এবারের ইউরোতে সবচেয়ে সাদামাটা গ্রুপ বলা যেতে পারে গ্রুপ ‘সি’কে। কারণ, নেদারল্যান্ড ছাড়া বড় কোনো দেশ থাকছে না এই গ্রুপে। তাই ম্যাচগুলো নিয়ে আলোচনা অথবা সমালোচনাও কিছুটা কম হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে গ্রুপ ‘সি’তে থাকা দেশগুলোর মধ্যে নেদারল্যান্ড ছাড়া ইউক্রেন, নর্থ মেসিডোনিয়া ও অস্ট্রিয়া আলোচনা টেবিলের বাইরের দল হলেও ফুটবলের মাঠে এই তিন দেশের শক্তিমত্তা অপেক্ষাকৃত কাছাকাছি। তাই অভাবনীয় কিছু ঘটে না গেলে এই গ্রুপ মূলত তিন দলের লড়াই, দ্বিতীয় স্থানের জন্য।
প্রথমেই নেদারল্যান্ডস। গ্রুপ সি'র অবিসংবাদিতভাবে সেরা দল ও শিরোপা জেতার ক্ষেত্রে অন্যতম দাবিদার। তবে শেষ দুই আয়োজনে তাদের ইতিহাস ঠিক মনে রাখার মতো নয়। ২০১৬ সালে তারা ইউরোর মূলপর্বে খেলার সুযোগই পায়নি, তার আগে ২০১২ সালে তারা বিদায় নিয়েছিল গ্রুপপর্ব থেকেই। তাদের একমাত্র শিরোপা জেতা সাফল্য সেই ১৯৮৮ সালে। এরপর তাদের বড় অর্জন বলতে গেলে ১৯৯২, ২০০০ ও ২০০৪ সালে ইউরোর আসরে তৃতীয় স্থান। তাই এবারে লড়াইয়ের মঞ্চে নামার আগে ইতিহাস ডাচদের সেভাবে সাহস জোগাবে না।
তবে নেদারল্যান্ডের জন্য এই গ্রুপ সহজ হওয়ার পাশাপাশি তাদের বাড়তি সুযোগ দেবে ম্যাচগুলোর ভেন্যুও। গ্রুপপর্বের প্রতিটি ম্যাচই হবে আয়াক্সের মাঠে। নিজের দেশের মাটিতে খেলার পুরো ফায়দা তোলার সুযোগ থাকছে তাদের সামনে। নেদারল্যান্ডের ইউরো-যাত্রা শুরু হবে ইউক্রেনের বিপক্ষে, যে দেশের বিপক্ষে তারা এ পর্যন্ত দুইবার খেলেছে এবং কোনো ম্যাচই হারেনি। তবে এ দু'টি ম্যাচের ভিতর কোনোটিই বিশ্বকাপ বা ইউরোর মতো বড় প্রতিযোগিতার ম্যাচ ছিল না। তাই বলা যায়, বড় মঞ্চে এই দুই দলের মুখোমুখি লড়াইয়ের ঘটনা এই প্রথম।
নিজেদের শেষ আট ম্যাচে ডি বোরের দল হেরেছে মাত্র একটি ম্যাচ। তবে ইউক্রেনের খেলা শেষ আট ম্যাচে জয়ই দুটো ম্যাচে। অবশ্য তাদের শেষ আট ম্যাচের পরিসংখ্যান ঘাটলে দেখা যায়, তারা হেরেছে কম, তবে ড্র করেছে বেশি। বাহরাইন, কাজাখাস্তান, ফিনল্যান্ড ও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের মতো 'ছোট' দল ছাড়াও তারা একবার রুখে দিয়েছে ফ্রান্সকেও। ১-১ গোলে ড্র হওয়া সে ম্যাচে ফ্রান্স সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ করলেও ৯০ মিনিটে ইউক্রেনের রক্ষণে ফাটল ধরাতে পারেনি তারা।
