Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গ্যারি লিনেকার: সাড়া জাগানো স্ট্রাইকার

ফুটবলের ইতিহাসে ইংল্যান্ডের এক প্রতিভাধর স্ট্রাইকারের নাম গ্যারি লিনেকার। আশির দশকে যে  ক’জন স্ট্রাইকার তার প্রতিভা এবং ব্যক্তিত্বের অনন্য নজির স্থাপন করেছেন, তাদের মধ্যে লিনেকার অন্যতম। সদা হাস্যোজ্জ্বল এই সাবেক ব্রিটিশ স্ট্রাইকারকে ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার বলা হয়। তার এক অসাধারণ গুণ হচ্ছে গোল চেনা। বিশ্বে অবশ্য খুব কম ফুটবলারেরই এই গুণটি রয়েছে। আশির দশক ছিল তার ক্যারিয়ারের সেরা সময়। এ সময় ইংল্যান্ডের হয়ে অসাধারণ সব গোল করে সবার নজর কাড়েন এই স্ট্রাইকার।

আপাতদৃষ্টিতে যেসব গোল অসম্ভব বলে মনে হয়, অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় তাকেই জালে জড়িয়ে দিয়ে আসেন লিনেকার। কোন ‘মুভ’ থেকে গোল হতে পারে আর কোনটি থেকে নয়– এটা বিশেষভাবে অনুভব করার ক্ষমতায়ই তাকে অন্যদের থেকে পৃথক করেছে। এরকম খেলোয়াড় তাই যেকোনো দলের এক বড় সম্পদ। লিনেকার ছিলেনও তা-ই। তার মতো খেলোয়াড়ের এক একটি গোল যে প্রায় সমশক্তিসম্পন্ন দুই দলের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয়, তা বলাই বাহুল্য। আর সে কারণে লিনেকার হয়ে উঠেছিলেন ইংল্যান্ড দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এক সদস্য। দক্ষ ফুটবলার হিসেবে খুব একটা সুনাম না থাকলেও গতি, বুদ্ধিমত্তা, ঠান্ডা মাথার এই ফুটবলার ক্লিনিক্যাল ফিনিশিংয়ের কারণে বিপক্ষ দলের কাছে ছিলেন এক আতঙ্কের নাম। তার ফুটবল ক্যারিয়ারে বার্সেলোনা, এভারটন, লিচেস্টার সিটি, টটেনহ্যাম হটস্পারের মতো বিশ্বসেরা ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে মোট ৫৬৭টি ম্যাচ খেলেছেন, যাতে তিনি গোল করেছেন ২৮১টি।

১৯৬০ সালের ৩০ নভেম্বর ইংল্যান্ডের লিচেস্টার শহরে এই প্রতিভাবান স্ট্রাইকারের জন্ম। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ফুটবল ও ক্রিকেটে সমান দক্ষ। অভিজাত পরিবারের ছেলেটি খেলাধুলায় এতটাই মনোযোগী ছিল যে কিছুতেই স্কুলের গন্ডি পেরোতে পারছিল না। পড়াশোনার চেয়ে খেলাধুলায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পছন্দ করে ছেলেটি। তা দেখেই বাবা পাঠিয়ে দিলেন বাড়ির নিকটবর্তী লিচেস্টার সিটির ফুটবল একাডেমিতে। ১৯৭৬ সালে লিচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাবের যুবদলে নাম লেখানোর আগে লিচেস্টার স্কুল ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক ছিলেন তিনি।

লেইচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাবের যুবদলে যোগ দেয়া লিনেকার; Source: newstatesman.com

১৯৭৮-৭৯ মৌসুমে লিচেস্টার সিটির হয়ে দ্বিতীয় বিভাগের লীগে লিনেকারের ফুটবল ক্যারিয়ারের সূচনা। প্রথম তিন মৌসুমে মোট ৩৭ ম্যাচ খেলে তরুণ লিনেকারের গোলসংখ্যা ছিল ৭। সেসময় তাকে স্টাইকার পজিশনে না খেলিয়ে উইঙ্গার পজিশনে খেলানোয় তেমন একটা গোলের দেখা পাননি। দলেও খুব একটা নিয়মিত ছিলেন না। ১৯৮১-৮২ মৌসুমে ক্লাবের নির্ভরযোগ্য সদস্য হিসেবে নিজের আসন পাকা করেন লিনেকার। ঐ মৌসুমে দ্বিতীয় বিভাগের লীগে ৩৯ ম্যাচ খেলে ১৭ গোল করেছিলেন। পরের মৌসুমে ৪০ ম্যাচে ২৬ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার অর্জন করেন এবং লিচেস্টারকে দ্বিতীয় বিভাগের শিরোপা জেতাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বল নিয়ে ক্ষিপ্ত গতিতে বিপক্ষের রক্ষণভাগের দুর্গ ভাঙতে যার জুড়ি ছিল না; Source: Daily Mirror

