Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কাগুজে সিংহের আসল সিংহ হওয়ার গল্প

প্রতিটা বিশ্বকাপের শুরুতেই অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে তিনটি প্রধান তালিকায় ভাগ করা হয় – ফেভারিট, ডার্ক হর্স আর আন্ডারডগ। এখন পর্যন্ত যতগুলো বিশ্বকাপ হয়েছে তার অধিকাংশ আসরেই শিরোপাটা গেছে ফেভারিট কোনো দলের দখলে, আর বাকিগুলো গেছে ডার্ক হর্সদের ঘরে। শুধুমাত্র একটা বিশ্বকাপ আছে যেখানে সবার ভবিষ্যদ্বাণীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিরোপা চলে গেছে এক আন্ডারডগ দলের কাছে। বলছিলাম ১৯৯৬ বিশ্বকাপের শ্রীলঙ্কা দলটার কথা।

সেই বিশ্বকাপ শুরুর আগে কেউ যদি বলতো যে, এবারের শিরোপাটা শ্রীলঙ্কার ঘরে যাবে, তবে সেই সময়ে সিংহভাগ মানুষই সেই কথাটা হেসে উড়িয়ে দিত। আর সেটা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক, যে দলটা আগের পাঁচ আসরের একটিতেও গ্রুপপর্বের বাঁধা পার হতে পারেনি, তাদের নিয়ে কোন ভরসায় বিশ্বকাপ জয়ের বাজি ধরা যায়?

বিশ্বকাপ শুরুর দুই মাস আগেও দলটির অবস্থা ছিল ভীষণ ছন্নছাড়া। অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে বল টেম্পারিং ও মুরালির বোলিং অযাকশন নিয়ে ওঠা বিতর্ক নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ভীষণ কোণঠাসা হয়ে পড়ে তারা। সাথে গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটির বিশ্বকাপের সহ-আয়োজক হওয়া নিয়েও শঙ্কা দেখা যায়। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কি সত্যিই বড় কিছুর স্বপ্ন দেখা যায়?

কিন্তু একজন মানুষ বড় কিছুর পরিকল্পনা করেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা। একজন প্রকৃত নেতার যেসব গুণ থাকা দরকার, তার সবটাই তার মধ্যে ছিল। নিজের সবটুকু দিয়ে দলের খেলোয়াড়দের আগলে রাখতেন, আবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে নিজের যেটা ভালো মনে হতো, সেটাতেই অটল থাকতেন। 

একজন প্রকৃত নেতার মতো সবসময় নিজের দলের খেলোয়াড়দের আগলে রাখতেন রানাতুঙ্গা; Image Source: India Today

জয়াসুরিয়া কিংবা আতাপাত্তুর ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল রীতিমতো ভয়াবহ। কিন্তু তবুও রানাতুঙ্গা তাদের সমর্থন দিয়ে গেছেন, দলে ফিরিয়ে এনেছেন বারবার। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন, শ্রীলঙ্কা দলকে যদি বড় কিছু করতে হয়, তবে এই প্রতিভাগুলোকে কাজে লাগাতেই হবে। বিশ্বকাপ শুরুর এক বছর আগে থেকেই শ্রীলঙ্কার তৎকালীন কোচ ডেভ হোয়াটমোরকে সাথে নিয়ে এমন ২০ জন প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের ছোট্ট তালিকা বানিয়েছিলেন রানাতুঙ্গা। তাদেরকে বারবার সুযোগ দিয়েই বিশ্বকাপের ১৪ সদস্যের দল সাজিয়েছিলেন তারা।

শুধু দল সাজানোতেই নয়, রণকৌশলেও সাহসী কিছু পদক্ষেপ এনেছিলেন রানাতুঙ্গা ও হোয়াটমোর। সাধারণ ছক কষলে সেই বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার উদ্বোধনী জুটিতে মারভান আতাপাত্তু ও রোশান মহানামারই থাকার কথা। কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্ট কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে সনাথ জয়াসুরিয়া ও রমেশ কালুভিথারানাকে দিয়ে ইনিংস সূচনা করে কিছুটা পিঞ্চ হিটিংয়ের কৌশল নিতে চাইলো। সেই লক্ষ্যে তারা বিশ্বকাপের আগে অজিদের মাঠে ত্রিদেশীয় সিরিজে এই জুটিকে দিয়েই ইনিংস সূচনা করালেন।

