Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইতিহাসের সেই বিখ্যাত ‘ফ্রেড টেটের টেস্ট’

গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেট। ক্ষণে ক্ষণে উত্তেজনা আর পরতে পরতে রোমাঞ্চের খেলা ক্রিকেট। এই ক্রিকেট কত জনকে রাজা আর কত জনকে ফকির বানিয়েছে তার হিসেব আছে? অবিস্মরণীয় কীর্তি গড়েও অনেক খেলোয়াড় রয়ে গেছেন মানুষের চোখের অন্তরালে, আবার প্রায় কিছুই না করেও অনেকে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়। একজন বোলার। জীবনে খেলেছেন মাত্র ১টি টেস্ট। ৯৬ বার হাত ঘুরিয়ে দিয়েছেন ৫১ রান, নিয়েছেন ২ উইকেট। আর ব্যাটিংয়ে নেমে দুই ইনিংস মিলিয়ে করেছেন মাত্র ৯ রান।

অতি সাধারণ পরিসংখ্যান। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস ঘাঁটলে এর চাইতে ভালো পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে অন্তত হাজার বোলারের। কিন্তু তারপরেও ক্রিকেট ইতিহাসের একটা বিশেষ পাতা দখল করে আছেন সেই বোলার, একটা টেস্টের নামই হয়ে গেছে তার নামে। সেই বোলারের নাম ছিল ফ্রেড টেট। ক্রিকেট ইতিহাসে সেই টেস্টের নাম হয়ে আছে ‘ফ্রেড টেটের টেস্ট’।

ফ্রেড টেট; Source: RealSport101.com

সময়টা বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ। ১৯০২ সাল। ৫ টেস্টের অ্যাশেজ সিরিজ খেলতে ইংল্যান্ডে গেল অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দল। প্রথম দুই টেস্ট থেকে কোনো ফল এলো না, ম্যাড়মেড়ে ড্র হলো বৃষ্টির কারণে। আর তৃতীয় টেস্ট জিতে সিরিজে ১ – ০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল অস্ট্রেলিয়া। হাতে বাকি আর ২ টেস্ট। সিরিজ জিততে হলে ইংল্যান্ডকে জিততে হবে দুটো টেস্টেই, ড্র করতে হলেও জেতা লাগবে অন্তত একটিতে। এই অবস্থায় ইংল্যান্ডের একাদশ থেকে ছেঁটে ফেলা হলো জর্জ হার্স্ট এবং গিলবার্ট জেসপ নামের দুজন খেলোয়াড়কে। সেখানে নেয়া হলো কুমার রণজিৎসিংজী এবং ফ্রেড টেটকে। ফ্রেড টেট, যিনি এর আগে খেলেননি একটি টেস্টও!

জর্জ হার্স্ট ছিলেন একজন অলরাউন্ডার, ব্যাট আর বল দুটোতেই বেশ পারদর্শী। এটা ঠিক যে, তৃতীয় টেস্টে তার পারফরম্যান্স ছিল একেবারে বাজে, উইকেট পাননি একটিও, দুই ইনিংসে রান ছিল ৮ আর ০। কিন্তু আপনি যখন জেতার জন্য খেলতে নামবেন, কেন আপনি অভিজ্ঞ একজন খেলোয়াড়কে না নামিয়ে আনকোরা নতুন একজনকে নামাবেন যার কোনো টেস্ট খেলারই অভিজ্ঞতা নেই?

এই টেস্টে ডাক পাওয়ার আগে সে মৌসুমে কাউন্টি ক্রিকেটে সাসেক্সের হয়ে ১৪ ম্যাচে ১২৮ উইকেট নিয়েছিলেন ফ্রেড টেট। এত উইকেট প্রাপ্তিকে তার ডাক পাওয়ার কারণ হিসেবে দাঁড় করানো যায় অবশ্যই, কিন্তু কাউন্টি ক্রিকেট আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে আকাশপাতাল পার্থক্য সেটাও তো কারও অজানা নয়। আবার একটা কনস্পিরেসি থিওরির কথাও শোনা যায়। সে সময়ের ইংলিশ নির্বাচক ছিলেন লর্ড হক নামের একজন ভদ্রলোক, ইনি ছিলেন ইয়র্কশায়ারের। ইয়র্কশায়ার আর সাসেক্সের মধ্যে সেবার সমানে সমানে লড়াই হচ্ছিল, ফ্রেড টেটকে সরিয়ে আনায় অনেকটাই খর্বশক্তির হয়ে গেল সাসেক্স।

