Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যে সৌরভ ছড়িয়ে গেল সবখানে

মস্কোর আকাশ ম্যাচের শুরু থেকেই মুখ ভার করে রইলো।

ম্যাচ শেষ হতে না হতেই নামলো ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যেই ট্রফি, মেডেল তুলে দেওয়া; বৃষ্টির মধ্যেই উৎসব। বৃষ্টির এতটুকু পরোয়া না করেই খেলোয়াড়রা এক এক করে ট্রফিটা হাতে করে ছবি তুললেন, আলতো করে একটু চুমু খেলেন। এর মাঝে অফিশিয়াল সাক্ষাতকার দিতে ডাক পড়লো কোচ দিদিয়ের দেশমের।

যখন কথা বলছিলেন, তখনও শরীরে একটু আগে খেলোয়াড়দের লোফালুফি করার চিহ্ন আছে। কিন্তু কণ্ঠে দারুণ উচ্ছাস। কথা বলা শেষ করে মাঠের এক পাশে একটু শান্ত হয়ে দাঁড়ালেন। খেলোয়াড়রা তখনও মাঠে উচ্ছ্বাস করছে, ট্রফি নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। সেদিকে চেয়ে বুকের কাছে হাত জড়ো করে কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে দাড়িয়ে থাকলেন দেশম। যেন এক পলকে ফিরে যেতে চাইলেন বিশ বছর আগে, যেন এক পলকে দুই বছর আগের অপমানের কথা মনে পড়ে গেলো। দেশমের চোখেমুখে তখন ইতিহাস ফেরানোর স্বস্তি এবং অপমান মোছার শান্তি।

গতকাল ক্রোয়েশিয়াকে বড় ব্যবধানে হারিয়ে নিজেদের ২য় বিশ্বকাপ শিরোপা জিতলো ফ্রান্স। এই জয় ফ্রান্সের জন্য এক অসাধারণ অর্জন। বিশ বছর আগে জিনেদিন জিদান, ফ্যাবিয়ান বার্থেজ এবং এই দেশমরা যে কীর্তি গড়েছিলেন, তারই পুনরাবৃত্তি করলো ফ্রান্স। কিন্তু এই জয় কেবল একটা বিশ্বকাপ জয় নয়। এখানে লুকানো আছে আরও অনেক অনেক গল্প।

নিন্দিত দেশম এখন মাথার ওপর; Image Source: AP

দেশমের পণ

কোচ ও অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ ট্রফি জিতলেন দেশম। কোচ ও খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ জেতা মাত্র তৃতীয় ব্যক্তি তিনি। এর আগে এই কাজ করেছেন কেবল ফ্রাঞ্জ ব্যাকেনবাওয়ের এবং মারিও জাগালো। আর অধিনায়ক ও কোচ হিসেবে এই কাজটা করেতে পেরেছেন কেবল ব্যকেনবাওয়ের ও দেশম। কিন্তু এই অর্জন করার পথটা সোজা ছিলো না দেশমের জন্য। গত দু বছর ধরে দেশের ফুটবলে তিনি একজন ভিলেনের জীবন যাপন করছিলেন।

২০১৬ ইউরোতে নিজেদের মাটিতে ফ্রান্স ছিলো দারুণ ফেভারিট দল। কিন্তু ফাইনালে তারা হেরে গিয়েছিলো পর্তুগালের কাছে। সেই থেকে দেশমকে সহ্য করতে হচ্ছিলো সমালোচনা। অনেকেই মনে করছিলেন, ফ্রান্সের এই উত্তপ্ত চেয়ারে বসার যোগ্যতা বিশ্বকাপজয়ী এই অধিনায়কের নেই। এমনকি দেশম থাকতেই তার বদলি হিসেবে জিনেদিন জিদানের কল্পনা করতে শুরু করে দিয়েছিলো অনেকে।

