মেসি-রোনালদো পরবর্তী ফুটবল বিশ্ব যে কিলিয়ান এমবাপ্পে নামের এক ১৯ বছরের তরুণের হাতের মুঠোয় থাকবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বকাপের সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরষ্কারের পাশাপাশি পেলের পর দ্বিতীয় টিনএজার হিসেবে বিশ্বকাপের নক আউট ম্যাচে জোড়া গোল করার কীর্তিও গড়েছেন। কিন্তু এই এমবাপ্পেই শুরুর দিকে কয়েকটি ফুটবল ক্লাব থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন।
মজার বিষয় হচ্ছে, শুধু এমবাপ্পেই নন, এরকম প্রত্যাখ্যানের শিকার হয়েছেন বর্তমান ফুটবলের বেশ কয়েকজন নামকরা তারকা। আজ আমরা জানবো এমনই কয়েকজন ফুটবলারের গল্প।
হ্যারি কেইন
মাত্র ২৪ বছর বয়সেই ইংল্যান্ড জাতীয় দলের অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরেছেন হ্যারি কেইন। বর্তমান ফুটবলের কয়েকজন বাঘা বাঘা স্ট্রাইকারের মধ্যে একজন এই টটেনহাম খেলোয়াড়। অথচ এই হ্যারি কেইনের প্রতিভা নিয়ে সংশয় ছিলো। তা-ও আবার টটেনহ্যামের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্সেনালের।
ছোটবেলা থেকেই ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর কেইন ভর্তি হয়েছিলেন আর্সেনাল একাডেমিতে। কিন্তু মাত্র আট বছর বয়সেই হ্যারি কেইনকে রিলিজ করে দেয় আর্সেনাল। সেই সময় কেইন কিছুটা স্থূলকায় ছিলেন বিধায় আর্সেনাল থেকে প্রত্যাখ্যাত হন তিনি। এরপরের গল্প সবারই জানা। কয়েক বছর পর টটেনহামে যোগ দেওয়ার পর থেকেই আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি কেইনকে। কয়েক বছরের মধ্যেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে বর্তমানে টটেনহামের জার্সি গায়ে করেছেন ১৪৬ গোল। ক্লাবের সর্বোচ্চ স্কোরারদের তালিকায় তার স্থান ইতিমধ্যেই পাঁচ নাম্বারে। ২০১৫/১৬ মৌসুমে গোল্ডেন বুট জিতে ১৬ বছর পর কোনো ইংলিশ খেলোয়াড় হিসেবে এই কীর্তি গড়েন কেইন। আর্সেনালের বাতিলের খাতায় পড়ে যাওয়া কেইন বেশ ভুগিয়েছেন আর্সেনালকেও।
আতোঁয়ান গ্রিজম্যান
অন্যান্য অনেক ফরাসির মতোই ছোটোবেলা থেকেই পেশাদার ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছা ছিলো গ্রিজম্যানের। কিন্তু বিধিবাম! একের পর এক ক্লাবে ট্রায়ালের পরও কেউই থাকে সাইন করাতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। সর্বপ্রথম অলিম্পিক লিঁওর হয়ে ট্রায়াল দেন। কিন্তু বয়সের তুলনায় খাটো ও পাতলা ছিলেন বিধায় তার ফুটবল খেলার জন্য শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে লিঁও।
এরপর একে একে আরো কয়েকটি ফরাসি ক্লাবে ট্রায়াল দিলেও কেউই গ্রিজম্যানকে দলে ভেড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। পরবর্তীতে ১৫ বছর বয়সে মন্টিপিলিয়ারের হয়ে ট্রায়ালের সময় এরিক ওলহাটস নামের এক স্কাউটের চোখে পড়েন গ্রিজম্যান। গ্রিজম্যানে মুগ্ধ হয়ে এরিক রিয়াল সোসিয়েদাদকে রাজি করায় গ্রিজম্যানকে দলে ভেড়ানোর জন্য। এরপরের ইতিহাস নিজ হাতেই লিখেছেন আতোঁয়ান গ্রিজম্যান।
মিশেল প্লাতিনি
মেসি-রোনালদো যুগের আগে প্লাতিনিই ছিলেন তিনবার ব্যালন ডি অর জয়ী দুই ফুটবলারের একজন। আরেকজন ছিলেন ইয়োহান ক্রুয়েফ। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল প্রডিজি হওয়া সত্ত্বেও মেটজ নামের এক ক্লাব থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন তিনি। মেটজের ফুটবল ট্রায়ালে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। আর তাই মেটজও প্লাতিনিকে সাইন করাতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে। পরবর্তীতে প্লাতিনি যোগ দেন ন্যান্সিতে। সেখান থেকে সেঁত এঁতিয়েন হয়ে জুভেন্টাস সহ পুরো বিশ্ব মাতান নিজের জাদুকরী পা দিয়ে।