সেবার কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিল কিন্তু ইয়র্কশায়ারই! আসলেই কি লর্ড হক ইয়র্কশায়ারকে এগিয়ে দেয়ার জন্য বাঁচামরার টেস্টে ডেকে পাঠিয়েছিলেন টেটকে? নাকি একটা জুয়া খেলতে চেয়েছিলেন তিনি?

ম্যানচেস্টারে শুরু হলো চতুর্থ টেস্ট। বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন সকাল থেকেই। বৃষ্টি থামতেই টসে জিতে ব্যাটিং নিলেন অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেন জো ডার্লিং। সে সময় বৃষ্টি হলে পিচ ঢাকার নিয়ম ছিল না। পিচ খোলা পড়ে থাকত। বৃষ্টির পানিতে ভেজা সেই পিচে যখন রোদ পড়ত, তাকে বলা হতো স্টিকি উইকেট। খেলার সময় এই স্টিকি উইকেট হয়ে উঠত ব্যাটসম্যানদের মাইনফিল্ড। সবকিছু জেনেও ব্যাটিং নিলেন জো। ওপেন করতে নামলেন ভিক্টর ট্রাম্পার আর রেজিনাল্ড ডাফ। প্রতিপক্ষ অধিনায়ককে ব্যাটিং নিতে দেখে বোলারদের প্রতি ইংলিশ ক্যাপ্টেন আর্চি ম্যাকলারেনের নির্দেশ ছিল একটাই। ‘রোদ ওঠা পর্যন্ত ট্রাম্পারকে ঠেকাও।’

কিন্তু সে পর্যন্ত ট্রাম্পার অপেক্ষা করলে তো! সেই ভেজা উইকেটেই স্ট্রোকের ফুলঝুরি ছোটালেন, লাঞ্চের আগে মাত্র ৭৮ মিনিটে রেজিনাল্ড ডাফের সাথে স্কোরবোর্ডে তুললেন ১৩৫। লাঞ্চে যখন যাচ্ছেন তখন সেঞ্চুরি হয়ে গেছে তার, প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে লাঞ্চের আগে সেঞ্চুরি করার কৃতিত্ব দেখালেন তিনি। পরে এই কীর্তি আরও তিনজন গড়েছেন- চার্লি ম্যাককার্টনি, ডন ব্র্যাডম্যান এবং মাজিদ খান।

লাঞ্চ থেকে ফেরার পরেই আউট হয়ে গেলেন ভিক্টর। ড্রেসিংরুমে যখন ফিরছেন, তখন তার সংগ্রহ ১০৪, সময়ের হিসেবে ১১৫ মিনিট। সে যুগের ক্রিকেটের সাথে এ যুগের টি-২০ ক্রিকেট মেলালে তিনি কতটা বিধ্বংসী ছিলেন সেদিন, তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। ট্রাম্পার আউট হওয়ার পরে একটা ছোট বিপর্যয়ে পড়ল অস্ট্রেলিয়া, স্কোর হয়ে গেল ১৭৫/২ থেকে ১৮৩/৪। তবে ক্যাপ্টেন জোকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন ক্লেম হিল, ৭৩ রানের জুটি গড়ে দলকে নিয়ে গেলেন ২৫৬ রানে। এরপরেই আউট হয়ে গেলেন ব্যক্তিগত ৬৫ রানে।

অস্ট্রেলিয়া আরও অনেক দূর যেতে পারত, কিন্তু গেল না টেলএন্ডারদের ব্যর্থতার কারণে। শেষ পাঁচজন মিলে করলেন ১২। ক্যাপ্টেন জো ডার্লিঙের হাফ সেঞ্চুরির কারণে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস শেষ হলো ২৯৯ রানে।

