২০০১ সালে সিংহলিজ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অভিষেক হয় ১৭ বছর বয়সী এক তরুণের। প্রথম ইনিংসে ৯০ রানে গুটিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের ইনিংসে সর্বোচ্চ রানটি আসে তার ব্যাট থেকে। ভাস, মুরালিধরনের বিপক্ষে বুক চিতিয়ে লড়াই করে যাওয়া ৫৩ বলের সেই ২৬ রানের ইনিংসেই সম্ভাবনার ঝলক দেখিয়েছিলেন তিনি। পরের ইনিংসে দিলেন সেই সম্ভাবনার পূর্ণ প্রতিদান। সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরি করার কীর্তি গড়েন এই তরুণ।
আমিনুল ইসলাম বুলবুলের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে অভিষেকে শতক হাঁকানো ছেলেটি এরপরে হয়ে উঠেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সমার্থক শব্দ। বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম তারকা কিংবা যার কীর্তিতে হাজার হাজার ছেলে স্বপ্ন দেখেছে ব্যাট ধরার। তিনি মোহাম্মদ আশরাফুল। ফিনিক্স পাখির মতোই তার আগমন ক্রিকেট রাজ্যে। প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেটকে যিনি দেখিয়েছিলেন আশার আলো।
সেই ম্যাচে দ্বিতীয় ইনিংসে তার করা ১১৪ রানের পরও ইনিংস ব্যবধানে হেরে যায় টাইগার বাহিনী। তবে পরের গল্পটা মধুর। যতবারই জ্বলে উঠেছে আশরাফুলের ব্যাট, ততবারই বিশ্বকে কোনো না কোনো চমক দেখিয়েছে সে সময়ের আনকোরা বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। চলুন দেখে আসা যাক বাংলাদেশকে জেতানো মোহাম্মদ আশরাফুলের সেরা পাঁচটি ইনিংস।
৫. শ্রীলংকা (৭১ বলে ৫১) - ২০০৬ সাল
এই ম্যাচের আগ পর্যন্ত যে কয়টি টেস্ট খেলুড়ে দলের বিপক্ষে বাংলাদেশ জয় পায়নি তার মধ্যে একটি ছিল শ্রীলংকা। অবশেষে সেই জয় এসে ধরা দেয় মোহাম্মদ আশরাফুলের ধৈর্য্য আর দৃরতায়। তিন ম্যাচের সিরিজে প্রথম ম্যাচ হেরে বগুড়ায় দ্বিতীয় ম্যাচটি খেলতে নামে দুই দল। সৈয়দ রাসেল, অলক কাপালি আর মোহাম্মদ রফিকের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে মাত্র ২১২ রানেই লংকানদের বেঁধে ফেলে টাইগাররা। তবে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট পড়তে থাকলে এই মামুলি লক্ষ্যটাই একসময় কঠিন হয়ে পড়ে বাংলাদেশের জন্য।
একমাত্র আশা ছিল আশরাফুল। ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন তিনি, রানরেটের হ্যাপা না থাকায় ধীরে সুস্থে খেলে বাংলাদেশকে জয়ের বন্দরে ভেড়ান এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান। আশরাফুলের ব্যাটে ভর করে ১৮ বল বাকি রেখেই তিন উইকেটে জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ। যদিও শেষদিকে আফতাব আহমেদ ২১ বলে ৩২ রান করলে ম্যাচ সেরার পুরষ্কার যায় তার ঘরে। হাল ধরে রেখে জয়ের আশার আলো জ্বালিয়ে রেখেছিলেন আদতে আশরাফুলই।
৪. জিম্বাবুয়ে (৩২ বলে ৫১) - ২০০৪ সাল
২০০৪ সালে পাঁচ ম্যাচের একটি সিরিজ খেলতে জিম্বাবুয়ে যায় বাংলাদেশ। ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে জয় পাওয়ার পর টানা পাঁচ বছর ধরে জয় নেই বাংলাদেশের। প্রথম দুইটি ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ায় তৃতীয় ম্যাচটিই হয় সিরিজের প্রথম ম্যাচ। প্রথমে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ নামলে অন্য সব ম্যাচের মতো স্লো রানরেটের সাথে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে। ঠিক তখনই ধারার বিপরীতে পালটা আক্রমণে ৩২ বলে ৫১ রানের একটি ঝড়ো ইনিংস খেলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। সাথে হাবিবুল বাশারের ৬১ রানের সুবাদে ২৩৮ রানে লড়াই করার পুঁজি পায় বাংলাদেশ।
