Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মাশরাফিদের জন্য গ্যারি কারস্টেনের তিন কোচের টোটকা ও বাস্তবতা

গেল এক সপ্তাহে বাংলাদেশ ক্রিকেটে যে ঝড় বয়ে গেছে, তা নিয়ে এখনও ক্রিকেট পাড়া তোলপাড়। ইস্যু একটাই, হেড কোচ খুঁজে পাওয়া। সেই যে চান্দিকা হাতুরুসিংহের নাটকীয় পদত্যাগ হলো, তারপর থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে শূন্যস্থান পূরণ করার। কিন্তু এখন পর্যন্ত মেলেনি কোচের সন্ধান। তাছাড়া উপায়ও বা কতটা? এই ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের যুগে কোচরাও দিনে দিনে জাতীয় দলের প্রতি আশা হারাচ্ছেন, জায়গা খুঁজছেন লিগগুলোতে। তাতে দুটো জিনিস হয়। প্রথমত মেলে অঢেল পয়সা, সঙ্গে বিশাল ছুটি।

সে কথা থাক। গ্যারি কারস্টেনকে নিয়ে বিসিবি কম টানা-হেঁচড়া করেনি। কিন্তু ভারতের বিশ্বকাপ জয়ী সাবেক কোচ বাংলাদেশের দায়িত্ব নিতে চাননি। তারপরও পিছু ছাড়েনি বাংলাদেশ। পরে তাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রধান পরামর্শকের দায়িত্ব দেওয়া হলো। তাতেও তার আসা নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়েছে বিসিবিকে। জানিয়ে দিলেন, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) পর আসছেন তিনি। তার দল লিগ থেকে বাদ পড়ার পরপরই এলেন বাংলাদেশে। তার প্রথম মিশনই হলো মাশরাফি বিন মুর্তজা-সাকিব আল হাসানদের জন্য কোচ খুঁজে দেওয়া। তিনি আসলেন, দলের জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটারদের সঙ্গে আলাপ করলেন। আলাপ করলেন দেশি কোচের সঙ্গেও। তারপর টোটকা দিলেন, বাংলাদেশকে তিন ফরম্যাটে তিন ধরনের কোচ দিতে হবে। অর্থাৎ, টেস্ট, টি-টোয়েন্টি আর টেস্টে বাংলাদেশ তিন ধরনের কোচ পাবে। বিসিবিও তা-ই মেনে নিল।

তামিম ইকবালের সঙ্গে সাবেক কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহে; Image Source: Cricbuzz

বলা চলে একেবারে নতুন ধরনের উদ্যোগ। অনেকে সাধুবাদ জানিয়েছেন গ্যারির এমন মন্ত্রে।  একইসঙ্গে বাস্তবতাও টের পাওয়া যাচ্ছে। এই মন্ত্র কতটা কাজে দেবে এবং বাস্তবায়নের সম্ভবনা কতটা সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

একটু পিছনের দিকে আসা যাক। মূলত, হাতুরুসিংহের পদত্যাগের পর বাংলাদেশের কোচ হতে আগ্রহ জানিয়েছিলেন অনেক নামকরা কোচ। কিন্তু বিসিবির মনঃপুত হয়নি। তার মধ্যেই বাংলাদেশেরই সাবেক কোচ রিচার্ড পাইবাস বিসিবির কাছে সাক্ষাৎকার দেন, প্রেজেন্টেশনও উপস্থাপন করেন। তার সবকিছু পছন্দও হয়েছিল বোর্ডের। কিন্তু ওই যে! ‘সাবেক’ তকমাটাই কাল হয়ে দাঁড়ালো পাইবাসের জন্য। ফলাফল, বাদ পড়লেন তিনি। এরপর এলেন উইন্ডিজের মাত্র সাবেক হওয়া কোচ কিংবদন্তি ফিল সিমন্স। তিনিও আগ্রহী ছিলেন। তার প্রেজেন্টেশনও পছন্দ হয়েছিল বিসিবির। কিন্তু তাকেও নেওয়া হয়নি। শোনা যায়, তিনি নাকি বোর্ডের চেয়ে ক্রিকেটারদের স্বার্থ দেখেছিলেন বেশি। তার প্রেজেন্টেশনেও এমন কিছু ছিল। তাছাড়া এই ক্রিকেটারদের স্বার্থ দেখতে গিয়েই বাদ পড়েন উইন্ডিজের দায়িত্ব থেকে। অর্থাৎ, পাইবাসও বাদ।

আবারও কোচ খোঁজা শুরু করে বিসিবি। যত কিছু হোক, হেড কোচ পেতেই হবে। এর মধ্যে সহকারী কোচ রিচার্ড হ্যালসলও দায়িত্ব ছাড়েন মিথ্যে অজুহাত দিয়ে। শুরুতে বলেন পরিবারের জন্য দায়িত্ব ছাড়েন। বিসিবি তার সিদ্ধান্তে সম্মান জানিয়ে পদত্যাগপত্র গ্রহণও করে। কিন্তু পরে দেখা যায়, তিনি যোগ দিয়েছেন ইংল্যান্ডের কাউন্টি দল সাসেক্সের হয়ে!