কৌশল কিছুটা কাজে লাগায় বিশ্বকাপে এই জুটিকে দিয়েই ইনিংস সূচনা করানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু বাকি ব্যাটিং অর্ডারের কী হবে? এই দুই পিঞ্চ হিটার যদি দ্রুত আউট হয়ে যায়, তবে সে বিপর্যয় কীভাবে সামলাবে দল? সে কারণে তিন নাম্বারে ব্যাট করার জন্য রাখা হয় আশাঙ্কা গুরুসিনহার মতো ঠাণ্ডা মাথার একজন ব্যাটসম্যানকে। পাঁচ নাম্বার ব্যাটসম্যান হিসেবে ছিলেন অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা।

আর ছয় ও সাত নাম্বার ব্যাটসম্যান হিসেবে ছিলেন হাসান তিলকারত্নে ও রোশান মহানামা, যাদের আসল ব্যাটিং পজিশন ছিল টপ অর্ডারে। আর চার নাম্বার ব্যাটসম্যান হিসেবে দলের সেরা সেরা ব্যাটসম্যান অরবিন্দ ডি সিলভাকে রাখা হয়। রানাতুঙ্গা জানতেন, যদি তার দলকে বড় কিছু করতে হয় তাহলে উদ্বোধনী জুটি এবং ডি সিলভা, এই দুই এক্স-ফ্যাক্টরকে কাজে লাগাতেই হবে। আর সে কারণে তিনি ব্যাটিং অর্ডারকে এমনভাবে সাজালেন, যাতে এই তিনজন ব্যাটসম্যান পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে ব্যাট চালাতে পারে।

বিশ্বকাপ শুরুর আগে মুরালির বোলিং অ্যাকশন নিয়ে বিতর্ক উঠে;Image Source: Sportskeeda

শুধু ব্যাটিং অর্ডারই নয়, বোলিং লাইনআপ সাজাতে গিয়েও রানাতুঙ্গাকে কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। বিশ্বকাপ শুরুর আগে মুরালির বোলিং অ্যাকশন নিয়ে বিতর্ক উঠে গেল, এদিকে বিশ্বকাপের দল ঘোষণার সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। মুরালিকে নিয়ে দল সাজালে বিশাল একটা ঝুঁকি থেকে যাবে। কারণ যদি মুরালির বোলিং অ্যাকশন অবৈধ বলে প্রমাণিত হয়, তবে বিশ্বকাপে ১৩ জন নিয়েই খেলতে হবে। এক্ষেত্রেও বাজি ধরলেন রানাতুঙ্গা, মুরালিকে নিয়েই দল সাজালেন। আর পরে মুরালির বোলিং অ্যাকশন বৈধ বলে প্রমাণিত হওয়ায় সেই বাজিটাও বেশ ভালোভাবে লেগে গেলো।

মুরালির সাথে ধর্মসেনার মতো একজন হিসেবি বোলার, সাথে জয়াসুরিয়া-ডি সিলভার মতো স্পিন অলরাউন্ডার দলে থাকায় শ্রীলঙ্কার স্পিন বিভাগ বেশ শক্তিশালী ছিল। পেসার হিসেবে চামিন্দা ভাস ছাড়া আহামরি আর কেউই তাদের দলে ছিল না। তবে রানাতুঙ্গা জানতেন, যেহেতু বিশ্বকাপটা উপমহাদেশে হচ্ছে, তাই দলের স্পিনাররা জ্বলে উঠলে শুধু চামিন্দা ভাসের মতো একজন পেসারকে সামনে রেখেই এই বোলিং লাইনআপ নিয়ে লড়াই করা যাবে।

