Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইউরোপিয়ান ফুটবল কিংবা সৌদি প্রো লিগের উত্থান

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পাট চুকিয়ে সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসেরে পাড়ি জমিয়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো বলেছিলেন,

“আমি সৌদি আরবে বেশ খুশি। এখানেই এখন থাকছি আমি। তারা যে পরিকল্পনা করে এগোচ্ছে, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে আগামী পাঁচ বছরে সৌদি লিগ শীর্ষ পাঁচ লিগের মধ্যে থাকবে।” 

ইউরোপ থেকে সৌদি আরবের ক্লাবে যাওয়া নিয়ে রোনালদোকে অনেকেই হাসিঠাট্টার পাত্র বানিয়েছিলেন। এরপর সৌদি আরবের লিগের প্রশংসা করা নিয়ে আরেক দফায় তামাশার পাত্র বনেছিলেন তিনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের তাদের খেলোয়াড় কেনা এবং ইউরোপের অর্থ বিনিয়োগ করা নিয়ে অনেকের ধারণা এখন একেবারে পালটে গেছে। সৌদির এই পথে একসময় চীনের মতো দেশও হেঁটেছিল। তবে সৌদি আরব এবার একেবারে অঙ্ক কষে মাঠে নেমেছে। চীনের ফুটবল লিগের বিনিয়োগ ব্যর্থ হবার পরে সৌদির তাদের কৌশল তাহলে কী?

আল নাসেরের জার্সিতে রোনালদো; Image Credit: REUTERS/Ahmed Yosri

সৌদির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান একাই তার জাতিকে বদলে দিয়েছেন। বিশ্বের কাছে তার দেশকে সমৃদ্ধিশীল উন্নত একটা রাস্ট্র হিসেবে তুলে ধরার পেছনে তার একক অবদান এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে তিনি বুঝেছিলেন, একটি উন্নত দেশ হতে গেলে শুধু অর্থ, বাণিজ্য ও শিক্ষার হার উন্নত করলেই চলবে না। কোনো নির্দিষ্ট দেশকে সফল ও পুরো মহাবিশ্বের সামনে তুলে ধরতে খেলাধুলাও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সৌদি সরকার আগামী ২০৩০ বিশ্বকাপ সেখানো আয়োজন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এমনকি কাতার বিশ্বকাপে মোহাম্মদ বিন সালমান ফিফার প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর পাশে বসে ম্যাচও উপভোগ করেছেন। আর্জেন্টিনার সাথে বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ জেতার পর সৌদি আরবে ঘোষণা দিয়েছিলেন সরকারী ছুটি।

তবে ২০৩০ না হলেও ২০৩৪ বিশ্বকাপকেও পাখির চোখ করে রেখেছে তারা। আর এসব কিছুই একটা কারণে। ফুটবলের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক তৈরি করা এবং জনগণের মাঝে এই খেলার আমেজ ছড়িয়ে দেওয়া। তবে এই কাজে শুধুমাত্র বিশ্বকাপ আয়োজন করলেই ফলাফল আসবে না, পাশাপাশি স্থানীয় ফুটবল লিগকেও সৌদি আরব ছাড়াও ইউরোপের মঞ্চে জনপ্রিয় করতে হবে।

সম্প্রতি সৌদি আরব তাদের প্রথম সাড়ির ফুটবল লিগ সৌদি প্রো লিগকে ঢেলে সাজানোর কাজে নেমেছে। দেশের সার্বভৌম সম্পদ তহবিল পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড বা পিআইএফ সৌদির জায়ান্ট চার ক্লাব আল-নাসের, আল-হিলাল, আল-আহিল, আল-ইতিহাদের মালিকানা কিনে নিয়েছে। এই পিআইএফ পূর্বে নিউক্যাসল ইউনাইটেডের আশি শতাংশ শেয়ার কিনে রেখেছিল।

পিআইএফ সৌদির জায়ান্ট চার ক্লাব আল-নাসের, আল-হিলাল, আল-আহিল, আল-ইতিহাদের মালিকানা কিনে নিয়েছে; Image Source: Twitter