ব্যাটিংয়ে নেমে ২৩০ রানে শেষ হয় জিম্বাবুয়ের ইনিংস। সবকটি ওভার খেলে নয় ইউইকেট হারিয়ে এই সংগ্রহ দাড় করায় জিম্বাবুয়ে। ফলাফল পাঁচ বছর পর বাংলাদেশ আবার ওয়ান ডে ম্যাচ জেতার স্বাদ লাভ করে। বোলিংয়ে এসে গ্রান্ট ফ্লাওয়ারের মহামূল্যবান উইকেটটি তুলে নেন আশরাফুল। আর স্বাভাবিকভাবেই ম্যাচ সেরার পুরষ্কার উঠে ২০ বছর বয়সী এই তরুণের হাতে।
৩. দক্ষিণ আফ্রিকা (৮৩ বলে ৮৭) - ২০০৭ সাল
বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা, বারমুডা নিয়ে করা গ্রুপ থেকে প্রথম পর্বেই বাংলাদেশ বাদ পড়বে তা অনুমেয়ই ছিল। তবে চমক দেখিয়ে হাবিবুল বাশারের দল ভারতকে বাদ করে সুপার এইটে জায়গা করে নেয়। সুপার এইট যে এই টিমের জন্য অস্বাভাবিক ছিল না তা প্রমাণ করে দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম বাংলাদেশ ম্যাচে। বলতে গেলে প্রমাণ করেন মোহাম্মদ আশরাফুল একাই। তার ব্যাটে ভর করে বাংলাদেশ তুলে নেয় দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে প্রথম জয়। তাও আবার বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে।
টসে জিতে বাংলাদেশ দলকে ব্যাট করতে পাঠায় গ্রায়েম স্মিথ। জ্যাক ক্যালিস, মাখায়া এনটিনি, পোলকদের বোলিংয়ে শুরু থেকেই হাঁসফাঁস করতে থাকে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইন আপ। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন একজন। মোহাম্মদ আশরাফুল। ১২টি চার নিয়ে ৮৩ বলে করে ফেলেন ৮৭ রান। তাতে বাংলাদেশও পায় চ্যালেঞ্জিং স্কোর। দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে ছুড়ে দেয় ২৫১ রানের টার্গেট।
ব্যাটিংয়ে নেমে রফিক, রাসেল সাকিব আল হাসানদের তোপের মুখে পড়ে ১৮৪ রানে গুটিয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস। মোহাম্মদ আশরাফুলের সাহসী ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ পায় আরেকটি বড় জয়। ম্যাচ সেরার পুরষ্কার অর্জন করেন মোহাম্মদ আশরাফুল।
২. ওয়েস্ট ইন্ডিজ (২৭ বলে ৬১) - ২০০৭ সাল
প্রথম টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপে মোহাম্মদ আশরাফুলের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ পা রাখে দক্ষিণ আফ্রিকায়। জোহানেসবার্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হওয়ার আগে যোজন যোজন পিছিয়ে ছিল আশরাফুলের দল। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সংগ্রহ করে ১৬৪ রান। সে সময় টি টুয়েন্টিতে যেকোনো দলের জন্য এই রান ছিল পাহাড়সম।
ব্যাটিংয়ে নেমে শুরুতেই তামিম ইকবাল আর নাজিমুদ্দিনের উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ। তবে দায়িত্ব কঁধে তুলে নেন মোহাম্মদ আশরাফুল। আফতাব আহমেদকে সাথে নিয়ে গড়েন ১০৯ রানের পার্টনারশিপ। রানরেটের চাকাও সচল রাখেন পাওয়েল, ব্রাভো, রামপলদেরকে বেধড়ক পিটিয়ে।