রুদ খুলিত
এফসি হারলেম নামের এক ক্লাবের হয়ে পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেন রুদ খুলিত। একবছর সেখানে খেলার পর ট্রায়াল দিতে যান আর্সেনালে। কিন্তু তৎকালীন আর্সেনাল কোচ টেরি নেইল রুদ খুলিতকে অলস ও বিশৃঙ্খল বলে আখ্যা দেন। এই অজুহাতের জের ধরে রুদ খুলিতের পেছনে ২ লাখ ইউরো খরচ করতে রাজি ছিলেন না তিনি।
আর্সেনাল থেকে বাতিল হয়ে খুলিত যোগ দেন আইন্দহোভেনে। সেখান থেকে এসি মিলান। সেই এসি মিলানে ভ্যান বাস্তেন ও ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড সহ গড়ে তোলেন বিধ্বংসী ট্রায়ো। আর্সেনালের আফসোস বাড়িয়ে রোজানেরিদের হয়ে জিতে নেন একে একে সবকিছু। পাশাপাশি নিজের অর্জনের খাতাও ভারী করে নেন এই ডাচ কিংবদন্তী। ১৯৮৭ সালে জিতেন ব্যালন ডি অর-ও।
কিলিয়ান এমবাপ্পে
বিস্ময়কর হলেও সত্যি, কিলিয়ান এমবাপ্পেকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো ইংলিশ ক্লাব চেলসি।
২০১২ সালের কথা। ১৩ বছর বয়সী এমবাপ্পে ট্রায়াল দেওয়ার জন্য আসেন চেলসিতে। কিন্তু চেলসি এই প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের পেছনে টাকা ঢালতে গররাজি দেখায়। সেই সময়ের ড্যানিয়েল বোগা নামের একজন চেলসি স্টাফ এমবাপ্পেকে সাইন না করানোর পেছনে যুক্তি দেন যে, এমবাপ্পে প্রতিভাবান হলেও পরিশ্রমী নন। আক্রমণ থেকে নিচে নেমে রক্ষণে সহায়তা করার প্রবণতা কম বিধায় তাকে দলে ভেড়ায়নি চেলসি।
বর্তমানে অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এমবাপ্পে। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই ক্লাব পর্যায়ে করে ফেলেছেন ৬০ এর উপর গোল।
ফ্রাঙ্কো বারেসি
ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডারদের মধ্যে একজন বারেসি পড়েছিলেন ইন্টার মিলানের বাতিলের খাতায়। ১৯৭৪ সালে ১৪ বছর বয়সী বারেসি বড় ভাইয়ের দেখানো পথে হেঁটে ইন্টার মিলানে ট্রায়াল দেন। সেই সময় বারেসির বড় ভাই ছিলেন ইন্টারের একাডেমির সদস্য। কিন্তু ইন্টার মিলান তাকে ফিরে যেতে বলে এবং এক বছর পরে যোগ দিতে বলে। আর এই সুযোগটাই লুফে নেয় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এসি মিলান। বারেসিকে রোজানেরিরা দলে ভেড়ায় সেই বছরই।
এরপরের গল্প শুধুই বারেসিময়। এসি মিলানের জার্সি গায়ে এই কিংবদন্তি ডিফেন্ডার খেলেন ৭১৯ ম্যাচ। ১৫ মৌসুম ধরে ছিলেন ক্লাবটির অধিনায়ক। জিতেছেন প্রায় সব শিরোপাই। ১৯৯৯ সালে এসি মিলান বারেসিকে ক্লাবের ইতিহাসে শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ঘোষণা করে। পাশাপাশি বারেসির সম্মানে তার পরিহিত ৬ নাম্বার জার্সিকে চিরদিনের জন্য অবসরে পাঠায়।
গুইসেপ্পে মিয়াজ্জা
ইতালিতে ইতিমধ্যেই তার নামানুসারে তৈরি স্টেডিয়ামই বলে দেয় ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় ফুটবলারদের একজন তিনি। ১৩ বছর ধরে ইন্টার মিলানে খেললেও শুরুতে মিয়াজ্জা চেয়েছিলেন পছন্দের ক্লাব এসি মিলানের হয়ে খেলার। নিজের পছন্দের ক্লাব একাডেমি ভর্তি হন মাত্র ১৩ বছর বয়সেই। কিন্তু কিছুটা হালকা-পাতলা থাকায় তার শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দেয় এসি মিলান কোচিং স্টাফদের মাঝে। তাই মিয়াজ্জাকে তারা বাতিলের খাতায় ফেলেন।