বিশ্বকাপ শুরুর পরও অবশ্য কিছুটা ভাগ্যের ছোঁয়া পায় শ্রীলঙ্কা। নিরাপত্তার কারণে শ্রীলঙ্কায় আসতে অস্বীকৃতি জানায় অস্ট্রেলিয়া ও উইন্ডিজ। ফলে দুইটি ম্যাচেই ওয়াকওভার পায় তারা। কিন্তু রানাতুঙ্গা অবশ্য এই ঘটনায় বেশ ক্ষেপে যান, তিনি বলে দেন যে ফাইনালে প্রতিপক্ষ হিসেবে তিনি অস্ট্রেলিয়াকেই চান। অস্ট্রেলিয়ার মতো পরাশক্তি ফাইনাল খেলতেই পারে, কিন্তু শ্রীলঙ্কার মতো আন্ডারডগ দলের অধিনায়ক যখন ফাইনাল খেলার কথা বলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই অনেকে কথাটাকে হেসে উড়িয়ে দেন।

কিন্তু রানাতুঙ্গা জানতেন, উপমহাদেশীয় কন্ডিশনে বড় কিছু করার সামর্থ্য এই দলটার আছে। দুইটি ম্যাচ ওয়াকওভার পাওয়ার পর শ্রীলঙ্কার কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার পথটা বেশ সহজ হয়ে গেছিল। অরবিন্দ ডি সিলভার ৯১ রানের দারুণ এক ইনিংসে জিম্বাবুয়েকে ৬ উইকেটে হারিয়ে শুরুটাও বেশ ভালো করেছিল লঙ্কানরা। তবে সিংহের গর্জনের তীব্রতা টের পাওয়া যায় দিল্লীতে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটিতে।

টসে হেরে ব্যাটিং করতে নেমে শচীন টেন্ডুলকারের অনবদ্য ১৩৭ রানে ভর করে ভারত যখন ২৭১ রানের বড় সংগ্রহ দাঁড় করাল, তখন ভারতের বড় জয়টা শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষাই মনে হচ্ছিল। কিন্তু নাটকের মূল অংশ তখনও বাকি রয়ে গিয়েছিল। এই বড় রান তাড়া করতে নেমে শুরুতেই ভারতীয় বোলারদের উপর তাণ্ডবলীলা চালাতে শুরু করলেন সনাথ জয়াসুরিয়া । তার বেধড়ক পিটুনির কারণে মাত্র তিন ওভারেই ৪২ রান তুলে ফেলে শ্রীলঙ্কা! 

জয়াসুরিয়ার এই ইনিংসটা শ্রীলঙ্কার মনোবল অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়; Image Source: The Hindu

প্রথম তিন ওভারে ৪২ রান সেই যুগ তো বটেই, এই টি-টুয়েন্টির যুগেও স্বপ্নীল সূচনা। জয়াসুরিয়া সেদিন এমনই রণমূর্তি ধারণ করেছিলেন যে, তাকে আটকানোর কোনো উপায়ই ভারত খুঁজে পাচ্ছিল না। তার এই ঝড়ের বড় অংশটা ভারতীয় অলরাউন্ডার মনোজ প্রভাকরের উপর দিয়েই গিয়েছিলো। সেই ঝড়ের প্রভাব এতটাই গুরুতর ছিল যে, বেচারা প্রভাকর পেস বোলিং বাদ দিয়ে জয়াসুরিয়ার বিপক্ষে স্পিনার হিসেবে বোলিং করতে এসেছিলেন!

শেষ পর্যন্ত সেই প্রভাকরের হাতে ক্যাচ দিয়েই কুম্বলের বলে ব্যক্তিগত ৭৯ রানে যখন তিনি ফিরে যান, ২০ ওভার শেষে শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ ১৩৭ রান। তার এই দাপুটে ইনিংসের কল্যাণে ৬ উইকেটে ম্যাচটি জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা।

জয়াসুরিয়ার ঐ একটা ইনিংস পুরো লঙ্কান দলের আত্মবিশ্বাসকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। রানাতুঙ্গার কথাগুলো যে ফাঁকা বুলি নয়, সেটা প্রমাণের জন্য এমন একটা ম্যাচ ভীষণ জরুরী ছিল।