চার দেশের বিপক্ষে ড্র করার তথ্যই বলে দেয়, ইউক্রেন রক্ষণের কায়দা বেশ ভালোই জানে। শেভচেঙ্কোর দল কাউন্টার অ্যাটাকে খেললেও নেদারল্যান্ডের রক্ষণভাগ যদি ডি লিট ও ডি ভ্রাই সামলে রাখেন, তাহলে ইউক্রেনের আক্রমণ নিয়ে ডাচদের বেশি বেগ পোহাতে হবে না। তবে সমস্যা হতে পারে নিজেদের আক্রমণ নিয়েই, কেননা ডিপাই ছাড়া প্রতিপক্ষের ডেরায় ত্রাস ছড়ানোর মতো খেলোয়াড় নেদারল্যান্ডের আক্রমণে কমই আছে। মালেন, ডি ইয়ং, প্রমেসরা আছেন বটে, তবে তারা ডিপাইয়ের মতো গোল করতে অতটা নিয়মিত নন। তাই ইউক্রেন যদি ডিপাইকে কড়া মার্ক করে খেলে, তাহলে গোল করতে ডাচদের জন্য কিছুটা কঠিনই হবে।
নেদারল্যান্ডের পরবর্তী প্রতিপক্ষ অস্ট্রিয়া। ডাচদের বিপক্ষে ইউরোর মঞ্চে দুইবারের দেখায় দুটোতেই হেরেছে অস্ট্রিয়া। আর সর্বশেষ ছয় দেখায় ছয়বারই ম্যাচের ভাগ্য গেছে ডাচদের দিকেই। অস্ট্রিয়ার দলে এবার বেশ কয়েকজন তরুণ খেলোয়াড় আছেন। রয়েছেন লাইমার, সাবিৎজারের মতো নির্ভরশীল খেলোয়াড় ও ডেভিড আলাবার মতো অভিজ্ঞ দলনেতা।
কিন্তু সব মিলিয়ে এই দলটির সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। গত ইউরোতেও তারা পর্তুগালের মতো দলকে জয়ের হাত থেকে বঞ্চিত করার পর বাকি ম্যাচগুলোতে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী খেলতে পারেনি। তাই সেবার গ্রুপ পর্ব থেকে কোনো ম্যাচ না জিতেই বিদায় নিতে হয়েছিল তাদের। ২০১৬ সালের ইউরোর পর থেকে নিজেদের শক্তিমত্তার কাছাকাছি দলের বিপরীতে অস্ট্রিয়া কিছুটা লড়তে পারলেও বড় দলের বিপক্ষে তাদের পারফরম্যান্স বেশ নাজুক। তাই দুই দলের পারফরম্যান্স ও ইতিহাস বিবেচনার এ ম্যাচেও ডাচবাহিনী বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে।
এ গ্রুপের শেষ দল নর্থ মেসিডোনিয়া, যারা নেদারল্যান্ডের সাথে কখনো জেতেনি। দুই দলের শক্তি ও সামর্থ্যে যোজন যোজন পার্থক্য। তবুও ডাচদের জন্য এ ম্যাচ সহজ প্রতিপক্ষ ভেবে গা-ছাড়া পারফরম্যান্স দেবার সুযোগ নেই।
নর্থ মেসিডোনিয়া ডাচদের সাথে গ্রুপপর্বের একদম শেষ ম্যাচ খেলবে। এ সময়ে গ্রুপের অবস্থা অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যায়। অস্ট্রিয়া ও ইউক্রেন নর্থ মেসিডোনিয়া থেকে শক্তিতে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও এই তিন দলকে আসলে মধ্যমসারির কাতারেই ফেলতে হবে। তাই নেদারল্যান্ড যদি তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পারফরম্যান্স করতে পারে, তাহলে এই গ্রুপের লড়াই হবে মূলত এই তিন দলেরই।
মুখোমুখি শেষ পাঁচ ম্যাচে ইউক্রেন কোনো ম্যাচ না হারলেও মেসিডোনিয়ার সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে সেই অর্থে এগিয়েও নেই। ২০০৪ সালে নর্থ মেসিডোনিয়া ইউক্রেনকে ইতোমধ্যে একবার হারিয়েছে। আর মধ্যমসারির দলের বিপক্ষে নর্থ মেসিডোনিয়া গোরান পান্দেভ ও আলেক্সান্দার ত্রাকোভস্কির গোলে বরাবরই বড় ব্যবধানে জিতেছে।