পরবর্তীতে একদিন রাস্তায় ফুটবল খেলার সময় ইন্টার মিলানের এক স্কাউট দলের চোখে পড়েন তিনি। তার সহজাত প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে ইন্টার মিলান দলে ভেড়ায় এই ফরোয়ার্ডকে। সেই থেকে তিনি বনে যান ইন্টারের অবিসংবাদিত নেতা। ১৩ মৌসুম খেলে ইন্টারের হয়ে গোল করেন ২৪০টি। পাশাপাশি এখনো পর্যন্ত জিজি রিভার পর ইতালির হয়ে বেশি গোলদাতায় নিজের নামটি ধরে রেখেছেন দ্বিতীয় স্থানে।
লিওনেল মেসি
আতোঁয়ান গ্রিজম্যানের মতো লিওনেল মেসিকেও শুনতে হয়েছে দেখতে ছোটখাটো হওয়ায় ফুটবল খেলা সম্ভব না তার পক্ষে। নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজে খেলার সময় আর্জেন্টাইন ক্লাব রিভারপ্লেটের সামনে সুযোগ ছিলো মেসিকে সাইন করানোর। কিন্তু প্রতি মাসে হরমোনজনিত সমস্যার কারণে মেসির পেছনে ৫০০ ডলার খরচ করতে রাজি হয়নি রিভারপ্লেট। ফলশ্রুতিতে নিউওয়েলসেই থেকে যান মেসি।
২ বছর পর গ্রোথ হরমোন সমস্যা দেখা দিলে বার্সেলোনা মেসির চিকিৎসা করানোর পাশাপাশি মেসির পুরো পরিবারের ব্যয়ভারও নিতে রাজি হয়। এর বিনিময়ে মেসি হয়ে যান লা মাসিয়ার সদস্য। ধীরে ধীরে নিজেকে গড়ে তোলেন ফুটবল বিশ্বের অন্যতম সেরা তারকা হিসেবে।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো
২০০৩ সালে আর্সেনাল কোচ আর্সেন ওয়াঙ্গারের সামনে সুযোগ ছিলো তরুণ ক্রিস্টিয়ানোকে দলে ভেড়ানোর। কিন্তু স্পোর্টিং লিসবনের চাহিদা মতো দাম দিতে অপারগতা প্রকাশ করে আর্সেনাল।
সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে তৎকালীন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ম্যানেজার স্যার এলেক্স ফার্গুসন রোনালদোকে নিয়ে আসেন ওল্ড ট্রাফোর্ডে। ম্যানইউর হয়ে সব ধরনের শিরোপা জেতা ছাড়া একটি ব্যালন ডি অর-ও রেড ডেভিলের জার্সি গায়ে জেতেন রোনালদো।
পরবর্তীতে ২০১৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে আর্সেন ওয়েঙ্গার জানিয়েছিলেন, রোনালদোকে সাইন করাতে না পারা তার জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস হয়েই থাকবে।
রোনালদো দ্য ফেনোমেনন
একেবারে ছোটবেলায় ক্যারিয়ারের শুরুতেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন রোনালদো। রিও ডি জেনেইরো তে জন্মগ্রহণ করায় ছোটবেলা থেকেই রোনালদোর স্বপ্নের ক্লাব ছিলো ফ্ল্যামেঙ্গো। পাশাপাশি নিজের ফুটবল আদর্শ জিকোও খেলেছিলেন ফ্ল্যামেঙ্গোতে। জিকোর পদক্ষেপ অনুসরণ করে ফ্ল্যামেঙ্গোতে ট্রায়াল দিতে যান রোনালদো।
নিজের সহজাত প্রতিভায় সেদিন সবাইকে মুগ্ধ করেন রোনালদো। কিন্তু ফ্ল্যামেঙ্গো স্টাফরা আরো একদিন রোনালদোর ট্রায়াল দেখতে চেয়েছিলেন। তাই তারা পরদিন আবার আসতে বলেন রোনালদোকে। কিন্তু পরেরদিনের ট্রেনের টিকেটের টাকা যোগাড় করতে না পারায় আর আসা হয়নি রোনালদোর।
তবুও ভাগ্য ভালো যে আরেক ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি জেয়ারজিনহোর চোখে পড়েন তিনি। জেয়ারজিনহোই রোনালদোকে নিয়ে আসেন ক্রুজেইরোতে। সেখান থেকে রোনালদো বার্সা, রিয়াল, মিলানসহ মাতান পুরো বিশ্বকেই।
Feature Image : Goal.com
Description : This article is about the footballers who got rejection in their early career.
References : Hyperlinked inside article.