করোনাভাইরাস প্রকোপে এক বছর পর ইউরোপজুড়ে শুরু হয়েছে ইউরো ২০২০। এক বছর পেছানোর কারণে দর্শকদের যে অধীর প্রতীক্ষা ছিল টুর্নামেন্টটি ঘিরে, এখন পর্যন্ত তা পূরণ করেই চলেছে ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের এ লড়াই।
ইউরোর দ্বিতীয় রাউন্ডের শেষ দুই দিন ও তৃতীয় রাউন্ডের প্রথম দিন দেখেছে দুর্দান্ত সব ম্যাচ, পর্দা উঠেছে দারুণ কিছু নাটকের। রোর বাংলার ইউরো আয়োজনের তৃতীয় পর্বে থাকছে ১৮-২০ জুনের ম্যাচগুলোর সেরা সব মুহূর্ত।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন এরিকসেন
ফিনল্যান্ডের বিপক্ষে ডেনমার্কের ম্যাচের প্রথমার্ধের শেষ দিকের কথা। থ্রো-ইন থেকে বলটা রিসিভ করতে এগুচ্ছিলেন ডেনমার্কের ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন। বলটা তার কাছে এলো বটে, কিন্তু ততক্ষণে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের কারণে লুটিয়ে পড়েছেন এই ড্যানিশ তারকা।
থমকে যায় পুরো ফুটবল বিশ্ব। সবার তখন একই প্রার্থনা, এরিকসেন সুস্থ হয়ে উঠুন।
মাঠেই চলল যমে-মানুষে টানাটানি, সেখানে জয়টা মানুষের। এরিকসেনের জ্ঞান ফিরল, নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে।
সেখানেই তার হৃৎপিণ্ডে সফলভাবে বসানো হয়েছে ডিফিব্রিলিটর ইমপ্ল্যান্ট। এটি ব্যবহার করেই হার্ট অ্যাটাকের পরও খেলছেন নেদারল্যান্ডের ডেলি ব্লিন্ড।
ডিফিব্রিলিটর ইমপ্ল্যান্ট বসানোর পর শুক্রবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান এরিকসেন। ইউরোতে আর মাঠে নামতে না পারলেও দলকে উৎসাহ দেবেন পাশে থেকেই, এমনটিই জানিয়েছেন ইন্টার মিলানের এ মিডফিল্ডার।
এই ইতালিকে থামাবে কে?
২০১৮ বিশ্বকাপে পৌঁছাতে না পারার পর ইতালি দলের দায়িত্ব পেয়েছিলেন সাবেক ম্যানচেস্টার সিটি ম্যানেজার রবার্তো মানচিনি। দায়িত্ব নিয়েই দলে এনেছেন দারুণ পরিবর্তন, চিরাচরিত রক্ষণাত্মক ফুটবলের খোলস ছেড়ে আজ্জুরিদের পায়ে এখন বসে শৈল্পিক আক্রমণাত্মক ফুটবলের পসরা।
গ্রুপ-এ'তে নিজেদের শেষ ম্যাচে ওয়েলসকে ১-০ গোলে হারিয়ে ইতালি তাদের জয়ের ধারা বাড়িয়ে নিয়েছে ১১ ম্যাচ পর্যন্ত, এই ১১ ম্যাচে এক গোলও খায়নি তারা। শেষ ৩০ ম্যাচে অপরাজিত তারা, ইউরোর গ্রুপপর্ব তারা শেষ করেছে ৩ ম্যাচে ৩ জয় নিয়ে।
এই তিন ম্যাচে ইতালি গোল করেছে ৭টি, খায়নি একটিও। এই তিন ম্যাচ মিলিয়ে তাদের বিপক্ষে প্রত্যাশিত গোল ছিল মাত্র ১.৩টি, যা তাদের দারুণ আক্রমণের পাশাপাশি দুর্দান্ত রক্ষণেরও প্রমাণ দেয়।
ইউরো শুরুর আগে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সত্ত্বেও ফেভারিটদের তালিকায় ইতালিকে জায়গা দেননি অনেকেই। কিন্তু গ্রুপপর্বেই অনেক 'হট ফেভারিট' যেখানে ধাক্কা খেয়েছে, সেখানে ইতালি অদম্য। গ্রুপপর্ব শেষে ফেভারিটদের তালিকায় তাই হয়েছে রদবদল, নিজেদের জায়গা নিজেরাই বানিয়ে নিয়েছে ইতালি।
নখদন্তহীন ইংল্যান্ড
দারুণ প্রতিভাবান দল নিয়ে এবারের ইউরো খেলতে এসেছিল গ্যারেথ সাউথগেটের ইংল্যান্ড। ডিফেন্স থেকে অ্যাটাক - সব জায়গায়ই নামীদামী তারকাদের ভিড়ে এবার অন্তত বুকে আশা নিয়েই ইংল্যান্ড সমর্থকরা বলতে পেরেছিলেন, ‘ইটস কামিং হোম!’