ভিক্টর ট্রাম্পার; Source: TheCricketMonthly.com

অস্ট্রেলিয়া দলে এক অফস্পিনার ছিলেন, নাম তার হিউ ট্রাম্বল। ব্যাটসম্যানদেরকে ‘ট্রাবল’ দিতে তার জুড়ি ছিল না। তার পার্টনার ছিলেন জ্যাক সণ্ডার্স নামের এক বাঁহাতি স্পিনার। ইংল্যান্ড ব্যাটিংয়ে নেমেই এই দুজনের তোপের মুখে পড়ল। জুটি বেঁধে জোড়ায় জোড়ায় শিকার করতে লাগলেন উইকেট, একপর্যায়ে ইংল্যান্ডের স্কোর দাঁড়াল ৪৪/৫। ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে সতীর্থ লেন ব্র্যান্ডকে নিয়ে পাল্টা লড়াই শুরু করলেন স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন। ১৪১ রানের জুটি গড়লেন তারা। দল পৌঁছে গেল ১৮৫-তে। ঠিক তখনই ৬৫ রানে মন্টি নোবেলের বলে আউট হয়ে গেলেন ব্র্যান্ড।

এর পরের ৪ ব্যাটসম্যানের সাথে ছোট কিন্তু কার্যকরী জুটি গড়লেন স্যার স্ট্যানলি। দলীয় ২৬২ রানে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন তিনি আউট হলেন তখন তার নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে ১২৮। অস্ট্রেলিয়ার লিড ৩৭ রানের।

স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন; Source: Gettyimages

দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমেই কঠিন বিপদে পড়ল অস্ট্রেলিয়া। ১০ রানেই ৩ উইকেট নেই হয়ে গেল তাদের, তিনজনের মধ্যে আছেন হিল এবং ট্রাম্পারও। অবস্থা বেগতিক দেখে নিজেকে টু ডাউনে তুলে আনলেন ক্যাপ্টেন জো ডার্লিং। তার সাথে যোগ দিলেন সিড গ্রেগরি। এখন পর্যন্ত পুরো ম্যাচের কোথাও টেটের উপস্থিতির কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু এবার তিনি দৃশ্যপটে আবির্ভূত হলেন যখন ক্যাপ্টেন আর্চি ম্যাকলারেন তাকে ফিল্ডিং করতে পাঠালেন বাউন্ডারির কাছে।

শুরু থেকেই উসখুস করতে লাগলেন তিনি, অস্বস্তি লাগতে লাগল তার। তিনি আসলে স্লিপের ফিল্ডার, সাসেক্সে স্লিপেই দাঁড়ান সাধারণত। এখানে আগে কখনোই ফিল্ডিং করেননি, অভিজ্ঞতাও নেই তাই। জো-র ব্যক্তিগত সংগ্রহ তখন ১৭। একটা বলে হাঁটুগেঁড়ে বসে শট খেললেন তিনি, বল উঠে গেল আকাশে। প্রবল বিস্ময় এবং আতঙ্ক নিয়ে বলটা তার দিকে আসতে দেখলেন ফ্রেড টেট। বাউন্ডারির ওপাশে বসে থাকা দর্শকদের চিৎকারে কান পাতা দায় তখন। আন্দাজের উপর ভর করে কিছুটা এগিয়ে গেলেন তিনি। পজিশন নিতে ভুল হয়ে গেল। বল থেকে অনেকটা ডানে সরে এসেছেন, শেষ মুহূর্তে বামহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলেন অন্ধের মতো। তাকে ফাঁকি দিয়ে ড্রপ খেলো বল, পার হয়ে গেল বাউন্ডারির সীমানা। হায় ফ্রেড টেট!