গ্রুপপর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে কেনিয়ার মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কা। অরবিন্দ ডি সিলভার ১১৫ বলে ১৪৫ রানের অনবদ্য এক ইনিংসে ভর করে শ্রীলঙ্কা দাঁড় করায় ৩৯৮ রানের পাহাড়সম সংগ্রহ। সে সময়ে এই ৩৯৮ রান ছিল ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ, যে রেকর্ড দীর্ঘ ১২ বছর অক্ষুণ্ণ ছিল। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পা রাখে শ্রীলঙ্কা, যেখানে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড।

ফয়সালাবাদে আগে ব্যাট করতে নেমে ৮ উইকেটে ২৩৫ রান সংগ্রহ করে ইংলিশরা। সে সময়ের বিচারে ২৩৫ রান বেশ ভালো একটা পুঁজি হিসেবে বিবেচিত হত। কিন্তু মাতারা হারিকেনের তাণ্ডবলীলা শুরু হলে ২৩৫ রান কি আর ধোপে টিকতে পারে? ৪৪ বলে ৮২ রানের এক ঝড়ো ইনিংসে ইংলিশ বোলিং লাইনআপকে গুঁড়িয়ে দেন জয়াসুরিয়া। তার এই অসাধারণ ইনিংসে ভর করে ৯ ওভার হাতে রেখেই ৬ উইকেটের জয় তুলে নেয় শ্রীলঙ্কা। ব্যাট হাতে ৮২ রানের ইনিংসের সাথে বল হাতে ২ উইকেট নেওয়ায় ম্যাচসেরার পুরস্কারটা জয়াসুরিয়ার হাতেই উঠে। 

কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়াসুরিয়া; Image Source : Cricketsoccer

সেমিফাইনালে কঠিন এক অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হয় শ্রীলঙ্কা। ইডেন গার্ডেনসে লাখখানেক দর্শকের সমর্থন নিয়ে গ্রুপপর্বে হারের বদলা নিতে প্রস্তুত ছিল স্বাগতিক ভারত। শ্রীলঙ্কাকে যত বড় টার্গেটই দেওয়া হচ্ছিল, তার কোনোটাই তাদের ডায়নামিক ব্যাটিং লাইনআপের কাছে ধোপে টিকতে পারছিল না। এ কারণে ভারতের অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন টসে জিতে নিলেন ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত। তার সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণের জন্য খুব বেশি সময় ভারতীয় বোলাররা নিল না, প্রথম ওভারে মাত্র ১ রানের মধ্যেই শ্রীলঙ্কার দুই পিঞ্চ হিটার ওপেনার কালুভিতারানা ও জয়াসুরিয়াকে ফিরিয়ে দেন পেসার জাভাগাল শ্রীনাথ।

সেই বিপর্যয় সামাল দেন অরবিন্দ ডি সিলভা, জ্বর শরীরে নিয়েও ব্যাটিংয়ে নেমে শুরু করেন কাউন্টার অ্যাটাক। এক ঘণ্টা পর তিনি যখন আউট হন, তখন শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ ১৪.২ ওভারে ৮৫/৪। আর সেই ৮৫ রানের মধ্যে ডি সিলভার ব্যাট থেকেই এসেছিল ৬৬ রান! রানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তিনি এই রান করতে খরচ করেছিলেন মাত্র ৪৭ বল। ১ রানে দুই ওপেনারের উইকেট পেয়ে যাওয়ার পর ভারত যখন লংকান ব্যাটিং ইউনিটকে পুরোপুরি চেপে ধরার পরিকল্পনায় ছিল, খেলার এমন পর্যায়ে তার এমন কাউন্টার অ্যাটাকে উল্টো ভারতের বোলাররাই চাপে পড়ে যায়। ডি সিলভার ইনিংসটার জন্যই পরের ব্যাটসম্যানদের রানরেট নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হয়নি, ধীরেসুস্থে খেলে বাকি ব্যাটসম্যানরা মিলে শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ ২৫১ রানে নিয়ে যায়। 

