বেলজিয়ামের আধিপত্য নাকি রাশিয়ার চমক?

আজ বাংলাদেশ সময় রাত একটায় রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবুর্গের ক্রেস্তোতভস্কি স্টেডিয়াম (স্পন্সরশিপজনিত কারণে গ্যাজপ্রম এরেনা নামেও পরিচিত) মুখোমুখি হচ্ছে রাশিয়া ও বেলজিয়াম। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে এবারই প্রথম মুখোমুখি হচ্ছে দুই দল।

বিভিন্ন ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট ও প্রীতি ম্যাচে এখন পর্যন্ত সাতবার পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছে বেলজিয়াম ও রাশিয়া। এর মধ্যে দু’টি ম্যাচ ড্র হয়েছে, বাকি পাঁচটি ম্যাচেই জয় পেয়েছে বেলজিয়াম।

শেষ দুইবারই দেখা হয়েছিল ২০১৯ সালে, ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ তথা ইউরোর কোয়ালিফাইং রাউন্ডে। একটি ম্যাচে ৩-১ গোলে এবং অপর ম্যাচে ৪-১ গোলে রাশিয়াকে হারায় বেলজিয়াম। ফলে দৃশ্যত পরিষ্কার ব্যবধানেই এগিয়ে আছে বেলজিয়াম।

এর আগে ২০১৪ বিশ্বকাপ ও ২০০২ বিশ্বকাপেও দুই দল মুখোমুখি হয়েছিল। ২০১৪ বিশ্বকাপে ১-০ ব্যবধানে ও ২০০২ বিশ্বকাপে ৩-২ গোল ব্যবধানে বেলজিয়ামের কাছে পরাজিত হতে হয় রাশানদের। এছাড়া তিনবার নিজেদের মধ্যে প্রীতি ম্যাচও খেলে দল দু’টি।

রাশিয়া – বেলজিয়ামের হেড টু হেড স্ট্যাট; Image Credit: 11 vs 11

বেলজিয়াম

একঝাঁক তারকা নিয়ে ইউরোতে খেলতে এসেছে বেলজিয়াম। এবারের ইউরো টুর্নামেন্ট জয়ের জন্য অন্যতম ফেভারিট হিসেবে ভাবা হচ্ছে বেলজিয়ামকে। বর্তমানে ফিফা র‍্যাংকিংয়ে এক নম্বরে দলে থাকা দলটি যে এই টুর্নামেন্টের জন্য অন্যতম ফেভারিট, সেটা বলাই বাহুল্য।

কিন্তু ইনজুরিও বেশ জোরেসোরেই ছোবল মেরেছে বেলজিয়ান শিবিরে। চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল ম্যাচে চেলসির অ্যান্তোনিও রুডিগারের সাথে ধাক্কা লাগায় নাকের হাড় ও চোখে ব্যথা পান ম্যানচেস্টার সিটির মিডফিল্ডার কেভিন ডি ব্রুইনা, ৬০ মিনিটের মাথায় ব্যথায় কাতর হয়ে মাঠ ছাড়েন তিনি। ছোটখাটো সার্জারিরও প্রয়োজন পড়েছে। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি এখনও, তাই টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে কেডিবিকে না পাওয়ারই সম্ভাবনা বেশি বেলজিয়ামের। ‘রেড ডেভিল’দের কোচ রবার্তো মার্টিনেজ নিজেই কেডিবির অনুপস্থিতির ব্যাপারে নিশ্চিত করেছেন।

২৯ বছর বয়সী এই প্লেমেকারের অনুপস্থিতি ভোগাতে পারে তাদের। পরবর্তী ম্যাচগুলোতে খেলার সময়ও হয়তো প্রোটেকটিভ মাস্ক পড়ে খেলতে নামতে হতে পারে তাকে। ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ মৌসুমে টানা দু’বার প্রিমিয়ার লিগের ‘প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ার’ খেতাবজয়ী ডি ব্রুইনার সার্ভিস যদি শেষ পর্যন্ত সত্যিই না পায় রেড ডেভিলরা, রাশিয়ার বিপক্ষে এই প্লেমেকারকে ছাড়াই ট্যাকটিক্স সাজাতে হবে রবার্তো মার্টিনেজকে।

অভিজ্ঞ প্লেমেকার কেভিন ডি ব্রুইনাকে দেখা না যাওয়ারই সম্ভাবনা বেশি রাশিয়ার বিপক্ষে; Image Credit: Reuters

 

এদিকে গোড়ালির চোট নিয়ে এখনো অস্বস্তিতে ভুগছেন অ্যাক্সেল উইটসেল। জানুয়ারির পর মাঠেই নামেননি তিনি আর। প্রথম ম্যাচে সাইডলাইনে বসে থাকতে হতে পারে তারও।