জো ডার্লিং আউট হন ৩৭ রান করে, অস্ট্রেলিয়া অলআউট হয় মাত্র ৮৬ রানে। ৩৭ রানের লিড যুক্ত হয়ে ইংল্যান্ডের সামনে টার্গেট দাঁড়ায় ১২৪ এর। টেট সে সময় ক্যাচটা নিতে পারলে টার্গেট যে একশরও নিচে হতো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জাস্টিন পার্কিনসন সবচেয়ে ভালো বলেছেন। ‘টেটের ক্যাচ ড্রপের আগে ইংল্যান্ডের জয় ছিল আনুষ্ঠানিকতা। ক্যাচ ড্রপের পরে তা হয়ে গেল সম্ভাব্যতা।’

১২৪ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ডের শুরুটা হলো এককথায় চমৎকার। বিনা উইকেটে ৪৪ রান তুলে ফেলল তারা। এরপরেই সণ্ডার্সের আঘাত, ৪৪/১। ওয়ান ডাউনে নামা টিলডেসলির সাথে ২৪ রান যোগ করলেন ক্যাপ্টেন আর্চি ম্যাকলারেন। দলীয় ৬৮ রানে টিলডেসলিও হাঁটা ধরলেন ড্রেসিংরুমের দিকে। ঘাতক আবারও সণ্ডার্স, ৬৮/২। অবশেষে দেখা মিলল হিউ ‘ট্রাবল’ ট্রাম্বলের। অসাধারণ একজন বোলার ছিলেন তিনি, অ্যাশেজ সিরিজের এত বয়স হওয়ার পরেও সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারির তালিকায় তার নাম তৃতীয় স্থানে। সামনে আছেন কেবল ওয়ার্ন আর ম্যাকগ্রা। টেস্ট ক্রিকেটে দুবার হ্যাটট্রিক করা বোলারদের যে ক্লাব আছে, হিউ ট্রাম্বল ছিলেন সে ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

দলীয় ৭২ রানে ক্যাপ্টেন ম্যাকলারেনকে তুলে নিলেন তিনি। ২০ রান পরে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেললেন খাবি খেতে থাকা রণজিৎসিংজীকে। এর ৫ রান পরেই তুলে নিলেন ববি অ্যাবেলকে। ইংল্যান্ড- ৯৭/৫। ক্রিজে সে সময় ব্যাট করছেন প্রথম ইনিংসের দুই নায়ক স্যার স্ট্যানলি এবং লেন ব্র্যান্ড। দলকে নিয়ে গেলেন ১০৭ পর্যন্ত, জিততে লাগে আর মাত্র ১৭ রান। হাতে তখনও আছে ৫ উইকেট। জয়ের বন্দর দৃষ্টিসীমায় চলে আসায় মনে মনে হয়তো একটু স্বস্তির নিঃশ্বাসও ফেললেন টেট। ইংল্যান্ড জিততে যাচ্ছে, তার ক্যাচ মিসের কথা আর মনেই রাখবে না কেউ। কিন্তু ভাগ্যের লিখন কি আসলেই খণ্ডানো যায়?

হিউ ট্রাম্বল; Source: CricketCountry.com

১০৭ রানে স্যার স্ট্যানলিকে ফেরালেন সণ্ডার্স। তাতেও খুব একটা ভাঁজ পড়ল না ইংল্যান্ড দলের কারও কপালে। কারণ তখনও মাঠে নামার অপেক্ষায় আছেন উইকেটকিপার ডিক লিলি এবং পরবর্তীতে জ্যাক হবসের ওপেনিং পার্টনারে পরিণত হওয়া উইলফ্রেড রোডস, ব্যাটটা মোটামুটি ভালোই ধরতে জানেন এরা। ১৭ রান করতে আর কয় উইকেটই বা লাগে! ট্রাম্বল তার ম্যাজিকের শেষ অংশ মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নিলেন বড় মোক্ষম সময়ে। স্ট্যানলি জ্যাকসন আউট হওয়ার পরেই তিনি স্ট্যাম্পিঙের ফাঁদে ফেললেন লেন ব্র্যান্ডকে, স্কোর ১০৯/৭। এর সাথে ১ রানও যোগ না করে ফেরার পথ ধরলেন বিল লকউড, ট্রাম্বল লেগস্ট্যাম্প গুঁড়িয়ে দিয়েছেন তার, ১০৯/৮।

