নিজেদের প্রিয় কাতালান ভাষায় কথা বলার একমাত্র জায়গা। এমনকি স্থানীয় অনেক অনুষ্ঠানাদিও অনুষ্ঠিত হতো সেখানেই। সে কারণে বার্সেলোনা কাতালানদের কাছে ক্লাবের চেয়েও বেশি কিছু, যেটিকে তারা সগর্বে ‘More Than A Club’ বলে থাকে।

১৯৭৫ সালে স্পেন গণতন্ত্রে প্রবেশ করলে কাতালোনিয়াকে দেওয়া হয় স্বায়ত্বশাসনের মর্যাদা। সেখানেও গলদ থেকেই যায়। বড় বড় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা থেকে যায় স্প্যানিশদের কাছেই। সমৃদ্ধ কাতালোনিয়া যে অর্থ রাজস্ব হিসেবে পাঠায় রাজকোষে, তা বাকিদের চেয়ে ঢের বেশি, কিন্তু বিনিময়ে তাদের এলাকার উন্নয়ন হয় কমই। কাতালানদের কর স্পেন কোষাগারে না আসলে অবশ্যই স্পেন অর্থনীতি ভেঙে পড়বে, কিন্তু নিজস্ব অর্থায়নে কাতালোনিয়া হয়ে উঠবে আরো যশস্বী। সে কারণেই স্বাধীনতার দাবি ছাড়েনি তারা, আর যার ফলশ্রুতিতেই এই গণভোট।

এমন ব্যানার অহরহই পাওয়া যায় ক্যাম্প ন্যু তে; Source:Roger Galisteo

কী হবে ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার?

এই আলোচনার শুরুতেই ধরে নেওয়া যাক, কাতালোনিয়া স্বাধীনতা পেয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি একই রকম থাকবে না। স্পেন-কাতালোনিয়ার বিভাজন রাজনৈতিক ময়দানে ফুটবলের চেয়ে নেহায়েত কম না। বর্তমান স্প্যানিশ আইন অনুযায়ী, স্পেনের বাইরের কেবল একটি ক্লাবই লিগে খেলতে পারে, সেটি হলো অ্যান্ডোরা অঞ্চলের। যদি কাতালান আলাদা হয়ে যায়, তবে সেক্ষেত্রে বিপত্তি আরো বাড়বে অ্যান্ডোরার। অ্যান্ডোরা বর্তমানে কাতালান ফুটবল ফেডারেশনের অধীনে লিগে রেজিস্টার্ড। কাতালোনিয়া আলাদা হয়ে গেলে আবার নতুন করে তাদের অন্য ফেডারেশনের দ্বারস্থ হতে হবে, কারণ কোনো আঞ্চলিক ফেডারেশনের আওতায় না থাকলে স্পেনে খেলা যায় না।

কাতালান অঞ্চলে থাকা তিনটি লা লিগার ক্লাব বার্সেলোনা, এস্প্যানিওল ও জিরোনা প্রাথমিকভাবে স্প্যানিশ লিগ থেকে বহিস্কার হয়ে যাবে। তাদের লিগে রাখতে গেলে স্প্যানিশ আইন সংশোধন দরকার পড়বে, যেটা হয়তো ‘আলাদা হওয়া ঠেকাতে ব্যর্থ’ স্প্যানিশ রাজনীতিবিদগণ করতে চাইবেন না। আবার না করে থাকাটাও কষ্ট। লা লিগার টিভি রাজস্ব ফুটবল বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ। তার কারণও স্পষ্ট, রিয়াল-বার্সা দ্বৈরথ। মরিনহোর ভাষায়, এল ক্লাসিকোর সময় নাকি বিশ্ব থমকে যায়! বছরে ন্যূনতম দুইটি ম্যাচ হলেও তাদের রেশ এর চেয়েও অনেক বেশি। নিজেদের প্রতিটি ম্যাচে একজন আরেকজকে ছাপিয়ে যেতে চেষ্টা করে তারা। সারা বছরই চলে রিয়াল-বার্সা আলোচনা। তাই এই বিশাল রাজস্ব স্প্যানিশ সরকার হারাতে চাইবে না। বার্সা চলে গেলে লিগের জৌলুশ যেমন কমবে, কমবে রাজস্বও। তাই বলে বার্সাও কি লা লিগায় থাকার চেষ্টা করবে না? অবশ্যই করবে।

এল ক্লাসিকো, ফুটবলের চুড়ান্ত মহারণ; Source:Paddy Whelan`s

লা লিগা ছাড়লে বার্সার সামনে পথ খোলা থাকবে তিনটি। এক, নিজেদের লিগ খোলা। যদি তাই করে তবে সেটা হবে অন্যতম একপেশে একটি লিগ। কাছাকাছি শক্তির দল হবে এস্পানিওল! এক লাখ দর্শক আর এত বড় আর্থিক সামর্থ্য বিশিষ্ট ক্লাবের জন্য এটি মোটেও আশাপ্রদ না।