এডেন আজারও ইনজুরিপ্রবণ। ইনজুরি কাটিয়ে প্রায় ১৮ মাস পর জাতীয় দলের জার্সিতে ক্রোয়েশিয়ার সাথে ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন রেড ডেভিলদের ক্যাপ্টেন। রিয়াল মাদ্রিদের হয়েও বিগত মৌসুম খুব ভালো যায়নি, লা লিগায় ১৪টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র, তাতে ৩টি গোল ও মাত্র একটি অ্যাসিস্ট তার ফর্মহীনতারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। ফিটনেসজনিত কারণেই রাশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে শুরুর একাদশে থাকতে পারেন কি না, থাকলেও পুরো ৯০ মিনিট তাকে খেলতে দেখা যাবে কি না, এ নিয়েও সংশয় রয়েছে। তার পরিবর্তে খেলতে পারেন তারই ভাই থোরগান আজার।

থিবো কোর্তোয়া গোলবারে অটোমেটিক চয়েস। রক্ষণে ডেনায়েরের পাশে দুই অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার ইয়ান ভার্টোঙ্ঘেন ও টোবি অল্ডারওয়াইরেল্ড থাকবেন, এটা অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। মিডফিল্ডে ডি ব্রুইনার ঘাটতি ঘোচাতে ক্যারাসকো, চ্যাডলি, ইউরি টিয়েলম্যানস, ডেন্ডোঙ্কার থাকবে। সম্মুখভাগে এদেন আজারের পা মাঠে কথা না বললে কিংবা শেষমেশ মাঠেই নামতে না পারলে সমস্যায় পড়তে পারে বেলজিয়াম।

তবে রোমেলো লুকাকু দারুণ ফর্মে আছেন। এ মৌসুমে সিরি আ’র সেরা খেলোয়াড় তিনিই। ইন্টার মিলানের জার্সি গায়ে করেছেন ৩০টি গোল ও ১০টি অ্যাসিস্ট। আর রাশিয়া রোমেলো লুকাকুর প্রিয় প্রতিপক্ষ; রাশিয়ার বিপক্ষে কোয়ালিফাইং রাউন্ডের দুইটি ম্যাচ মোট তিনটি গোল করেছেন তিনি।

বেলজিয়ামের দলটি বয়স ও অভিজ্ঞতা দুটোতেই বেশ এগিয়ে; Image Credit: PA graphics

 

রবার্তো মার্টিনেজের বেলজিয়াম স্কোয়াড এবারের ইউরোর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বয়স্ক স্কোয়াড (সবচেয়ে বয়স্ক স্কোয়াড সুইডেনের)। ২৬ জন খেলোয়াড়ের গড় বয়স ২৮.৭ বছর। ২৬ জনের নামের পাশে প্রায় ১৩০০+ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার রেকর্ড রয়েছে। সে হিসেবে এবারের ইউরোর সবচেয়ে অভিজ্ঞ স্কোয়াডও বলা যায় এই দলটিকে। এডেন আজার, থমাস ভার্মায়েলেন, ড্রিয়েস মার্টেনস, ইয়ান ভার্টোঙ্ঘেন, টোবি অল্ডারওয়াইরেল্ড – সবার বয়সই ত্রিশ ছাড়িয়ে গিয়েছে। কেভিন ডি ব্রুইনা, রোমেলো লুকাকু, থিবো কোর্তোয়া – এদের বয়সও ত্রিশ ছুঁইছুঁই।

বেলজিয়ামের এই দলটিকে ডাকা হয় তাদের ‘সোনালি প্রজন্ম’। বেশ কিছু খেলোয়াড়ের জন্য এবারের ইউরোই হয়তো শেষ ইউরো হবে। তাই এবার যদি বেলজিয়াম ইউরো জিততে না পারে, তাহলে দলটির অনেক তারকা খেলোয়াড়ই কোনো মেজর ইন্টারন্যাশনাল ট্রফি না জিতেই হয়তো ক্যারিয়ার শেষ করবেন।

বেলজিয়ামকে রবার্তো মার্টিনেজ বরাবরই একই ফর্মেশনে খেলাচ্ছেন (৩-৪-২-১)। প্রথম ম্যাচেও হয়তো তার ব্যতিক্রম দেখা যাবে না।

রাশিয়ার বিপক্ষে বেলজিয়ামের সম্ভাব্য লাইনআপ হতে পারে এটি; Image Credit: Buildlineup.com

রাশিয়া

রাশিয়া ইউরোতে বরাবরই আন্ডার-অ্যাচিভার। বেশ কয়েকবার গ্রুপপর্ব থেকেই তাদের বিদায় নিতে হয়েছে। ২০০৮ সালে আন্দ্রে আরশাভিনের রাশিয়া সেমিফাইনাল খেলে, যেটা এখনও রাশিয়ার ইউরোর সর্বোচ্চ অর্জন।

রাশিয়ার গোলবারে দাঁড়াবেন অ্যান্টন শুনিন। প্রায় ১৪ বছর ধরে রাশিয়ার এক নম্বর জার্সি পরেছেন আইগর আকিনফেভ। তিনি অবসরে যাওয়ার পর জায়গা করে নিয়েছেন শুনিন। আইগর আকিনফেভের শূন্যতা তিনি কতটুকু পূরণ করতে পারবেন, সেটি একটি প্রশ্ন বটে। তবে শুনিন তড়িৎগতির রিফ্লেক্সের জন্য খ্যাত, বল নিয়ন্ত্রণে তার দক্ষতার ঘাটতি অনেকটা এভাবেই পূরণ হয়ে যায়।