এবার ভয় পেল ইংল্যান্ড। নিশ্চিত জেতা ম্যাচ হারতে হবে নাকি? লিলি আর রোডস যদি খেলাটা শেষ করে দিয়ে আসতে পারেন, তবে…। দেখতে দেখতে ইংল্যান্ডের স্কোর চলে গেল ১১৬-তে। আর ৮ রান দরকার, তার চেয়েও বড় কথা, দারুণ আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে দুই ব্যাটসম্যানকে। আত্মবিশ্বাসই কাল হলো! লিলির শটকে ক্যাচে পরিণত করলেন হিল। তবে যে ক্যাচটা হিল নিলেন, তার বর্ণনা দেয়া প্রয়োজন মনে করছি, না দিলে এই ম্যাচ জেতার জন্য অস্ট্রেলিয়া ঠিক কতটা বদ্ধপরিকর ছিল, তা বুঝতে অসুবিধা হতে পারে পাঠকের।

ট্রাম্বলের বলে সপাটে ব্যাট চালালেন লিলি, বল উঠে গেল ঊর্ধ্বাকাশে। বলের দৃষ্টিসীমায় নেই কেউ, বাউন্ডারি যে হতে যাচ্ছে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। বাউন্ডারি হলে স্কোর হবে ১২০, জয়ের বন্দরে নোঙর ফেলার অপেক্ষা শুধু। কিন্তু হঠাৎ করেই কোত্থেকে যেন উদয় হলেন ক্লেম হিল, বাতাস ফুঁড়ে বের হলেন বলে মনে হলো! চিতার গতিতে অনেকটা পথ দৌড়ে এলেন তিনি, বল মাটি স্পর্শ করার ঠিক আগের মুহূর্তে শরীরটাকে শূন্যে ভাসিয়ে দিলেন, হাত বাড়িয়ে দিলেন সামনে। নিশ্চিত বাউন্ডারি হতে যাওয়া বলটি নিখুঁতভাবে জমা পড়ল তার হাতে, আর গতিবেগ তার শরীরটাকে সবুজ গালিচার উপর দিয়ে টেনে নিয়ে গেল আরও বেশ কিছুটা দূর।

ক্লেম হিল; Source: CricketCountry.com

এই ক্যাচ নিয়ে দর্শকসারি থেকে একজন মানুষ সে সময় একটি মন্তব্য করলেন, সেই মন্তব্য জায়গা পেয়ে গেল ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায়- “আ সিনফুল ক্যাচ”। এর বঙ্গানুবাদ কী হতে পারে? ‘একটি পাপী ক্যাচ’ নাকি ‘ক্যাচ ধরে কামানো পাপ’? ১১৬/৯।

এই টেস্ট নিয়ে পরে লিখতে গিয়ে নেভিল কার্ডাস লিখেছিলেন, নবম উইকেট পতনের পর মাঠে তখন সবাই বলাবলি করছে যে, প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ফ্রেড টেটের হাফ সেঞ্চুরিও আছে কয়েকটা। আসলে ছিল ৬টা, সর্বোচ্চ রান ছিল ৮৪। তবে সমস্যা হচ্ছে, তার কোনটিতেই এরকম শক্তিশালী বোলিং লাইনআপ ছিল না। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে মাঠে নামলেন ফ্রেড টেট। ব্যাটিংয়ে তিনি এমনই আনাড়ি ছিলেন যে ব্যাটটা ঠিকমতো ধরতেও পারছিলেন না তিনি। সেই তাকে খেলতে হবে জ্যাক সণ্ডার্সকে। সেই সময়ে বোধহয় টেটের তো বটেই, ইংল্যান্ড দলের সকল সদস্যের শিরদাঁড়া বেয়েও একটা শীতল স্রোত বয়ে গিয়েছিল।