আশরাফুলের ২৭ বলে ৬১ এর সুবাদে দুই ওভার আগেই জয় তুলে নেয় টাইগার বাহিনী। ৭টি চার আর ৩টি ছয়ে ২২৫ স্ট্রাইক রেট নিয়ে এই রান করেন তিনি। এইরকম স্ট্রাইক রেট সে সময়ে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের কাছে ছিল অকল্পনীয়। আফতাব আহমেদ ৬২ রান করলেও যোগ্য হিসেবেই ম্যাচ সেরার পুরষ্কার জেতেন অধিনায়ক আশরাফুল। পরের ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে হেরে বাদ পড়লেও আশরাফুলের ইনিংস পরশ বুলিয়েছিল শত শত বাঙালির চোখকে।
১. অস্ট্রেলিয়া (১০১ বলে ১০০) - ২০০৫ সাল
কার্ডিফে ৫ ফুট ৩ ইঞ্চির এক ২১ বছর বয়সী ছেলে অনায়াসে কাভার ড্রাইভ মারছেন ম্যাকগ্রা, গিলেস্পিদের। শুধু কাভার ড্রাইভ না, এক একটা বাউন্সার সামলিয়ে এনে দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র ওয়ানডে জয়। হাঁকিয়েছেন শতকও।
২০০৫ সালে ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ আয়োজিত হয় ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া আর বাংলাদেশকে নিয়ে। দ্বিতীয় ম্যাচেই টাইগার বাহিনী মুখোমুখি হয় রিকি পন্টিংয়ের মহাপরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। টসে জিতে ব্যাট করতে নামা অস্ট্রেলিয়া পরপর গিলক্রিস্ট ও পন্টিংয়ের উইকেট হারালেও শেষ পর্যন্ত ২৪৯ রানের বড় সংগ্রহ দাড় করায়।
সে সময়ের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জন্য ২৫০ রান টপকানো বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। সাথে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকগ্রা, গিলেস্পিদের মতো বোলাররাও ছিলেন। তবে দিনটি ছিল মোহাম্মদ আশরাফুলের। অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের পাড়ার নামিয়ে এনে ঠিকই তুলে নেন নিজের প্রথম শতক। বাংলাদেশকে ভাসান জয়োৎসবে। হাবিবুল বাশারকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে রানরেটের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়িয়েছেন রানের গতিও। শেষ পর্যন্ত আফতাব আহমেদের তুলির শেষ আচড়ে বাংলাদেশ ম্যাচটি জিতে নেয় ৫ উইকেটে।
১১ টি চারে ১০১ বলে ১০০ করা মোহাম্মদ আশরাফুল জিতে নেন ম্যাচ সেরার পুরষ্কার।
ইংল্যান্ডের সাথে ৫২ বলে ৯৪ রানের ইনিংস কিংবা ঢাকা টেস্টে ভারতের সাথে ১৫৮ রানের ইনিংস সহ আরো অনেক নান্দনিক ইনিংস এসেছে আশরাফুলের ব্যাট থেকে। মোহাম্মদ আশরাফুল; বাংলাদেশের প্রথম তারকা যিনি অস্ট্রেলিয়াকে একা হাতে হারিয়ে রচনা করেছেন ‘বিগেস্ট আপসেট অব ক্রিকেট’ এর, যিনি প্রথম ক্রিকেট বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে চিনিয়েছেন বারংবার, যার হাত ধরে বাংলাদেশ হারিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজদের মতো ক্রিকেট পরাশক্তিদের।
সদ্যই পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়েছেন মোহাম্মদ আশরাফুল। জাতীয় দলে ফেরা হবে কি হবে না তা নিয়ে সংশয় আছে। তবে বাংলাদেশ মানুষের মণিকোঠায় চিরম্লান হয়েই থাকবেন মোহাম্মদ আশরাফুল।
This articles is about the genius of Bangladeshi cricketer Mohammad Ashraful. Necessary references are hyperlinked in the article.
Feature Image : ESPN Cricinfo