অন্যদিকে, ২০১৯ সালে ইউরোর বাছাইপর্বে নর্থ মেসিডোনিয়ার সাথে দুইবার দেখা হয়েছে অস্ট্রিয়ার। আর দুই ম্যাচেই তাদেরকে হারিয়েছে অষ্ট্রিয়া। তাই মুখোমুখি লড়াই ও সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স বিচারে এ ম্যাচে এগিয়ে থাকবে ডেভিড আলাবার দেশই।
কিন্তু ইউক্রেন ও অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে কোনো ম্যাচে নর্থ মেসিডোনিয়া যদি কোনোভাবে জয়ের দেখা পায়, তবে তারা তৃতীয় স্থানের জন্য হলেও শেষ একটা চেষ্টা করবে। এবং সে ম্যাচে তারা মুখোমুখি হবে ডাচ-বাহিনীর। নেদারল্যান্ডের সাথে তারা ফেভারিট নয়, তাই জেতার আশা না করে তাদের লক্ষ্য হতে পারে এই ম্যাচে অন্তত এক পয়েন্ট নিয়ে ফেরা। এবং বড় দলের বিপক্ষে এমন খেলার কৌশল একটাই; ৯০ মিনিটজুড়ে আক্রমণের চাইতে রক্ষণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
কোনো অঘটন না ঘটলে এই গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দাবিদার নেদারল্যান্ডসই। পারফরম্যান্স ও ইতিহাস বিবেচনায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানের দেখা যাওয়ার কথা অস্ট্রিয়া ও ইউক্রেনের। তাই এই গ্রুপের দিকে গোটা দুনিয়ার নজর থাকার সম্ভাবনা যথেষ্টই কম। তাছাড়া ইউরোর মূল মঞ্চে প্রথমবারের মতো খেলা নর্থ মেসিডোনিয়ার খেলোয়াড়দের বড় আসরে খেলার অভিজ্ঞতাও বেশ কম। তাছাড়া মাঠের পারফরম্যান্স ছাড়া অভিজ্ঞতাও খেলার মোড় ভোজবাজির মতো পালটে দিতে পারে। তাই চমকপ্রদ কোনো পারফরম্যান্স উপহার দিতে না পারলে নিজেদের প্রথম আসরে তাদের গ্রুপে চার দলের মধ্যে চতুর্থ হয়েই খুশি থাকতে হবে।
তবে ছোট বা অখ্যাত দলের হুট করে গর্জে ওঠার নমুনা নতুন নয়। গত মৌসুমেই যেমন চমকে দিয়েছিল আইসল্যান্ড। গ্রুপপর্বে দ্বিতীয় হয়ে শেষ-ষোলোতে ইংল্যান্ডের মতো পরাশক্তিকে হারিয়ে তারা পৌঁছেছিল কোয়াটার ফাইনাল পর্যন্ত। আর ওয়েলসের জন্য সেবারের ইউরো ছিল স্বপ্নের মতো। বেলজিয়াম ও হাঙ্গেরিকে হারিয়ে তারা গিয়েছিল সেমিফাইনাল পর্যন্ত!
হয়তো এই গ্রুপে পরাশক্তি দলগুলোর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখা যাবে না। কিন্তু দিনশেষে যদি দেখা যায়, কোয়াটার ফাইনাল বা সেমিফাইনালে এই গ্রুপ থেকেই কোনো অখ্যাত দল মোকাবেলা করছে পর্তুগাল-ইংল্যান্ড-ফ্রান্সের মতো প্রতাপশালী দলের সাথে, অবাক হবেন না যেন!
This article is in Bangla language. It is about the analysis for group C in EURO 2020. The group includes Netherlands, Ukraine, Austria, and North Macedonia.
Featured Image Credit: UEFA
Background Image Credit: Foot The Ball