বিশ্বকাপে এসেও দেশকে বারবার বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে ইউরো নিয়ে কথা বলতে হয়েছে। এই ফাইনালের আগেও তিনি বলেছেন, একমাত্র বিশ্বকাপ জয়ই পারে সেই ইউরো ব্যর্থতার ক্ষতে প্রলেপ দিতে। সত্যিই তা-ই। দেশমের নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এই বিশ্বকাপ জয়ের কোনো বিকল্প ছিলো না। শেষ অবধি নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ ট্রফি হাতে নিয়েই দিলেন এই কোচ।

উমতিতি, এমবাপেদের শেকড় আফ্রিকায়; Image Source: AP

অভিবাসীদের জয়

ফ্রান্সের এই জয় কেবল ফ্রান্স ফুটবল দলের জয় নয়। এটা সারা পৃথিবীর অভিবাসীদের এক জয়। পৃথিবী এখন অশান্ত এক ভূমি। জায়গায় জায়গায় যুদ্ধ আর নিপীড়ন দেশছাড়া করছে মানুষদের। উদ্বাস্তু হয়ে লোকেরা জীবন বাঁচাতে ছুটছে নতুন কোনো দেশের দিকে। এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নয়া অভিবাসননীতি কঠিন করে দিয়েছে জীবন বদলাতে ভিনদেশে পাড়ি দেওয়া এই মানুষগুলোর জীবনযাত্রা। পাশাপাশি ইউরোপ জুড়ে সিরিয়া ও অন্যান্য রাষ্ট্র থেকে আসা অভিবাসীদের যখন ঢল নেমেছে, তখন সেখানে শুরু হয়েছে পাল্টা সংঘাতও। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে একটা রব উঠেছে এই অভিবাসীরা তাদের জন্য বোঝা মাত্র।

ফলে শুরু হয়েছে দাঙ্গা, দমনের মতো ব্যাপারও। এই গেলো বছরেই প্যারিসের উপকণ্ঠে হয়েছে এরকম সব সংঘাত। ফ্রান্সের জন্য আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষের সাথে সংঘাত কোনো নতুন ব্যাপার নয়। ফরাসিদের একটা অংশ সবসময়ই অভিবাসীদের ‘উৎপাত’ মনে করে থাকে। ইতিহাসের মজাটা এখানেই যে, আজ সেই অভিবাসীরাই ফ্রান্সকে মাতালো বিশ্ব জয়ের আনন্দে।

ফ্রান্সের এই বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ১৫ জন ফুটবলার আছেন, যাদের শেকড় আফ্রিকায়। উমতিতি, কান্তে, পগবার মতো সুপারস্টাররা তো বটেই, এবার বিশ্বকাপ মাতিয়ে ফেলা এমবাপের শেকড়ও ফ্রান্সে নয়; আলজেরিয়ান মা ও ক্যামেরুনের বাবার সন্তান এমবাপে। ফ্রান্সের এই বিশ্বকাপ জয়ে খোদ আমেরিকার রাস্তায় নেমে এসেছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে, বিশেষ করে আফ্রিকা থেকে অভিবাসী হওয়া মানুষেরা। ফ্রান্সের সড়কে সড়কেও কালো মানুষদের উৎসব হয়েছে। সেই সাথে মূল ফরাসিরা নতুন করে হয়তো উপলব্ধি করতে পারছে যে, অভিবাসীরা তাদের বোঝা নয়, সম্পদ।

বাজারমূল্যে সেরারাই সেরা হলো; Image Source: Getti

বাজারমূল্যের যথার্থতা

যদিও ফ্রান্স দলে লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো বা নেইমার জুনিয়রের মতো শীর্ষ আয় করা ফুটবলার কেউ ছিলেন না। কিন্তু মোট দামের দিক থেকে তারাই সবচেয়ে এগিয়ে ছিলো।

এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে দামি স্কোয়াড ছিলো ফ্রান্সের। মোটামুটি ১.২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজার দর ছিলো এই দলটির। মেসি-রোনালদোরা তাদের বাজারমূল্যের প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এখানে ক্রোয়েশিয়ার কোচ জ্লাৎকো দালিচের একটা কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলছিলেন, “কোনো একজন মহাতারকার চেয়ে দলে বেশ কয়েকজন মাঝারি তারকা থাকা অনেক ভালো।”

সেই সুবিধাটা নিতে পেরেছে ফ্রান্স। তাদের দলের সবাই মাঝারি মূল্যবান। আর সবমিলিয়ে তারা হয়ে উঠেছে সবচেয়ে মূল্যবান। আর এই টাকার মূল্যটা মাঠে পারফরম্যান্স দিয়ে প্রমাণ করতে পেরেছে তারা। বিশেষত কিলিয়ান এমবাপে প্রমাণ করতে পেরেছেন যে তিনি এই অল্প বয়সেই বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যয়বহুল খেলোয়াড় হয়ে উঠেছেন।

এই তরুণরাই ফ্রান্সের প্রতীক; Image Source: ‍Sky Sports

তারুণ্যের জয়গান

ফ্রান্সের এই স্কোয়াডটিকে বলা যায় খাঁটি তারুণ্যের প্রতীক। এই তরুণদের দলে সবচেয়ে সেরা তরুণ হলেন এবার বিশ্বকাপের সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরস্কার পাওয়া ১৯ বছর বয়সী এমবাপে। তবে এমবাপে একাই নন; পুরো দলটিতেই এমন সদ্য কৈশোর পার হওয়া ফুটবলারের ছড়াছড়ি। এই ফ্রান্সের ২৩ সদস্যের দলে তিরিশ পার হওয়া ফুটবলার মাত্র ৪ জন। ৮ জন খেলোয়াড়ের বয়স ২৩-এর কম।  ২৪-২৫ বছরের আছেন আরও ৬ ফুটবলার। বুঝতেই পারছেন, এই দলটির আসল শক্তি কোথায় লুকানো!

এমবাপে, পগবারা এই দলটার প্রাণভোমরা। আর ফুটবলের বিচারে তারা কেবলই জীবন শুরু করলেন। একদিকে আর্জেন্টিনার মতো দলগুলো যখন প্রায় বুড়িয়ে যাওয়া ফুটবলারদের নিয়ে একটা চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো, তখন এই সদ্য তরুণ ফুটবলারদের নিয়ে রুখে দাঁড়ালো ফ্রান্স। টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ গতি, পাল্টা আক্রমণ করার ক্ষমতা আর মাঠে খুব দ্রুত বদলে ফেলা কৌশলে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়াটা একমাত্র তরুণদের পক্ষেই সম্ভব। সেই তারুণ্যের কাছেই আসলে বড় বড় দলগুলোর অভিজ্ঞতা ও বয়স এবার বিপাকে পড়েছে।

এই তরুণদের পাশে ২৭ বছর বয়সী গ্রিজম্যানকে অবধি একটু বুড়ো বলে মনে হতে পারে। কিন্তু তিনিও প্রমাণ করে দিয়েছেন, তিনি তরুণই আছেন। বিশ্বকাপ জুড়ে এমবাপের সাথে তার দুরন্ত ফর্ম দলকে টেনে এনেছে ফাইনালে। আর ফাইনালে দু’জনই গোল করে সেই তারুণ্যের পতাকাটা আরও উপরে তুলে ধরেছেন। এই তরুণদের নিয়ে একটা ভয় ছিলো যে, তারা হয়তো ডিফেন্সটা ঠিকমতো আগলাতে পারবে না। মাঝে মাঝে ডিফেন্স একটু দুর্বল হয়ে পড়লেও শেষ বিচারে কান্তেরা দারুণভাবে সামলেছেন প্রতিপক্ষ আক্রমণ। উড়িয়েছেন তারুণ্যের ঝাণ্ডা।

ফিচার ইমেজ: FIFA

Related Articles