বেলজিয়ামের যদি সেরা খেলোয়াড় হয়ে থাকেন কেভিন ডি ব্রুইনা, তবে রাশিয়ার আছেন আর্টেম জুবা। রাশান অধিনায়ক ও দলের সবচেয়ে সিনিয়র খেলোয়াড় আর্টেম জুবা দারুণ ফর্মে আছেন। শেষ দুই রাশিয়ান প্রিমিয়ার লিগে সর্বোচ্চ অ্যাসিস্ট প্রোভাইডার তিনি। সের্গেই ইভানিস্লেভিচ ও রাশিয়ার কিংবদন্তিতুল্য গোলকিপার আইগর আকিনফিভ অবসরে যাওয়ার পর থেকে তিনিই রাশিয়ার অধিনায়কত্ব করছেন। কোয়ালিফাইং রাউন্ডে ৯টি গোল করেছেন,সতীর্থদের দিয়ে ৫টি গোল করিয়েছেন। একমাত্র হ্যারি কেইনই জুবার থেকে বেশি (মোট ১৭টি) গোলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার জাতীয় দলের হয়ে গোলসংখ্যা ২৯, আর একটি গোল করলে তিনি রাশিয়ার সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ডে ভাগ বসাবেন। আর্টেম জুবার পজিশন হোল্ড করে খেলা, বল পায়ে ধরে রাখা, লং রেঞ্জের শটে দক্ষতা, অন্যকে দিয়ে গোল করানো, কিংবা বিগ চান্স ক্রিয়েট করা কিংবা নিখুঁত ফিনিশিং – এসব মিলিয়েই তিনি রাশিয়ার মূল খেলোয়াড় এই টুর্নামেন্টে। ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা এই খেলোয়াড় ম্যাচ চলাকালীন যেকোনো দলের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠেন।

স্ট্যানিস্লাভ চারচেশভে মাঝেমাঝে ব্যাক-ফাইভ নিয়েও খেলেছেন, তবে ৪-২-৩-১ ফর্মেশনেই রাশিয়া বেশি খেলে থাকে। মিরানচুক-গোলোভিন জুটি মাঝমাঠ থেকে বল তৈরি করে দেন আর্টেম জুবাকে, জুবা নিট অ্যান্ড ক্লিন স্টাইলে বল পাঠিয়ে দেন সোজা প্রতিপক্ষের গোলপোস্টে। ডিফেন্সে ফার্নান্দেজ এবং ইউরি জিরকভ কার্যকরী একটি জুটি গড়ে তোলেন।

রাশিয়াকে বেলজিয়ামের বিপক্ষে খুবই সাবধানী ভূমিকা নিতে হবে। কয়েকদিন আগে প্রীতি ম্যাচে বুলগেরিয়াকে ১-০ গোলে হারিয়েছে রাশিয়া, পোল্যান্ডের সাথে ১-১ গোলে ড্র করেছে। রাশিয়াকে খুব শার্প ও ক্লিনিক্যাল ফুটবল খেলতে দেখা গেছে মাঠে। সেটপিসে গোল করা রাশিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মিডফিল্ডারদের টেকনিকাল অ্যাবিলিটি যথেষ্ট ভালো বলে রেড ডেভিলদের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে ও পজেশন ধরে রেখে ম্যাচ খেলাটাই হতে পারে রাশিয়ার পরিকল্পনা। যেহেতু বেলজিয়াম শুরু থেকেই অ্যাটাকিং ফুটবল খেলবে ধরে নেওয়া যায়, চারচেশভ হয়তো এই ম্যাচে মাঠে ফাইভ-ম্যান-ব্যাক নামিয়ে দিতে পারেন। তবে স্ট্যানিস্লাভ চারচেশভের শিষ্যরা কিন্তু কাউন্টার অ্যাটাকে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেন।

রাশিয়াকে ফাইভ-ম্যান-ব্যাক নিয়ে খেলতে দেখা যেতে পারে; Image Credit: Buildlineup.com

 

এদেন আজারের অফ-ফর্ম এবং কেভিন ডি ব্রুইনার না থাকা বেলজিয়ামের জন্য ‘মাইনাস পয়েন্ট’। ম্যাচে রাশিয়ার অন্যতম লক্ষ্য হবে লুকাকুকে আটকানো, আর বেলজিয়ামের লক্ষ্য থাকবে ডি ব্রুইনা না থাকলেও ছন্দ ধরে রাখা, মাঝমাঠে বাড়তি স্পেস যাতে তৈরি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা। ঘরের মাঠের সুবিধা পাবে রাশিয়া। তবে রাশিয়ার মাঠ ও আবহাওয়া বেলজিয়ামেরও অচেনা নয়। দুই দলই জয় দিয়েই নিশ্চয়ই ইউরোতে শুভ সূচনা করতে চাইবে।

Related Articles

Exit mobile version