সৌদি লিগের এই জায়ান্ট চার ক্লাবের মালিকানা পরিবর্তনের সাথে সাথেই ক্লাবগুলো তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করে। প্রথমেই আল-নাসের হাত বাড়ায় রোনালদোর দিকে। প্রায় একই সময়েও মেসিকেও আল-হিলাল পাহাড় সমান অর্থের প্রস্তাব দিয়েছিল। মাত্র দুই বছর সৌদির মাটিতে খেলে মেসি পেতেন ৪০০ মিলিয়ন ইউরো। মেসি এবং রোনালদোকে এমন বড় অংকের অর্থের প্রস্তাব দেওয়ার কারণ ছিল তাদের খ্যাতি। মেসি এবং রোনালদোর নামই সৌদি প্রো লিগের মর্যাদা এক লাফে কয়েক ধাপ উপরে তুলে দিত। যদিও মেসি এই প্রস্তাবে রাজি না হলেও রোনালদো ঠিকই এসেছেন সৌদি আররে। আর এই এক তারকাই লিগের চেহারাই পালটে দিয়েছে। তবে শুধু এই চার ক্লাব তো পিআইএফের দৌলতে পালটে গেল। তাহলে বাকি ক্লাবদের কি হবে? সৌদির বাকি ক্লাবগুলোতে বিভিন্ন কোম্পানি বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে অথবা কিনে নেবে একটি নির্দিষ্ট মালিকানা। তাই বিগ ফোর ছাড়াও বাকি ক্লাবগুলোতেও বদল আসন্ন।

এরপর রোনালদোর পর ব্যালন ডি’অর জয়ী তারকা করিম বেনজেমা, বিশ্বকাপ এবং চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা মিডফিল্ডার কান্তে, ডিফেন্ডার কলিদু কুলিবালি, গোলরক্ষক মেন্ডি একে একে পাড়ি জমিয়েছেন সৌদির নানা ক্লাবে। শুধু কি এরাই? মাত্র ২৬ বছর বয়সী মিডফিল্ডার রুবেন নেভেস, সদ্য চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল খেলা ব্রজোভিচ, সেল্টিকের উইঙ্গার জোটা, ফিরমিনো, মিলেঙ্কোভিচ-স্যাভিচদের মতো অনেক তরুণ এবং তারকা খেলোয়াড় সৌদির ফুটবলের হয়ে নাম লিখিয়েছেন। এদের সবার চুক্তি যেমন চোখ কপালে ওঠার মতো, সাথে তাদের বার্তাও বেশ পরিষ্কার: সৌদি আরব বিশ্ব ফুটবলে আলোড়ন তুলতেই ফুটবলে নতুনভাবে নাম লেখাতে যাচ্ছে।

করিম বেনজেমা আল-ইতিহাদের সাথে তিন বছরের চুক্তি করেছেন; Photo Source: Ittihad/Twitter

সৌদি আরবের ক্রীড়ামন্ত্রী সরাসরি ঘোষণা দিয়েই রেখেছেন, সৌদি প্রো লিগকে তারা বিশ্বের সেরা লিগের একটিতে রূপান্তর করতে চান। সৌদি প্রো লিগকে বিশ্বের সেরা লিগের কাতারে নিতে হলে লিগের মার্কেট ভ্যালুকেও বাড়াতে হবে। এজন্য তারা লিগের মার্কেট ভ্যালু আট বিলিয়ন সৌদি ডলারে নিতে চায়, যা বর্তমান মার্কেট ভ্যালুর প্রায় তিনগুণ। আর মার্কেট ভ্যালু বাড়ানোর জন্য প্রধান কাজ হচ্ছে ইউরোপের তারকা ফুটবলাদের ধরে ধরে সৌদি প্রো লিগের ক্লাবে নিয়ে আসা। তারকা ফুটবলার লিগে থাকার অর্থ ইতোমধ্যেই পেয়ে গেছে সৌদি প্রো লিগ। রোনালদো আসার পরে প্রো লিগের ম্যাচের টিকেটের বর্তমান মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫০ সৌদি রিয়াল, যেখানে পূর্বে টিকেটের মুল্য ছিল ১০ সৌদি রিয়ালের আশেপাশে।

এ পর্যন্ত তো সবই হলো, এমন পথে একসময় চীন এবং জাপানিজ হেঁটেও ব্যর্থ হবার নজির রয়েছে। সেক্ষেত্রে সৌদি আরব নতুন কী করছে?

