তখনকার দিনে ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলতো পূর্ব আফ্রিকা। শক্তির দিক থেকে সবচেয়ে নিচের দিকে। ১৯৮৩ সালে ভারত যখন বিশ্বকাপ জিতে নিল, তার আগের দুই আসরে ভারতের প্রাপ্তি বলতে ৬ ম্যাচে কেবল একটি জয়, সেটিও আবার নিচের দিকের দল পূর্ব আফ্রিকার বিপক্ষে। কেউ তাই বিশ্বাস তো দূরের কথা, কল্পনাতেও আনতে পারেনি ভারত বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে নেবে। বিশ্বাস করেনি স্বয়ং ক্রিকেট বিশ্বকাপের আয়োজক সংস্থা আইসিসিও। তাই তারা করলো কি, উইন্ডিজ ও ভারতের মধ্যকার ফাইনাল ম্যাচের উদযাপনের জন্য আনা শ্যাম্পেইনগুলো রেখে এলো ক্যারিবিয়ানদের ড্রেসিংরুমে! অর্থাৎ, ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছেও ভারতের শিরোপা জয় নিয়ে সন্দেহের অবকাশ ছিল সবার মাঝে।
তবে ভারতের ব্যাপারে এমন মানসিকতার কারণ যে কেবল বিশ্বকাপের আগের দুই আসর তা নয়। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হার তাদেরকে টেনে নিচে নামিয়েছিল। সেই শ্রীলঙ্কা যারা কি না তখনও টেস্ট স্ট্যাটাসই পায়নি! এরপর বিশ্বকাপের আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে হার। সবমিলিয়ে বিশ্বকাপেও যখন তরুণ কপিলের কাঁধে অধিনায়কের দায়িত্ব চড়িয়ে দেওয়া হলো, তখন প্রায় সবাই বলেছিল, ভারত গা বাঁচিয়ে কোনোরকমে টুর্নামেন্টে অংশ নিতে যাচ্ছে!
কিন্তু কপিল দেবের মনে অন্যকিছু ছিল। তার হাত ধরেই বিশ্বকাপে ভারতের শুরুটা হয় চমকের মাধ্যমে। প্রথম ম্যাচেই আগের দুই আসরের চ্যাম্পিয়ন উইন্ডিজকে হারিয়ে বিশেষজ্ঞদের ভাষায় ‘আপসেট’ ঘটায় ভারত। পরের ম্যাচে হারায় জিম্বাবুয়েকে। এরপর দুই ম্যাচে হার। তৃতীয় ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হারে বিশাল ব্যবধানে। হারতে হয় উইন্ডিজের বিপক্ষেও। ফাইনালে যেতে হলে প্রয়োজন আবারও জিম্বাবুয়েকে হারানো। শুধু তা-ই নয়, হারাতে হবে অস্ট্রেলিয়াকেও। এই জিম্বাবুয়েকে একবার হারিয়েছে ভারত। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মতো কঠিন দলকে আবার হারিয়েছে জিম্বাবুয়ে। তাই নিজেদের সেরাটা না দিয়ে উপায় নেই। তাই করেছিলেন কপিলরা। নিজেদের পারফরম্যান্স দিয়ে জিতেছিলেন জিম্বাবুয়ে ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। টুর্নামেন্টে ততদিন নিজেদের অন্য অবস্থানে নিয়ে গেছে ভারত। তারপরও, এশিয়ার এই দল চ্যাম্পিয়ন হবে; এমনটা আশা করতে নারাজ সবাই। হয়তো ভারতীয় সমর্থরাও একই মনোভাবের ছিল!
কপিল দেব এশিয়ার প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক। কে জানতো যে, ইতিহাস গড়বেন এই লোকটি? Image Source: ICC Cricket
দিনশেষে সবকিছু পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত। নিজেদেরকে প্রমাণ করে পুরো বিশ্বব্যাপী। সেবার দলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে দারুণ অবদান ছিল ২৪ বছর বয়সী অলরাউন্ডার ও অধিনায়ক কপিল দেবের। কেমন ছিল সেই মুহূর্তগুলো? ২০১৯ বিশ্বকাপে সেই দিনগুলোর কথা কপিল জানিয়েছেন এক সাক্ষাৎকারে। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাতকারটি তুলে ধরা হলো।
লর্ডসে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্বকাপ হাতে আপনাকে দেখেছিলাম আমরা…
আমি ব্যক্তিগত কাজে ওই সময়ে লর্ডসে এসেছিলাম। এমন সময়ে তারা আমাকে ডেকে বিশ্বকাপ হাতে দিয়ে কিছু ছবি তুলেছিল। ব্যস, এটুকুই। এর কম বেশি কিছু নয়। এটা অনেক বড় ব্যাপার যে আমরা ৩৮ বছর আগে যে ট্রফিটা জিতেছিলাম, তারা সেই ট্রফি আমার হাতে আরও একবার তুলে দিল। অনেক ভালো লেগেছে বলতেই হবে। ঐতিহাসিক ভেন্যু লর্ডসের সংক্ষিপ্ত সফরে বিশ্বকাপ নিয়ে এই ঘটনা আমার খুব ভালো লেগেছে।
এটা কি সত্যি যে ১৯৮৩ বিশ্বকাপ ফাইনালের সকালে এক বোতল শ্যাম্পেইন তোয়ালেতে জড়িয়ে আপনি ঘুরছিলেন?
হ্যাঁ, আমি যখন ফাইনাল খেলতে মাঠে যাচ্ছিলাম তখন ব্যাগে এক বোতল শ্যাম্পেইন রেখেছিলাম।
আপনি কি এর মাধ্যমে ফাইনাল জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস বোঝাতে চাইছিলেন?