হাই প্রোফাইল কোচের খোঁজে নাম উঠে আসে গ্যারি কারস্টেনের। আঠার মতো বিসিবি তার পেছনে লেগে ছিলো। কিন্তু প্রতিবারই ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি। শেষমেষ যখন রাজি হলেন, এমন সব শর্ত এই কিংবদন্তি দক্ষিণ আফ্রিকান জুড়ে দিলেন যে, এবার বিসিবিই পিছু হটলো। বিসিবির কাছে গ্যারি কারস্টেন মাসিক বেতন চেয়েছিলেন ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যা সোয়া ৪২ লাখেরও উপরে, যেখানে হাতুরুসিংহে নিতেন ২২ লাখ টাকা। যদিও গ্যারি পরবর্তীতে ৫০ হাজার ডলার থেকে নেমে ৪৫ হাজার ডলার চেয়ে বসেন। একইসঙ্গে তিনি জুড়ে দেন অদ্ভুত এক শর্ত। কেবল সিরিজ চলাকালীন সময়েই মাশরাফি-সাকিব-মুশফিকদের সঙ্গে কাজ করবেন তিনি। বাকিটা সময় তিনি থাকবেন বাংলাদেশের বাইরে।

স্বাভাবিকভাবেই তাই আর তার পথ মাড়ায়নি বিসিবি। কিন্তু তাকে রাখতে চেয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে। তাই দায়িত্ব দেওয়া হয় পরামর্শকের। গ্যারির বাংলাদেশ সফর যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করেছে। বাংলাদেশ দলের সাবেক ফিল্ডিং কোচ ও সহকারী কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন গ্যারি। এছাড়া সৌম্য সরকার-সাব্বির রহমানদের সঙ্গেও নাকি আলাপ করেছেন তিনি। আলাপ করেছেন নির্বাচকদের সাথেও। মোদ্দাকথা, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ব্যাপারে হাতে-কলমে একটা ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি।

ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার কোচের দায়িত্বেও; Image Source: AFP

কী কথা হয়েছে সালাউদ্দিনের সঙ্গে? গণমাধ্যমকে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের কোচ সালাউদ্দিন বলেন, “তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেট এবং ক্রিকেটারদের ব্যাপারে আমার কাছে জানতে চেয়েছেন। আমার ব্যাপারেও জিজ্ঞেস করেছেন তিনি।

এই সফরে কোচ নিয়ে গ্যারি কারস্টেন কী ভাবছেন, তার পরিকল্পনা কী সেটাও তিনি জানিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, “আমার মনে হয়, আমি বুঝতে চেয়েছি আগে কারা ভালো কাজ করেছে। আমি জানি, চান্দিকা দলের জন্য ভালো  কাজ করেছে। আমি বুঝতে চেয়েছি ওই সময় দলের জন্য ভালো হয়েছে কিনা। আমার মনে হয়, আমি ভেতরটা কিছুটা বুঝতে পেরেছি। একজনকে দ্রুত বেছে নিতে হবে। কারণ কোচ ছাড়া অনেকটা সময় চলে গেলো। আশা করি, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কোচ পাওয়া যাবে। সেটা হতে পারে উইন্ডিজ সফরের আগেই।

তিনি আরও বলেন, “সব দলেরই চ্যালেঞ্জ থাকে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের দারুণ সম্ভাবনা আছে। সম্প্রতি তাদের ভালো সাফল্য আছে। কয়েকজন সিনিয়র ও প্রতিভাবান তরুণের মিশেল আছে দলে। আমার মনে হয়, এই মিশেলের স্থায়িত্ব রাখা দরকার। এজন্য তেমন কোচিং স্টাফ যুক্ত করলে কোনো সন্দেহ নেই, সর্বোচ্চ পর্যায়ে তারা লড়াই করবে। আমার মনে হয়, এখন প্রতিটি কাজই হবে সামনের ১৮ মাসের বড় একটা লক্ষ্য অর্জনের ধাপ।