তারা ব্যবহার করছে দুটো ভিন্ন কৌশল। প্রথমত এমন কিছু তারকা ফুটবলার তারা আনবে, যারা ইতোমধ্যে বিশ্বসেরা। প্রো লিগে দুই থেকে তিন মৌসুম খেললেও যাদের গোল বা পারফরম্যান্সের কোনো কমতি হবে না। এবং এমন ফুটবলার মাঠে পারফর্ম বা অনুশীলন করতে দেখে স্থানীয় ফুটবলাররা আরও বেশি আগ্রহী যেমন হবে, তেমনি হাতে-কলমে শিখতেও পারবে। 

দ্বিতীয় কৌশল হচ্ছে অর্থের বিনিময়ে কার্যকর খেলোয়াড় নিয়ে আসা যারা প্রো লিগে আগামী চার থেকে পাঁচ মৌসুম অনায়াসে খেলে যেতে পারবে। পূর্বে এখানেই ভুল করেছিল চাইনিজ ফুটবল লিগ। ইউরোপ থেকে তারা একেবারে ফুরিয়ে যাওয়া খেলোয়াড় দলে ভেড়াচ্ছিল অথবা এমন কয়েকজন ফুটবলারকে তারা চড়া দামে কিনেছিল যাদের কাছে ফুটবল ক্যারিয়ার গড়া থেকে অর্থের চাহিদা বেশি। কালেভদ্রে অস্কারের মতো তারকারা ইউরোপের মঞ্চ ছেড়ে চাইনিজ লিগে গেছে বটে। কিন্তু এই এক থেকে চারজনের যাওয়াতে তাদের লিগে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি।

এখানেই সৌদির কৌশল ভিন্ন। তারা এমন কিছু খেলোয়াড়ও চড়া দামে নিতে রাজি যাদের পারফরম্যান্স এবং খ্যাতিতে ক্লাবের নামডাক বাড়বে। প্রথম উদাহরণ উলভসের পর্তুগিজ মিডফিল্ডার রুবেন নেভেস। উলভসের সাথে তার চুক্তি প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছিল। ক্লাব ছাড়বেন সেটা অনুমেয়ই ছিল। এ জন্য আল-আহিলের দেওয়া ৫০ মিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাব উলভস প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি। কারণ নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে এই অর্থ ক্লাবটির প্রয়োজন ছিল। তেমনি বাৎসরিক চড়া বেতনে সায় দিয়েছেন নেভেস নিজেও। ইন্টারের ব্রজোভিচ এবং লাজিও এর মিলেঙ্কোভিচ-স্যাভিসের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা ঘটেছে একইরকম। খেলোয়াড়দের চুক্তি শেষের দিকে, অথবা তারা নতুন চুক্তি করতে রাজি না। এর মাঝে সৌদির বিভিন্ন ক্লাব তাদের বড় অঙ্কের অর্থের প্রস্তাবও দিয়েছে। যে প্রস্তাব ক্লাব বা খেলোয়াড় কেউই ফেলতে পারেনি।

মাত্র ২৬ বছর বয়সেই ইউরোপিয়ান ফুটবলকে ছেড়ে গেলেন রুবেন নেভেস; Image Source: Saudi Gazette report