দ্বিতীয় বিভাগের শিরোপা জিতে পরের বছরেই প্রিমিয়ার লীগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলো লিচেস্টার। ১৯৮৩-৮৪ মৌসুমে দলের হয়ে ৩৯ ম্যাচে ২২ গোল করে লিনেকার হন লীগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা। পরের মৌসুমে ২৪ গোল করে হন লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা। লিচেস্টারের হয়ে সাত বছরে মোট ২১৬ ম্যাচ খেলে ১০৩টি গোল করেন লিনেকার। ফলে জাতীয় দলে ঢুকতে এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি তাকে।

লিচেস্টার দলের হয়ে তার অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখে ইংল্যান্ডের বড় বড় দলগুলো তাকে দলে ভেড়াতে বেশ আগ্রহী হয়ে পড়ে। ১৯৮৫ সালে লিনেকার যোগ দেন সেসময়ের ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন এভারটন ক্লাবে। সেই মৌসুমে এভারটনের হয়ে ৫২টি ম্যাচ খেলে ৩০ গোল করে দ্বিতীয়বারের মতো প্রথম বিভাগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন লিনেকার এবং তার সাথে জিতে নেন পিএফএ ও ফুটবল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের বর্ষসেরা খেলোয়াড়। ঐ মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এভারটনের হয়ে লিনেকারের গোলসংখ্যা ছিল ৩৮। কিন্তু সে মৌসুমে এভারটন কোনো শিরোপা ঘরে তুলতে পারেনি। লীগে দ্বিতীয় হওয়ার পাশাপাশি এফএ কাপের ফাইনালে লিভারপুলের কাছে পরাজিত হয় তারা।

এভারটনের হয়ে খেলা লিনেকারের প্রতাপ কোনো অংশে কম ছিল না; Source: Liverpool Echo

১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের হয়ে তার অসাধারণ পারফরম্যান্সে স্প্যানিশ জায়ান্ট ক্লাব বার্সেলোনা বিরাট অর্থ ব্যায়ে লিনেকারকে দলে অন্তর্ভুক্ত করে। বার্সেলোনার হয়ে নিজের প্রথম মৌসুমে লিনেকার ছিলেন লা লিগার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা। এল ক্লাসিকোতে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ৩-২ গোলের জয়ে হ্যাটট্রিকসহ ঐ মৌসুমে তিনি  লা লিগায় করেন ২০ গোল। পরের মৌসুমে বার্সেলোনার হয়ে জিতে নেন ‘কোপা দেল রে’ শিরোপা।

বার্সেলোনার হয়ে সমান সফল ছিলেন লিনেকার; Source: Daily Mail

১৯৮৭-৮৮ মৌসুমের শেষদিকে বার্সেলোনার কোচ নিযুক্ত হন ডাচ কিংবদন্তী ইয়োহান ক্রুইফ। তিনি লিনেকারকে সেন্টার ফরোয়ার্ডের পরিবর্তে উইংয়ে খেলানো শুরু করেন। লিনেকারের পারফরম্যান্সে তা বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের অভাবে বার্সার মূল একাদশ থেকে বাদ পড়েন। বার্সেলোনার হয়ে তিন মৌসুমে ১৩৮ ম্যাচ খেলে তিনি ৫২ গোল করেছিলেন।

১৯৮৯ সালে বার্সেলোনা থেকে ফিরে এসে লিনেকার যোগ দেন ইংল্যান্ডের টটেনহ্যাম হটস্পারসে ক্লাবে। টটেনহ্যামে নিজের পছন্দের পজিশনে খেলার সুযোগ পেয়ে আবার ছন্দে ফিরে আসেন লিনেকার। টটেনহ্যামের হয়ে প্রথম মৌসুমেই ২৪ গোল করে তৃতীয়বারের মতো ইংলিশ লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার জিতে নেন তিনি। ১৯৯০-৯১ মৌসুমে টটেনহ্যামকে তিনি এফএ কাপ জেতাতে সাহায্য করেন। টটেনহ্যামের হয়ে ১৩৮টি ম্যাচ খেলে ৮০টি গোল করেন। আর তিনটি ভিন্ন ক্লাবের হয়ে ইংলিশ লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার জেতা প্রথম ও একমাত্র ফুটবলারের নাম গ্যারি লিনেকার।

টটেনহ্যাম হটস্পার ক্লাবের হয়ে তৃতীয়বারের মতো ইংলিশ লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন লিনেকার; Source: fourfourtwo.com

জাতীয় দলের হয়েও গোল করায় কখনো ক্ষান্ত ছিলেন না লিনেকার। যদিও তা দেশকে কোনো শিরোপা এনে দিতে পারেননি। ১৯৮৪ সালে প্রথম জাতীয় দলে খেলার ডাক পান। লিনেকারের গোল করার ক্ষমতা কতখানি, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোতে দেশের হয়ে তার গোলের পরিসংখ্যানটি নিলে। ১৯৮৪ সালে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে তার প্রথম ম্যাচ থেকে অবসর নেওয়া পর্যন্ত ৮০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে খেলে গোল করেন ৪৮টি।