কেবল ইংল্যান্ড সমর্থকরাই নয়, ফুটবল পণ্ডিতদের মতেও ইংলিশরা ছিল হট ফেভারিট। কিন্তু সেই তকমা মুখ থুবড়ে পড়েছে গ্রুপপর্বের দুই ম্যাচ শেষেই।
প্রথম ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে কষ্টেসৃষ্টে জয় পেলেও দ্বিতীয় ম্যাচে সেটি হয়নি। স্কটল্যান্ড এবারের ইউরোর দলগুলোর মধ্যে র্যাংকিংয়ে রয়েছে তৃতীয় সর্বনিম্ন স্থানে, সেই স্কটিশদের বিপক্ষেই গোলশূন্য ড্র করেছে থ্রি লায়ন্সরা।
গোলশূন্য ড্র হতেই পারে, কোনো দল মুহূর্মুহূ আক্রমণ করলেও প্রতিপক্ষ সেগুলো ফিরিয়ে দিয়ে বের করে নিতে পারে এক পয়েন্ট। কিন্তু স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ইংল্যান্ড যেন ছিল নখদন্তহীন সিংহ; পুরো ম্যাচে একবারও মনে হয়নি, এই বুঝি গোল পেল ইংল্যান্ড!
পরিসংখ্যান বলছে, ইংল্যান্ডের গোল করা উচিত ছিল ১.৪৫টি। কিন্তু ইংল্যান্ড গোলেই শট নিতে পেরেছে মাত্র একটি!
তাতে দায় আছে কোচ সাউথগেটেরও। পুরো মৌসুম দুর্দান্ত খেলা জ্যাক গ্রিলিশ ও জ্যাডন স্যাঞ্চোকে বেঞ্চে বসিয়ে তিনি খেলিয়েছেন মৌসুমজুড়ে অনিয়মিত রাহিম স্টার্লিংকে। সেই স্টার্লিং স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ছিলেন একদমই গড়পড়তা। তাকে উঠিয়ে নেয়াই যখন ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত, তখন ফিল ফোডেনকে তুলে গ্রিলিশকে নামান সাউথগেট।
শেষ পর্যন্ত পুরো ম্যাচ খেলেন স্টার্লিং, বেঞ্চেই পচে মরেন স্যাঞ্চো। আর তাতে মরে ইংল্যান্ডের তিন পয়েন্টের আশাও।
গোল মিসের মহড়ায় বিপদে স্পেন
রিয়াল মাদ্রিদের কোনো খেলোয়াড় ছাড়াই স্পেন দল ঘোষণা করায় কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন স্পেন কোচ লুইস এনরিকে। সেই সমালোচনার কড়া জবাবটা মাঠেই দিতে পারতেন, কিন্তু পারলেন না স্ট্রাইকারদের ব্যর্থতায়। আরও নিখুঁত করে বললে, আলভারো মোরাতার ব্যর্থতায়।
প্রথম ম্যাচে একের পর এক সুযোগ নষ্ট করেছিলেন মোরাতা, দ্বিতীয় ম্যাচে গোল পেলেও সেই মিসের মহড়া বজায় রেখেছেন তিনি। পোল্যান্ডের বিপক্ষে স্পেনের প্রত্যাশিত গোল ছিল ২.৯৫টি; কিন্তু তারা দিতে পারে মাত্র একটি, সেটিও ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির কল্যাণে।
গোলের দুইটি বড় সুযোগ মিস করেন মোরাতা, অর্থাৎ দুই ম্যাচ মিলিয়ে মোরাতা সুযোগ নষ্ট করেছেন তিনটি। সঙ্গে আছেন ভিয়ারিয়ালের হয়ে দুর্দান্ত মৌসুম কাটানো জেরার্ড মোরেনোও, তিনিও বড় সুযোগ মিস করেছেন তিনটি। এমনকি কাজে লাগাতে পারেননি একটি পেনাল্টিও!
এসব মিলিয়ে দুই ম্যাচে যথাক্রমে ৮৫ ও ৭৬ শতাংশ বল পায়ে রেখে এবং ১০টি বড় সুযোগ তৈরির পরও স্প্যানিশরা গোল করতে পেরেছে মাত্র একটি!