কারস্টেনের মাধ্যমে আসলেও কাজ হবে কিনা, কিংবা তিনি বাংলাদেশের কোচ খোঁজা নিয়ে কী ভাবছেন তা নিয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। তিনিই জানান, গ্যারি কারস্টেন যে টোটকা দিয়ে গেছেন তার মূল কথা হলো তিন ফরম্যাটে তিন ধরনের কোচ।

পাপন বলেন, “কারস্টেন মনে করেন, সাদা বল এবং লাল বলের জন্য আলাদা কোচ নিয়োগ দেওয়া উচিত। টেস্টকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এটা ভিন্ন রকম হতে পারে। প্রধান কোচের অধীনে দুই-তিনজন পরামর্শক থাকতে পারে তিন ফরম্যাটের জন্য।

সেই ঐতিহাসিক বিশ্বকাপ জয়ের পর ভারতের কোচ গ্যারি কারস্টেন; Image Source: India Today

একেবারেই নতুন ভাবনা। তাতে অনেকে গা ভাসালেও, বেশিরভাগই আঙ্গুল তুলছেন বাস্তবতার দিকে। বিশেষ করে টি-টোয়েন্টিতে এখন পর্যন্ত বিশেষজ্ঞ কোচের ধারণাটি কখনওই সামনে আসেনি। শুধু তা-ই নয়, যে গ্যারি কারস্টেনকে কোচ করার ব্যাপারে খরচের দিকটাও বিসিবিকে পিছনের দিকে ঠেলে দিয়েছে, সেই কারস্টেনের পরামর্শ অনুযায়ী, বিসিবি যদি তিন ফরম্যাটে সত্যিই তিন কোচ নেয়, তাতে খরচ খুব যে একটা কমবে তার নিশ্চয়তা নেই

স্থানীয় কোচরাও তিন কোচের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। বাংলাদেশের প্রথম টেস্টের কোচ সারোয়ার ইমরান বলেছেন, “এই আইডিয়াটা আধুনিক। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থায় বাস্তবায়নের যোগ্য নয়। আমি এমন জিনিস আগে কখনোই শুনিনি। আমরা এখনও লঙ্গার ভার্সন ও শর্টার ভার্সনের জন্য আলাদা দলই গড়তে পারিনি। তাই আমি এটা ভেবে অবাক হচ্ছি যে, কিভাবে এখানে এমন সময়ে আলাদা কোচের তত্ত্ব কতটা কাজ করবে! আমার কাছে মনে হয়, এটা আসলে একধরনের আগাম ভাবনার মতো। এই মুহূর্তে এ জিনিস আমাদের কাজে দেবে না।

আরেক খ্যাতিমান কোচ জালাল আহমেদ বলেন, “গ্যারি কারস্টেনের তত্ত্ব কাজে দেবে যারা বলছেন, তাদের কথা শুনে আমি খুবই আনন্দিত। আমার মনে হয় এটা একটা এক্সপেরিমেন্ট। এটা আসলে আমাদের পরবর্তী যে দলটা হবে তাদের জন্য কাজে লাগতে পারে। কিন্তু এখন যে সিনিয়র জাতীয় দল আছে, তাদের জন্য এটা নয়। পুরো ধারণাটাই নতুন। কেউ যদি ঠিকভাবে এটার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারে তাহলে পুরো ব্যাপারটাই গুবলেট হওয়ার সুযোগ আছে। আমার মনে হয়, সবার আগে একজন প্রধান কোচ নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে বিসিবির ভাবা উচিত।

সাকিবদের কোচ সালাউদ্দিন। গ্যারি তাকে ডেকে একান্ত বৈঠক করেছেন; Image Source: Prothom Alo

শুধু আলাদা ফরম্যাটে আলাদা কোচই নয়, আলাদা ব্যাটিং স্পেশালিষ্ট নিয়োগের কথাও জানিয়ে গেছেন গ্যারি কারস্টেন। ক্রিকেটারদের মধ্যেও গুঞ্জন, কতটা কাজে দেবে এই ভাবনা। তাছাড়া বিসিবি সভাপতি নিজেই জানিয়েছেন, টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডের জন্য ফুল টাইম কোচ হতে অনেকে রাজি থাকলেও টেস্টের জন্য আলাদা করে কেউ রাজি নন। সেটার পেছনে মূল কারণ হতে পারে বাংলাদেশের কম টেস্ট খেলার ব্যাপারটি।

ধারণা যা-ই হোক, বাংলাদেশের জন্য ‘সেরা’ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন হলেই কেবল শীর্ষে উঠবে লাল-সবুজ পতাকা।

ফিচার ইমেজ- New Age

Related Articles