তবে এক্ষেত্রে লাভ হচ্ছে ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোকেও। অঢেল অর্থ এবং সুযোগ সুবিধার পরও চেলসির পারফরম্যান্সে চলছিল দৈন্যদশা। সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমের ভরাডুবির পর টড বহেলি চাচ্ছিলেন আবার নতুন করে ঢেলে দলকে সাজাতে। অর্থ কোনো সমস্যা নয়, তারা চাইলেই খেলোয়াড় কিনতে পারবেন। কিন্তু এএফপির নিয়ম তো রয়েছে। আয় এবং ব্যয়ের সমতা না আনতে পারলে তাদের উপর দলবদলের নিষেধাজ্ঞা ধেয়ে আসবে। তাই প্রয়োজন ছিল খেলোয়াড় বিক্রি এবং তাদের চড়া বেতন বাঁচানোর। কুলিবালি, মেন্ডি, কান্তে, হাকিম জিয়েশরা একেবারে ফুরিয়ে গেছেন এমন নয়। কিন্তু চেলসির কাছে তাদের চাহিদা ফুরিয়েছে। কিন্তু সৌদি প্রো লিগের জন্য এমন খেলোয়াড় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই চেলসি থেকে বেশ কয়েকজনকে দলে ভিড়িয়েছে সৌদি প্রো লিগের ক্লাবগুলো। এক্ষেত্রে লাভও হয়েছে উভয় দিকে। যদিও পিআইএফ এবং চেলসির আরেক মালিকানা ক্লিয়ারলেক ক্যাপিটালের সাথে সুসম্পর্কের বিষয়ও উহ্য রাখা যায় না। তবে দুই পক্ষের চাহিদা তো পূরণ হয়েছে।

নিজেদের দলকে নতুনভাবে সাজানোর মিশনে নেমেছে লিভারপুলও। হেন্ডারসন এবং ফাবিনহো ক্লাব ছেড়ে যেতে পারেন নতুন মৌসুমেই। এক্ষেত্রে লিভারপুলের ত্রাণকর্তা হয়ে আসতে পারে সৌদি প্রো লিগ। কারণ হেন্ডারসন এবং ফাবিনহোর মতো ‘আইকন’ প্রো লিগে বিশেষভাবে প্রয়োজন। 

সৌদির করা পরিকল্পনা ঠিকভাবে এগোলে যেমন তাদের লাভ, তেমনি এভাবে চললে ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোর ব্যাঙ্ক ব্যালান্সও ফুলে ফেপে উঠবে। কারণ উলভসের মতো মধ্যমসারির দল সবসময়ই চায় তাদের তারকা ফুটবলার অথবা চুক্তি শেষের দিকে থাকা ফুটবলারকে কিছু অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দিতে। আর এই অর্থ দিতে সৌদি প্রো লিগের ক্লাব এক বাক্যে তৈরি। তাছাড়া তার চুক্তি করতে এলেই তো অর্থের ঝাঁপি খুলে বসে।

সৌদির ক্রাউন প্রিন্স চাচ্ছেন ইউরোপিয়ান ফুটবলের মাঝে সৌদি আররের নাম জড়িয়ে ফেলতে; Photo Credit: SPA/AFP via Getty Images

তবে শুধু খেলোয়াড় নয়, ক্লাবের কোচ হিসেবে সেখানকার ক্লাবগুলো নিয়েছে নুনো এসপিরিতো সান্তো, রুডি গার্সিয়া, স্টিভেন জেরার্ড এবং স্লাভেন বিলিকদের মতো কোচদের। সম্প্রতি রাফা বেনিতেজও সোদি প্রো লিগ থেকে অফার পেয়েছেন। তবে ইউরোপ ছেড়ে চলে যাওয়া এখন ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে বেশ সংশয়ে আছে তিনি। যদিও চোখধাঁধাঁনো প্রস্তাবে সায় দেননি অনেকেই। মেসি আল-হিলারের বাৎসরিক ৪০০ মিলিয়ন চুক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। না বলে দিয়েছেন লুকা মদরিচ, ইল্কায় গুন্দোয়ানের মতো ফুটবলারও। তবে সৌদি প্রো লিগ নিজেদের চেহারা খুব শীঘ্রই বদলে ফেলবে। কারণ সৌদির উচ্চাকাঙ্ক্ষা যেমন বৃহত্তর তেমনি ক্রমে ক্রমে তারা সাহসী হয়ে উঠছে। নিজেদের ফুটবল সংস্কৃতির পরিমার্জিত করতে তাদের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর সাহসিকতাই প্রয়োজন।

তাই ইউরোপ পাট চুকিয়ে ফেলা ফুটবলাদের জন্য যেমন সৌদি আরব নতুন বৃদ্ধাশ্রম হয়ে উঠছে, তেমনি সেখানে তারার মেলা গড়ে ওঠাও সময়ের দাবিমাত্র।

Related Articles