আর এতে দুই ম্যাচ শেষে দুই পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ-ই'র তিন নম্বরে আছে লা রোজারা। শেষ ম্যাচে স্লোভাকিয়ার বিপক্ষে জয় না পেলে গ্রুপপর্বেই ইউরো যাত্রা শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এনরিকের শিষ্যদের। সেটি হলে আবারও সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হতেই হবে এই স্প্যানিশ কোচকে।
বিশ্বজয়ীদের রুখে দিল হাঙ্গেরি
গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স জয় পেয়েছিল জার্মানির বিপক্ষে। আগের ম্যাচেই পর্তুগালের কাছে ৩-০ ব্যবধানে উড়ে যাওয়া হাঙ্গেরির বিপক্ষে ম্যাচে ফরাসিরাই ফেভারিট, সে আর আলাদা করে বলার দরকার পড়ে না।
কিন্তু ডেভিড আর গোলিয়াথের লড়াইয়ে ফল ফেভারিটদের পক্ষে গেল না, বরঞ্চ এক সময় এক গোলে পিছিয়ে থাকা ফ্রান্স আঁতোয়া গ্রিজমানের গোলে ড্র করে।
হাঙ্গেরির গোলের ওপর ঠিক আক্রমণের বন্যা বইয়ে দিতে পারেনি ফরাসিরা, কিন্তু যা আক্রমণ করেছে, তাতে হিসেবমতে প্রত্যাশিত গোল প্রায় দু'টি। উল্টোদিকে, হাঙ্গেরির প্রত্যাশিত গোল ছিল পুরো ম্যাচে মাত্র ০.৬৬।
কিন্তু প্রথমার্ধ শেষে যোগ করা সময়ে আতিলা ফিওলার দারুণ এক গোলে এগিয়ে যায় হাঙ্গেরিই।
হাঙ্গেরির ঘরের মাঠ পুসকাস স্টেডিয়ামই এবারের ইউরোর একমাত্র মাঠ, যেখানে করোনাভাইরাসজনিত বিধিনিষেধ নেই, পুরো গ্যালারিতেই থাকছে দর্শক। ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচে উপস্থিতি ছিল প্রায় ৫৬ হাজার।
৫৬ হাজার হাঙ্গেরিয়ানের গর্জনের সামনে দারুণ উদ্যমে খেলে যায় স্বাগতিকরা। গ্রিজমানের গোলে সমতায় ফিরলেও আর গোল করা হয়নি ফ্রান্সের। তাতে দুই পয়েন্ট খুইয়েছে তারা, তবে এক পয়েন্ট তুলে নিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার আশাটা বাঁচিয়ে রেখেছে হাঙ্গেরি।
মরার ওপর খাড়ার ঘা হিসেবে এই ম্যাচেই চোটে পড়ে ইউরো থেকে ছিটকে গেছেন ফ্রান্সের উইঙ্গার উসমান দেম্বেলে। চোট থেকে সেরে উঠতে দুই মাস লাগতে পারে তার।
পুরনো জার্মানির ঝলক
প্রথম ম্যাচে ফ্রান্সের কাছে হারের পর পর্তুগালের বিপক্ষে জয় ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না জার্মানির। আর সেটিই তুলে নেয় তারা; সেটাও এমন এক ভঙ্গিতে, যা মনে করিয়ে দেয় বিশ্বজয়ী সেই জার্মান দলের কথা।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর গোলে শুরুতেই পিছিয়ে পড়লেও ইস্পাতকঠিন জার্মান মানসিকতা দিয়ে ম্যাচে ফেরে জার্মানি। যদিও রুবেন দিয়াস ও রাফায়েল গুরেইরো - দুই পর্তুগিজ ডিফেন্ডারের আত্মঘাতী গোলেই ম্যাচে লিড নেয় তারা, কিন্তু সেটি ছিল ক্রমাগত আক্রমণেরই ফসল।
দ্বিতীয়ার্ধে কাই হাভের্টজ ও রবিন গোসেন্সের গোলে ৪-১ ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়ার পর আবারও জার্মানির হাতে নতুন কোনো রেকর্ড গড়া হবে কি না, এমন প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল বটে। তবে রোনালদোর অ্যাসিস্টে ব্যবধান ৪-২ করেন ডিয়োগো জোটা। এরপর আর গোল হয়নি ম্যাচে।
কিন্তু এই ম্যাচে জার্মানি জেতায় গ্রুপ এফ থেকে দ্বিতীয় পর্বে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে চার দলেরই। শেষ ম্যাচে পর্তুগাল ফ্রান্সের কাছে হারলে এবং হাঙ্গেরি জার্মানিকে হারিয়ে দিলে বরং বাদ পড়তে পারে এবারের ইউরোর অন্যতম ফেভারিট পর্তুগালই।
তবে শেষ পর্যন্ত কী হয়, সেটির জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে শেষ রাউন্ডের জন্যই।
This article is in Bangla language. It is about the third three days highlights of euro 2020. Necessary hyperlinks and images are attached in the article.
Featured image: Cambridgeshire FA
Background Image: UEFA