দুই, অন্য লিগে খেলা। এটি নিয়ে এখন সবচেয়ে বেশি আলোড়ন চলছে। ভৌগোলিকভাবে ফ্রান্স কাতালোনিয়ার খুব কাছে হওয়ায়, সবচেয়ে সম্ভাব্য বিদেশী লিগ হতে পারে ফ্রেঞ্চ লিগ। ফ্রেঞ্চ লিগের জায়ান্ট ক্লাব মোনাকো একইভাবে সংশোধিত ফ্রেঞ্চ আইনের সাহায্যে খেলছে। বার্সেলোনাও একই উপায়ে খেলতে পারে। ট্রাভেলিং টাইম খুব কম লাগে বলে এটা বেশিই বিবেচ্য হচ্ছে। ওদিকে প্রচণ্ড শক্তিশালী পিএসজির সাথে অন্য দলগুলো পেরে না উঠায়, লীগে প্রতিযোগিতা খুব কম। বার্সা এই লিগে আসলে প্রবল প্রতিযোগিতায় এই লিগেরও যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি হবে। আবার ইংলিশ লিগে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনাও শোনা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে ভ্রমণের সময় নিয়ে একটা দারুণ ঝামেলা হবে। আবার ইংল্যান্ডে এফ. এ কাপ ও লিগ কাপ দুটো খেলতে হয় লিগের পাশাপাশি, তাই চাপও হয়ে যাবে বেশি। ইতালিও বার্সাকে তাদের লিগে চায়। বড় ক্লাব হিসেবে বার্সার চাহিদা থাকলেও এস্পানিওল, জিরোনাদের কপালে কী আছে কেউ জানে না!

তাই বলে বার্সার কি সবই সুবিধা মনে হচ্ছে? আসলে না। যেকোনো লিগে নতুন ক্লাবকে নিম্নতম বিভাগ থেকে শুরু করতে হয়। সেক্ষেত্রে বার্সাকে নতুন কোনো লিগে খেলতে হলে তৃতীয় বা চতুর্থ বিভাগ থেকে খেলা শুরু করতে হবে। নিম্নতর বিভাগে একটি নির্দিষ্ট টাকার বেশি বাজেট বা টাকা থাকা যায় না। সেক্ষেত্রে মেসি, সুয়ারেজদের বিক্রি বা লোনে পাঠাতে হবে। তবে যদি আইন সংশোধন করে আনে, সেটি অন্য কথা।

লা লিগায় আর না-ও দেখা যেতে পারে এই দুজনের মহারণ; Source:NewsX

তৃতীয় অপশন হলো, লা লিগায় থেকে যাওয়া। প্রবল জাত্যাভিমানী কাতালানরা কি আদৌ চাইবে যাদের সাথে লড়লো এতকাল, তাদের কাছে খেলার অনুমতি প্রার্থনা করতে? আবার লা লিগায় বার্সার যে আয় বা স্পটলাইট, সেটা ফ্রেঞ্চ বা ইতালিয়ান পাবে না। রিয়াল-বার্সা একে অন্যকে আরো বেশি প্রতিযোগী বানায়, যার ফলাফলস্বরূপ ইউরোপীয় মাটিতে তাদের আধিপত্য। লা লিগা ছাড়লে সেটি না-ও থাকতে পারে।

সমস্যা কি এখানেই শেষ? না। যদি কাতালোনিয়া স্বাধীন হয়েই যায়, তারা চাইবে বিশ্বকাপ বা আন্তর্জাতিক খেলা খেলতে। ফিফার নিয়মমাফিক আন্তর্জাতিক কাপগুলো খেলতে হলে নিজস্ব লিগ থাকতে হয়। নিজস্ব লিগ খুললে ক্লাব ম্লান হতে বাধ্য। আর ক্লাবের জৌলুশ ধরে রেখে লা লিগা বা অন্য কোথাও খেলতে চাইলে নিজস্ব জাতীয় দলের আন্তর্জাতিক কাপ খেলার আশা বিসর্জন দিতে হবে। ইইউ বলে দিয়েছে, কাতালান স্বাধীনতা স্প্যানিশ সংবিধান না মেনে হলে, তারা কাতালোনিয়াকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত করবে না। এমন পদক্ষেপ উয়েফা নিলে, সেক্ষেত্রে বার্সেলোনার চ্যাম্পিয়ন্স লিগে কী হবে, তা অস্পষ্ট। এদিকে স্পেন সরকার ফুটবলের উপর কী কী করে তা ফিফারও শ্যেনদৃষ্টিতে থাকবে। কারণ ফিফার নিয়মমাফিক কোনো দেশের সরকার যদি সেই দেশের ফুটবলের উপর অযাচিত হস্তক্ষেপ করে, তবে সেই দেশকে কমপক্ষে এক বছরের জন্য বহিস্কার করা হয়। আর তা হলে স্পেন বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়বে!

কাতালান পতাকা হাতে স্বাধীনতাকামী কাতালান জনগণ; Source:The Local Spain

এল ক্লাসিকো হলো ফুটবল রোমান্স। রিয়াল-বার্সেলোনা দ্বৈরথ হলো ইউরোপীয় তথা বিশ্ব ফুটবলের প্রাণ। এতক্ষণের সব আলোচনা হলো কাতালোনিয়া স্বাধীন হলে ফুটবলে তার কী প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে। কিন্তু সব ফুটবল ফ্যানই চায় রাজনৈতিক ময়দানে যা-ই হোক, অটুট থাকুক রিয়াল-বার্সা দ্বৈরথ। রোমাঞ্চকর সেই লড়াইয়ে বুঁদ হয়ে থাকুক বিশ্ব ফি-বছর, এই কামনাই রইল।

ফিচার ইমেজ- The Fantasy Football News

Related Articles