ঠিক তা নয়। যতদূর মনে পড়ে আমারর বিশ্বাস ছিল যে আমরা ট্রফি জিততে পারবো। আমি অধিনায়ক ছিলাম। তো অধিনায়কের মধ্যে যদি আত্মবিশ্বাস না থাকে তাহলে কী করে সে দলের অন্যান্য সদস্যের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে দেবে? এমনকি আমি নিজেকে এটাও বলেছিলাম যে, যদি আমরা ফাইনালে হেরে যাই, তারপরও শুধু ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোর কারণে আমরা উদযাপন করবো।
১৯৮৩ বিশ্বকাপে ভারত দল। ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ আসে এই দলের হাত ধরেই; Image Source: Livemint
আমরা শুনেছি আপনি ফাইনালের পর উইন্ডিজ ড্রেসিংরুমে গিয়ে ফ্রিজ থেকে তাদের শ্যাম্পেইনের বোতলগুলো নিয়ে এসেছিলেন।
হ্যাঁ, আপনার তথ্য সঠিক। বিশ্বকাপের ফাইনালে উইন্ডিজকে হারিয়ে শিরোপা জয়টা উদযাপনের জন্য সত্যিই আমাদের শ্যাম্পেইনের বোতলের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বিশ্বকাপের ম্যানেজমেন্ট অন্যকিছু ভেবেছিল। তারা ভাবতেই পারেনি ভারত বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে নেবে। তাই তারা সব শ্যাম্পেইনের বোতল উইন্ডিজের ড্রেসিংরুমে রেখে এসেছিল, যেন তৃতীয়বারের মতো শিরোপা জিতে ওই শ্যাম্পেইন নিয়ে ক্যারিবিয়ানরা উদযাপন করতে পারে।
আপনি কীভাবে উইন্ডিজ দলের কাছে গিয়ে শ্যাম্পেইনের বোতলগুলো চেয়েছিলেন?
ফাইনালে জয়ের পর চ্যাম্পিয়ন হয়ে আমি সোজা ক্লাইভ লয়েডের কাছে চলে যাই। তাকে গিয়ে বলি, যেহেতু তোমাদের আর শ্যাম্পেইনের বোতলগুলোর প্রয়োজন নেই, তাই ওগুলো আমি আমার দলের ছেলেদের জন্য চাই। ক্লাইভ মাথা নেড়ে উইন্ডিজ ড্রেসিংরুমে থাকা সবগুলো শ্যাম্পেইনের বোতল এনে আমাকে দিয়ে দেয়।
ক্লাইভ লয়েড একবার বলেছিলেন, ইনিংসের পুরোটা সময়েই নাকি স্লিপে ফিল্ডার রেখেছিলেন আপনারা। এটাকে তিনি ‘মাস্টারস্ট্রোক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন…
কপিল দেব ও ক্লাইভ লয়েড। দুজনেই দুজনার সম্মানের ও প্রিয়পাত্র; Image Source: AP
তো কী করবো? আমাদের ইনিংসে আমরা বড় রান তুলতে পারিনি। সে কারণে আমরা আক্রমণাত্মক ফিল্ডিংয়ে নজর দিয়েছিলাম। পুরো ইনিংসে স্লিপে ফিল্ডার রেখেছিলাম। আপনি কি জানেন মধ্যাহ্ন বিরতিতে আমি ছেলেদের কি বলেছিলাম?
আমি তাদেরকে বলেছিলাম, যদিও এটা ৬০ ওভারের খেলা, কিন্তু আমাদেরকে এই ম্যাচ জিততে হলে অবশ্যই ৩ ঘন্টার মধ্যে শেষ করতে হবে। কারণ আমি জানতাম তারা যদি ৬০ ওভার পর্যন্ত ব্যাট করে তাহলে খুব সহজেই ১৮৩ রানের লক্ষ্যে পার করে ফেলবে। তাই আমাদের সামনে একটাই পথ ছিল, ইনিংসের প্রথম বল থেকে আক্রমণ করা এবং তিন ঘন্টায় ম্যাচ শেষ করা। আমাদের দলের বোলাররা সেদিন সত্যিই খুব ভালো করেছিল, যে কারণে শেষ পর্যন্ত আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছিলাম।
আপনার সময় সতীর্থদের কাছে বিশ্বকাপ জয়ের অর্থ কী ছিল?
এর অর্থ সবকিছু ছিল। আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত ছিল। আমি নিশ্চিত যে দলের বাকি ১৩ ক্রিকেটারের কাছেই আবেগটা আমার মতোই ছিল। চমৎকার একটা বিজয় ছিল আমাদের সেবার।
রজার বিনি, কে. শ্রীকান্ত, সন্দ্বীপ পাতিল রেকর্ড গড়েছিল, যা প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। আমি টিম মিটিংয়ে প্রায়ই বলতাম, “আমরা চেষ্টা করি, তারপর দেখি কী হয়”। এরপর আমরা ম্যাচ জিততে শুরু করলাম। যখন সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম তখন সবাই খুব আত্মবিশ্বাসী ছিল যে ভালো কিছু হতে যাচ্ছে।
ঐতিহাসিক সেই ম্যাচের টসে ক্লাইভ-কপিল একসাথে; Image Source: Mid-Day
২০১৯ বিশ্বকাপে কোন দল চ্যাম্পিয়ন হবে?
এবার তো দেখে মনে হচ্ছে ইংল্যান্ড। ভারত এবং দুই দলই সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছাবে। সত্যি বলতে, সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোর পর ফাইনালের জন্য কিছুটা হলেও ভাগ্যের সহায়তার দরকার পড়ে। ভারত খুব ভারসাম্যপূর্ণ দল। তাদের ভালো করা উচিত।