এই আউটটি হয়তো পুরো বিশ্বকাপেরই টার্নিং পয়েন্ট; Image Source : Hindusthan Times

ইডেনের স্লো পিচে ২৫১ রান বেশ ভালো সংগ্রহ ছিল, কিন্তু সেই আসরে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা শচীন টেন্ডুলকারের দারুণ ব্যাটিংয়ে বেশ চাপে পড়ে যায় শ্রীলঙ্কা। এক পর্যায়ে ভারতের সংগ্রহ ছিল মাত্র ১ উইকেট হারিয়ে ৯৮ রান। সেখান থেকেই খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেন জয়াসুরিয়া। তার বলে ৬৫ রান করে শচীন স্ট্যাম্পড আউট হওয়ার পর রীতিমতো তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ। ৯৮/১ স্কোরলাইন থেকে চোখের পলকে ১২০/৮ এ পরিণত হয় ভারত! খেলার এই অবস্থায় ভারতের দর্শকরা মাঠে মারমুখী হয়ে গেলে খেলা বন্ধ করে শ্রীলঙ্কাকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। অসাধারণ ক্যামিওর জন্য সেদিন ডি সিলভা ম্যাচসেরা হলেও জয়াসুরিয়ার ১২ রানে ৩ উইকেটের অসাধারণ স্পেলটাও শ্রীলঙ্কার সেদিনের জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল। 

১৭ মার্চ, ১৯৯৬ ছিল শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। রানাতুঙ্গার ইচ্ছার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটে ফাইনালে, লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া। এর আগে অনুষ্ঠিত পাঁচ বিশ্বকাপ ফাইনালের সবগুলোতেই আগে ব্যাট করা দল জয়ী হয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও টসে জিতে সবাইকে অবাক করে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেন লংকান অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা। ২৮ ওভার শেষে অজিদের রান যখন মাত্র এক উইকেট হারিয়ে ১৩৭ রান, তখন মনে হচ্ছিল টসে জিতে ফিল্ডিং নিয়ে ম্যাচটাই বুঝি হাত থেকে ফেলে দিয়েছেন রানাতুঙ্গা।

তখনই বল হাতে দলের ত্রাণকর্তা হয়ে আবির্ভূত হন অরবিন্দ ডি সিলভা, অজি অধিনায়ক মার্ক টেইলরকে ফিরিয়ে দিয়ে ভাঙেন টেইলর-পন্টিং এর ১০১ রানের জুটি। এরপরের ওভারেই আরেক সেট ব্যাটসম্যান পন্টিংকে বোল্ড করে খেলার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি শ্রীলঙ্কার হাতে এনে দেন তিনি। এত কম সময়ের ব্যবধানে দু’জন সেট ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে ব্যাটিংয়ের খেই হারিয়ে ফেলে অস্ট্রেলিয়া। ফলে এক পর্যায়ে ৩০০ রানের কাছাকাছি স্কোর গড়ার কথা ভাবলেও শেষ পর্যন্ত অজিদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৭ উইকেটে ২৪১ রান। আর টেইলর, পন্টিংয়ের পর শেষে ইয়ান হিলির উইকেটটাও তুলে নিয়ে ফাইনালে শ্রীলঙ্কার সেরা বোলার ছিলেন অরবিন্দ ডি সিলভা। 

ফাইনালে অসাধারণ সেঞ্চুরির পর ডি সিলভা; Source : espncricinfo.com

২৪২ রান সে সময়ের বিচারে খুব একটা সহজ টার্গেট ছিল না। কিন্তু সেই টুর্নামেন্টে শ্রীলঙ্কা দুই পিঞ্চ হিটিং ওপেনারে ভর করে যেকোনো টার্গেট এত অবলীলায় তাড়া করছিল যে, ২৪২ রানকে খুব একটা বড় মনে হচ্ছিল না। তবে সেমিফাইনালের মতো ফাইনালেও দুই পিঞ্চ হিটার কালুভিতারানা ও জয়াসুরিয়া ব্যর্থ, মাত্র ২৬ রানেই দু’জন সাজঘরে ফিরে গেলে ২৪২ রানের টার্গেটকেই পাহাড়সম লাগছিল।  অতঃপর সেমিফাইনালের মতো ফাইনালে আবারও ত্রাতা হিসেবে হাজির অরবিন্দ ডি সিলভা। 