সণ্ডার্সের প্রথম বল। লেগের দিকে সরে গেল কিছুটা। ব্যাট চালালেন টেট, ব্যাটে-বলে হলোও। উল্লাসধ্বনি উঠল দর্শকসারি থেকে। কারণ বল চলে যাচ্ছে ফাইন লেগ দিয়ে সোজা সীমানার দিকে। বিশাল বপুর অধিকারী ওয়ারউইক আর্মস্ট্রং দৌড়ে আসার আগেই বল সীমানার বাইরে, ১২০/৯। ইংল্যান্ডের খেলোয়াড় এবং সমর্থক সবাই চাচ্ছিলেন যে, ১ রান নিয়ে টেট যেন রোডসকে স্ট্রাইক দেন। রোডস স্ট্রাইকে গেলেই আর কোন চিন্তা নেই।

দ্বিতীয় বল। ঠেকালেন টেট। তৃতীয় বল। টেট আবারও ঠেকালেন। ৩ বল হয়ে গেছে সণ্ডার্সের, আর ৩ বল কি এভাবে ঠেকিয়ে দিতে পারবেন ফ্রেড টেট? সণ্ডার্স তার চতুর্থ ডেলিভারিতে যে বলটা করলেন, সেটা সম্ভবত ইংল্যান্ডের সেরা ব্যাটসম্যানের পক্ষেও ঠেকানো সম্ভব ছিল না, ফ্রেড টেটের তো প্রশ্নই আসে না। বেশ খানিকটা সুইং করে ভিতরে ঢুকল, তারপর উইকেট গুঁড়িয়ে দিল। ১২০/১০। রুদ্ধশ্বাস এই ম্যাচ অস্ট্রেলিয়া জিতল মাত্র ৩ রানে।

চোখভরা জল নিয়ে যখন মাঠ ছেড়ে যাচ্ছেন টেট, তখন তাকে দুয়ো দিতে লাগল দর্শকেরা। অথচ এক ক্যাচ মিস বাদে ম্যাচে তেমন আর কোনো ভুলই করেননি তিনি। ড্রেসিংরুমে ফিরে শিশুদের মতো কান্নায় ভেঙে পড়লেন, কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আজ আমি ইংল্যান্ডের যে ক্ষতি করলাম, আমার ছেলে তা একদিন পুষিয়ে দেবে।” কাকতালীয়ই বলা যায়, এই ঘটনার ২২ বছর পরে ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষেক হয় তার বড় ছেলে মরিস টেটের। পিতার করা ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পেরেছিলেন কিনা তা জানা নেই, তবে ৩৯ টেস্টে ১৫৫ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডের বোলারদের মধ্যে নিজের নামটা উজ্জ্বলই করে রেখেছেন মরিস।

মরিস টেট; Source: Alloutcricket.com

লেখাটার ইতি টানা যাক একটা ঘটনা দিয়ে। টেটকে কাঁদতে দেখে তাকে সামলানোর জন্য এগিয়ে গেলেন লেন ব্র্যান্ড। বললেন, “টেট, বাদ দাও তো। দেখবে, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই এই ঘটনা ভুলে যাবে সবাই।” টেট কী বলেছিলেন, জানতে চান? “কেউ ভুলবে না, লেন। এই ঘটনা কখনোই কেউ ভুলবে না।

১৯০২ সালের অ্যাশেজের অস্ট্রেলিয়া দল; Source: espncricinfo.com

১৯০২ সালের অ্যাশেজ সিরিজের চতুর্থ টেস্টে অনেক কিছুই হয়েছিল। লাঞ্চের আগেই ভিক্টর ট্রাম্পারের সেঞ্চুরি অথবা হিউ ট্রাম্বলের ম্যাজিক কিংবা ক্লেম হিলের দুর্দান্ত ব্যাটিং প্রদর্শনীর পরে সেই অবিস্মরণীয় ক্যাচ। সেগুলো হয়তো মনেও আছে অনেকের। কিন্তু ১১৫ বছর পরে, আজও এই টেস্টের নাম হয়ে আছে ‘ফ্রেড টেটের টেস্ট’। ‘অমর হতে এক জীবন লাগে’ এই কথা যে বলে সে আসলেই একটা আস্ত বোকা!

ফিচার ছবি- Chris Hobbs

Related Articles