জাতীয় দলের হয়ে লিনেকার ছিলেন সে সময়ে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা; Source: My Football Facts & Stats

দুর্দান্ত সুযোগ সন্ধানী স্ট্রাইকার হিসেবে ইংল্যান্ডের ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ দলে স্থান হয় তার। প্রথম বিশ্বকাপেই তার অসাধারণ গোল করার সুবাদে ফুটবল ভক্তদের মাঝে স্থায়ী আসন গেড়ে নেই এই গোল স্কোরার। ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার অনন্য কৃতিত্ব অর্জন করেন লিনেকার। দুর্দান্ত সাফল্য বলাই বাহুল্য। ইংল্যান্ড সেই বিশ্বকাপে দলগতভাবে তেমন কিছু করতে না পারলেও লিনেকারকে আটকে রাখা যায়নি। ছিয়াশির বিশ্বকাপে লিনেকার ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থাতেও তিনি গোলের জন্য মরিয়া হয়ে বল তাড়া করতেন।

১৯৮৬ সালের প্রথম বিশ্বকাপে খেলতে নেমে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন লিনেকার; Source: Daily Mail

গ্রুপ লীগে পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে হাফ টাইমের আগেই হ্যাটট্রিক করেন। প্যারাগুয়ের বিরুদ্ধে করেন দুটি গোল। আর কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ইংল্যান্ড হারলেও একটি গোল পরিশোধ করেন এই লিনেকারেই। মোট ৬টি গোল করে লিনেকার হন সর্বোচ্চ গোলদাতা, জেতেন গোল্ডেন বুট।

১৯৮৬’র বিশ্বকাপে গোল্ডেন বুট জেতেন লিনেকার; Source: the100.ru

১৯৮৮ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে ইংল্যান্ড এবং লিনেকারের জন্য ছিল হতাশাময়। টুর্নামেন্টে লিনেকার কোনো গোলের দেখা পাননি আর ইংল্যান্ডকেও গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিতে হয়। ১৯৯০ এর ইতালির বিশ্বকাপে লিনেকার যেন আবার স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। এই বিশ্বকাপে করেন চার গোল। গ্রুপ পর্বে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে একটি গোল এবং কোয়ার্টার ফাইনালে তার করা দুই গোলের সুবাদে ইংল্যান্ড পৌঁছে যায় সেমিফাইনালে।

সেমিফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ১-০ গোলে পিছিয়ে থাকার পর লিনেকারের গোলে সমতায় ফিরে ইংল্যান্ড। তবে শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা টাইব্রেকারে জিতে যায় পশ্চিম জার্মানি। লিনেকার দুই বিশ্বকাপ মিলে ১২ ম্যাচে ১০ গোল করেন। ১৯৯১ সালে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হন তিনি।

১৯৯০ এর ইতালি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে সমতা নির্ধারণী গোল করেন লিনেকার ; Source: Daily Mail

গ্যারি লিনেকার মানেই একজন আপাদমস্তক ভদ্রলোক। তার ১৬ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে কখনোই কার্ড দেখেননি। শুধু লাল কার্ডই নয়, জীবনে কখনো হলুদ কার্ডও দেখেননি। এটি সত্যি যে, সত্তর এবং আশির দশকে ফুটবল মাঠে শারীরিক ট্যাকল করার প্রচলন ছিল এবং ফিফার নিয়ম-কানুনও তত কড়া ছিল না। তারপরও লিনেকারের মতো মহান ফুটবলারের একেবারেই কোনো কার্ড না দেখাকে কোনো অংশেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। আর সে কারণে ১৯৯০ সালে লিনেকারকে ফিফা ফেয়ার প্লে পুরস্কার দিতে দুবার ভাবতে হয়নি।

বিভিন্ন দল এবং ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের হয়ে পুরস্কার জেতা লিনেকার; Source: FourFourTwo.com

জাতীয় দলের হয়ে অবসর নেন ১৯৯২ সালে আর ১৯৯৪ সালে সবধরনের পেশাদার ফুটবল থেকে  অবসর নেন লিনেকার। এই অসমান্য ফুটবলারকে ১৯৯২ সালে ইংল্যান্ড সরকার ‘অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ খেতাবে ভূষিত করে। ২০০৩ সালে তাকে ‘ইংলিশ ফুটবল হল অব ফেম’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর বর্তমানে জনপ্রিয় ফুটবল বিশেষজ্ঞ ও ধারাভাষ্যকার হিসেবে লিনেকার তার কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন।

ফিচার ইমেজ: FourFourTwo.com

Related Articles