এবার আর পাগলাটে কোনো ক্যামিও না, খেললেন ঠাণ্ডা মাথায় মনঃমুগ্ধকর এক ইনিংস। প্রথমে গুরুসিনহার সাথে ১২৮ রানের জুটি গড়ে প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নেন। ৯৯ বলে ৬৫ রান করে গুরুসিনহা আউট হলে জুটি বাঁধেন অধিনায়ক রানাতুঙ্গার সাথে। ডি সিলভার দুর্দান্ত সেঞ্চুরি ও রানাতুঙ্গার ৩৭ বলে ৪৭ রানের ক্যামিওতে ২২ বল হাতে রেখে ৭ উইকেটের জয় তুলে নেয় শ্রীলঙ্কা। গ্লেন ম্যাকগ্রার বলে রানাতুঙ্গার লেট কাটে বল সীমানা পার হওয়ার সাথে সাথে রচিত হয় এক অবিশ্বাস্য ইতিহাসের। 

বিশ্বকাপের শিরোপা হাতে রানাতুঙ্গা; Image Source: Daily News

শক্তির বিচারে সেই সময়ের শ্রীলঙ্কা শ্রেষ্ঠ ছিল না, সেটা রানাতুঙ্গাও স্বীকার করেন। তবে তার স্কোয়াডের প্রতিটি খেলোয়াড়ের আত্মনিবেদন বাকি সব দলের চেয়ে অনেক বেশি ছিল, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। একটা উদাহরণ দিলেই এই ব্যাপারটা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে, সেই বিশ্বকাপের পুরোটা সময়ই সাইডবেঞ্চে বসে কাটিয়েছেন শ্রীলঙ্কান লেগ স্পিনার উপুল চন্দনা। তবে খুব ভালো ফিল্ডার হওয়ায় একাদশের কারো কোনো সমস্যা হলে তিনিই দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নেমে যেতেন।

ইডেনের সেমিফাইনালে রোশান মহানামার বদলে ফিল্ডিং করছিলেন চন্দনা। যেহেতু তিনি খুব ভালো ফিল্ডার, তাই রানাতুঙ্গা তাকে ইনার সার্কেলের দিকেই রাখতেন। ভারতের ওই ঐতিহাসিক ব্যাটিং বিপর্যয়ের পর দর্শকরা যখন ক্ষেপে গিয়ে যা পাচ্ছে তা-ই মাঠে ছুঁড়ছে, তখন তিনি রানাতুঙ্গার কাছে গিয়ে বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করার অনুমতি চাইলেন। রানাতুঙ্গা কারন জানতে চাইলে তিনি বলেন,

‘ডি সিলভা বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে ফিল্ডিং করছে, এখন কোনো অঘটনের মাধ্যমে যদি ডি সিলভার কিছু হয়ে যায় তবে সেটা আমাদের জন্য বিশাল ক্ষতি বয়ে আনবে। এর চেয়ে আমার সেখানেই যাওয়াটাই দলের জন্য মঙ্গলজনক।’

দলের প্রতি কতটা আত্মনিবেদন থাকলে একটা ম্যাচেও সুযোগ না পাওয়া খেলোয়াড় এত বড় ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত থাকে, সেটা একবার কল্পনা করে দেখুন তো! স্কোয়াডের প্রতিটি খেলোয়াড় নিজেদের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছিল বলেই আন্ডারডগ একটা দলের পক্ষে বিশ্বজয় সম্ভব হয়েছিল, কাগুজে সিংহ হয়ে উঠেছিল সত্যিকারের সিংহ। একটা বিশ্বকাপজয় শ্রীলঙ্কার পুরো ক্রিকেটকে আমূল বদলে দেয়, আন্ডারডগ থেকে পরবর্তীতে পরিণত হয় পরাশক্তিতে। বিশ্বকাপ ইতিহাসে যত বর্ণিল রূপকথার গল্প আছে, তার মধ্যে হয়তো লঙ্কানদের এই বিশ্বজয়টাই সবচেয়ে আশ্চর্যজনক গল্প। 

This article is in Bangla language. It's about the historical world cup win of Sri Lanka in 1996. For references please check the hyperlinks inside the article.

Featured Image: espncricinfo.com

Related Articles